Site icon BnBoi.Com

ভালবাসার অনেক নাম – শিবরাম চক্রবর্তী

ভালবাসার অনেক নাম - শিবরাম চক্রবর্তী

ইঁদুর ধরা কল

ইঁদুর অর্চনার রেয়াজ এদেশে নেই, কিন্তু সিদ্ধিদাতার বাহন শ্ৰীমান মূষিকও কিছু কম সিদ্ধিপ্রদ নন – উৎসর এই কাহিনী থেকে আমরা জানতে পাব।

এমনকি অতঃপর ইঁদুরকে নিয়ে একেবাবে বারোয়ারি সার্বজনীনের চল না হলেও ছোট খাট ঘরোয়া উৎসব বেশ জমতে পারে, আশা করা অবশ্যই।

পর্বতের মূষিকপ্রসব বলা ঠিক না গেলেও মূষিকের পর্বতপ্রসব হত বা বলা যায়। পর্বত না হলেও পার্বতী তো বটেই।

সেদিন সকাল আটটার সময় চোখ মেলেই উৎস দেখতে গেল তার ঘরের জানালার গা ঘেঁষে রঙিন শাড়ি ঝুলছে একখানা। তবে ওপরকার ফ্ল্যাটে ভাড়াটে এলো তাহলে এতদিনে।

রঙিন শাড়িটা তার মনেও একটু রঙ ধবালো বুঝি।

উপরে নীচে পাশাপাশি অনেক গুলো ফ্ল্যাট নিয়ে তাদের পাঁচতলা বাড়িটা। একঘরে ফ্ল্যাট, দুঘরা, আর তিনঘরা ফ্ল্যাট সব। প্রত্যেক ফ্ল্যাটের সঙ্গে সংযুক্ত রান্নাঘর, স্নানের ঘর এবং সব কিছু। টেলিফোনও আছে প্রত্যেক তলাতেই। তবে নিজেরটায় দুটি শয়নকক্ষ। তার উপরেরটাও দুঘরা ফ্ল্যাট উৎস এখানে এসে আগেই ওটা দেখেছিল, তার পরে দুটোর ভেতরে পছন্দ করে এই নীচেরটাকেই সে বেছে নিয়েছে।

নিয়েছিল যে তার ভাগ্যি! নইলে, উপরের ফ্ল্যাট হলে এই শাড়িধারিণীর আবির্ভাব তার অলক্ষ্যেই থেকে যেতে হত। তারপরে যাব শাড়ি তার সঙ্গে তার দেখা হয়েছে মুখোমুখি—সিঁড়ি দিয়ে উঠতে নামতে একাধিকবাব। মেয়েটি তরুণী সুশ্রী আর অবিবাহিত, তাও দেখেছে সে।

দেখে তার মনে হয়েছে যে, উপরের ঘর ভাড়া নেবার এমন কী দরকার ছিল মেয়েটির। তার পাশের ফ্ল্যাটটাই তো খালি পড়ে আছে, আর, যে কালে প্রত্যেক ফ্ল্যাটই স্বতন্ত্র, স্বয়ংসম্পূর্ণ আর প্রত্যেক তলাতেই টেলিফোন।

আর একই ভাড়া যখন সব ফ্ল্যাটের, তখন পাশাপাশি বাস না করে উপরে গিয়ে থাকার কোনো মানে হয়?

সিঁড়ি ধরে ওঠা নামার অবসরে গায়পড়া আলাপও যে এক আধটু গড়ায়নি তা নয়। উৎস জেনেছে যে মেয়েটি কোন ইস্কুলের শিক্ষিকা, একলাই থাকে। আর নাম তার পার্বতী। আর সেই সূত্রে মেয়েটিকে সে জানিয়ে দিয়েছে যে সে হচ্ছে উৎস, এক কলেজে প্রফেসারি করে—সম্প্রতি ডক্টরেটের থিসিস লেখায় উৎসাহী।

এর বেশি এগোয়নি আর। তবে নীচের ঘরে নিজের বিছানায় শুয়ে বা ডেকম্মোরে বসে বসেই সে উপরের খবর সব রাখতে পারে। কখন মেয়েটি বেরোয়, কখন ফিরে আসে, কখন তার স্টোভ ধরায় আবার কখনই বা সে বাথরুমে যায়-নীচে বসেই সব টের পায় উৎস।

আর, সেই আন্দাজে যথাসময়ে সে সিঁড়িটার মাথায় গিয়ে দাঁড়ায়। দেখতে পায় নেমে আসছে মেয়েটি কিন্তু তার কুশল জিজ্ঞাসা আর মেয়েটির মিষ্টি হাসির বেশি এগোয় না কিছু আর। নিজের কাজে বেরিয়ে যায় মেয়েটি।

এইরকমই চলেছে, অকস্মাৎ একদিন ধারাটা যেন পালটে গেল কেমন করে।

উৎস বেড়াতে বেরিয়েছে, কিন্তু সিঁড়ির সম্মুখে পৌঁছতে না পৌঁছতেই তর তর করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলো মেয়েটি ভীত চকিত বন্যহরিণীর মতই।

উৎস বাবু! বেরুচ্ছেন নাকি আপনি? জিজ্ঞেস করেছে সে। বেরুচ্ছিলাম, তবে দূরে কোথাও নয়, এই ডাকবাক্সে একটা চিঠি ফেলতেই যাচ্ছিলাম। দাঁড়িয়ে গেল সে।

আমার ঘরে একটা ইঁদুর! সভয়ে জানালো পার্বতী। আমি ছুটে পালিয়ে এসেছি। উৎসর হাতে যে কোনো চিঠি-পত্র ছিল না তা সে লক্ষ্য করেনি।

চলুন তো দেখি। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে উৎস শুধোযনেংটি ইঁদুর? না ধাড়ী একটা?

খুব ধাড়ী নয়, নেহাত নেংটিও না, তার মাঝামাঝি…কিন্তু ভয়ঙ্কর।

তা, ইঁদুর একটু ভয়ঙ্কর বই কি! উৎস সায় দেয় তার কথায়? কামড়ে দিলেই তো র্যাটফিভার। তার কোনো চিকিচ্ছে আছে কিনা আমার জানা নেই।

কী সর্বনাশ! বলে মেয়েটি নিজের ঘরের দরজা খোলে। তারপর তড়াক করে এক লাফে একটা চেয়ারের ওপরে গিয়ে দাঁড়ায় ওই! ওই যে! ভীতিবিহ্বল চোখে সে তাকিয়ে থাকে।

ওটাকে ধরতে না পারলে তো রাত্তিরে আমি ভয়ে ঘুমুতেই পারব না। সে বলে, পারবেন তো পাকড়াতে?

চেষ্টা করে দেখা যাক। উৎসাহিত হয়ে এগুলো উৎস। যদিও আমার তেমন প্র্যাকটিশ নেই। ধরতে গেলে এটা বেড়ালদেরই কাজ তো।

একটু তাড়া পেতেই ইঁদুরটা উধাও হয়েছে। চকিতের মধ্যে চোখের উপরেই যেন অদৃশ্য হয়ে গেল। আনাচেকানাচে কোথাও আর তার পাত্তা নেই।

যাক পালিয়ে গেছে ইঁদুরটা। এতক্ষণে তিনটে বাড়ি ছাড়িয়ে গেছে আমার বিশ্বাস। এ তল্লাটেই নেইকো আর। যা তাড়া লাগালুম ওকে। বলতে গেছে উৎস; বাধা পেয়েছে মেয়েটির কাছ থেকে : পালাবে কোথায়! ওই তো, পাপোষের পাশটিতে ঘাপটি মেরে বসে আছে।

তাইতো! পাপোষের আড়ালেই আত্মরক্ষা করছে বটে।

যাক্, এইবার ওকে ঘেরাও করতে পারব। ডাণ্ডা-টাণ্ডা কিছু দিন তো আমায় দেখি। উৎস বলল, ঠাণ্ডা করে দিই ওকে।

তাড়া খেলেই ইঁদুররা নিজেদের গর্তে গিয়ে সেঁধোয়, তার এতকালের বদ্ধমূল ধারণা যেন টলিয়ে দিল ইঁদুরটা। পাপোষের সঙ্গে আপোষ করে উৎসর চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হলো সে।

না না নাআর্তনাদ করে উঠল মেয়েটি? মারবেন না বেচারীকে। ঐ ঝাড়নটা দিয়ে তাকে ধরে বাইরে নিয়ে যে দূরে কোথাও ছেড়ে দিয়ে আসুন বরং। পাকড়াতে পারবেন না ঝাড়ন দিয়ে?

ঝাডনটার বর্ণবৈচিত্র্যে ইঁদুরটা সম্মোহিত হয়েছিল মনে হয়। সহজেই উৎসর হাতে ধরা দিল সে।

ইঁদুরটা ধরা পড়বার পর চেয়ার থেকে নামল পার্বতী। আপনি আমায় বাঁচালেন উৎসবাবু! উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল সে।

কুণ্ডলী পাকানো ইঁদুরের পুঁটুলিটা হাতে নিয়ে রাস্তা পেরিয়ে ওধারের পার্কে ছেডে দিয়ে এল উৎস।

ঝাড়নটা নিয়ে ফিরে আসতে দেখল, পার্বতী দেবী তাদের দুজনের জন্যে দুপেয়ালা কফি বানিয়ে বিস্কুটের বাক্স বার করেছে।

কিন্তু ঐ কফির পেয়ালা পর্যন্তই। তার বেশি আর এগুতে পারেনি উৎস।

কতোবার ভেবেছে যে সে শুধোয় বিকেল বেলায় ঘরে বসে বসে করেন কী? চলুন না কোথাও একটু বেড়িয়ে আসি গিয়ে। কিংবা, সামনের পার্কটায় আসুন একটু হাওয়া খাওয়া যাক। সিনেমায় যাওয়ার কথাও তার মনে হয়েছে, কিন্তু কোথায় যেন আটকায়। মেয়েটার মধ্যেই, না, তার নিজের মনেই কোথায় যেন বাধা রয়েছে। কেমন বাধ বাধ ঠেকে।

তার মনে হতে থাকে যে নিজের সুবর্ণ সুযোগটা সে ফসূকে যেতে দিয়েছে। ভাব জমাবার সেই মাহেন্দ্রক্ষণ সে হারিয়েছে কখন যে!

অনেকবার তার মনে হয়েছে সেই ইঁদুরটা ফিরে এসে যদি তার ভ্রষ্ট লগ্ন আবার তাকে ফিরিয়ে দেয়? দ্বিতীয়বার কফিপানের অবকাশে কফির পেয়ালায় তুফান তুলবার সুযোগ কি আর হবে তার? ভাবতে ভাবতে কত রাত সে ঘুমিয়ে পড়েছে।

অবশেষে এক সুপ্রভাতে ঘুম থেকে উঠতেই তার মাথায় একটা আইডিয়া খেলল।

সটান সে চলে গেল নিউ মার্কেটে। পোয্য পশুপক্ষীর এলাকাটায়।

একটা ইঁদুর চাই আমার। পঙ্কশ্ব এক বুড়ো দোকানীর কাছে গিয়ে বলল।

একটা ইঁদুর? নিশ্চয়। এই যে, দেখুন না, কী চমৎকার ইঁদুর সব। দেখছেন?

খাঁচা তর্তি সুশ্রী সাদা রোমশ যত ইঁদুর—দেখলে চোখ জুড়োয়, সত্যি! মনে হয় যেন খরগোসের বাচ্চারা।

না, না। এ ইঁদুর নয়। এরা তো বিলিতি ইঁদুর। আমি চাচ্ছি আমাদের দেশী বাঙালী ইদর। আমাদের ঘরে বাইরে যাদের দেখতে পাই—সেই রকম ঘরোয়া জিনিস।

আজ্ঞে, সে আমাদের কাছে আপনি পাবেন না। রাখিনে আমরা। অবজ্ঞায় নাক কুঁচকে বলল দোকানদারঃ কেউ আবার চায় নাকি সে ইঁদুর! বাড়িতে দেখতে পেলে মেরে তাড়ায়।

তাই একটা আমার চাই যে। জানাল উৎস: ভয়ঙ্কর দরকার ছিল। যা দাম লাগে দেব।

দিয়ে যান দাম। চেষ্টা করে দেখব। আশপাশের বাড়ির বাচ্চা চাকরদের বলে-কয়ে যদি যোগাড় করতে পারি একটা।

উৎস তক্ষুনি তার হাতে দশ টাকার একখানা নোট ধরে দিল।

আপনার ঠিকানাটা দিয়ে যান বাবু! বলল দোকানীটা : আপনার বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসব ইঁদুর।

দিন কয়েক বাদেই পেছিল এসে ইঁদুরটা।

তারপর পার্বতীর কক্ষে ইঁদুরটার অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় মুহূর্ত গুনতে লাগল উৎস—নিজের বিছানায় শুয়ে শুয়ে কান খাড়া করে।

যখন তার বাথরুমে যাবার আওয়াজ এল তার কানে, স্নানের ঘরে কল খোলার শব্দ পেল সে–আস্তে আস্তে উপরে গিয়ে, ঘরের দরজা একটুখানি ফাঁক করে, ইঁদুরটাকে ঢুকিয়ে দিয়েই, দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে চুপ চাপ ফিরে চলে এল উৎস নীচে। নিজের ঘরে বসে পার্বতীর চিৎকারের প্রতীক্ষায় রইল নিঃশব্দে।

একটু পরেই, সেই আগের দিনটির মতই, ধুপধাপ পায়ের আওয়াজ তীরবেগে নেমে এল তার দরজায়। দুয়ার ঠেলে তার ঘরে সদ্যমাতা পার্বতীর আবির্ভাব হল।

উৎস বাবু! আসুন আসুন! চট করে একবারটি আসুন ওপরে। রুদ্ধশ্বাসে বলল সে-আমার ঘরে আবার একটা ইঁদুর! সেই ইঁদুরটাই ফিরে এল কিনা কে জানে!

তাই নাকি? কী সর্বনাশ! উৎসমুখ উন্মুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উৎসর পা-ও চঞ্চল হয়ে উঠল।

উঠল গিয়ে একেবারে পার্বতীর ঘরে।

কোথায় সে হতভাগা? দেখিয়ে দিন তো।

ঐ যে—ঐ টিপয়ের তলায়।

দেখেই চিনতে পাবল উৎস। তারই সদ্য আমদানি-কৃত নেংটি!

পূর্ব পরিচযের জনাই কিনা কে জানে, ইঁদুরটা উৎসকে দেখে ভয়ে যেন শিটিযে গেল। সহজেই ধরা দিল তার হাতে।

বিজয়গর্বে তাকে করকবলিত করে যেই না উৎস উঠে দাঁড়িয়েছে, অমনি অপর কোণ থেকে আরেকটা ধেড়ে ইঁদুর তেড়ে এল টিপয়ের দিকটায়।

ও বাবা! এ আবার কে! আরেকটা ইঁদুর দেখছি যে! লাফিয়ে উঠেছে উৎস। পার্বতীও তৎক্ষণাৎ নিজের বিছানায় গিয়ে উঠেছে—কী হবে উৎস বাবু! এটা যে আরো সর্বনেশে চেহারার।

একটা কেঁদো ইঁদুর! উৎস বলল, গেরস্থ বাড়ি সচরাচর তো দেখা যায় না এমনটা। সরকারী গুদামের চালমারা ইঁদুর মনে হচ্ছে—খেয়ে দেয়ে বেশ নাদুস নুদুস হয়েছে।

কেঁদো ইঁদুরটাকে ধরতে রীতিমত বেগ পেতে হলো উৎসকে। তারপর কেঁদো আর কঁদো কাঁদো দুটোকেই পাকড়ে ঝাড়ন জড়িয়ে ছেড়ে দিয়ে এলো সেই পার্কটায়।

ঝাড়নটা ফিরিয়ে দিতে এসে আবার দেখল টিপয়ের ওপরে কফির পেয়ালা সাজানো—সেই আগের বারের মতই।

এবারকার সুযোগ সে আর হাতছাড়া করল না।

কফি পানের ফাঁকে ফাঁকে পাড়ল কথাটা—আপনার ঘরে যেমন ইঁদুরের উপদ্রব, তাতে দেখছি, ইঁদুর তাড়াবার জন্যই একটা লোক না রাখতে হয় আপনাকে।

ভাবছি তাই। কিছু না ভেবেই জবাব দিয়েছে পার্বতী!

যদি রাখেনই কোনো লোক, বলল উৎস, তাহলে আমার আবেদনটা করে রাখছি সবার আগে এই ফাঁকে। আমাকেই রাখতে পারেন।

পার্বতী এর কোন উত্তর দিল না, তারা সারামুখ সিঁদুরের মত টকটকে হয়ে নিজের নিরুক্তিটি জানাল।

তারপরে ইঁদুর-লগ্ন থেকে গোধূলির সিঁদুর-লগ্নে পৌঁছতে আর বিশেষ দেরি হলো উৎসর।

সেদিন উৎস এসে আমন্ত্রণ জানাল আমায়-আমাদের বিয়ের উৎসবে আসবেন দাদা! রীতিমতন প্রেম করে বিয়ে, বুঝলেন? বলে সে পুনশ্চ যোগ করে–তা প্রেম করেই বলুন বা ইঁদুর ধরে বিয়ে করাই বলুন!

প্রেম করা তো ইঁদুর ধরার মতই দুঃসাধ্য ব্যাপার ভাই! আমি বলি : শুনি তো ব্যাপারটা।

তারপর থেকে যা উৎসারিত হলো সেই কাহিনীটাই উদ্ধৃত করেছি এখানে। কিন্তু আসল কথাটাই আপনাকে বলা হয়নি দাদা! তার উৎসার শেষ হবার পর সারাংশ সে নিবেদন করে : আজ সকালে যখন আপনাকে নেমন্তন্ন করতে বেরুচ্চি, দেখি যে নিউ মার্কেটের সেই লোকটা ঘুর ঘুর করছে আমাদের বাড়ির সামনে—যার কাছ থেকে ইঁদুরটা আমি কিনেছিলাম।

ইঁদুর ধরবার ফিকিরেই ঘুরছিল বুঝি?

তা নয়। কী দরকারে এসেছে তাকে শুধাতে, সে একটা চিরকুট আমার হাতে দিয়ে বলল, এই ঠিকানার একটি মেয়ে কয়েকটা ইঁদুর চেয়েছিলেন…।

সে কী? কাগজখানা পড়ে দেখি—পার্বতীর নাম ঠিকানা তাতে লেখা।

আমি আরো অবাক হলাম যখন সে বললে, মেয়েটি মাসখানেক আগে একটা ইঁদুর কিনেছিল তার কাছে, আর দিন কয়েক আগেই নিয়েছে আরেকটা। আরো বলেছে যে হয়তো আবারও কয়েকটার দরকার হতে পারে, তাই আমি তার খোঁজ নিতে এসেছিলাম বাবু!

না, না, ইঁদুরের আর দরকার হবে না, আমি বলে দিলাম তাকে। বলল উৎস: ইঁদুর ধরা পড়েছেদরকার নেই আর ইঁদুরের। ইঁদুর দিয়ে ইঁদুর ধরেছে মেয়েটা।কথাটায়, মনে হল, উৎস নিজের প্রতিই যেন কটাক্ষপাত করল— পার্বতীই মূষিক প্রসব করল, মূষিকটাই পার্বতী প্রসব করল!–এখনও আমি ঠিক ঠাওর করতে পারছি না, দাদা।

একটি মেয়ের জন্য

অনেক দিনের পর শ্রীমান অশোক চট্টোপাধ্যায়ের দর্শন মিললো আমার আস্তানায়। অশোক আমার ভাগনে-রত্নদের একজন।

কোথায় ছিলিরে অ্যানি? আমি শুধালাম।

এলাহাবাদ গেহলাম মামা।

ও বুঝেছি। তাজমহল দেখতেই! আমি ঘাড় নাড়ি।

তাজমহল কি এলাহাবাদে নাকি গো? আমার কথায় সে ভারী অবাক হয়, তাজমহল তো আগ্রায়। তোমার ভূগোল জ্ঞান তো খুব-টনটনে দেখছি মামা!

ও—তাই নাকি রে! আমার ধারণা ছিল ফতেপুর সিক্রিতেই। তা, তুই যখন বলছিস, তাহলে আগ্রাতেই হবে হয়ত। আমি মেনে নিই।

আমার ভূগোল জ্ঞান সত্যি ভারী গোলমেলে। ভূগোলের সঙ্গে একেবারেই মেলে না।যথার্থ বলতে, সানফ্রান্সিসকো যে কোথায়, কলঙ্করূপে সূর্যে, না নিষ্কলঙ্করূপে ফ্রান্সে—তাও আমি সঠিক বলতে পারব না। তবে নায়াগ্রাপ্রপাত যে আগ্রায় না, তা আমার জানা আছে বেশ।

কী জন্যে গেছলি এলাহাবাদ—এত খরচা করে এই সময়? এমনি বেড়াতেই–না কী?

বেড়াতেই, তবে একপয়সা খরচা না করে। বিলকুল মুফৎ, মামা।

বটে? বটে? শুনে আমার উৎসাহ হয়। বিনা টিকিটেই সেরেছিস বুঝি?

না মামা! ইনফ্যান্ট্রি মিলিটারি কমিশনে একটা ইন্টারভিউ দিতে গেছলাম যে!

অ্যাঁ?  শুনেই আমার পিলে চমকায়। যুদ্ধ করতে? বলিস কি রে তুই?

না না, যুদ্ধ করতে নয় ঠিক, তবে কি জানো মামা, সৈনিক জীবনলাভের কোনো সুযোগ এলে সেটা আমার ছাড়তে ইচ্ছে করে না। সৈন্যদলে, কি বিমানবহরে, কি নৌবাহিনীর জন্যে সরকার লোক চেয়ে বিজ্ঞাপন দিলেই অমনি আমি একটা আবেদন ঠুকে দিই —যদিও আমি ভালোমতই জানি তেমন কাজ পাবাব সৌভাগ্য আমার কোনদিনই হবে না।

কী করে জানলি?

জানি যে ইন্টারভিউয়ের প্রথম ধাপই আমি উৎরাতে পাব না। প্রথম পরীক্ষা পাশ করতে পারলে তবেই তো সৈনিকের চাকরী—তারপরেই না যুদ্ধটুদ্ধ? অতদূর আমায় এগুতেই দেবে না ওরা।

একেবারে দেবে না? একদম বদ্ধপরিকর?

কই আর দিচ্ছে। এই নিয়ে তো চারবার ইন্টারভিউ দেওয়া হলো চার জায়গায়—হলো আর কই! তবে একটা হলো বটে, সরকারী খরচায় যাওয়া আসা থাকা খাওয়া…নানা দেশ-দেশই বলো আর প্রদেশই বলে—ঘুরে ঘুরে দেখে আসা হলো বেশ। এইটেই যথালাভ। বলে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল, তবে খুব ভালো কাজ ছিল এটা মামা, কমিশনের চাকরি, বেশ মোটা মাইনের…।

এটাও হলো না? •

না। বলে সে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল, আর হোলো না শুধু তোমার জন্যই।

আমার জন্যে? শুনে তো আমি হতবাক।

হ্যাঁ। নরানাং মাতুলক্রমঃ বলেছে না একটা কথা? তোমার ঐ ক্রম-টা আমার মধ্যেও সংক্রামিত হয়েছে, কী করে হলো কে জানে!

আমি কোনো কথাটি না বলে ওর ধারাবাহিকের ক্রমশ প্রকাশ্যর আশায় উদ্গ্রীব হয়ে থাকি।

??? মুখে কিছু না বলে স্বচক্ষে আমার প্রশ্নটা তুলি।

সত্যি, ভারী সংক্রামক ব্যায়রাম এই মামারা!… আমার ইন্টারভিউ ছিল সাড়ে আটটায়। অশোক প্রকাশ করে, আমি হাজির হয়েছি গিয়ে সাড়ে নটায়। ইন্টারভিউ-এ একঘন্টা লেট। বোর্ডের একজন মেম্বর আমায় জিজ্ঞেস করল—এত দেরি হলো কেন? আমি বললাম-আজ্ঞে, স্যর, ঘুম ভাঙতে দেরি হয়ে গেছে। রোজই দেরী করে ওঠার অভ্যেস কিনা! এ অভ্যেস কোথা থেকে পেয়েছি তা আর বললাম না, তোমার কথা কি বলা যায় সেখানে? তোমার পদাঙ্ক অনুসরণ করেই যে এই দশা আমার হয়েছে তা আমি বলি কী করে? তাই চেপে গেলুম বেমালুম।

বেশ করেছিস চেপে গিয়েছিস। আমি সায় দিই—নইলে হয়ত আমায় ডি-আই-রুলে পাকড়াও করত এখন।

তখন ভদ্রলোক বললেন, ধরো যুদ্ধ বেধে গেল ফ্রন্টে। তখন এই বদ অভ্যেসের জন্য লড়াইয়ে যোগ দেবার দেরি হয়ে গেল তোমার, তাহলে…?

আমি জবাব দিলাম-আজ্ঞে, তাতো হতেই পারে…। ঘুমের ওপর কি কারো জোর আছে?

তারপর আমাকে আরো শুধালো—ধরো, তুমি যদি লটাবিতে হঠাৎ হাজার বারো টাকা পাও তাহলে সেই টাকা দিয়ে কী করবে তুমি? আমি বললাম, খেয়ে দেয়ে ফুর্তি করে উড়িয়ে দেব টাকাটা। একটা পয়সাও জমাবো না তার। এরকম জবাব তারা প্রত্যাশা করেনি। শুনেই না পত্রপাঠ বিদায় করে দিল আমায়। চাকরির অগই ডিসমিস হয়ে গেল আমার।।

কী রকম জবাবের প্রত্যাশা ছিল তাদের? আমি জানতে চাই।

তারা আশা করেছিল যে, ওর মোটা অংশ দিয়ে আমি ডিফেন্স বণ্ড কিনব আর বাকীটা দিয়ে দেব প্রধানমন্ত্রীর আর্তত্রাণ তহবিলে। এই রকম ধারার একটা কিছু বোধ হয়। কিন্তু তেমন জবাব আমার এই পাপ জিভের ডগায় জোগাবে কী করে? সেই ছোট্ট বেলার থেকে তোমার দৃষ্টান্ত দেখে দেখে মানুষ তো! তুমিই আমাদের মাথা খেয়ে রেখেছ মামা!

যাক, না হয়েছে ভালোই হয়েছে…। আমি সান্ত্বনাচ্ছলে বলি—কোথায় কবে কোন্ লড়াইয়ে গিয়ে বেঘোরে ই মারা পড়তিস…।

আমার এক মুসলিম বন্ধু কিন্তু পেয়ে গেল চাকরিটা। ঠিক সময়ে হাজিরা দিয়েছিল, ঠিক ঠিক জবাব দিয়েছিল সে। কিন্তু সেজন্যে নয়, শেষ পর্যন্ত একটা মেয়ের জন্যই চাকরিটা হলো তার।

ও, বুঝেছি। সমঝদারের মতন আমি সমঝে নিই, সেই ইন্টারভিউ বোর্ডে মেয়েরাও ছিল বুঝি তোর?

মিলিটারি ইন্টারভিউ বোর্ডে কারা থাকে তার কোনো ধারণা আছে তোমার? ভূগোল জ্ঞানের পরিচয় পাবার পর সে আমার সাধারণ জ্ঞানের বহর বিচার করে। জানো, লেফটেনান্ট কমাণ্ডার, কম্যাণ্ডিং অফিসার এঁরাই সব থাকেন ইন্টারভিউ বোর্ডে। এরা সব মেয়ে নাকি?

মেয়েই তো মনে হয়। আমি জানাই।

!…!…অশোক মুখে কিছু বলে না, তার জবাবটা কেবল তার আর আমার চক্ষুগোচর করে দেয়। একটু আগে আমার চোখে যেমন–???–আমার প্রশ্নপত্র প্রকাশিত হয়েছিল তেমনি এবার ওর অবাক চক্ষে দুটি বিস্ময়চিহ্ন বিমুদ্রিত হতে দেখলাম।

যদি না হয়ে থাকে তো জানি না, আমার সাফাই গাই—কিন্তু মেয়েরাই হবে আমার ধারণা। লেফটেনান্টকে যে কম্যাৎ করে সেই তো লেফটেনান্ট কম্যান্ডার? তার ঝে ছাড়া আর কে তাকে কম্যাণ্ড করার ক্ষমতা রাখে? তেমনি কোনো অফিসারকে যেকম্যাণ্ডকরতে পারে এবং করেও, যারকথায় সেই অফিসার ওঠ-বোস করে লেফট-রাইট করে থাকে, সে তার বৌ ছাড়া আর কে হবে আবার?

খুব হয়েছে। এক কথায় আমার এতবড় কথাটা সে উড়িয়ে দেয়—কমিশনের ইন্টারভিউ বোর্ডের—জেনে রাখো মামা, ত্রিসীমানায় কোনো মেয়েটেয়ে থাকে না।

তুই-ই বলছিস মেয়ের জন্যই চাকরিটা হলো তার, আবার তুই নিজেই ফের বলছিস বোর্ডের কোথাও কোনো মেয়ে ছিল না—উল্টোপাল্টা গাইছিস তো তুই নিজেই!

রশিদুল হকের গল্পটা শোনো আগে, তবেই না বুঝবে। অশোক বলে, বোর্ডের ইন্টারভিউয়ে ভারী ভারী মিলিটারি অফিসাররা থাকেন সব। …তারপর, রশিদের মুখে যা শুনেছি পরে, যেমন যেমনটা শুনলাম…বলছি তোমায়…।

ওর বিবৃতির জন্য আমি উৎকর্ণ হই।

ইন্টারভিউ নেয়া হয়ে যাবার পর, বলতে থাকে অশোক, আপনাকে আমরা নেব কিনা চিঠি দিয়ে পরে জানাব আপনাকে, বলে বোর্ড যখন রশিদুলকে প্রায় বিদায় করে দিচ্ছে তখন সে বোর্ডকে বলল, যাবার আগে আমার দু-একটা কথা কি আপনাদের জানাতে পারি? তারা বলেছেন, হ্যাঁ বলুন বলুন! বাধা কী? তখন রশিদুল বলেছে, দেখুন স্যর, ইন্টারভিউ দেবার পর আমি দুটো সম্ভাবনার কথা ভাবছি, প্রথমত, আমি চাকরিটা পেতে পাঁরি, দ্বিতীয়ত, চাকরিটা না পেতে পারি। চাকরি যদি নাই পাই, তাহলে আমার বলার কিছু নেই। কিন্তু চাকরিটা পেলে আরো দুটো প্রশ্ন তখন আমার মনে জাগবে—এক-আপনারা আমাকে হেড কোয়াটার্সে রাখতে পারেন, দুই—আপনারা আমায় সীমান্তে পাঠাতে পারেন…

বোর্ডের একজন বলেছেন—তাতে পারি। তবে প্রপার ট্রেনিং দেবার পরই সে কথা।

সেই কথা ভেবেই আমি বলেছি, বলল রশিদুল, তারপর যদি আপনারা আমায় হেড কোয়াটার্সে রাখেন তাহলে আমার আর বলার কিছু নেই। কিন্তু যদি আপনারা আমায় সীমান্তে পাঠান তখন আরো দুটি সম্ভাবনা দেখা দেবে। প্রথমত, আপনারা আমায় পাকিস্তান-সীমান্তে পাঠাতে পারেন, দ্বিতীয়ত, আমাকে চীন-সীমান্তে পাঠাতে পারেন। যদি আমাকে পাক-সীমান্তে পাঠান তাহলে কিছু বলার নেই। কেননা তারা আমায় মারতে পারবে না, সেখানে ভয়ের কোনো কারণ নেই আমার…।

এ কথা বলছ কেন? বোর্ডের এক সদস্য বাধা দিয়ে তাকে শুধিয়েছেন, তুমি মুসলমান বলে পাকিস্তানীরা তোমায় রেহাই দেবে ভেবেছ? মারবে না তোমাকে?

আজ্ঞে না, মারবার কোনো ক্ষমতাই হবে না তাদের। উলটে তারাই মার খাবে আমাদের কাছে। পাকিস্তানীদের আমরা ভয় করিনে, কিন্তু যদি আপনারা আমায় চীন-সীমান্তে পাঠান তাহলে আরো দুটো সম্ভাবনার কথা আমি ভাবছি…প্রথম, চীন ভারত আক্রমণ করতে পারে, দ্বিতীয়, নাও করতে পারে।

চীনাকে চেনা কঠিন। মন্তব্য করলেন বোর্ডের একজন।

আজ্ঞে যা, স্যর। কিন্তু চীন যদি ভারত আক্রমণ না করে তাহলে কোনো কথাই নেই, কিন্তু যা আক্রমণ করে তাহলে আরো দুটি সম্ভাবনার কথা ওঠে। যুদ্ধে আমি মারা যেতেও পারি আবার না যেতেও পারি। যদি মারা না যাই তাহলে আমার কিছু বলার নেই, কিন্তু মারা গেলে আরো দুটি প্রশ্ন দাঁড়ায়—আমার মৃতদেহ পাওয়া যেতে পারে, আবার নাও পাওয়া যেতে পারে…।

না পাওয়া যাবে কেন? বোর্ডের একজন শুধাল। মৃতদেহ তো আর পালিয়ে যায় না।

চীনেরা আমায় খেয়ে ফেলতে পারে। শুনেছি ওরা মানুষ খায়। কিন্তু চীনেরা যদি আমায় খেয়েই ফেলে তার জন্যে মোটেই আমি চিন্তিত নই। কিন্তু যদি না খায় আর আমার মৃতদেহ পাওয়া যায় তখন আরো দুটো সমস্যা ওঠে। হয় আর মৃতদেহ আমার আত্মীয়দের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হবে, নয় আমার শবদেহ সীমান্তেই কবরস্থ করা হবে। যদি আমার আত্মীয়-স্বজনের কাছে আমার দেহ পাঠানো হয় তাহলে আমার বলার কিছু নেই। কিন্তু যদি আমায় সীমান্তেই কবর দেওয়া হয় তাহলে আমি আরো দুটি সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দিতে পারি না। এক নম্বর সম্ভাবনা, আমার কবরের জমির ওপর ঘাস গজাতে পারে, নম্বর, আবার ঘাস নাও গজাতে পারে। ঘাস না গজালে আমি কিছু বলতে চাই না, কিন্তু যদি ঘাস গজায় তাহলে আরো দুটি সম্ভাবনা দেখা যায় আবার… গরুতে সে ঘাস খেয়ে ফেলতে পারে, আবার নাও খেতে পারে। গরুর পেটে সে ঘাস—গরু যদি ঘাস খেয়ে ফেলল তো ল্যাঠা চুকেই গেল, কিন্তু যদি সে সুযোগ সে না পায় তাহলে সেই ঘাসের থেকে আরো দুটো জিনিস ঘটতে পারে। এক, সেই ঘাস কোনো খাদ্যদ্রব্যের ভেজাল হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে—শুনেছি প্রোটিনের বিকল্প রূপে ঘাস নাকি বেশ পুষ্টিকর নয়তো কাগজ তৈরি হতে পারে সেই ঘাসের থেকে। কাগজ তৈরি হলে আবার দুটি সম্ভাবনা দেখা দেয়—একনম্বর, লেখার কাগজ, দুনম্বর, টয়লেটের কাগজ। লেখার কাগজ হলে তার যা গতি হয় তোক গে, বই ছাপা হোক বা হিসেবের খাতা হোক তা নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই, কিন্তু যদি তার থেকে টয়লেটের কাগজ তৈরি হয়…মানে আমি যদি টয়লেট পেপার হই তাহলে আমার ভাবনার কারণ। আছে। হয় কোনো ছেলে সেই টয়লেট কাগজ ব্যবহার করবে নয়তো কোনো মেয়ে… বলে রশিদুল হক একটু থামে… এইবার আমার শেষ কথাটি আমি বলতে চাই। বলতে পারি স্যর আপনাদের কাছে?  জিজ্ঞেস করে রশিদ।

অসঙ্কোচে বলতে পারেন। অভয় দিল বোর্ড।

তখনো আমার দুটি সম্ভাবনা রয়েছে স্যর। জানায় রশিদুল—সেই আমার শেষ সম্ভাবনা। বলে আমার বন্ধু রশিদুল হক একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল।

যদি সেই টয়লেট পেপার কোনো ছেলে কাজে লাগায় আমার বলার কিছু নেই, কিন্তু যদি সেই টয়লেট কোনো মেয়ের কাজে লাগে, মানে, টয়লেট কাগজ হয়ে কোনো মেয়ের কাজে আমি লাগি তাহলে একটা কথা আমি বলতে চাই…।

এই পর্যন্ত বলে অশোক একটুক্ষণের জন্য থামল। কীভাবে কথাটা প্রকাশ করবে তাই সে ভাবতে লাগল বোধহয়।

কী কথা বলল তোমার বন্ধু শ্রীরশিদুল হক? আমি অশোককে উসকে দিতে চাই।

না-হক কিছু বলেনি। হককথাই বলেছে মামা। সে তখন বলল, মহোদযগণ, তাহলে এ-চাকরিটা আমাকে দিতেই হবে আপনাদের। কেননা, আমি বাল্যকাল থেকেই একটি মেয়ের স্বপ্ন দেখেছি…সেই মেয়েটির জন্যেই আমার এই জীবন ধারণ…আর আমি সেই। মেয়েটির জন্যই আমার জীবন দান কবতে চাই। যদিও তাকে কখনো আমি দেখিনি, কোনদিনও দেখতে পাব না আর, তাহলেও, মরে গিয়েও আমার প্রাণ দিযেও যে তার একটুখানি সেবায় লেগেছি—লাগতে পেরেছি তাই ভেবেই আমার পরিতৃপ্তি। তার দেখা কখনো না পেলেও তার একটু ছোঁয়া যে পেলাম…সেই এতটুকু তার স্পর্শসুখের থেকে দয়া করে আপনারা আমায় বঞ্চিত করবেন না, এই আমার আর্জি।

বোর্ড তখন একবাক্যে বলল-তোমার আর্জি মঞ্জুর।…সেই মেয়েটির জন্যই শেষ পর্যন্ত এই চাকরিটা হলো তার। বলে অশোকের কাহিনীর উপসংহার।

একটি শ্লীলতাহানির কাহিনী

বৌয়ের দিকে তাকিয়ে হতবাক হলেন শচীন সেন।

কীব–ব্যাপার!

শুধু এই কথাটিই কোন রকমে তাঁর অথই বিস্ময়ের অতল থেকে উথলে উঠল।

পরীর মত হলেও, উত্তর তিরিশে, প্রায় সাঁইত্রিশে এসে তার বৌকে এখন পরিণত বয়সী বলা যায় হয়তো। প্রার্থনীয় হলেও, এমন উত্তঙ্গ দৃশ্য সেনে প্রত্যাশিত নয়। এই পীনোন্নত পরিস্থিতিতে তিনি যেন একটু হতচকিতই হলেন।

নয়া ব্লাউজের মোড়কে পদ্মকোরকের ন্যায় প্রস্ফুটিত হলেও দৃশ্যটা তার চোখে ঠিক আলপিনের মতই ফুটতে লাগল।

মনে পড়ে, একদা এক কিশোরীকে তিনি যদুবাবুর বাজারের মোড়ে এক জোড়া পদ্মকোরক কিনে উপহার দিয়েছিলেন। আর বলেছিলেন, তোমাকে তো ভগবান দুটো দিয়েছেন। আমিও আর দুটো পদ্মকোরক দিলাম তোমায়!

তখন যেন তিনি পাগল হয়েছিলেন। কিন্তু সে তো অনেকদিন আগের কথা।

সেই কথা স্মরণ করে এতদিন পরে আবার তাঁকে পাগল করার মানসেই তার গৃহিণী যে তাঁর এই পঞ্চাশোর্ধ এসে পদ্মিনীরূপে দেখা দেবেন তা তিনি ধারণাই করতে পারেন। না। বানপ্রস্থানের বয়সে এসে আরেক প্রস্থ যৌবনলাভ?–না, না, শচীন সেন হলেও এখনও তিনি such insane হননি।

বৌকে নিয়ে বেরুচ্ছিলেন একট, কিন্তু বৌ শাড়ি ব্লাউজ বদলে সেজে গুজে এসে দাঁড়াতেই কোথায় যে তাঁদের যাবার ছিল সেকথা স্রেফ ভুলে গেছেন বেমালুম।

সেদিন হগসাহেবের বাজার থেকে নতুন যে ব্লাউজটা কিনে আনলে—সেইটে বুঝি? এই কথাই তাঁর মুখ দিয়ে বেরুলো কেবল।

যা, সেইটেই। বৌয়ের চোখে কৌতুক কী রকম লাগছে তোমার বল তো?

না, খারাপনয়তেমন। তবে চোখে লাগছেএলে একটু দম নিয়েবললেন, এ রকমটা হলো কী করে?

কী রকমটা?

কী রকম যে, তা তিনি ভাষায় প্রকাশ করতে অপারগ। শ্লীলতায় না কোথায় যেন বাধল; এই স্তনঢ্যতার সামনে ব্রীড়াবোধ করে বিড়ম্বিতের মতই তিনি বললেন-এমনি ভাবে তোমায় নিয়ে রাস্তায় বার হব কী করে ভাবছি তাই।

কেন, কী হয়েছে?

এই বুড়ো বয়সে এক অষ্টাদশীকে নিয়ে কী করে পথে বেরুব–লোকে কী ভাববে—তাই ভাবছি, বলে তিনি আর একটু প্রাঞ্জল হবার চেষ্টা করলেন—সামান্য একটা ব্লাউজে এমন অসামান্য পরিবর্তন…তোমাকে একেবারে অর্ধেক বয়সে এনে ফেলেছে যে! ভাবতেই পারা যায় না।

ব্লাউজে নয় মশাই, ব্রা-এর জন্যেই। বৌও একটু প্রাঞ্জল হয়, এবার ব্লাউজের সঙ্গে নতুন-সেই কিশোরী-তনু-ব্রা-টা পরেছি কিনা–তাইতেই।

কি-শো-রী-ত-নু?!

হ্যাঁ, এই বিজ্ঞাপনটা দ্যাখো না, তাহলেই টের পাবে।

বৌ পাশের ঘর থেকে একটা সচিত্র পত্রিকা এনে তার হাতে দিল—এ জিনিসটা এখন এখানে নিউ মার্কেটেও পাওয়া যাচ্ছে আজকাল।।

দেখলেন বিজ্ঞাপন। বোম্বাইয়ের এক চিত্ৰবহুল ইংরেজি সাপ্তাহিকে প্রকাশিত মেইডেন ফর্ম -এর বিশদ বিবৃতি : অনুবাদে সংক্ষেপে দাঁড়ায়-বিজ্ঞানের নবীনতম আবিষ্কার যা আপনাকে আবার নারীত্বের পূর্ণ মহিমায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। পরমাশ্চর্য রবার স্পঞ্জে প্রস্তুত আমাদের এই আধুনিকতম ব্রা-ধারণে আপনার বক্ষসৌষ্ঠবের সুষমা সবাইকে বিমোহিত করবে—এর কৃত্রিমতা অত্যন্ত খুঁটিয়ে দেখেও কারোর ধরবার সাধ্য নেই, মূল্য মাত্র…ইত্যাদি।

কী? আশ্চর্য নয়?

আশ্চর্য বলে! কিন্তু এই চমকদার বক্ষবেষ্টনী কার জন্যে পরা তা কি জানতে পারি? শচীনবাবু শুধান, পাড়ার ছেলেদের মাথা খারাপ করতে চাও নাকি এই বয়সে?

তোমার জন্যেই পরেচি মশাই! আবার কার জন্যে? কেন, তোমার কি ভালো লাগছে মোটেই?

সত্যি কথা বলতে, একটু আমতা করে তিনি ভাঙলেন, তোমার এই উদ্ধত যৌবন-শ্রীর চাইতে আগেকার শান্তশ্রীই আমার পছন্দ—সেই আমার ভালো লাগত আরো। বুড়ো হয়ে গেছি তো, চোখে চালসে পড়েছে কত কাল, বেশি পাওয়ারের আলোয় এখন চোখ ধাঁধায়। চোখে বড় লাগে—এই আর কি।

সেদিন বেীকে নিয়ে বেরিয়ে পদে পদেই তিনি যেন বিপন্ন বোধ করেন। সারা পথটাই, তাঁর বিপথ বলে মনে হতে থাকে। একবার অপাঙ্গে বৌয়ের দিকে তাকান, আরেকবার অপর পথচারীদের দিকে। আর তাকিয়ে দ্যাখেন তারাই বা কেমন করে তাকাচ্ছে তাঁর বৌয়ের পানে। তাদের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে মিলিয়ে নিজের বৌয়ের ভাবগতিক লক্ষ্য করেন। এমন কি উঠতি বয়সের ছেলেদের চাল-চলনও তার নজর এড়ায় না। যাদের দিকে কখনো ভুলেও তিনি তাকাতেন না আজ তারাও তার লক্ষ্যণীয় হয়ে ওঠে।

লোকে মেয়েদের দ্যাখে কী? কী দ্যাখে? কানের গোড়ায় এসে ফিসফিস করে বৌ।

প্রথমত, তার মুখটাই দ্যাখে অবশ্যি, বলেন উনি : অন্ততঃ আমি তো তাই লক্ষ্য করি।

তারপর, তৃতীয়ত তার হাত দুখানি দ্যাখে সে…

তারপরে?

তারপর তার পায়ের দিকে নজর দেয় মুখপদ্ম থেকে পদপল্লবে…

কিন্তু দ্বিতীয় কী দ্যাখে তাতে তুমি বললে না, মনে করিয়ে দেয় ওঁর বৌ।

সে আর আমি কী বলব! বলেন শচীনবাবুঃ সে তো তুমিই বলে দিয়েছ।..আর…আর তোমার নিজের কথার জবাব পাচ্ছো চারধার থেকেই। পাচ্ছো না? আমরা যতটা ভাবি মানুষের দৃষ্টি তেমন নিচের দিকে নয়। প্রায় সবারই বেশ উঁচু নজর। বুঝেছ?

পাড়া ছাড়িয়ে ট্রাম রাস্তায় নামতেই তিনি ঘামতে থাকেন। কী ভাবছে আশপাশের সহযাত্রীরা। অচেনারাও কেমন যেন বক্রকটাক্ষে তাকিয়ে যাচ্ছে তাদের দিকে। এক পৃর্ণযৌবনার সহিত আরেক প্রায়-প্রৌঢ়ের গতিবিধি তারা তেমন সুনজরে দেখছে বলে মনে হয় না।

ট্রামভর্তি যাচ্ছে কত লোক। তারাই বা কী ভাবছে রাস্তায় তাদের দিকে তাকিয়ে

কে জানে! তাদের ভেতর তাঁর চেনা জানাও যাচ্ছে কত জনা। আপিসের সহকমীরাও রয়েছে হয়তো। তাঁদের দুজনকে দেখে কী ঠাওরাচ্ছে কী জানি! এই বয়সে এক পরীকে নিয়ে ঘুরছেন তিনি? না, দ্বিতীয় পক্ষে এক নব যুবতীকে বিয়ে করেছেন আবার! করেছেন বেশ করেছেন, তাই বলে সেই দ্বিতীয় পক্ষিনীকে সঙ্গিনী করে রাস্তায় বেরুতে লজ্জা করে না লোকটার! এই সবই ভাবছে তারা হয়তো বা। ফলে নিন্দমুখর আপিসে গিয়ে হয়তো কান পাতা যাবে না কালকে।

না, এর পর থেকে বৌকে নিয়ে…না, আর নয়! একলাই তাঁকে বেরুতে হবে এবার থেকে। বৌকে নিয়ে ক্রিকেট মাঠে কি সিনেমায় যাওয়ার দিন তাঁর গেল এবার।।

হপ্তা চারেক বাদে ইডেনে টেস্টম্যাচ দেখতে বৌকে সঙ্গে না নিয়েই তিনি বেরুলেন। এই প্রথম একলা! মনটা খচ খচ করতে লাগল তার। মনে পড়ল, এই ইডেনের মাঠেই তিনি নিজের ঝেটিকে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন; তাঁর পাসে বসে একদা যে অপরিচিতা কিশোরীটি ক্রিকেট ম্যাচ দেখছিল তাকেই তিনি একদিন বিয়ে করে নিজের ঘরে এনে তুলেছেন। সেদিনের তনু কিশোরীটি আজ কিশোরীতনু পরে কেমন করে যেন তাঁর নাগালের বাইরে চলে গেল একেবারে!

মাঠের থেকে ফিরতে দেখলেন, বৌ রাজ্যের অন্ধকার মুখে নিয়ে দাঁড়িয়ে।

আপিস থেকে সোজা ইডেনে গেছলাম কিনা টেস্ট ম্যাচ ছিল আজকে। অনেকটা কৈফিয়তের সুরেই তিনি জবাব দেন—আপিস থেকেই চলে গেলাম বলে তোমায় আর নিয়ে যেতে পারিনি। সেই জন্যেই এই মুখভার নাকি গো?

না। সেজন্যে নয়। আমার সেই ব্রা-টা কোথাও খুঁজে পাচ্ছিনে। বৌ জানায়।

পাচ্ছ না বুঝি?

কথা আর না বাড়িয়ে তিনি হাত মুখ ধুতে বাথরুমে গিয়ে ঢোকেন।

বাথরুমে আজ অনেকদিন পরে তাঁর মন যেন গুঞ্জরণ করে ওঠে। …আমার মল্লিকা বনে…যেদিন প্রথম কলি… তিনি গুণ গুণ করে উঠলেন আপন মনে… তোমার লাগিয়া সেদিনই বন্ধু গেঁথেছিনু অঞ্জলি।

সেদিনের সেই তন্বী কিশোরীটির মুখে শোনা তার প্রথম গান। আর তারই মুখ থেকে কিছুদিন আগেকার শোনা, আমরা দুজনে দুলেছিনু বনে, ফুল ডোরে বাঁধা ঝুলনায়। ভুল না সে কথা ভুল না! এই গানটাও তার মনে পড়ল সেই সঙ্গে।…

সে গানটির কলিও তাঁর মুখে ফুটল নাইতে নাইতে…সেদিন প্রভাতে কী ছিল তা জানো? তোমার মনের মাধুরী মিশানো, আকাশে আকাশে আছিল ছড়ানো তোমার হাসির তুলনা। ভুল না ভুল না।

না, সেকথা ভোলার নয়, ভুলবেন কী করে? অতুলনীয়…অতুলনীয়…যেমন সেই হাসি তেমনি সেই গান আর তেমনিই বুঝি সেই গায়িকা!

চা জলখাবার এনে দিয়ে বৌ জানাল-পেয়েছি আমার ব্রা-টা। কথাচ্ছলেই বলল যেন কথাটা সে।

পেয়েছে বুঝি?

কথাটা তিনি এড়িয়ে যেতে চান।

আচ্ছা, ওটা ওখানে নিয়ে গেলে কী জন্যে গো? গুমরে ওঠে ওঁর বৌ…খেলার মাঠে কী কাজ দিচ্ছিল ওটা?

চিরদিন তুমি আমার সঙ্গে যাও তো…আজ তোমাকে যখন সঙ্গিনীরূপে পেলাম, তখন তোমার স্মৃতিচিহ্ন হিসাবেই নিজের সাফাই দেন শচীনবাবুঃ খেলার মাঠে কে আর কবে একলাটি যায়? হয় নিজের স্ত্রী নয় পরস্ত্রীকে সঙ্গে নিয়েই যায় তো সবাই। এই বয়সে আর আমার সঙ্গে যাবার কে জুটবে তাই…।

তা নিয়ে গেছ বেশ করেছ, কিন্তু ওটার এমন দফা রফা হোল কী করে বল তো? পরবার কোন জো রাখখানি একেবারে।

একদম পরা যাচ্ছে না বুঝি? বলতে গিয়ে শচীনবাবু ফুর্তিতে যেন উহলে ওঠেন।

যাগ্‌গে…নাই পরলাম আর। বলল ওঁর বৌ : তুমিও তো চাও না যে ওটা আমি পরি। আমাকে এই রকমই তো তোমার ভালো লাগে! তাই না?

হ্যাঁ, সত্যি। এই রকমই তোমায় বেশ ভালো দেখায়। সায় দেন শচীনবাবুঃ অ্যাতো সুন্দর দেখায় যে…

বুঝেছি। আর বলতে হবে না। কিন্তু ওটার এরকম দশা হলে কী করে তাই আমি ঠাওর পাচ্ছিনে।

গল্প করার কাউকে পাশে না নিয়ে ইডেনের ঐ কঠিন আসনে ঠায় দু ঘন্টা বসে থাকা যায়?—তুমিই বলো! তাই সঙ্গিনীর অভাব মোচনেই…

তারপর আর বলার দরকার করে না। কার ধর্ষণে তাঁর কিশোরী তনুর কৈশোরধর্ম

যে বিনষ্ট হয়েছে তা বুঝতে আর বিলম্ব হয় না বৌয়ের।

আসনের দুঃখ ভোলাতে কোনো তনু কিশোরীকে সঙ্গিনী না পেয়ে সেটাকে সুখাসন করে তোলার জন্যই ওই কিশোরী তনুর ওপরেই কর্তা চেপে বসেছিলেন এতক্ষণ!

কণ্ঠলগ্ন

ভারী সমস্যায় পড়েছি মশাই! গোবর্ধন আমার অধ্যবসায়ের মাঝখানে এসে বসল। গল্প লিখছিলাম।

কী সমস্যা? আমার নিস্পৃহ প্রশ্ন। তোমার সমস্যা তো তোর গুরুজনদেরই জানাতে হয়। তারাই তো আমার সমাধান করবেন। বাড়িতেই তো আছেন…তোমার দাদা…তোমার বৌদি…

সব কথা কি বলা যায় দাদাকে? গোবরার একটু লজ্জা-লজ্জা ভাব: দাদা কি তাহলে রক্ষে রাখবে নাকি? …আমি প্রেমে পড়েছি।

তাই নাকি হে?আমার চক্ষেরসমক্ষে যেন শরৎচন্দ্রের চরিত্রহীনের পুনর্মুদ্রণ প্রকাশিত হতে দেখলাম। নবোদিত দিবাকরের দিকে তাকিয়ে এতক্ষণে আমার একটু উৎসায়ে সঞ্চার হলো—তোমার বোদির প্রেমে পড়েই বুঝি?

ছি ছি ছি! কথাটায় গোবরা যেন কুঁকড়ে যায়—বৌদির প্রেমে কেউ পড়ে নাকি? বৌদি মায়ের মতন না?

তা বটে। সায় দিই আমি—বাচ্চা ছেলেরাই বৌদির প্রেমে পড়ে বটে! অবোধ বালক তো! যাহা পায় তাহা খায়। তোমার মতন এত বেশি বয়সে…তা বটে…বৌদি মা কেন, প্রায় পিসিমার মতই বলতে গেলে এখন।

বৌদির প্রেমে পড়ার সম্ভাবনাতে থনা হলেও ওর এই কথাটায় একটুখানি থই মেলে। কিন্তু বলতে কি, হর্ষবর্ধনের দিক থেকে আশ্বস্ত হলেও আমার উৎসাহ যেন উপে যায়। প্রায় উপেন্দ্রনাথের মতই আমি অস্তায়মান দিবাকরের দিকে কটাক্ষ করি। না, কেননা উপন্যাস নয়, উপন্যাসের মাল-মশলাও না। বৌদির পিসিমা হয়ে যাবার পর প্রেমের সীমান্তে পৌঁছে গেছি বলে আমার ধারণা হয়। আমি অন্য প্রসঙ্গে যাই–

তোমার দাদা কী করছেন এখন? আমি শুধাইঃ তোমার বৌদির কাছে ঘুর ঘুর করছেন তো?

কোনো কালেই নয়। সে বলে: যা করে থাকেন চিরকাল। জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরছেন। একা একা? আঁ, প্রকৃতিরসিক হয়ে গেল নাকি লোকটা, খটকা লাগে আমার।

না না একলা কেন? তার পাঞ্জাবী কটাক্টারের সঙ্গে ট্রাকে করে ঘুরছেন তো! গাছ বাছছেন, গাছ কাটাচ্ছেন, তারপরে ট্রাক বোঝাই করে কাঠ পাঠাচ্ছেন আমাদের কলকাতার কারখানায়। আমাদের কাঠের কারবার, জানেন না? ঐ কাঠের জন্যেই তো দাদার এই ঘাটশিলায় আসা।

তা জানি। তাঁর পাঞ্জাবী কন্ট্রাক্টারকেও জানি। জানি তার মেয়ে, কও। জানাই আমি। চমৎকার মেয়েটি। পাঞ্জাবী হলেও বাংলা বলে চমৎকার। শান্তিনিকেতনে ছিল কিনা।

বাঙালী মেয়ে বলেই মনে হয়—তাই না দাদা?

স্বাস্থ্যের দিক দিয়ে ঠিক না হলেও, তবে সৌন্দর্যের হিসেবে বলতে পারে বটে। সব সময় ঘোড়ায় চড়ে বেড়ায় মেয়েটা। আমি বলি : দাহিগড়ার দিকে গেছলাম সেদিন, আমার ভাইঝির শ্বশুরবাড়ি। আলাপ হয়েছিল সেইখানেই।

আলাপ হয়েছে আপনার সঙ্গে? এর মধ্যেই হয়ে গেছে? তির্যক দৃষ্টিতে সে আমার দিকে তাকায়।

এমনি আলাপ। এমন কিছু আলাপ নয়। আমি বলি? কিন্তু তোমার কথাটা তো বললে না? কার প্রেমে এমন করে পড়তে গেলে হঠাৎ?

বললাম তো। ঐ মেয়েটির প্রেমেই পড়েছি যে।

তাই নাকি হে? শুনে আমার তাজ্জব লাগে। কিন্তু ভেবে দেখলে বিস্ময়ের কী আছে, বিশ্ব জোড়া ফাঁদে অশ্বারোহিণীকে যদি এক গোবেচারীর সঙ্গে বাঁধে অবাক হবার কিছু নেই। কিন্তু তাহলেও পাঞ্জাবীকে গায় চড়ানো যায়, হাওয়ায় ওড়ানো যায়, অঙ্গে ধারণ, এমন কি পাগড়ির ন্যায় শিরোধার্য করতেও বাধা নেই, কিন্তু তাকে উদ্বাহবন্ধনে বাঁধা যায় কি? খটকাটা আমার ব্যক্ত করি।

আরে মশাই! ভাব করতেই পারছি না। বিয়ে তো ঢের পরের কথা। সে বলেঃ কী করে যে তার সঙ্গে ভাব জমাই তাইত হয়েছে সমস্যা।

ভাব করতে পারছ না?

কই আর পারছি!

কেন, পারছ না কেন?

কী করে রব! ঘোড়ার থেকে নামেই না যে মেয়েটা। কতো আর ঘোড়ার সঙ্গে তাল রেখে, ঘোড়র তাল সামলে আলাপ চালানো যায় বলুন!

ভাবনার কথাই বটে। প্রেম এমনিতেই ঘোরালো, তার মধ্যে যদি আবার ঘোড়া এসে আলো করেন তো অন্ধকার দেখতে হয় বইকি!

তাইত গোবরা ভায়া, ভাবনার কথাই দেখছি। ভালবাসার সীমান্তে গোধূলি লগ্ন, সেটা ঠিকই, কিন্তু তার আগে তো কণ্ঠলগ্ন বলে একটা রয়েছে। আগে গলায় গলায় ভাব না হলে আর তলায় তলায় না জমলে…শেষ পর্যন্ত কী কখনো বিয়ে হয়?

কী করে হবে গলায় গলায়? আমি একতলায়, সে রইল দোতলায়—দুজনে সমান স্তরের না হলে কী করে তা হবে? সমান সমান না হলে কি ভালোবাসা হয়? কথায় বলে সমানে সমানে ভালোবাসা। অন্ততঃ মাথায় মাথায় সমান তো হতেই হবে। কিন্তু পাশাপাশি না এলে তা কী করে হয় বলুন?

তা বটে! কাছাকাছি না এলে তো, ওই যে কী বলে ঐ কণ্ঠলগ্ন, তাও তো প্রায় আসবে না। আমি সায় দিই ওর কথায়।

তাহলে কী করবে ঠিক করেছ?

ভাবছি ঘোড়াটাকে খুন করে ফেলব। প্রতিদ্বন্দ্বীসুলভ প্রতিহিংস্রতা প্রকাশ পায় ওর—আমাদের মাঝখানে কোনো তৃতীয় পক্ষ রাখব না।

শুনে আমি চমকে যাই। প্রেম একটা যজ্ঞ হলেও তাকে রাজসূয় বলেই আমি জানি, রাজার মতন শুয়ে শুয়ে করবার জিনিস; কিন্তু প্রেমের জন্য অশ্বমেধ করতে যাওয়া…ঠিক গগাবর্ধনসুলভ না হলেও, হয়ত প্রেমিকের যোগ্য বলেই আমার মনে হয়।

কিন্তু সেটা করাটা কি ঠিক হবে? ঘোড়াকে খুন করলে ফাঁসি হয় কি না জানি, কিন্তু তোমার জেল হয়ে যাবে নির্ঘাত!

তাহলে কী করে কী করব! সে হতাশ হয়ে বলে: আর তো কোনো পথ দেখি

দাদা! মাঝখানে ঐ ঘোড়াতেই আটকাচ্ছে যে আমার। সখেদে সে জানায় : ঘোড়াতেই আমার গলদ হয়েছে। গোড়াতেই গলদ।

কিন্তু ঘোড়া থেকে খোঁড়া হলে চলবে কেন? আমি উৎসাহ দিই ওকে: যে মাটিতে পড়ে লোক ওঠে তাই ধরে। ওই ঘোড়া ধরেই তোমাকে এগুতে হবে ভাই!

ঘোড়া ধরে?

হ্যাঁ। ঐ ঘোড়ার কিস্তিতেই মাত করতে হবে তোমাকে। ইংরেজিতে একটা কথা আছে, জানো কি? সাত মি, লাভ মাই ডগ। তার মানে, কোনো মেয়ের সঙ্গে ভাব জমাতে হলে তার পেয়ারের কুকুরটিকেও ভালবাসতে হয় এক্ষেত্রেও, গোড়ায় তোমায় ঘোড়ার প্রেমে পড়তে হবে ভাই! ঘোড়ার থেকেই এগুতে হবে, তাহলেই তোমার পথ পরিষ্কার।

কী রকম? খুলে বলুন!

তুমি যদি ওর ঘোড়াটিকে ভালবাসো, তার সঙ্গে ভাব জমাতে যাও, মেয়েটি তাতে মোটেই অবাক হবে না। সন্দেহের চক্ষে দেখবে না তোমায়। ঈর্ষান্বিতও হবে না। কেননা, সেও তো তার ঘোড়াকে ভালবাসে, ভালবাসার পাত্র বলেই মনে করে। সুতরাং তোমাদের দুজনের অনুভূতি এক হয়ে গেল এইখানের নাম হলো গিয়ে সহানুভূতি। আর ওই সহানুভূতির থেকেই হয়ে থাকে ভালবাসার সূত্রপাত! বুঝতে পেরেছ?

গোবরার কতখানি বোধগম্য হয় সেই জানে, কিন্তু এক ঘাড় মাথা নেড়ে দেয়।

উৎসাহিত হয়ে আমি আরও বলি—ঘোড়া এগুলে মেয়েটাকেও এগুতে হবে; ঘোড়াও সঙ্গে সঙ্গে বাধ্য হয়েই—মেয়েটা কিছু ঘোড়া ছাড়া নয় যেকালে। ঘোড়া হাতে এলে মেয়েটি কি আর তোমার তফাতে থাকবে?

যা বলেছেন। হাসিখুশির মলাট হয়ে সে চলে যায়।

আমি কিন্তু ভাবনায় পড়ি। ভাব জমাতে গিয়ে ঘোড়ার হাতে হাতে না বলে পায়ে বলাই উচিত, বেচারা না অপঘাতে মারা যায়। এর আগে সে কোনো মানবের প্রেমে পড়েনি, কোনো মানবকও পড়েনি তার প্রেমে। কিন্তু এখন সেই প্রেমের দাবিই সইতে হবে প্রাণীটিকে। এই ধকল কি সইবে তার? এহেন বিটকেল ব্যাপার হয়ত সে বরদাস্ত নাও করতে পারে।

তবে কি না, প্রেমকে সর্বজয়ী বলে থাকে…সেইখানেই যা ভরসা! বিশ্বজয়ী প্রেম কি আর অশ্বজয়ী হতে পারে না?

তাহলেও, গোবরা যে কী কবে এগুবে তা আমি ভেবেই পাই না। ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওযা…মেয়েটির সঙ্গে ভাব জমানো, মনে হয় কষ্টসাধাই। বলতে কি, অসুবিধাটা আমি নিজেও যে বোধ করিনি তা নয়। মেয়েটি ভাব করবার মতই সত্যি, কিন্তু তার পথে ভাবনাও পদে পদে। ঘোড়ার সঙ্গে ঘোরাঘুরি করে কাঁহাতক ভাব জমানো পোষায়? আর যদি গোড়াগুড়ির থেকেই তা করতে হয়…একটু কষ্টকর নয় কি? পথ কেবলই যে দুর্গম তাই না। রীতিমতন অশ্বক্ষুরলাঞ্ছিত। পরব্রহ্মের মত পরি-ব্রহ্মের পথও যদি ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা হয়, পাশাপাশি চলতে গিয়ে পাছে ঘোড়ার পায়ের চোট লাগে সেই ভয়ে পদে পদে হোঁচট খেয়ে চলতে হয়, তাহলে অবশ্যই বলতে হয়, হে দেবি, তোমার ক্ষুরে ক্ষুরে দণ্ডবৎ! আমি সটকালাম।

দিন কতক আর গোবরার দেখা নেই। অবশেষে একদিন দেখি সে কলার কাদি কাঁধে নিয়ে দাহিগড়ার দিকে চলেছে।

কোথায় চলেছ গোবরা ভায়া? আমি শুধাই : এত কলা কিসের জন্যে হে?

ভালবাসার জন্যে। সে সংক্ষেপে সারে।

প্রেমে শেষ পর্যন্ত দিতে হয় জানা কথা, কিন্তু তা কি এই কলার কাঁদিতে? ওর কথায় আমি বিস্ময় মানি।

প্রেমে বিস্তর হলা কলা আছে, জানি তা, প্রেম একটা কলাবিদ্যাও বটে, আমি বললাম। কিন্তু প্রেমিকাকে কি কেউ কলা দেখায় নাকি কখনো?

প্রেমিকাকে কেন মশাই, ঘোড়াটাকেই দেখাব তো! সে বলে: ঘোড়াটা ফল খেতে ওস্তাদ। কলা খাইয়ে খাইয়ে পটিয়েছি ঘোড়াটাকে। কলা দেখলেই সে দৌড়ে আসে। গোবরা তার পটিয়সী বিদ্যা প্রকাশ করে।

মেয়েটাও তার পিঠোপিঠি দৌড়য় তো? মানে, তার পিঠে চেপে মেয়েটাকেও আসতে হয় নিশ্চয়?

নিশ্চয়! মেয়েটাও যে হড়ার থেকে দুয়েকটা খায় না তা নয়।

কেমন? বলেছিলাম না? ঘোড়াকে পটাতে পারলে মেয়েটাও পটবে। ঘোড়ার সঙ্গে এগুতে হবে মেয়েকেও কেমন হল কিনা? কী কৌশলে ঘোড়াটাকে তুমি কাবু করবে আমি ভাবছিলাম, যাক তোমার কাজ হাসিল হয়েছে তাহলে। তোমাকে কলাকুশল বলতে হয় ভায়া।

ঘোড়াটাও আমার বেশ কলারসিক দাদা! গোবরার একগাল হাসি।–কিরকম পুরুষ্ট পুরুষ্ট মর্তমান কলা সব দেখছেন?

তা তো দেখছি! …মেয়েটাও তো তোমার কলা খায় বলছ আবার। তা মেয়েটাকে এইভাবে কলাৎকার করলেও তোমার আসল কাজ কদ্দুর এগুলো? গোধূলি লগ্নের দিকে কতটা এগিয়েছ শুনি?

বুঝতে পারছিনে ঠিক। মেয়েদের কিছু বোঝা যায় না দাদা! তবে মেয়েটার না হলেও ঘোড়াটার আমি হৃদয় জয় করেছি ঠিকই।

গোবরার হ্যত ঠিকে ভুল হয়নি। রমণীর মন সহস্র বর্ষের সাধনার ধন হলেও, এবং তার জন্যে কেউ কেউ সমরখন্দ আর বোখারা বিলিয়ে দিতে চাইলেও, কেউ আবাব ঘোড়ার জন্যও কি তাঁর রাজত্ব বিকিয়ে দিতে চাননি? হর্স! হর্স! মাই কিংডম ফব এ হর্স-বলেছিল কে? নিশ্চয় সে গোবর্ধনের চেয়ে কোনো অংশে নূ্যন ছিল না। ভালবাসার নানান রূপ-হাজার চেহারা। মোটের ওপর, হৃদয় একটা কারও পেলেই হলো! সেইটেই নেট লাভ! তা অশ্বিনী বা আ-মোহিণী যারই হোক না!

তারপর আর গোবরার দেখা পাই না। দেখা পেলাম হর্ষবর্ধনের।

কাঁচুমাচু মুখ করে তিনি হাজির।

গোবরাকে নিয়ে ভারী ভাবনায় পড়েছি মশাই! কাঁদো কাঁদো সুরে তিনি আওড়ান।

কী হয়েছে? অ্যাঁ?

কী যে তার হয়েছে তাই তো আমরা ঠাওর পাচ্ছিনে। সব সময় কেমন যেন আনমনা হয়ে থাকে। আর মাঝে মাঝে…

প্রেমে পড়েনি তো কারো?

কে জানে! কিছু তো বলে না। মাঝে মাঝে কেবল চিঁ হিঁ চিঁ হিঁ করে ওঠে। তিনি বললেন—প্রেমে পড়লে কি মানুষ চিঁ হিঁ চিঁ হিঁ করে নাকি?

চিঁ চিঁ করে বটে অনেকে, শুনেছি আমি। আমি বলি—তবে প্রেমের চিৎকার তো কতো রকমই হতে পারে। কিছু কি তার বলা যায়?

তার চালচলন কেমন ধারা যেন। এরকম বেচাল তার কখনো আমি দেখিনি। কি রকমের পাগলাটে পাগলাটে ভাব।

ঠিক সময়ে ওর বিয়ে না হওয়ার জন্যই এমনটা হয়েছে মনে হচ্ছে। যথাসময়ে যদি ওর গলায় একটাকে ঝুলিয়ে দিতেন… একজন কেউ কণ্ঠলগ্ন হলে আজ আর এমনটা হতে পারত না।

তা যখন হয়নি, এখন কী করা যায়? রাতবিরেতে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ওর ওই চিহি চিহি করে ওঠাটাই আমার খারাপ লাগছে আরো। ওই বিটকেল আওয়াজে আমাদের ঘুম ভেঙে যায় মশাই! একটুও ঘুমোতে পারি না আমরা, না আমি না আমার স্ত্রী। পাশের ঘর থেকে দেয়াল ছুঁড়ে যেন তেড়ে আসে আওয়াজটা। আমার স্ত্রী বলছিলেন কোনো ঘোড়াভূতে ওকে ধরেছ হয়ত…?

মানুষ মরলেই তো ভূত হয় জানি। ঘোড়া মরলে কি ভূত হয় নাকি? ঘোড়াদের কি আত্মা আছে? বলে আমি ওঁকে অভয় দিই—না না, ওসব কিছু নয়টয়। ভূতটুত নয় কিছু।

কিন্তু তাহলেও আমার ভয় হয়, সেই ঘোডাটা ভালবেসে ওকে কামড়ে দেয়নি তো? কণ্ঠলগ্ন হয়ে ওর ঘাড়ে যদি দাঁত বসিয়ে দিয়ে থাকে তাহলে কুকুরে কামড়ালে যেমনটা লোক ঘেউ ঘেউ করে আর জলাতঙ্ক দাঁড়ায়…আমার কেমন যেন সন্দেহ হতে থাকে।

ঘাস দিয়ে দেখেছেন? ওর মুখের সামনে ঘাস ধরে দিয়ে দেখবেন তো, খায় কিনা। যদি খেতে না চায়, আর চিহি চিঁহি ডাক ছাড়ে…।

কী যা তা বলছেন! ঘাস খেতে চাইবে সে! ডাল ভাতই তার মুখে রোচে না আজকাল! খেয়ে খেয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে দিনকের দিন! কী যে হলো ছোঁড়াটার।

তাহলে ডাক্তার দেখান এক্ষুনি। দেহের নয়, ওর মনের চিকিৎসা করানো দরকার। এমন ডাক্তার যিনি মনোবিকলন করতে পারেন…।

মনোবিকলন! সে আবার কী মশাই? হর্ষবর্ধন হতবাক হন।

মনের কলকজা বিগড়ে গেলে যিনি মেরামত করতে জানেন এমন ডাক্তার। আমি বিশদ করি : গোবরা ভায়ার বিকল মনকে যিনি আগের মত অবিকল করে দিতে পারবেন আবার।

এমন কোনো ডাক্তার কি জানা আছে আপনার?

কলকাতার থেকে কদিন হলো একজন এখানে বেড়াতে এসেছেন বলে শুনেছি, তার কাছে নিয়ে যাওয়া যায় এখুনি।

গেলাম তার কাছে গোবরাকে নিয়ে সহর্ষবর্ধন।

দেখুন তো ডাক্তারবাবু, আমার ভাইয়ের কী হয়েছে। দিনরাত কী সব আবোল-তাবোল বকে। তিনি বলেন-আর মাঝে মাঝে…সময়ে বিয়ে দিইনি, সেইজন্যেই কিনা কে জানে!

কী হয়েছে আপনার? শুধান ডাক্তারবাবু গোবরাকে।

আমি প্রেমে পড়েছি! মুক্তকণ্ঠে জানিয়ে দেয় গোবরা।

সে আর অবাক হবার কি? বললেন ডাক্তার : আপনার বয়সে সকলেই প্রেমে পড়ে। তাতে দোষের কিছু দেখি নে।

কিন্তু আমি—আমি যে একটা ঘোডাকে ভালবেসেছি মশাই।

তাতে কী! তাতেই বা কী? লক্ষ লক্ষ মানুষ জীবজন্তুদের ভালবাসে! কেউ পাখি, কেউ কুকুর, কেউ বা বেড়াল। ঘোড়ার প্রেমে পড়ে বাজি ধরে কত লোক ফতুর হয়ে যায় পর্যন্ত।

সে ভালবাসা নয় ডাক্তারবাবু! রীতিমতন গভীর প্রেম যাকে বলে। তার জন্যে প্রাণ কাঁদে আমার। রাত্তিবে সেই ঘোড়াটার আমি স্বপ্ন দেখি।

বটে? তা, সেটা মন্দা ঘোড়া না মাদী ঘোড়া?

আপনি পাগল হয়েছেন ডাক্তারবাবু? আমি পুরুষ মানুষ হয়ে একটা মদ্দা ঘোড়ার প্রতি আসক্ত হবো? বলেন কী আপনি? মেয়ে ঘোড়া আলবাৎ! আমার কি মাথা খারাপ হয়েছে নাকি? তাই আপনি ঠাউরেছেন আমায়…?

না, তা কেন ভাবব! তবে…

তবে আমার কী মনে হয় জানেন ডাক্তারবাবু? তাঁর কথার মাঝখানে বাধা দিয়েছেন দাদা : গোবরাটা ছোট বেলার থেকেই আমাকে ভীষণ ভালবাসে। ভ্ৰাতৃভক্ত বেজায়। আর আমার নাম হর্ষবর্ধন। আর জানেন তো——হর্ষ মানে হচ্ছে ঘোড়া…ছোঁড়াটা আমার প্রেমে পড়ে যায়নি তো? সেইটাই আমার সন্দেহ। সহর্ষ হয়ে তিনি জানান।

তা কী করে হবে! হতভম্ব হয়ে ঘাড় নাডেন ডাক্তার : হর্স মানে ঘোড়া বটে, কিন্তু যে ঘোডা ঘাস খায়…আপনি কি আর ঘাস খান? সেই হর্স কি আপনি নাকি?

তালগোল পাকিয়ে ডাক্তারেরই যেন মাথা খারাপ হয়ে যাবার মতন হয় তখন।

খট্টাঙ্গপুরাণ

বহুদিন পরে আবার ভাইদুটিকে দেখা গেল। আবির্ভাবের মতই দেখতে পেলাম। গোলদিঘী কফি হাউসের কোণ ঘেঁসে বসে।

আমিও ওদের কোল ঘেঁসে পাশের টেবিলে গিয়ে বসেছি। আমাকে দেখে হর্ষবর্ধন—ঠিক হর্ষধ্বনি নয়, প্রায় অর্ধপরিচিতের মতই অভ্যর্থনা করল—এই যে!

বলেই আবার ভাইয়ের সঙ্গে মশগুল হয়ে গেল সে গরে।

অনেকদিন পরে দেখা। মনে হলো, হয়তো আমায় চিনতে পারেনি ঠিক। কিংবা হয়তো বা হাড়েহাড়ে চিনেই? নইলে শুধু এই ভাষণ—এই শুক সভাবণ—এত কম ভাষণ নিতান্তই হর্ষবর্ধন-বিরুদ্ধ, কিন্তু ও নিয়ে আর মাথা না ঘামিয়ে নিজের কফির পেয়ালায় মন দিলাম। আর কান দিলাম ওদের কথায়….

বুঝলি গোবরা, এ রকমের আরেকটা কফি হাউস আছে কলকাতায় চৌরঙ্গীর কাছে। কিন্তু সাবধান, সেখানে যেন ভুলেও কখনো যাস না।

কেন, যাব না কেন? কানাড়াকরা তাই মাথা চাড়া দিয়েছে কী হয় গেলে?

গেছিস কি মরেছিস। এ কফি হাউস তো ভাল। এখানে খালি বাণী। বাঙালী ছেলে মেয়েরাই আসে। নিতান্ত নিরাপদ। কিন্তু সেখানে বাবা, যা মারাত্মক!

বলে মারাত্মক ভাবের চোখখানা তিনি ভাইয়ের ওপর রাখেন।

মারাত্মকটা কিসে শুনি?

মেমরা আসে সেখানে। হর্ষবর্ধন বিশদ হন–মেমরা দেখা দেয়।

দিলেই বা। মেম তো আর বাঘ নয় যে গিলে ফেলবে!

বাঘেরা বেশি না গিলেই হজম করতে পারে। তবে আর বলছি কী!…সেদিন একটা মেয়ের পাল্লায় পড়েছিলাম রে! ধরেছিলো আমায়।

কী করেছিলে তুমি?

কিছু না। সবেমাত্র সেখানে ঢুকে একটা খালি জায়গা পেয়ে বসেছি। অতো বড় হটা গিসগিস করছে মানুষে। বাঙালী, পাঞ্জাবী, চীনেম্যান, সায়ে মেমে ভর্তি। হলের মাঝামাঝি একটা থাম ঘেঁষে দুটি মাত্র চেয়ার খালি একখানা ছোট্ট টেবিল বিরে। তারই একটিতে গিয়ে বসেছি আমি। একটু পরেই একটা মেম এসে আমার সামনে চেয়ারটায় কালো।

ও এই ধরা! সে তোমাকে ধরবার জন্যে নয় গো দাদা, বসবার আর জায়গা ছিল না বলেই- বলতে যায় গোবর্ধন। নিজের দাদাকে সে ধর্তব্যের মধ্যে জ্ঞান করে না।

শোন্‌ না আগে। সবটা শোন্ তো, হর্ষবর্ধন বাধা দেন-মেমটা বসেই না আমাকে বললো—গুড় ইভিনিং মিষ্টার। আমি তার জবাব দিলাম—গুড নাইট মিসেস্‌।

তুমি গুড নাইট বলতে গেলে কেন? গুড নাইট তো বলে লোকে বিদায় নেবার সময়।

তখন কি আর ইভিনিং হিল নাকি? সন্ধ্যে উতরে গেছে কতক্ষণ! আটটা বাজে প্রায়। আমি শুধু মেমটার ভুল শুধরে দিয়েছি। কিন্তু বলতে কি, আমি অবাক হয়ে গেছি বেশ। মেমরাও ইংরাজিতে ভুল করে তাহলে? আশ্চর্য!

তারপর? তারপর?

তারপর মেমটা কী যেন বলল ইংরাজিতে, তার একটা কথও যদি আমি বুঝতে পেরেছি–!

নিশ্চয় খুব ভুল ইংরেজি?

ক্যা জানে! তারপরে কী করলো মেয়েটা। তার ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটা নোটবই বার করলো; আর ছোট্ট একটুকরো পেনসিল। কী যেন লিখলো কিছুক্ষণ ধরে, তারপর সেটা দেখালো আমায়।।

তুমি পড়তে পারলে?

পারবো না কেন, ইংরেজি তো নয়। পেয়ালা।

পেয়ালা? পেয়ালা আবার কোনদেশী ভাষা দাদা?

এই পেয়ালারে বোকা! হর্ষবর্ধন কফির পাত্রটা তুলে ধরেন—এই বাংলা কাপ ডিশ। এই না এঁকে মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। যাকে বলে সপ্রশ্ন নেত্রে।

তুমি কী করলে?

আমি বুঝলাম মেমটা এক পেয়ালা কফি খেতে চাইছে। আমিও আর দ্বিরুক্তি না করে বেয়ারাকে কফি আনতে বললাম—দুপাত্তর আমাদের দুজনের জন্য।

মেমটা দেখতে কেমন?

মেম-মেম। আবার কেমন! মেমরা যেমন হয়ে থাকে। তবে বয়েস বেশি নয়। পচিশ কি ছাব্বিশ। বাঙালীর মেয়ের মত অত সুন্দর না হলেও দেখতে বেশ ভালোই।

তাই বলে। গোবর্ধন সমঝদারের মত ঘাড় নাড়ে, প্রেম করবার মত মেম? তা বলতে হয়।

কী যে বলিস! তোর বৌদি যদি জানতে পারে। তারপর শোন। আমি ভাবলাম একটা মেয়েকে কি শুধু শুধু কফি খাওয়ানোটা ঠিক হবে? সেটা যেন কেমন দেখায়। তাই ওর খাতাটা নিয়ে একটা পাতায় টোসটের মতন কতকগুলে আঁকম। এঁকে দেখালাম ওকে! দেখে সে বল্‌লো—ইয়েস্ ইয়েস্। থ্যাংকু।

ইয়েস্ ইয়েস্‌ মানে? জানতে চায় গোবরা।

মানে তুই করেছিস এখন। হাঁ, দাদা জানায়—ইয়েস, মানে জানিসনে বোকা? তারি ডবোল, বুঝেছিস এখন? আর থ্যাংকু মানে—।

জানি জানি। আর বলতে হবে না। তাহলে মেমটা তোমার কথায় হাঁ হাঁ করে উঠলো বলো?

করবে না? তারপরে মেটা করলো কী, একজোড়া ডিম এঁকে দেখালো আমায়। বুঝলাম যে টোসটের সঙ্গে ডিমসেদ্ধ খেতে চাইছে। তাও আনতে বললাম বেয়ারাকে।

বাঃ বেশ তো! বলে গোবরা সুরুৎ করে জিভের ঝোল টানে।

মেমের কথা শুনে যে তোর জিভ দিয়ে জল পড়ছে দেখছি।

মেম নয়! মেমলেটের কথা ভেবে দাদা। মেমটা মেমলেট খেতে চাইল না? মেমলেট বা মামলেট যাই বলো!

ওর ডিম পাড়ার পর তারপর আমি খাতাটা নিলাম। নিয়ে এক প্লেট কাজু বাদাম আঁকলাম। আর ও আঁকলো কতকগুলো চ্যাপটা চ্যাপটা কী যেন। মনে হলো পাঁপড় ভাজা। কিন্তু বেয়ারাকে জিজ্ঞেস করায় সে বললো পাঁপড় ভাজা সেখানে মেলে না। আলুভাজা হতে পারে। সে আলুভাজা নিয়ে এলো। আর কাজু বাদামও। আলুভাজা খেয়ে মেয়েটাকে খুশি দেখে তখন বুঝলাম যে সে আলুভাজাই চেয়েছিল।

আলুভাজার আর পাঁপড় ভাজার কি এক রকম চেহারা নাকি? গোবরা নিখুঁত চিত্রসমালোচকের ন্যায় খুঁত খুঁত করে।

তা কি হয় রে? কিন্তু ছবি দেখে কিছু বোঝবার উপায় নেই। এই যে মশায়, আপনাকে বলছি-হর্ষবর্ধন সম্বোধন করেন আমাকে—আঁকার বিষয়ে আপনি কিছু বলুন তো, আঁকতে গেলে এমনটা কেন হয়? পাঁপড় ভাজার সঙ্গে আলুভাজা এমন মিলে যায় কেন?

আঁকের বেলায় যেমন এক এক সময় মিলে যায় না? তেমনি আর কি। তেমনি আঁকের মতই অনেক সময় মেলেও না আবাব। ভালো আঁকিয়ে হলে তবেই মেলাতে পারে। এমন ইঁদুর আঁকবে যে মনে হবে যেন হাতি। আবাব উটপাখিকে মনে হবে যেন একটা মুর্গি। এইখানেই আঁকার বাহাদুরি।

কী করে তা হয়ে থাকে? দুই ভাই একসঙ্গে শুধায।

দুজনের মুখে ডবোল ইয়েস দেখা দেয় তখন।

ব্লকেব কেরামতি মশাই আর কিছুই নয়। আঁকিয়ে তো একটুকরো কাগজে ছোট্ট একটুখানি আঁকে। যারা ব্লক বানায় তারাই হচ্ছে ওস্তাদ। তাই মাথা খাটিয়ে দরকার মাফিক সেটাকে বাড়িয়ে কমিয়ে যার যে ছবিটি চাই তার মনের মতন বানিয়ে দেয়। ধরুন, আপনি লিচু এঁকেছেন কিন্তু আপনার দরকার কাঁঠালের! ব্লকমেকার সেই লিচুকেই বড় কবে-বাড়িয়ে কাঁঠাল বানিয়ে ব্লকে আনতে পারে। একই আঁকুনি ছোট্ট করলেই লিচু আর বড়ো করলেই কাঁঠাল।

ছোট করলেই লিচু আর বড়ো করলেই কাঁঠাল? বারে!-গোবরা অবাক হয়।

তাহলে আমি যে কাজু বাদাম এঁকেছিলাম, ব্লকওয়ালা ইচ্ছে করলেই সেই ছবিব থেকেই কুমডোর ঝুড়ি করতে পারতো?

পারতোই তো।

যাকগে, আমাদের শিল্পতান্ত্রিক আলোচনায় গোবর্ধন বাধা দেয়।–-তারপর কী হলো বলো না দাদা।

তারপর অনেক কিছুই খেলুম আমরা—একটাও কথা না কয়ে—শুধু কেবল ছবি চালিয়ে। প্রায় টাকা পনেরোর মতো খাওয়া হলো। তারপর বেয়ারা বিল নিয়ে এলে আমি একটা একশো টাকার নোট দিযেছি আর সে ভাঙ্গানি আনতে গেছে এমন সময় দেখলাম কী–একমনে মেয়েটা কী যেন আঁকছে তখনো।

তোমার চেহারা বুঝি? গোববার মুখে বেড়া হাসি দেখা দেয়।

এই চেহারা আঁকা কোনো মেয়ের কম্মো নয়—ছোট্ট একটু খাতার পাতায়। তোর মত রোগা পাতলা হলেও হতে হতো। আঁকা শেষ করে ছবিখানি সে আমার হাতে দিলো। দিয়ে একটুখানি—যাকে বলে সলজ্জ হাসি-হাসলো।

ওর নিজের ছবি বুঝি?

না, দেখলাম একটা খাট এঁকেছে সে।

খাট! খাট কেন! খাট কি কোন খাবার জিনিস? শোবার তো জানি! গোবরা অবাক হয়,–ও, বুঝেছি, তোমাকে খাটাবার মতলব ছিল মেয়েটার।

আমি কি মশারি যে আমাকে খাটাবে। অতো সোজা নয়। হর্ষবর্ধন আপত্তি করেন। কিন্তু কেন যে সে খাট আঁকলো তাই আমি অবাক হয়ে ভাবতে লাগলাম।

কিরকম খাট? দুগ্ধফেননিভ? আমি শুধাই।

বেশ বড়ো খাট। জোড়া খাট যেমন হয়ে থাকে। কিন্তু সেজন্যে নয়, আমার তাক লাগলো এই ভেবে যে, আমি যে খাটের জন্মদাতা, কাঠের ব্যবসা যে আমাদের, তা সেই মেয়েটা টের পেল কী করে? এর রহস্য ভাই আমি এখনো অব্দি বুঝতে পারিনি। থ হয়ে রয়েছি সেই থেকে–রহস্যের থই না পেয়ে, বুঝলেন মশাই?

 গৃহিণী গৃহ মুছ্যতে

দাম্পত্যকলহ যে সব সময় বহু আড়ম্বর করেই শুরু হয় তা নয়, সামান্য কথায়ও হতে পাবে।

তবে আরম্ভ-র মধ্যে বৌ না থাকলেও, তার মাঝখানে বউ থাকেই!

পূজার বোনাসের উপরি পাওনার কী গতি করা যায় তাই নিয়ে কথা হচ্ছিল দুজনাব—টাকাটা দিয়ে কী করা হবে তারই বিলি বন্দেজ।

শিখরিণী বলছিল—–টাকাটা যা তা করে উড়িয়ে দেয়া চলবে না…।

শেখর বলল-তা তো নয়ই। আজে বাজে খরচ করা হবে না কিছুতেই যে, তা ঠিক।

টাকা তো আসতে না আসতেই ফুট! বলছিল বৌ-কী করে কোথা দিয়ে যে খরচ হয়ে যায় টেরই পাওয়া যায় না। কপূরের মতই উপে যায় যেন।

যা বলেছ। বৌয়ের কথায় ওর সায়।

এবার আর তা নয়। হিসেব মতন কেনা কাটা করতে হবে সব। অনেক কিছু করা যায় এই টাকায়। কী কী কিনতে হবে তার একটা লিস্টি করে ফেলা যাক, কী বলে?

তোমার খান কয়েক শাড়ি তো প্রথমেই—শেখরই পাড়তে যায়।

অনেক ঘাটের জল খেয়ে অবশেষে ঘাটশিলায় এসে প্রায় কপর্দক-হীন অবস্থায় কপার মাইনের চাকরিটা পেয়েছে শেখর-তার বৌয়ের পয়েই বলতে হয়। কোম্পানির থেকে কোয়ার্টারও পেয়েছে তারপর। ঘর পাবার পর ঘরণীকেও নিয়ে এসেছে তার পরে। আর তার পরেই এই মোটা টাকার পূজা বোনাস—তার বৌয়ের পয়েই নিশ্চয়। অতএব বৌকে সুখী করার কথাই সর্ব প্রথম।

আর বৌ খুশি হয় শাড়ি পেলে—তা কে জানে? শুক আর সারি যেমন জোড়বাঁধা, তেমনি শাড়ির সঙ্গে সুখ ওতপ্রোত। জড়োয়া গয়না দেবার সামর্থ্য নেই ওর, অতএব শাড়ি দিয়েই বোকে সুখের সঙ্গে জড়াও।

খা, শাড়ি তো আছেই, কিন্তু তার আগে চাই আসবাব পত্তর— শিখরিণীর বক্তব্য—কোনো ঘরে এক চিলতে সামগ্রী নেই। আসবাব পত্তর না থাকলে ঘরদোর যেন মানায় না। কোন্ ঘরে কী কী জিনিস দরকার তার একটা তালিকা করে ফেলা যাক। কোন্ ঘরের জন্য কী দরকার তার লিস্টি করা যাক, কেমন?

কাগজ আর পেনসিল নিয়ে দুজনে দুখানা ফর্দ করতে বসে গেল।

শেখরের লেখা শুরু হবার আগেই শিখরিণীর ফর্দের অর্ধেক প্রায় খতম্।

শেখরের তালিকায় একটা আইটেম ততক্ষণে খাড়া হয়েছে কোনো রকমে, শিখরিণী বলল, আমি রুম্ বাই রুম্ লিটি করছি, বুঝেছ? রান্নাঘর থেকেই শুরু করেছি আগে।

শেখর ওর কথায় আইডিয়াটা পেল। রান্নাঘরের পরেই খাবার ঘরের কথা। সে এক নম্বর আইটেম লিখল :

(১) আরো মাছ, তারপর আরো চিনি… দুনম্বরে ভেবে চিন্তে বসালো সে।

কী তোমার লেখা হলো? শেষ হল লিস্‌টি?

প্রায় শেষ। জানালো শেখর।

আচ্ছা, আমার তালিকাটা পড়ছি আমি আগে। তারপর তোমারটা শোনা যাবে। তখন কারটা বেশি জরুরি ভেবে চিন্তে ঠিক করা যাবে তারপর।

আচ্ছা।

রান্নাঘরের জন্য, একনম্বর, একটা ইলেকট্রিক স্টোভ চাই সবার আগে। তারপর এক সেট স্টেইনলেস স্টিলের বাসনকোসন, প্রেসার কুকার…

এমনি করে প্রায় সাতাশটা আইটেম আউড়ে গেল শিখরিণী।

তারপর বসবার ঘরের জন্য সোফাসেট, টিপয়, চেয়ার এসব না হলে চলে নাকো। শোবার ঘরে দেরাজ আলমারি ড্রেসিং টেবল…

শেখর মনে মনে খতিয়ে দেখল, সব কিনতে প্রায় সাত হাজার টাকার ধাক্কা। আর বোনাস তো মাত্র বারোশো টাকার। সে নিজের তালিকায়, আরো একটা, তিন নম্বরের আইটেম যোগ করল তখন।

এবার তোমার তালিকাটা শুনি তো। ওর বৌয়ের তলব।

তালিকার লেখাটা দেখালো সে—

(১) আরো বেশি মাছ (২) আরো বেশি চিনি (৩) আরো বেশি টাকা।

তোমার খালি খাওয়া। ঝঙ্কার দিয়ে উঠলো ওর বৌঃ খাই খাই করেই গেলে! মাছ আর চিনি? খাওয়া ছাড়া দুনিয়ায় যেন কিছুই নেই আর।।

কী আছে আর? তাছাড়া, যা আছে তা হলো গিয়ে শোয়া। খেয়ে দেয়ে পেট ঠাণ্ডা করে শুয়ে পড়া, বলল শেখর কাজের মধ্যে দুই, খাই আর শুই।

ভারী একলফেঁড়ে লোক বাবা তুমি!

একলষেঁড়ে হলুম? আমি কি একলা খাব নাকি? তোমাকে নিয়েই খাব তো। আর শোবার কথা যদি ধরো…।

হয়েছে, আর বলতে হবে না। বুঝতে পেরেছি। সাপের হাঁচি বেদেয় চেনে। বলল শিখরিণী।

খানিক চুপ থেকে প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে পেয়ে মুখর হয়ে ওঠে শেখর—কিন্তু এত আসবাব-পত্তর এনেই বা কী হবে শুনি? আসবাব আনলেই হয় না, তা সব সময় ঝকঝকে তকতকে রাখতে হয়। নইলে, দুদিনেই নোংরা হয়ে যাচ্ছেতাই হয়ে যায়। এত সোফাসেটি দেরাজ আলমারি রোজ রোজ ঝাড়-পোঁছ করবে কে? শুনি একবার?

ঝি থাকবে না? বলল বৌঃ লোক রাখব একটা।

কপার মাইনের এই আড়াই শশা টাকা মাইনের চাকরীতে আর ঝি চাকর পোষায়। জানাল শেখর, একটা ঝির বেতন আর খোরাকীতে এই বাজারে কত পড়ে তা জাননা? ষাট সত্তর টাকা চলে যায়–তার খেয়াল আছে?

শিখরিণী চুপ করে কথাটা ভাবে।

তবে হ্যাঁ, তুমি নিজে যদি আসবাব পত্তরের যত্ন নাও, ঝাড়-পোঁছ করার ভার নাও তো হয়। অবশ্যি, শাস্ত্রেও সেই কথা বলে বটে। বলে যে, গৃহিণী গৃহ মুছতে, ঘর দোর ঝাড়া মোছর কাজ যা তা বাড়ির গিন্নীরই করবার…

বিয়ে করে ভালো বিনে মাইনের দাসী পেয়েছে, না? ঝামটা দিয়ে উঠল ওর বৌ : তোমার ভাত রাঁধব, বাসন মাজব, আসবাব পত্তর ঝকঝকে তকতকে রাখব সারাদিন দাসীবৃত্তি করে, তবে তুমি দুটি আমায় খেতে দেবে—তাই না?

ব্যাস। শাস্ত্রকথার থেকে অনেক অশাস্ত্রীয় কথা উঠল তারপর। কলহ গড়ালো অনেক দূর, শেষ পর্যন্ত ধুত্তোর বলে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল শেখর।

যথারণ্যথা গৃহম্। আরেকটা শাস্ত্রবাক্য আউড়ে বোধকরি রোদশে জনেই অরণ্যের উদ্দেশে বেরুলো সে।

অরণ্যও খুব বেশি দূরে ছিল না। ঘাটশিলার চার ধারেই অরণ্য। শাস্ত্রমতে যে বাণপ্রস্থ পঞ্চাশশার্ধে হবার, পঞ্চাশের অর্ধেই তাই বরণ করে নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে গিয়ে সেঁধুল সে।।

সন্ধ্যে হয় হয়। জীবনসন্ধ্যা আসার ঢের আগেই সন্ধ্যে ঘনিয়ে এল তার জীবনে।

বিকেলে অফিস থেকে ফিরে চায়ের সঙ্গে এক বাটি হালুয়া খেয়েছে—খিদে তাই পাচ্ছিল না তার। আজ রাতটা না খেয়েই সে কাটাতে পারবে। কাল থেকে বনের ফলমূল তার সম্বল—জীবনের আমূল পরিবর্তন তার কাল থেকেই।

বুদ্ধি করে হালুয়াটা খেয়ে এসেছে পেট ভরে—নিজের বুদ্ধির সে তারিফ দিল। চায়ে চিনি ছিল না, চিনির অভাবে হালুয়াটাও মিষ্টি হয়নি তেমন—সেই কারণেই তার ফর্দের দুনম্বরে আরো বেশি চিনির উল্লেখ ওই।

কিন্তু চিনির যোগাড় করা যেমন কঠিন নিজের বৌকে চিনতে পারাও তার চেয়ে কিছু কম কঠিন নয় বুঝি। বহু আড়ম্বরে শুরু না হলেও এবং বউ-র দিক থেকে আরম্ভ নাহলেও এই প্রথম কলহেই জীবনে অরুচি ধরে গেহল তার। তাই শেখরের এই যৌ-বনপ্রস্থানকে নেহাত লঘুক্রিয়া বলা যায় না হয়ত বা।

শেখর শুনেছিল, ঘাটশিলার জঙ্গলের এই ভূমিকা আদৌ সামান্য নয়, ক্রমেই গভীর থেকে গভীরতর হয়ে মধ্যপ্রদেশের দণ্ডক পর্যন্ত চলে গেছে এই অরণ্য। এর আনাচে কানাচে বাঘ, ভাল্লুক, বন-বেড়াল, খাকশেয়াল, সাপ, বিছে, বাদুড়, বাঁদর সব ওতপ্রোত হয়ে রয়েছে।

কিছুক্ষণ ইতস্তত ঘোরা ফেরার পর গাছের ফাঁকে চাঁদের আলোয় ঘড়ি দেখে সে জানল যে রাত দশটা হয়েছে—এবার শোবার ব্যবস্থা করতে হয় কোথাও। বনে রাত কাটাতে হলে গাছই হচ্ছে সব চেয়ে নিরাপদ এই ভেবে সে একটা গাছে উঠে তার শাখাপ্রশাখার জোড়বিজোড়ের ফোকরে কায়দা করে শুয়ে পড়ল কোনরকমে এবং প্রকৃতির ক্রোড়ে আদিম মানবদের মতই সে ঘুমিয়ে পড়ল দেখতে না দেখতেই।

খানিক বাদে এক বিরাট অজগর সেই পথে যেতে দেখতে পেল শেখরকে। ইস্ লোকটা কী বেকায়দায় শুয়েছে দ্যাখো দেখি! ঘুমের ঘোরে উলটে পড়ে হাড় গোড় ভাঙবে বোধ হয় বেচারা। না, ওকে বক্ষা করা আমার দরকার। আপনমনে আওড়ালো অজগর।

এই না ভেবে সেই পরহিতচিকীর্ষু সাপটা গাছে উঠে সাত পাকে তাকে জাপটে ধরল। এইভাবে ওকে সাপটে রাখলে আর ও গাছের থেকে পড়বে না, ভাবল সাপটা, আর, এখন যদি ওকে রক্ষা করি, তাহলে কাল সকালে এর আমি আরো সেবা করতে পারব। প্রাতরাশ হিসেবে নেহাত মন্দ হবে না মনে হচ্ছে।

সকালে গাছের ফোকর দিয়ে সূর্যের আলো চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙে গেল শেখরের। ঘুম ভাঙতেই শেখর দেখল বিরাট এক অজগর তাকে জড়িয়ে রয়েছে। এক সাতপাকের হাত থেকে বাঁচতে গিয়ে আরেক সাতপাকের ফাঁসে এসে পড়েছে সে। সাপটা তখনন গভীর নিদ্রায় অচেতন। শেখরের ডান হাতটা মুক্ত ছিল, আর দেরি না করে পকেট থেকে তার ছোরাটা বার করে সে সাপের পিঠে বসিয়ে দিল সবলে।

সাপটা তখন আরো জোরে জাপটাবার চেষ্টা করল তাকে-আর ছুরিটাও সেই চেষ্টায় আরো বেশি গেঁথে বসল তার গায়। একটু পরেই অজগর নিজের বাঁধন আগা কবে গাছ থেকে খসে পড়ে ভূমিশয্যায় দেহরক্ষা করল তার।

আলিঙ্গনমুক্ত হয়ে গাছের থেকে নামল শেখর। অজগরের অধঃপতনে শাখায় শাখায় পাখির দল কিচির মিচির লাগিয়ে দিয়েছে ততক্ষণে, বাঁদররা ডালে ডালে হপ হপ করে লাফাতে লেগেছে আর সামনের গাছে এক কাকাতুয়া শেখরের কাণ্ড না দেখে চেঁচিয়ে উঠেছে—কেয়া বাত! কেয়া বাত!

কিন্তু তাদের এসব উৎসাহ-প্রকাশে নজর ছিল না শেখরের। কাল রাত্রে শোবার আগে যদিও তার সংকল্প ছিল যে সকালে উঠে আরো গভীরতর বনে সে প্রবেশ করবে, কিন্তু এখন, সকলের অভিনন্দন, এমনকি, কাকাতুয়াটার সাধুবাদ সত্বেও সে-মতলব সে পরিহার করল। তার মনে হলো যে, বন যতই কেন উপাদেয় হোক না, বাড়ির মতন জায়গা আর নেই।

ইত্যাকার ভেবে বন ছেড়ে ঘরের পানেই পা বাড়ালো শেখর।

আবজানো দরজা ঠেলে ঢুকতেই তার নজরে পড়লো, ঘরের নেতৃত্ব নিয়েছে বৌ। সাবানজলে ভেজানো ন্যাতা দিয়ে মেজে ঘষে ঘরের মেজে তকতকে করতে লেগেছে। গৃহিণী গৃহ মুছতে-ই বটে!

বৌ তাকে আসতে দেখে বলল, কী কাণ্ড তোমার! অমন দুম করে কিছু না বলে চলে গেলে, আমি সারা রাত বাড়া ভাত নিয়ে ঠায় বসে কাটালুম। তোমার যে নাইট ডিউটি ছিল সেটা আমায় বলে যাবে তো?

শেখর কিছু না বলে গুম হয়ে থাকে।

চায়ের জল চাপিয়েছি। নাও, মুখ হাত পা ধুয়ে বোসো এখন–টোস্ট, ডিমসেদ্ধ নিয়ে আসছি সব।

ডেকচেয়ারটায় গা এলিয়ে মনে হলো শেখরের, গভীরতর বনে না সেঁধিয়ে ভালোই করেছে সে। কেননা, পরের বন যতই কেন গভীর হোক না, পরের বোনের মতন মিষ্টি আর হয় না—যদি সে পরী মতই হয় আবার। আর যদি সে ফের ঘরণী হয়ে আসে।

চোখের ওপর ভোজবাজি

সবার উপরে মানুষ সত্য—ঘোরতর সত্যি কথা। উপরওয়ালা যে প্রচণ্ডভাবে অমোঘ, তা কে না জানে? কিন্তু মানুষ আর কতক্ষণ উপরে থাকতে পারে? উপরের মানুষটির কতক্ষণ আর উপরি উপায়ের সুযোগ থাকে? নিজের কর্মদোষে আপনার থেকেই কখন নীচে নেমে পড়ে।

আমরা তো হর্ষবর্ধনকে অদ্বিতীয় বলেই জানতাম, কিন্তু তিনি যে নিজগুণে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করবেন, কবতে পারেন, তা কখনো আমার ধারণার মধ্যে ছিল না।

ধারণাটা পালটালো ওঁর গিন্নীর কথায়। যেতেই তিনি ভীষণ খাপপা হয়ে কথাটা জানালেন আমায়। আর বললেন যে, অ্যাদ্দিন লোকটা বেশ চৌকোস ছিল, কিন্তু আপনার সঙ্গে মেশবার পর থেকেই নাকি কেমন ধারা যেন ভোতা মেরে যাচ্ছে। বুদ্ধিশুদ্ধি বলতে কিছু নেই আর কিন্তু আমাকে তো বেশ ধারালো বলেই আমি জানতাম …মৃদু প্রতিবাদের ছলে বলি : উনি যেমন ধার দিয়ে ধারালো, তেমনি ধার নেবার বেলায় আমার তো আর জুডি হয় না।

ধারালো লোকের ধার ঘেঁষতে নেই কখনো। পাশ থেকে ফোডন কাটে গোবরা। ধারে ধারে ঘষাঘষি হয়ে ধার ক্ষয়ে ভোতা মরে যায় শেষ য। তাই হয়েছে গিয়ে দাদার।

তারপর সমস্ত কথা জানতে পারলাম সবিশেষ। হর্ষবর্ধনের চোখের ওপর ভোজবাজিটা ঘটে গেল কেমন করে! যেন কোন যাদুকরের মায়দণ্ডেই হাওয়া হয়ে গেল গাড়িটা!

হয়েছিল কী, হর্ষবর্ধন গত সকালে চুল ছাঁটতে গেছলেন পাড়ার কাছাকাছি এক সেলুনে।

সেলুনে কাল ভীড় ছিল বেজায়। তাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে খানিকক্ষণ।

অপেক্ষমান হর্ষবর্ধনের সামনে কতকগুলো বই এনে ধরে দিল সেলুনওলা–চুপচাপ বসে থাকরেন কেন বাবু! এই বইগুলো দেখুন ততক্ষণ নেড়েচেডে। আপনার আগে তো আরো জনাতিনেক রয়েছেন, তাঁদের ছাঁটাই শেষ হলেই তাবপর আপনাকে ধরব।

বইগুলো নিয়ে তিনি নাড়াচাড়া করছেন এমন সময় অপরিচিত একজন এসে তার পাশে বসল—

নমস্কার হর্ষবর্ধনবাবু! বলেই এক নমস্কার ঠুকল তাঁকে।

নমস–কার! প্রতিধ্বনির সুরে বললেও লোকটা যে কে তা কিন্তু তার আদৌ ঠাওর হয় না।

আপনি আমাকে চিনবেন না মশাই! আপনার প্রায় প্রতিবেশীই বলতে গেলে। দুটো গলির ওধারে আমি থাকি। তবে আপনাকে আমি বেশ চিনি। আপনি আমাদের পাড়ার। শীর্ষস্থানীয়। কে না চেনে আপনাকে?

না না! কী যে বলেন, আমি…আমি নিতান্ত সামান্য লোক। অপরের দ্বারা স্তৃত। হয়ে হর্ষবর্ধন কেমন অপ্রস্তুত বোধ করেন।

আপনি অসামান্য, আপনি অসাধারণ। জানেন, পাড়ার ছেলে বুড়ো সকলে, ইতর ভদ্র সবাই আমরা, আপনার পদাঙ্ক অনুসরণ করি? বলে লোকটি একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করে: এই দেখুন না, আপনাকে এই সেলুনে ঢুকতে দেখে আমিও এখানে দাড়ি কামাতে এলাম। নইলে নিজের বাড়িতেই তো কামাই রোজ। নিজের হাতেই কামাই।

আমি চুল ছাঁটতে এসেছি। হর্ষবর্ধন কথাটা উড়িয়ে দিতে চান। নিজের দৃষ্টান্তস্বরূপ হওয়াটা যেন তার তেমন পছন্দ হয় না।

বলেই তিনি বইগুলো ভদ্ৰলোকের দিকে এগিয়ে দেন—পড়তে দিয়েছে এগুলো। দেরি হবে এখানে চুল ছাঁটবার, দাড়ি কামাবার। হাত খালি নেই কারো—দেখছেন তো! পড়ুন এগুলো ততক্ষণ।

এসব তো রহস্য রোমাঞ্চের বই। দেখেশুনে নাক সিটকান ভদ্রলোক : ভুতুড়ে অ্যাডভেঞ্চারের গল্প যততা। পড়লে মাথার চুল খাড়া হয়ে ওঠে। কেন যে রাখে এগুলো এখানে কে জানে!

ওই জন্যেই বোধহয়। হর্ষবর্ধন বালান : মাথার চুল খাড়া হয়ে থাকলে ছাঁটবার পক্ষেও ওদের সুবিধা হয় হয়ত।

একটা গভীর রহস্যের রোমাঞ্চকর সমাধান করে ওঁকে যেন একটু সহ্যই দেখা যায়।

তা যা বলেছেন। তাঁর কথায় সায় দেন ভদ্রলোক : এই এলাকায় এই একটাই তো ভাল সেলুন! তবে এই বড় রাস্তার ওপরে, পাড়ার থেকে অনেকটা দূর—রোজ রোজ আর কে এখানে দাড়ি কামাতে আসছে বলুন! এধার দিয়ে যাচ্ছিলাম, আপনাকে ঢুকতে দেখলাম বলেই না…তা, আর গাড়িটা কোথায় রাখলেন?

গাড়ি! গাড়ি কই আমার! হর্ষবর্ধন নিজের দাড়িতে হাত বুলোন—গাড়ি নেই বলেই তো এত ঝামেলা, দুবেলা গিন্নী বাড়ি মাথায় করছেন সেইজন্যে! গাড়ি আর পাচ্ছি কোথায়!

সে কী! আপনি পাচ্ছেন না গাড়ি? ভদ্রলোক রীতিমতন সবিস্ময়।

কই আর পাচ্ছি মশাই! তিন বছর হলো দরখাস্ত দিয়ে বসে আছি…তবে এবার একটু আশার আলো দেখা যাচ্ছে। এতদিনে আমার নাম লিস্টির মাথায় এসেছে। সবার ওপরে আমার নাম দেখে এলাম সেদিন। এইবার পাবো মনে হয়।

পেলেও পেতে পারেন। ভরসা দেন ভদ্রলোক মাথায় মাথায় হলেই পাওয়া যায় কিনা?

হ্যাঁ, এজেন্টও সেই কথা বলল। বলল যে, আপনার গাড়ি পৌঁছে গেছে ডকে, দু-একদিনের মধ্যেই মাল খালাস হয়ে আসবে। দিন দুই বাদে এসে দাম চুকিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে যেতে পারবেন, বলল এজেন্ট।

আপনি ভাগ্যবান। উল্লসিত হন ভদ্রলোক, কী গাড়ি বলুন তো?

ফিয়াট তো বলল। হর্ষবর্ধন জানানঃ ফিয়াট না—কী যেন!

ফিয়া—ট! উপচে ওঠা উৎসাহ হঠাৎ যেন চুপসে গেল লোকটার—ফিয়াট।

কিরকম গাড়ি মশাই? হর্ষবর্ধন জানতে উদগ্রীব।

যাছছেতাই! ফিয়াট না বলে আপনি ফায়ারও বলতে পারেন।

তার মানে?

ফীয়ার মানে ভয়। ভয়ঙ্কর গাড়ি মশাই।

সে কী! তবে যে খুব ভালো গাড়ি বলল এজেন্ট?

ওরকম বলে ওরা। বেচতে পারলেই তো ওদের কমিশন। মোটামূটি লাভ।

তাই নাকি?

বেশ বড়ো গাড়িই তো পেয়েছেন? বিগ ফিয়াট, নাকি বেবি ফিয়াট? জানতে চান ভদ্রলোক।

না, তেমনটা নাকি বড় হবে না, বলল লোকটা। তবে নেহাত ছোটও নয় তাবলে। মাঝামাঝি সাইজের বলেছে এজেন্ট।

কজন চাপবার লোক বাড়িতে আপনার?

তিনজন আমল। আমি আমার গিন্নী আর আমার ভাই গোবরা—এই তো। ড্রাইভারকে ধরে জনা চারেক স্বচ্ছন্দে যেতে পাবে, সেইরকম জানা গেল।

কুলিয়ে যাবে তাহলে আপনাদের।

তা যাবে। গোবরা ড্রাইভারেব পাশেই বসবে না হয়, তাতে কী হয়েছে। আমরা কর্তা গিন্নী দুজনায় ভেবে বসব দুজনে। অবশ্যি, আমরা একটু ভাটার দিকে, তাহলেও মোটামুটি আমাদের চলে যাবে মনে হয়।

মোটামুটিই হন আর পাতলাপাতলিই হন, আপনাদের চলে যাবে বুঝলাম। বলার সময় ভদ্রলোকের মুখ বেশ ভার হয়—-তবে গাড়িটা যদি চলে—তবেই না!

কেন, গাড়ি কি চলবে না নাকি?

কেন চলবে না! চালালেই চলবে। ঠেলেঠুলে চালাতে হবে। ঠেলেঠুলে চালালে কী না চলে বলুন? বাড়িতে আপনারা কজনা আছেন বললেন? ড্রাইভারকে বাদ দিয়ে অবশ্যি সে তো ধর্তব্যের বাইরে, কেননা, সে তো স্টিয়ারিং ধরে বসে থাকবে। কজনা আছেন বললেন আপনারা?

আমি, আমার বৌ, আমার ভাই—তাছাড়া একটা বাচ্চা চাকর—এই চারজন।

চারজনা মিলে ঠেললে গাড়ি চলবেনা আবার! চারজনায় চার্জ করলে, বলে, ঠেলেঠুলে হাতিকেও চালিয়ে দেওয়া যায়।

ঠেলেঠুলে নিয়ে যেতে হবে গাড়ি, তার মানে? ঠেলাগাড়ি নাকি মশাই? অবাক হন হর্ষবর্ধন।

না না, তা কেন? মোটর গাড়িই, আর, দম দিয়ে চালাবার মত না হলেও, একটু উদ্যম লাগবে বইকি!… তবে একটু ঠেলা আছে। তিনি বিশদ করেন—

ঐ গোড়াতেই যা একটু ঠেলতে হবে। তারপর একবার ইঞ্জিন চালু হয়ে গেলে গড গড করে গড়িয়ে চলবে গাড়ি। এগুলোর অ্যাকসেলেটার ততো ভালো নয় কি না, তাই এরকমটা। আপনার থেকে স্টার্ট নেয় না তাই।

নতুন গাড়ির এমন দশা কেন মশাই? হর্ষবর্ধন জিজ্ঞাসু।

নতুন গাড়ি কি এদেশে পাঠায় নাকি ওরা? সব সেকেণ্ডহ্যাণ্ড। জানান ভদ্রলোক : বলে সেকেণ্ডহ্যাণ্ড, আসলে কতো হাত ঘুরে এসেছে কে জানে! তাকেই আনকোরা বলে চালায় এখানে বাজারে।

এই রকম! জানতাম না তো। হর্ষবর্ধনকে একটু ম্রিয়মাণ দেখা যায়। ওদের শো রুমে ঐ ফিয়াট ছিল আরো দু-একখানা। এজেন্ট ভদ্রলোক নমুনা দেখালেন আমায়—ঝকঝকে নতুন—খাসা চমৎকার দেখতে কিন্তু।

ঐ ওপর ওপর। সমঝদারের হাসি হাসেন ভদ্রলোক। -উপরে চাকন-চিকন ভিতরে খড়ের আঁটি। উপরটা ঝকঝকে, ভিতরটা ঝরঝরে। একটু দম নিয়ে তিনি নবোদ্যমে লাগেন আবার—তা ছাড়া এই গাড়িগুলোর আরেকটা দোষ এই যে পেট্রল কনজাম্পসন বড্ড বেশি। পেট্রল খায় খুব।

তা খা। খাইয়ে লোকেদের আমরা পছন্দ করি। আমরাও খুব খাই মশাই।

শুধুই কি পেট্রল? তাছাড়া হোঁচোট—?

হোঁচোট? হর্ষবর্ধন বুঝতে পারেন না। চোট খান হঠাৎ।

যেতে যেতে হোঁচট খায় যে গাড়ি। ভয়ঙ্কর স্কিড্‌ করে।

ছাগলছানা সামনে পড়লে আর রক্ষে নেই বুঝি? হর্ষবর্ধন শুধান : চাপা দিয়ে চলে যায় বলছেন তাই?

ছাগলছানা পাচ্ছেন কোথা থেকে? ভদ্রলোক হতবাক।

ঐ যে বললেন ইসকিড? ইকিড মানে তো ছাগলছানা। বিড এ ম্যান গো টু দি ইসকি। পড়িনি নাকি ফাস্টবুকে?

ছাগলছানা অব্দি যে তাঁর বিদ্যের দৌড় সেকথা অম্লানবদনে প্রকাশ করতে তিনি দ্বিধা করেন না।

না না। সে তো হলো গিয়ে কিড। এটা স্কিড। তার মানে, যেতে যেযে হঠাৎ লাফিয়ে যায় গাড়িটা। টক করে বেটরে গিয়ে পড়ে। বেঘোরে মানুষ খুন করেও বসে মাঝে মাঝে।

অ্যাঁ? আঁতকে ওঠেন হর্ষবর্ধন।

মারাত্মক গাড়ি মশাই—তবে আর বলছি কী!

কী সর্বনাশ!

সর্বনাশ–বলতে! গাড়ির ব্রেকটাই আসলে খারাপ। হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে দেবে আপনাকে। রাস্তায় যত খুন জখম হবে আপনার গাড়ির তলায়, তার খেসারত গুনতে গুনতে দুদিনেই আপনি ফতুর হয়ে যাবেন।

লাখ লাখ টাকা ফাঁক হয়ে যাবে ঐ গাড়ির জন্যেই? আপনি বলছেন?

ঐ ব্রেকের জন্যই ব্রোক হতে হবে আপনাকে শেষতক। ভদ্রলোকের শেষ কথা।

ব্রোক হবার আগেই যেন ব্রেক ডাউন হয় হর্ষবর্ধনের, ভেঙে পড়েন তিনি-শুনেই না!

আর কলিশন হলেই তো হয়েছে। যদি আর কোনো গাড়ি কি ল্যাম্পপোস্টের সঙ্গে একটু ধাক্কা লাগে তাহলেই ভেঙে তক্ষুনি চুরমার! যা ঠুনকো গাড়ি মশাই!

তাহলে আমরাও তো খতম্ হয়ে যাবো সেই সঙ্গে?

খতম না হলেও জখম তো বটেই। তবে গাড়িটা কিনেই ইনসিওর করিয়ে নেবেন, আপনারাও লাইফ ইনসিওর করে রাখবেন নিজেদের—তাহলেই কোনো ভয় নেইকো আর। দুদিকই রক্ষা পাবে তাহলে। কোম্পানির থেকে দুটোরই খেসারত পেয়ে যাবেন তখন।

মারা গিয়ে ঢাকা পাওয়ার কোনো মানে হয়? তাঁর কথায় হর্ষবর্ধন তেমন ভরসা পান না : আর নাই যদি বা মরি, কেবল হাত পা-ই হারাই—কিন্তু তা হারিয়ে অর্থলাভ করাটা কি একটা লাভ নাকি?

সেটা দৃষ্টিভঙ্গির তারতম্য। যে যেমনটা দ্যাখে। কেউ টাকা উপায় করার জন্য সারা জীবন ব্যয় করে। কেউ বা জীবন রক্ষা করতে গিয়ে দু হাতে টাকা ওড়ায়। যার যেমন অভিরুচি।

ইস্! ফেঁসে গিয়েছিলাম তো আবেকটু হলেই। ফাসিয়ে দিয়েছিল গাড়িটা। কী ভাগ্যি আপনার সঙ্গে দেখা হলো আজ, আপনি বাঁচিয়ে দিলেন মশায়। আমাকেও—আমার টাকাকেও।

না না, তাতে কী হয়েছে। আপনি ঘাবড়াবেন না। চাপবার জন্যে কি আর গাড়ি? তার জন্যে তো ট্যাক্সিই রয়েছে। রাস্তায় পা দিয়েই যদি ট্যাক্সি পাওয়া যায় তার চেয়ে ভালো আর হয় না। আর তা সস্তাও ঢের। আর এধারে দেখুন, এসব গাড়ির পেছনে ধৰ্চাটা কম নাকি? ঠুনকো গাড়ি, পচা কলকজা, একটুতেই বিকল। আর্ধেক দিন কারখানার গ্যারেজেই পড়ে থাকবে—তারপর মেরামত হয়ে এলেও, দুদিনেই আবার যে কে সেই।

এমন গাড়িতে আমার কাজ নেই। এ গাড়ি আমি নেব না।

না না, নেবেন না কেন? বললাম না, চাপবার জন্য তো গাড়ি নয়। গাড়ি হচ্ছে বাড়ির শোভা, বাড়ির ইজ্জৎ বাড়াবার। বাড়ির মনে গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকলে পাড়াপড়শীর কাছে মান বেড়ে যায় কতো।

আমার গিন্নীও সেই কথা বলেন বটে। বলেন যে, একটা গাড়ি নেই বলে পাড়াপড়শীর কাছে মুখ দেখানো যাচ্ছে না।

ঠিকই বলেন তিনি। বাড়ি গাড়ি এসব তো লোককে দেখানোর জন্যেই মশাই! দেখে যাতে পাড়ার সবার চোখ টাটায়। তবে এ যা গাড়ি—চোখে আঙুল দিয়ে তো দেখানো যাবে না পড়শীদের। বলেন ভদ্রলোক : তেমন করে দেখাতে গেলে তো তাদের চাপা দিয়ে দেখাতে হয়। নিদেন চাপা না দিলেও, গা ঘেঁষে গিয়ে কি গায়ে কাদা ছিটিয়ে গেলেও চলে, কিন্তু তাতো আর এ গাড়িতে সম্ভব হবে না। তবে হ্যাঁ, পড়শীদের কানে আঙুল দিয়ে দেখাতে পারেন বটে।

কানে আঙুল দিয়ে? তিনি অবাক হন? সে আবার কী রকম দেখানো?

হ্যাঁ, ঐ ঘচাং ঘচ্‌! ঐটা করতে পারেন বটে। ঐ ঘচাং ঘচ্‌।

ঘচাং ঘচ্‌?

হ্যাঁ। আপনারা চারজন আছেন বললেন না? কর্তা, গিন্নী, দেওর আর বাড়ির চাকর, চারজন তো রয়েছেন। বাড়ির দেউড়িতে থাকবে তো গাড়ি, গাড়ির চার দরজায় আপনারা চারজনা দাঁড়াবেন। তারপর ঐ ঘচাং ঘচ্‌।

ঘচাং ঘচটা কী মশাই? বারংবার শুনে বিরক্ত হন হর্ষবর্ধন।

আপনারা চারজনায় মিলে গাড়ির চারটে দরজা কেবল খুলুন আর লাগান—ঘন্টায় ঘণ্টায়—ঘণ্টার পর ঘণ্টা! ঘচাং ঘচঘচাং ঘচ…ঘচাং ঘচ…চলতে থাকুক পরম্পয। রীতিমতন কানে আঙুল দিয়ে টের পেতে হবে পড়শীদের…যে হ্যাঁ, গাড়ি একখানা আছে বটে পাড়ায়। চালান সারাদিন ঐ ঘচাং ঘচ।

কিন্তু নাহক ঘচাং ঘচ করাটা কি ভালো?

তাহলে ঘচাং ঘচের ফাঁকে ফাঁকে প্যাঁ পোঁ চালাবেন। তাও করতে পারেন ইচ্ছে করলে–সেও মন্দ নয় কিছু।

প্যাঁ পোঁ? একটু যেন ভড়কেই যান তিনি।

হ্যাঁ। ঐ প্যাঁ পোঁ, গাড়ির সবকিছু বাজে হলেও ওর হর্নটা কিন্তু নিখুঁত। সেটাও বেশ বাজে। মাঝে মাঝে তাই বাজান। চলুক ঐ পা পোঁ আর ঘচাং ঘচ্‌।

দূর মশাই ঘচাং ঘচ। আমি এক্ষুনি চললাম অর্ডার ক্যানসেল করতে—অমন ঘচাং ঘচে গাড়ি চাই নে আমার।

চুল না হেঁটেই তীর বেগে বেরিয়ে পড়লেন হর্ষবর্ধন। বাড়ি ফিরলেন গাড়ি খারিজ করে দিয়ে তারপর।

না গিন্নী! ঘচাং ঘচ করা পোষাল না আমার পক্ষে!

বলে বাড়ি ফিরে গিন্নীর কাছে পাড়তে গেছেন গাড়ির কথাটা, তিনি তো বাড়ি মাথায় করে তুললেন। কতর বোকামির বহর মাপতে না পেরে কিছু আর বাকী রাখলেন না তাঁর।

বৌয়ের বকুনি খেয়ে আজ সকালেই আবার তিনি মুখ চুন করে গেছেন সেই এজেন্টের কাছে—গাড়িটা চাই মশাই! আমি মত পালটেছি আমার।

গাড়ি আর কোথায়! আপনি অর্ডার ক্যানসেল করে যাবার পর যিনি দু-নম্বরে হিলেন—আপনার ঠিক পরেই ছিলেন যিনি-পেয়ে গেছেন গাড়িটা। ঐ যে তিনি ডেলিভারি নিয়ে বেরিয়ে আসছেন এখন। তিনি দেখিয়ে দেন—তবে যদি বলেন, আপনার নাম আমি দ্বিতীয় স্থানে রাখতে পাবি অতঃপর। এব পবেব পব যে গাড়ি আসবে সেইটা আপনি পাবেন। ফেব আবার তিন বছরের ধাক্কা হয়ত বা।

হর্ষবর্ধনের চোখের ওপর দিয়ে প্যাঁ প্যোঁ করতে করতে চলে গেল গাড়িটা। তাঁর মুখ দিয়ে বেরুতে শোনা যায় শুধু—সেই ভদ্রলোক দেখছ সেলুনের আলাপী কালকের সেই ঘচাং ঘচ্‌…!

অ-দ্বিতীয় সেই ভদ্রলোককে দেখে আপন মনেই তিনি খচখচ করেন।

 জীবন-জিজ্ঞাসা

জীবনরহস্যের কোনো হদিশ পেলাম না ভাই, দুঃখ করছিল আমার বন্ধু সোমনাথ ডাক্তার : সারাজীবন ধরে এত চেষ্টা করেও।

তোমাদের পাবার তো কথা নয়, তার খেদোক্তিতে আমি বাধা দিই- ওতো আমাদের…লেখকদেরই একচেটে এলাকা ভাই! তলিয়ে যাবার ভয় থাকলেও, ওর গভীরে আমরাই তো ডুব দেব…থই না পেলেও…থ হয়ে গেলেও। তোমাদের কারবার তো জীবন্মতদের নিয়েই। জীবনসংশয়ের সঙ্গেই তো যতো সম্পর্ক তোমাদের।

জীবনরহস্য মানে দীর্ঘ জীবনের রহস্য। বলে সে প্রাণীমাত্রের আদিমতম প্রাণের কথাটি প্রাঞ্জল করে—কী করে দীর্ঘ জীবন লাভ করা যায়, অনেকদিন বেঁচে থাকা যায়—সেই সমস্যার কথাই আমি বলছিলাম।

ও, এই কথা! বলে আমি হাঁফ ছাড়লাম।

অবশ্যি কিছু কিছু কিনারা যে পাওয়া না গেছে তা নয়। মিতাহারী মিতাচারী হলে মানুষ দীর্ঘকাল বাঁচে, পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সেটা প্রকাশ পেয়েছে। আহার-বিহারে সংযমীদের অকালমৃত্যুর আশঙ্কা ঢের কম। এই মিতাহারের কথাটাই ধরা যাক না…মিতাহার মানে পরিমিত আহার…

মিতাহারের কথায় আমার দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়ল।

সত্যি, পরীর মতই মেয়ে ছিল বটে মিতা। কিন্তু ওই মিতাহারের চেষ্টাতেই…পরিমিত পরিমাণেই, বলতে কি…

হ্যাঁ, মিতাহারী হবার সুযোগ পেলে আমি দীর্ঘজীবী…আরো একটু দীর্ঘজীবী হতে পারতাম হয়ত। এই যৎকিঞ্চিৎ জীবনে যে কটা দিন বেঁচেছি তার ভেতরেই আরো একটু বেশি দিন বাঁচা যেত, অনেক দিন অনেক রাত আরো অনেক বেশি জীবন্ত হতো, সেই তঙ্গভাগনীকে ক্ষণকালের জন্যেও সঙ্গিনীরূপে পেলেও এই এক জীবনেই অনেক জীবন-যাপন করা যেত, এই জনমেই জন্ম-জন্মান্তর লাভেরও কোনো অন্তরায় ছিল না। কিন্তু মিতালীর মুখপাতেই যেভাবে চডচিত হতে হলো মনে পড়ায় এতদিন পরেও দীর্ঘনিঃশাস পড়ল আমার।

মিতাহারের কথা তো বলছ! আমি ফোঁস করে উঠলাম। কিন্তু মিতাচার কিরূপ অম্লমধুর জানতে যদি! আঙুর ফলের মতই ভারী টক ভাই! ওর talk পর্যন্তই ভালো, তার বেশি এগুলেই মারাত্মক।

সেই বিপজ্জনক আচার-ব্যবহারের কথা স্মরণ করে এতদিন পরেও আমি শিউরে উঠি।

সে হাতের কাগজের একটা অংশে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল–আজকের এই খবরটা পড়েছ? এইটে পড়েই ওই দীর্ঘজীবনের প্রশ্নটা আমার মাথায় উঠেছে আবার নতুন করে।

খবরটায় নজর দিলাম—খবরের মত খবর বটে।

একালের এক দীর্ঘজীবী মানুষ—গতকাল ভট্টপল্লীর শ্রীভট্টশালী মহাশয়ের ১০৬তম জন্মাৎসব হয়ে গেল। তাঁর নিজের বিবেচনায় তার বর্তমান বয়স ১০৯ বছর, প্রাথমিক গণনার ভুলহেতু তিন বছর বাদ পড়ে গেছে..

ইস! লোকটা নিজের জীবনটাকে নিয়ে নয়-ছয় করেছে। খবরটা পড়ে আমি বিরক্তি প্রকাশ করি—অ্যাদ্দিন ধরে বেঁচে থেকে কী যে হয়! বুড়ো হয়ে বেঁচে থাকার কি কোন মানে আছে?

আরে, আজ যদি আমরা দীর্ঘজীবনের কিনারা করতে পারি তো কাল দীর্ঘ যৌবনলাভের কিনারে গিয়ে পৌঁছব, তা জানো? বলল সোমনাথ : চলে যাই ভাটপাড়ায়। ভদ্রলোকের ইনটারভিউ নিইগে। জীবনরহস্যের যদি কোন হদিশ পাওয়া যায় তার থেকে।

ভাটপাড়ায় পা দিয়েই একজনের কাছে শ্রীভট্টশালীর বাড়ির ঠিকানাটা শুধালাম।

অ্যাঁ? ভট্টশালার বাড়ি খুঁজছেন নাকি আপনারা? লোকটা যেন খেঁকিয়ে উঠল কেমন।

ভট্টশালা। তার মানে। আমরা তো হতবাক।

এক নম্বরের বদলোক মশাই। আমারা ওকে ভট্টশালাই বলি। শ্রীশ্রী ভট্টশালা।

এমন কথা বলছেন কেন? সোমনাথ একটু মৃদু প্রতিবাদ জানায় : এত দীর্ঘদিন ধরে বেঁচে রয়েছেন—উনি তো আপনাদের ভট্টপল্লীর গৌরব মশাই।

গৌরব! গৌরবই বটে লোকটার মুখভঙ্গি দেখবার মতই খেয়ে না খেয়ে অ্যান্দিন ধরে খালি বেঁচেই রয়েছেন, এ ছাড়া আর কী করেছেন উনি? শুনি তত একবার?

কিছুই করেননি? ভদ্রলোকের কথায় আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কী কী করা উচিত ছিল উক্ত ভট্টশালীর মনে মনে তাই খতাই। সুদীর্ঘকাল ধরে কেবল বেঁচে থাকাটা কি কোন কথাই নয়?

দীর্ঘজীবনবাবুর কথা আর বলবেন না। এই কথা বলে বিষবৎ আমাদের পবিত্যাগ করে চলে যায় লোকটা।

ঘুরতে ঘুরতে শেষ পর্যন্ত আমরা ভট্টশালী মশায়ের আটচালায় গিয়ে পৌঁছলাম।

চতুম্পাঠীতেই বসেছিলেন ভট্টশালী। নমস্কার করেই কথাটা পাড়া গেল-কলকাতাব থেকে আসছি আমরা। আজকের কাগজে খবরটা পডেই ছুটে এলাম, আপনার দীর্ঘজীবনলাভের কারণগুলো আমরা জানতে চাই যদি দয়া করে আমাদের জানান…

আমি একজন ডাক্তার। ইনি লেখক।

আজ্ঞে হ্যাঁ। দীর্ঘজীবনলাভের যদি কোনো শর্টকাট থাকে… সঙ্গে সঙ্গে আমারও অনুযোগ।

আসুন আসুন। বসুন আপনারা। আমাদের অভ্যর্থনা করে বললেন ভট্টশালী। —দেখুন, দীর্ঘজীবনের রহস্য কিছু নেই। দীর্ঘজীবনলাভের সোজা পথ হচ্ছে সহজ পথ। জীবনের আঁকা বাঁকা চোরা গলিতে না যাওয়া-ভুল পথগুলো এড়িয়ে চলা। সর্বদা সোজা পথে চলবেন—সেইটেই হচ্ছে সহজ পথ। সহজভাবে জীবন-যাপন কবলেই দীর্ঘায়ু হওয়া যায়। মিতাহার, মিতাচার, আহার-বিহারে সংযম, নিদ্বিয় নিশ্চিন্ত জীবন—এইগুলিই দীর্ঘায়ুলাভের সহায়ক। সংযত জীবন-যাপন কবলে যে পরমায়ু বাডে সেকথা আর না জানে কে?

আজ্ঞে, আমিও সেই কথাই বলছিলাম আমার বন্ধুকে, এই মিতাচারের কথাই। এখন আপনিও আবার সেই কথাই বলছেন। দ্বিরুক্তি করল সোমনাথ।

দেখুন আমি আজীবন নিরামিষাশী, জীবনে মদ্যমাংস স্পর্শ করিনি, কোনো নেশাভা নেই আমার, কিছুর জন্যেই কৈানো উদ্বেগ দুশ্চিন্তা নেইকো, মনে হয় এই সবই হয়ত আমার দীর্ঘজীবনলাভের হেতু হবে। বলে তিনি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন : তবে আমার এ আর কী দীর্ঘজীবন। আমার চেয়েও দীর্ঘতরজীবী ব্যক্তি এই অঞ্চলেই রয়েছেন। এই ভট্টপল্লীতেই।

বলেন কী! কই তাঁর খবর তো…

পাবেন কী করে, তিনি কখনো নিজের পরমায়ু কারো কাছে প্রকাশ করেন না। কিন্তু আমি তো জানি। এইটুকুন বয়স থেকে দেখে আসছি তাঁকে।

তার বয়স কত এখন? আমি জানতে চাই।

তিনি তো বলেন চুরাশী। ভট্টশালী বললেন, কিন্তু তাঁর এই চুরাশীই আমি চুরাশী বছর ধরে শুনে আসছি। আমার আট বছর বয়সে যেমনটি তাঁকে দেখেছিলাম, এখন এই একশো আটের পৈঠা পেবিয়েও ঠিক তেমনটিই দেখছি তাঁকে। কোনো বৈলক্ষণ্য নেই। কিছুমাত্র না। ডবোল আশী পার করে দিয়েও তিনি…

বলেন কী! শুনেই আমি আঁতকে উঠি : ডবোল আশীর চুড়ায় চুর হয়ে বসে আছেন—তার চিরকালের চুরাশীতে? আশীআশীকরেও আসেননি এতদিনেও! আর্ম! দীর্ঘজীবনের চূড়ান্ত যদি বলতে হয় তো বোধকরি এইটেই তার পরাকাষ্ঠা।।

শুধু তার চুলগুলো পেকেছে কেবল। বলে ভট্টশালী নিজের বক্তব্য সম্পূর্ণ করলেন।

এক চুলের তফাত মাত্র! আমার টিপপনি কাটলাম।

নামটি কী তাঁর? সোমনাথ শুধায়।

কেউ তাঁর নাম জানে না। কাউকে বলেনও না তিনি। তবে আমরা সবাই তাকে যোগেন্দ্রজী বলে থাকি। ঐ নামেই ডাকি আড়ালে। যোগবলেই তার এহেন দীর্ঘজীবন—আমাদের এই ধারণা।

হিন্দুস্থানী সাধক-ফাধক বুঝি?

না না, সাধক-ফাধক নয়। হিন্দুস্থানীও না। সাধারণ বাঙালী ভদ্রলোক। তবে ওঁর দীর্ঘজীবনের কোন কিনারা করতে না পেরে, হয়ত তান্ত্রিক ক্রিয়া-টিয়া যোগ-টোগ কিছু করে থাকেন, এই ধারণায় সবাই ওঁর ওই নাম দিয়েছে। এই আর কি! বলেন শ্রীভট্টশালী : তাহলেও তার কাছে যান না একবার। হয়ত এখানে আসাটা আপনাদের সার্থক হতে পারে তাহলে। যে গুহ্য রহস্যের সন্ধানী আপনার তাঁর চাবিকাঠি হয়ত তার কাছেই রয়েছে।

গেলাম তাঁর কাছে।

যোগেনবাবুকে দেখে কিন্তু চুরাশী দূরে থাক, চৌষট্টির বেশি বলে মনে হয় না কিছুতেই। নাদুস-নুদুস দেহ-স্বাস্থ্যখানা রেখেছেন মন্দ না। পঁয়ষট্টি দেবার এখনো কোনো লক্ষণ নেই, তার বেশ দেরি আছে বলেই মনে হয়।

এখানকার একজন বলছিলেন— কথায় কথায় ভট্টশালীর কথাটা পাড়া গেল——যে আপনি নাকি চুরাশীবছর ধরে চুরাশীতেই রয়ে গেছেন, দেখতেও রয়েছেন সেই একরকমটিই প্রায়, বয়স নাকি আপনার বাড়ছে না আদপেই।

শুনে তিনি হো হো করে হাসলেন। বললেন—দেখুন, অস্তিত্বের একটা স্থিরবিন্দু আছে—তাকে ঈশ্বরই বলুন আর অজ্ঞেয়ই বলুন—তার সঙ্গে কোনরকমে যুক্ত হতে পারলে—সময় তখন আপনার থেকেই স্তব্ধ হয়ে যায়। অস্তিত্বের সেই বিন্দুমাত্রায় বিন্দুমাত্রই অবস্থিতি থাকে কেবল। দেশকালাতীত ত্রিশূন্যে কি বয়স বাড়ে? আপনাদের বিজ্ঞানও কি এই কথায় সায় দেয় না? কিন্তু আমরা তো আর তা পারি না, সেই কেন্দ্রবিন্দুর থেকে প্রকৃতির বশীভূত হয়ে প্রবৃত্তির বশে ক্রমাগত বৃত্ত টেনে টেনে বৃত্তান্তরে গিয়ে পড়ি—তখন তার অনিবার্য পরিণামে নানান পরিণতি এসে দাঁড়ায় স্বভাবতই। সেই বৃত্ত-বৃত্তান্তই আমাদের এই ধারাবাহিক জীবদ্দশা।

কিছু না বুঝেও আমি ঘাড় নাড়ি—কেন এমনটা হয় মশাই?

নিছক মায়া বাড়াতে গিয়েই। আবার কী?

তিনি কিন্তু আপনার যোগবলের কথাও বলছিলেন। সোমনাথ বলল।

যোগবলের চেয়ে বড় হচ্ছে বিয়োগবল। যোগ হচ্ছে বিধাতার। মানুষের নয়। কেন না যোগানদার তিনিই। আমাদের সব কিছুই বিয়োগান্তক। ভগবতী দশ হাতে আমাদের যুগিয়ে যাবেন, আর আমরা দশ দিকে ত বিলিয়ে যাব। যাবার রাস্তা পরিষ্কার না এলে আসার পথ বন্ধ। উত্তরে বাতাস ঘরে ঢুকতেই পারবে না যদি না আমরা দক্ষিণের জানালাটা খুলে রাখিবাইরে যত ঝড়ই বয়ে যাক না কেন। তার কৃপায় উত্তরণ তখনই সম্ভব যখন দক্ষিণার দ্বার মুক্ত থাকবে আমাদের। ধন, ঐশ্বর্য, অর্থসামর্থ্য, স্নেহ ভালবাসা যাই বলুন—সবই আমাদের অপরকে দিয়ে দিয়ে পেতে হবে না দিয়ে পাওয়ার কোনো উপায় নেইপেয়েছি কি না সত্যিই, দিলে পরে তবেই তো সেটা টের পাই। পুঁজি করে রাখলে সেটা পুঁজ হয়ে থাকে—তার থেকেই যতো আধিব্যাধি—কি দেহের—কি সমাজের—কি রাষ্ট্রের…তামাম দুনিয়ার।

কিন্তু তার সঙ্গে বয়স না বাড়বার সম্বন্ধটা কী? সোমনাথ শুধায়।

বয়স বাড়ে ঠিকই, কিন্তু তার কোনো দাগ পড়ে না কেবল। বহতা নদী যেমন, তার কি কোনো বয়স আছে? পর্বতশীর্ষে তার জলযোগ আর ঘাটে ঘাটে জল বিলিয়ে সমুদ্রগর্তে গিয়ে সেই জলবিয়োগ—যেমন পাওয়া তেমনি তার দেওয়া—এই জন্যেই সে ফুরোয় না কখননা, অফুরন্ত, কানায় কানায় ভরা সব সময়—সময়ের কি কোনো ছাপ আছে তার গায়?

কিন্তু ঐ মায়া বাড়ানোর কথাটা বললেন যে… আমি ওঁকে মনে করিয়ে দিই তখন। শূন্যবিন্দুর থেকে যে-বৃত্তই টানি—যে বৃত্তিতেই যাই না, সবই তো শূন্যাকার। শূন্যর থেকে শূন্যেরই সৃষ্টি হয় বৃত্তাকার ধারণ করলেও তা শূন্যবিন্দুরই সমষ্টি মাত্র। সবই শূন্যকার, মায়া। ফাঁকি ফক্কিকার। উপনিষদের সেই বিখ্যাত বচনটা বদলে নিয়ে হয়ত বলা যায়—শূন্যমদঃ শূন্যমিদং শূন্যাৎ শূন্যমদুচ্যতে। শূন্যস্য শূন্যমাদায় শূন্যমেবাবশিষ্যতে।

কিন্তু ঐ বৃত্তাকার? সোমনাথ তর্কে প্রবৃত্ত।

সবই হচ্ছে আমাদের দানবৃত্ত—আত্মদানের প্রবৃত্তি। শূন্য তো আসলে পূর্ণ-ই, অলরাউন্ডার, সম্পূর্ণ। শূন্যের আত্মপ্রসার থেকেই তো বৃত্ত। তাই নিছক মায়া হলেও, যে কোনো বৃত্তিই, তা আমাদের কলাবৃত্তিই হোক যৌন প্রবৃত্তিই হোক, দেহদানই কি আর স্নেহদানই কি, সবই আমাদের নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া ছাড়া তো কিছু নয়। যেতে যেতে দেওয়া, দিতে দিতে যাওয়া—পেয়ে পেয়ে দেওয়া আর দিয়ে দিয়ে পাওয়া—সব বৃত্তের সব বৃত্তিই সেই এক বৃত্তান্ত।

দেওয়ার কথাটা যা বলেছেন সায় দেয় সোমনাথ ডাক্তার : না দিলে তো ব্রিবনে কিছুই মেলে না মশাই। না হৃদয়, না ভিজিট।

আসলে মেলা মানেই তো দেওয়া নেওয়া, আদানপ্রদান। মেলাই কথার ওপর আমার এক কথা।।

আর এ সমস্তই আমাদের মায়া বাড়ানো মাত্র। যোগেনবাবু যোগ দেন : মায়া তো ব্রহ্মের সম্প্রসারণ ছাড়া কিছু নয়; ব্রহ্মের নানারূপে নানন বৃত্তিলাভ। ব্রহ্মের আত্মদান। আপনাকে দেওয়া। আর সেই আত্মদানে তাঁর আত্মচরিতার্থত। তাঁর এই দানযোগে যদি আমরা ঠিক ঠিক যোগদান করতে পারি তাহলে এর সব কিছুই শূন্যমাত্ৰ হলেও, শেষ ফল সেই শূন্য হলেও, সেই শূন্যতার মধ্যেই আমরা পূর্ণতার স্বাদ পাব। দেশকালপাত্রের সীমানা উপচে সেই পরিতৃপ্তি। বলে তিনি নিঃশ্বাস ফ্যালেন : আর ভেবে দেখুন, ভূয়ো হলেও সেই স্বাদটুকুই তো আমার–জীবনের সহস্র যন্ত্রণা, হাজার বিষাদের মধ্যেও।

তত্ত্বকথার এই সব গোঁজামিলের গর্তে আর মাথা না গুজে সোমনাথ তার ডাক্তারি সত্তায় ফিরে আসে এবার। –আচ্ছা, এই দীর্ঘজীবনে কি কোনো অসুখবিসুখ করেনি আপনার? জিজ্ঞেস করে বসে হঠাৎ।

করেনি আবার? শরীরম ব্যাধিমন্দিরম। কোন অসুখটা করেনি। যে অসুখ একবার এসেছে সে আর যায়নি, যেতে চায়নি, খুঁটি গেড়ে বসেছে এই দেহে। কোন অসুখটা নেই বলুন আমার? বাত আছে, হাঁপানি আছে, ডায়াবিটিসও চাগাড় দেয় মাঝে মাঝে, উচ্চরক্তের চাপ তো রয়েইছে—আর এর কোনোটাই ভূয়ো নয়। ভূয়োদশী ব্যক্ত করেন : তবে হ্যাঁ, রক্তচাপ থাকলেও, বক্তের সেই চাপল্যটা ততটা নেই আর।

অ্যাতো অসুখ আছে আপনার? আমি হতবাক হই। কিন্তু কই, দেখে তো তা মনে হয় না মোটেই।

অসুখও যেমন আছে তেমনি তার ওষুধও রয়েছে যে! সবই আছে তবে প্রশমিত হয়ে আছে।

কী করে দমিয়ে রেখেছেন এত সব অসুখ? আমার প্রশ্ন।

ওষুধ খেয়ে—আবার কী করে? অসুখের আঁচ পেতেই ওষুধ খাই, শরীরকে বেশি তোগাই না। সুখভোগে অরুচি না থাকলেও অসুখভোগে আমার নিতান্ত অনীহা। আমার দেহে অসুখ আর ওষুধের সহাবস্থান– বলে তিনি সোমনাথের দিকে কটাক্ষ করেন—আপনারা ডাক্তাররা অসুখ হলে তার পরে ওষুধ দিয়ে তা সারান, আর আমি, অসুখের সম্ভাবনা দেখলেই ওষুধ খেয়ে তাকে সরিয়ে রাখি। আমার ঐ দেরাজটার দিকে চেয়ে দেখুন না একবার! এফিড্রিন, অ্যাড্রিনালিন, প্যাথিডিন, ইসিড্রেকস উইথ অ্যাডেলফিন, ইনসুলিন, আর যতো রাজ্যের ভিটামিন–এ বি সি ডি থেকে ঈ পর্যন্ত কী নেই?

সোমনাথ সেদিকে তাকাল না। মার কাছে মামার বাড়ির গল্পের মত ডাক্তারের কাছে ওষুধের তত্ত্ব ব্যাখ্যানা তার ভালো লাগল না বোধহয়। আচ্ছা, এবার আমরা আসি তাহলে। বলে সে উঠে পড়ল। নমস্কার ঠুকে বিদায় নিলাম আমরা।

ফিরে এলাম ফের সেই ভট্টশালীর সমীপে।

কী বললেন যোগেনবাবু? শুধালেন শ্রীভট্টশালী।

আসল কথা ফাঁস করলেন না কিছু। জানাল সোমনাথ : তবে আমাদের জ্ঞান দিলেন বটে বহুত।

উনি ঐ রকমই। মচকান তো ভাঙেন না। সহাস্যে বললেন ভট্টশালী: কারো কাহে ভাঙেন না কিছু কখননা। ওঁর রহস্য উনিই জানেন কেবল।

কিন্তু জীবনরহস্যের আসল কথাটা তো… সোমনাথ বলতে যায়।

আসল কথা আপনারা আমার কাছে শুনুন। বাধা দিয়ে তিনি বললেন—দীর্ঘজীবন যদি পেতে চান তো আমার পথ ধরুন। সংযত জীবনযাপন করুন, নেশা-ভাও করবেন না, বিড়ি-সিগ্রেট খাবেন না, মদ ছোঁবেন না কখনো…

এমন সময় সদর রাস্তার দারুণ একটা সোরগোল তাঁর কথার মাঝখানে এসে বাধা দিল।

ঐ যে ভট্টশালা! ভট্টশালা! ভট্টশালা কিঞ্জয়।

নিজের জয়ধ্বনি শুনেই কি না কে জানে, উনি মুখ বিকৃত করে সদুপদেশ বিতরণে ক্ষান্ত হলেন।

ব্যাপার কী? জানতে চাইলাম আমরা।

ও কিছু না। আমার বাবা আসছেন।

অ্যাঁ? আপনার বাবা? অবাক হয়ে যাই আমরা : উনি বেঁচে আছেন এখনো?

আছেন বলে আছেন! রীতিমতন সজীব। ওঁর জ্বালায় আমরা তো বটেই, পাড়াপড়শী—ভাটপাড়ার ইতরভদ্র সবাই অস্থির। বলে তিনি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন—আরো কতোকাল জ্বালাবেন কে জানে!

ওঁব নামটি কি আমরা জানতে পারি?

শ্রীশ্রীভট্টশালী। আমার শ্রী একটা, ওঁর দুটো শ্রী—উনি নিজেই এটা নিয়েছেন। কিন্তু মশাই, শ্রীশ্রী না বলে ওঁকে বিশ্রী বলাই উচিত বরং। পাড়ার ছোঁড়ারা ওঁকে ভট্টশালা বলে খ্যাপায়। এককালের ভারতবিশ্রুত মহামহোপাধ্যায় জীবন ন্যায়রত্নমশায়ের এই দশা—তার ছেলে হয়ে নিজের চোখে আমায় দেখে যেতে হলো…

তাঁর খেদোক্তি শুনতে হয় আমাদের…পিতৃনিন্দা মহাপাপ জানি, কিন্তু ওঁর যা আচাব ব্যবহার…আমরা মুখ দেখাতে পারি না লোকসমাজে। বলা উচিত নয়, কিন্তু হেন নেশা নেই যা ওঁর নেইকো। বিড়ি সিগ্রেট তো মুখে লেগেই আছে। তা ছাড়া গাঁজা আফিং চরস গুলি ভাঙ কিছু বাদ যায় না। কোকেন পেলেও খেতে ছাড়বেন না উনি…

তাহলে তো ওঁর জীবনটাই নিতে হয় সব আগে। সোমনাথকে আমি উসকালাম : জীবন সম্বন্ধে জীবনবাবুর বক্তব্যটাই জানা দরকার আমাদের।

বাইরের সেই হলাটা ক্রমেই আরো বেড়ে চলল।

সারা পাড়া জ্বালাতে জ্বালাতে ফিরছেন এখন উনি সেই ভাটিখানার থেকে…

টলতে টলতে ঘরের ভেতরে এসে ব্যক্ত হলেন একদা ভারত-বিক্ষত শ্রীশ্রীভট্টশালী মশায়। আমাদের কোনো প্রশ্ন তোলার সুযোগ না দিয়েই নিজের বক্তব্য-প্রকাশে আপনার থেকেই তিনি সোচ্চার হয়ে উঠলেন—

সভাপতিমশায়, সমবেত জনমণ্ডলী ও বন্ধুগণ! আমি প্রতিবাদ করছি…ঘোরতর প্রতিবাদ করছি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আপনারা শুনুন সবাই। আমার প্রতি কী দারুণ অন্যায় আচরণ করা হয়েছে কান পেতে আপনারা শুনুন একবার।

আমরা তটস্থ হয়ে দাঁড়ালাম উৎকীর্ণ হয়ে….

হ্যাঁ, আমি…আমি এহেন অসদাচরণের প্রতিবাদ করি। আপনারা বলবেন আমি কেন প্রতিবাদ করছি। কিন্তু প্রতিবাদ ছাড়া আমি আর কী করতে পারি? আমি বলব যে প্রতিবাদ ছাড়া আমি আর কিছুই করতে পারি না। সেই কারণেই আমি প্রতিবাদ করছি। শুনুন তাহলে আপনারা…আমার প্রতিবাদটা শুনে রাখুন সবাই…আমি ভাটিখানার মালিকের কাছে একের এক চেয়েছি, বলেছি তুমি আমায় একের এক দাও। সে আমাকে একের এক দিয়েছে…আমি একের এক খেয়েছি কিন্তু…কিন্তু…কিন্তু…।

বলতে বলতে এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় তাঁর সারা মুখ যেন কেমনধারা হয়ে যায়-–

কিন্তু ও আমাকে সত্যি সত্যি একের এক দেয়নি, আমি একের এক খাইনি, বলুন আপনারা, আমি একের এক খেয়েছি কি? আপনারাই বলুন একবার?…।

তিনি জিজ্ঞাসু নেত্রে আমাদের দিকে তাকান। ন্যাযরত্ন মশায়ের ন্যাযেব কূটতর্কে সবাই আমরা বিড়ম্বিত বোধ করি।

না, খাইনি। প্রকৃতপক্ষে আমি একেব এক খাইনি। প্রমাণ চান তাব? একেব এক যে কী বস্তু নিশ্চয় তা আপনাদেব অজানা নয়…

আমার জানা ছিল না। একের এক-টা কী হে? সোমনাথকে আমি শুধালাম। এমন কী চীজ?

একশা নম্বর ওয়ান-এর এক বোতল। সোমনাথ জানাল—মা, নদেব পরিভাষায় ঐ একের এক।

একশা নম্বর ওয়ান? তাহলে তো উনি বমি করে এখনি সব একশা কববেন। বলে আমি আঁতকে উঠে ওঁর সামনে থেকে সরে দাঁড়াই।

তার প্রমাণস্বরূপ আমি বলি… বলতে থাকেন ন্যায়রত্ন–সত্যি সত্যি একের এক খেলে আমি এরকম দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করতে পারতাম না। আপনারা বলবেন প্রতিবাদ না করে তাহলে আমি কী করতাম? আমি বলব একের এক খেলে আমি এইরকম কবে মাটিতে পড়ে যেতাম সটান…

বলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ধড়াস করে পড়ে গেলেন মেজেয়। আর উঠলেন না। তারপর আর কোনো উচ্চবাচ্য নেই তব।

সোমনাথ ডাক্তার তাড়াতাড়ি গিয়ে তার নাড়ি টিপে দেশে স্টেথিসকোপ বসিয়ে বুক পরীক্ষায় লাগলো।

বাধা দিলেন শ্রীভট্টশালা আপাতত হবে না ওকে। কিছু হয়নি ওর। মদ খেয়ে বেহুশ হয়ে পড়েছেন মাত্র। দিনে দশবার উনি অমন পড়ছেন, উঠছেন, আবার ছুটছেন ওই ভাটিখানার দিকে। একের এক না হলে তাঁর একদণ্ড চলে না।

একবাক্যে উভয় ভট্টশালীকে নমস্কার জানিয়ে আমরা ভট্টশালার থেকে বের হলাম।

সোমনাথ চুপ। আমিও। ওর চোখে নির্বাক জিজ্ঞাসা—??? (জীবনের একি রহস্য?)

আমার চোখে তার অবাক জবাব!!! (জীবন-রহস্যই বুঝি এই ভাই!)

কিন্তু একের এক কি সে পেয়েছিল? জীবনরহস্যের সব কিছু ছাপিয়ে জীবনন্যায়রত্নের সেই প্রশ্নটাই যন কানে বাজতে থাকে আমাদের।

জীবনজিজ্ঞাসার সেই প্রশ্নমীমাংসা কোথায়? হায়রে, তা কি কখনো পাওয়া যায়। সেই একের একটিকে। সেই মাতাল করা তাকে? মিতা-কে।

 ঢং থাকলেই দমকল হয় না

আগুনটা লাগতেই গোবর্ধন ক্যাশবাক্সটা হাতিয়ে আর হর্ষবর্ধন ভাইকে বগলদাবাই করে বেরিয়ে এসেছেন কারখানাব থেকে।

কী সর্বনাশ হলো বল দেখি! প্রজ্জ্বলন্ত কারখানার দিকে চেয়ে বললেন হর্ষবর্ধন।

আরো সর্বনাশ হতো যদি ক্যাশবাক্সটা না বাগাতে পারতাম দাদা! দাদার কথায় সায় দেয় ভাই।

আরো সর্বনাশ হতে পারত যদি তোকে হাতের কাছে না ওয়া যেত সময়মত, জানালেন শ্রীহর্ষ : অকালে ভ্রাতৃহারা হতে হতো আমায়।

কী করা যায় এখন? গোবরার জিজ্ঞাসা। আগুন না নেভাতে পারলে গোটা কারখানাটাই তো পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।

ওর গোটা মুখটাই যেন একটা প্রশ্নপত্র হয়ে ওঠে।

কে নেভাতে আসবে আগুন এখানে? দাদা বলেনঃ একি তোর সেই দেশ পাড়াগাঁ পেয়েছিস যে আগুন লাগলো আর অমনি চারধারের যতো লোক এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল, হোস্টেল ইস্কুলের সবাই ছুটে এল, পুকুর থেকে হাতাহাতি করে বালতি বালতি জল এসে পড়ল আর সকলে মিলে নিভিয়ে দিলো আগুন! এ হচ্ছে শহর কলকাতা, এখানে কি তোর পুকুরটুকুর আছে রে? তাছাড়া আগুন নেভাতেই বা আসছে কে হেথায়!

শহরের লোকরা বেজায় একলাফেঁড়ে হয় দাদা! সব সময় নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত তারা।

এখানে আগুন নেভাতে কেউ আসে না। এমনকি গায়ে পড়ে আগুন লাগাতেও নয়। হর্ষবর্ধন বিরক্তি প্রকাশ করেন।

তাহলে কী করে নেভে আগুন এখানে?

দমকলরা এসে নেভায়। সেই যে দেখিসনি, ঢং ঢং করে ছুটে যায় রাস্তা দিয়ে?

দেখেছি। সেই সঙ্গে আরো দেখেছি…তোমার কথায় মনে পড়ে গেল দাদা! কিন্তু ঢং থাকলেই কিন্তু দমকল হয় না। অনেক মেয়ের তো ঢং আছে, তারা কিন্তু দমকল নয়।

নয়ই তো। কথাটা দাদা মেনে নেন নির্বিবাদে, নিজের বাড়িতেই দেখছি দুবেলা,

সে আর তোকে বেশি করে দেখাতে হবে না।

আমি অন্য বাড়ির কথা বলছিলাম কিন্তু…

সব বাড়িতেই আছে রে…দুবেলাই দম দিচ্ছে কর্তাদের… বেদম-করা কল সব। কিন্তু এখন, দমকলকে তো খবর দিতে হয় আমাদের। কী করে দেয়া যায় বলতো?

কেন, ফোন করে, কী করে আবার? গোবর্ধন বাতলায় পাড়াগাঁর ডাকাডাকিতে যেমন হ্যালো হ্যালো, মেয়েদের কোতেই অবশ্যি…এখানে কলকাতায় কাউকে ডাকতে হলে তেমনি ওই ফোনে কান পেতে যালো হ্যালো!

তাতো বুঝলাম। কিন্তু ফোন করবি কোথা থেকে? আমাদের ফোনটা তো আপিস ঘরেই…কারখানার ভেতরেই আবার…।

ক্যাশবাক্সের পাশেই তো ছিল ফোনটা…বুদ্ধি করে তখুনি তখুনি যদি ফোনটা করে দিয়ে আসতাম…

বুদ্ধিটা খরচ করিসনি যে, কী ভাগ্যি! তাহলে তুইও খর্চা হয়ে যেতিস এতক্ষণ। খর্চা হয়ে যেতাম? বললেই হলো?

অবিশ্যি, আরো একটু বুদ্ধি খরচ করে দমকলের সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্সকেও ফোন করে আসতিস যদি…।

অ্যাম্বুলেন্সকে? কেন, অ্যাম্বুলেন্সকে যেন আবার?

আধ-ঝলসে শিককাবাব হয়েই বেরিয়ে আসতিস তো দেরি করলে আরেকটুখানি। অ্যাম্বুলেন্স করে হাসপাতালে চলে যেতে পারতিস সঙ্গে সঙ্গে তখুনিই।

শিকাকাবাব-এর দৃষ্টান্ত দ্বারা ভাইয়ের শিক্ষাভাব মোচনের প্রয়াস দাদার।

দাদার শিক্ষাদানে ভাই কিন্তু বিচলিত হয় না—ছুটে গিয়ে খবরটা দিলে হয় না? জিজ্ঞেস করে সে।

হয়; দমকলের মতই ছুটতে পারিস যদি, তাহলে হয়। ঘাড় নাড়েন দাদা–কিন্তু তা কি তুই পারবি? না, তা হয় না, দমকলকেই খবর দিতে হবে। আর কোনো উপায় নেই তাছাড়া। ফোন করেই দিতে হবে খবরটা। কিন্তু ফোন এন পাওয়া যায় কোথায়। শহরতলীর এই এলাকায় কি ফোন রাখে কেউ? মনে তো হয় না?

আগুনের লেলিহান ছটায় আকৃষ্ট হয়ে কিছু লোক এসে জমেছিল আশে পাশে। তাদের প্রশ্ন করেও হর্ষবর্ধন সেই একই জবাব পেলেন।

বস্তির ভেতর ফোন রাখবে কে? তবে হ্যাঁ, সামনের এই বাগানওয়ালা বাংলো বাড়িতে চেষ্টা করে দেখতে পারেন, ফোন আছে সেখানে। জানালে একজন।

মালিক কে বাড়ির? নাম কী তাঁর?

মালিক যে কে, কেউ জানে না। তাকে কেউ দ্যাখেনি কখনো তবে গিন্নী একজন আছেন বটে বাড়ির। জানালে একজন।

জানি আমি। গোবরাও বলল—তোমর ঢং-এর বথাতেই মনে পড়েছিল কথাটা। ফোন আছে বটে তার। দেখেছিও ভদ্রমহিলাকে কিন্তু তার ঢং বেজায়।

তাহলে যা না তুই। ফোনটা করে আয় সেখান থেকে। হর্ষবর্ধন বলেন।

কিন্তু ঐ যে বললাম, ঢং তার খুব।

তার ঢং তার ঢং-তোর কী! তুই ফোন করবি চলে আসবি। ছেলেমানুষই তে বলা যায় তোকে এখনও—অনায়াসেই লোকের, মানে যে কোনো স্ত্রীলোকের বাড়ির মধ্যে যেতে পারিস তুই।

না বাবা! বলেই জিভ কেটে গোবরা ভুলটা শুধরে নেয়—না দাদা! অমন আঁদরেল মেয়ের সামনে এগুবার সাহস হয় না আমার। তুমি যাও বরং।

দাদাকেই যেতে হলো অগত্যা।

গেট পেরিয়ে ফুলবাগান ভেদ করে ঝোপঝাড় লতাপাতার কেয়ারি ধরে এঁকে বেঁকে নানাজাতের ফুলের সুরভি শুকে শুকে রাজ্যের গোলাপের অট্টহাসির ভেতর দিয়ে বাংলোর সম্মুখে গিয়ে তিনি পৌঁছলেন।

সামনের ড্রইংরুমেই বসেছিলেন ভদ্রমহিলা। হর্ষবর্ধন তাঁর সমীপে গিয়ে নমস্কার করে বললেন-আমি হর্ষবর্ধন। আপনার এই বাগানবাড়ির সামনেই আমাদের কাঠচেরাইয়ের করাতি কারখানা। এখন যেজন্য এসেছি এখানে…আমাদের কাঠগুদামে আগুন লেগেছে হঠাৎ…

অ্যাঁ? আগুন? আঁতকে উঠলেন ভদ্রমহিলা, কী সর্বনাশ!

আজ্ঞে হ্যাঁ, সর্বনাশ তো বটেই…

হর্ষবর্ধনের দ্বিরুক্তিতে কর্ণপাত না করে ভদ্রমহিলা ততক্ষণে ফোন তুলে ধরেছেন…হ্যালো, দমকল…দমকল আপস? হ্যালো…

মেঘ না চাইতেই জল! বলতে না করতেই দমকল। এমন দয়াবতী সহানুভূতিপরায়ণা মহিলার ঢং-এর কথা বলছিল নাকি গোবরা? কিন্তু ঢং কোথায় ওঁর? ঢং তো কোনো দেখা যায় না। শোনাই যায় বরং। হবির্ধন নিজের দিব্যকর্ণে ঢং ঢং যেন শুনতে পান দমকলের…তার কাঠগুদামের সামনেই…

হ্যালো, দমকল আপিস? হ্যালো হ্যালো…শুনছেন?

হ্যাঁ বলুন। সাড়া এলো দমকলের থেকে।

দেখুন, অনেক সখ করে বাগানটা করা আমার। অনেক খর্চা হয়েছে এই বাগান করতে..।

কী বলছেন?

বাগানের কথাই বলছি। যতো দুর্লভ জাতের ফুল টুল, লতা পাতা এনে এনে লাগিয়েছি আমার বাগানে।

আগুনটা কোথায়? তাই বলুন!

এমন সব গোলাপের চারা এনে বসিয়েছি এখানে, যা আপনি আর কোথাও পাবেন …তার ওপর এমন করে কেয়ারি করা…এতখানি কেয়ার নেওয়া…

আগুন কি আপনার বাগানেই নাকি?

না, বাগানে কেন আগুন লাগবে?…কতকগুলো চারা এনে বসিয়েছি সুদূর অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ড নিউগিনির থেবে, এসব আনাতে বসাতে অনেক পয়সা গেছে আমার…

কিন্তু আগুনটা কোথায় বাগলো বলছেন না তো?

এই ফুলবাগানই আমার দিনের কাজ, রাতের স্বপ্ন…আমার অবসরের বিলাস…আমার বাগানের ফুল যদি আপনারা দ্যাখেন তো দু চোখ জুড়িয়ে যাবে আপনাদের—অবশ্যি যদি ফুল দেখবার চোখ আপনাদের থাকে…ঝোঁক থাকে আপনাদের।

শুনুন মশাই… সঙ্গে সঙ্গেই দমকলওয়ালার প্রুফ সংশোধন শোনা গেল…শুনুন ম্যাডাম, আপনাকে বলি, ভুল জায়গায় ফোন করেছেন আপনি। ফুলের সখ থাকলে আপনার ফোন করা উচিত গ্লোব নার্সারি কি হটিকালচারের আপিসে, কিংবা সেই বোটানিক্যাল গার্ডেনে। নাকি, কোনো ফুলের দোকানের খবর পেতে চান আপনি? ফুল যদি বেচতে চান তাহলে…

মোটেই না। ফুল বেচবার দরকার নেই আমার। তার প্রয়োজন কী বলুন? ফুল কি বেচবার বস্তু? তার কখনো দাম হয় নাকি? ফুল হচ্ছে আরাধনার জিনিস।…

আচ্ছা ফুলের পাল্লায় পড়া গেল তো, হর্ষবর্ধন আওড়ান আপন মনে। তারপর স্বগতোক্তির থেকে সম্ভাষণে আসেন…আগুন লাগার কথাটা জানান না একবারটি দয়া করে?

হর্ষবর্ধনের কথার কোনো জবাব না দিয়ে তিনি বলেই চলেন…আর আপনারা যে সামনের বাড়ি আগুন নেভাতে এসে আমার সাধের বাগান লণ্ড ভণ্ড করে দেবেন, ফুলের গাছ-টাছ মাড়িয়ে কেয়ারি টেয়ারি সব তছনছ করে দেবেন সেটি হচ্ছে না…।

কিন্তু আগুনটা কোথায় লেগেছে বললেন না তো? ঠিকানাটা দিন না! দমকলের থেকে তথাপি শুধালো। হর্ষবর্ধনের মনের প্রশ্নটাই পাড়লো যেন।  কোথায় আগুন? কোথায় না! হাটে আগুন, বাজারে আগুন, চালে আগুন, ডালে আগুন, পটলে আগুন, বেগুনে আগুন, আলুতে আগুন…আগুনকে আলুলায়িত করেও, তিনি ক্ষান্ত হলেন না… আমার মাথায় আগুন! আপনাদের ক্যাথায় আগুন! বলে রিসিভাব নামিয়ে রাখলেন অবশেষে।

বিরস মুখে ফিরে এলেন হর্ষবর্ধন। কী হলো দাদা? শুধালো গোবরা।

তুই যা বলেছিস…. বেজায় ঢং মেয়েটার…

বলেছিলাম তো! ঢং থাকলেই দমকল হয় না।

হলোও না। হলো না দমকল। বলে পথের ওপরেই বসে পড়লেন হর্ষবর্ধন। বসে বসে আগুনের ঢং দেখতে লাগলেন চোখের সামনে।

নামডাকের বহর

কলেজে উঠেই প্রিসিলা এসে ধরল আমায় একদিন, মেজমামা, একটা টাকা রোজগারের উপায় করে দাও।

টাকা রোজগার? ওর কথায় আমি অবাক হয়ে যাই; তোর আবার টাকা রোজগারের দরকার কী! রোজকার খরচ রোজ রোজ মিটে গেলেই তো হলো। তা কি তোর মিটছে না আর?

তাহলে কি আর আমি বলি তোমায়। তার দীর্ঘশ্বাস পড়ে।

খাওয়া পরার ধান্দাতেই মানুষ রোজগার করতে বেরোয়। আমি বলিঃ তোর তো সে-ধান্দা নেইকো। বাড়িতে খাস, খাস বাড়িতে বাস, আমার মতন বাসায় না। পেটে ভাত, মাথায় ছাতের ভাবনা নেইকো তোর। আমার মতো মেসখচা যোগাতে হয় না তোকে। আর মা মাসির দৌলতে শাড়ি ব্লাউজ তো এনতারই পাচ্ছিস-পরারও তোর কোনো ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। তাহলে?

বাড়ি খাওয়া খেলেই হয়ে গেল। বাইরে খেতে হয় না বুঝি?

সেই জন্যেই তো তোকে কেএডুকেশনের কলেজে অনেক কাটখড় পুড়িয়ে ভর্তি করে দিলাম। আবার কী চাই? বাইরেব খাবাব ভাবনা তো মিটেই গেল তক্ষুনি।

কী করে শুনি?

সহপাঠী বন্ধুরাই তো খাওয়াবে তারপর। তোর মতন স্মার্ট মেয়ে কি পড়তে পায় নাকি? মানে, কলেজে পড়তেই পারে কেবল? তাকে উড়তেও হবে না সেই সঙ্গে? উড়তির সঙ্গে ফুর্তি-ফুর্তির সঙ্গে উড়তি। সহপাঠীরাই তো এটা ওটা সেটা খাওয়াবে তুই খেতে চাস। কফি হাউসে, রেস্তরাঁয় কি যেখানে তোর প্রাণ চায়।

বারে! খেলেই হলো বুঝি? খাওয়াতে হবে না ছেলেদের? তাহলে তাদের কাছে মান থাকবে কেন?

মান রাখার দায় নয় তোদের। আমি জানাই: মুখরক্ষা হলেই হলো।

মুখরক্ষা?

তারা কি তোর কাছে তুচ্ছ জিনিস খেতে চাইবে রে? যেসব খাবার পয়সা ফেললেই কিনে খাওয়া যায় তোর কাছ থেকে তারা তা খাবে কেন? বরং এমন জিনিসই খেতে চাইবে যা নাকি পয়সা দিয়ে মেলে না, পেলে ওমনি পাওয়া যায়…আর খাওয়ার সঙ্গে সতেই খাওয়ানো হয়ে যায় ওমনি। যা, সে-খাবার তো পরের থেকে খেতে ঋরে, পরীর থেকেই খাবার। উপযুক্ত ভাগনির কাছে এর চেয়ে বেশি পরিষ্কার করে বলার আমি প্রয়োজন যোব করি না।

যাও! তোমার যতো সব আজে বাজে কথা। আমি চাইছি পার্ট টাইমের কোন কাজ-টাজ করে কিছু টাকা উপায় করতে…আমার পার্সোনাল খরচ মেটানোর জন্যে। আর তুমি কিনা…বড় হয়েছি না? চিরকাল কেন মা বাবার গলগ্রহ হয়ে থাকবো বললা? বড় হইনি কি? কলেজে পড়ছিনে? তুমি একটা সেলফুমেড ম্যান, তাই তোমার কাছে পরামর্শ চাইতে এলাম আর তুমি কিনা যতো…বলে প্রিসিলা ফেস করে উঠল।

আমি লেফমেড ম্যান! আমার অবাক হবার পালা এবার।।

না? বলেনি যে, তুমি বারো বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসে কলকাতায় খবর কাগজ বেচে বড় হয়েছ? বললানি তুমি?

বড়ো হয়েছি? বয়সে বড় কিন্তু কার্যত নয়। তখন খবর কাগজ বেচে দিনগুজরান করতাম এখনও সেই খবর কাগজের দৌলতে বেঁচে রয়েছি—এই মাত্র। তা, তুইও কি সেই খবর কাগজ বেচতেই চাস নাকি?

কথাটা আমার কেমনতরো লাগে যেন। শাস্তরে নরানাং মাতুলক্রম বলে বটে, ভাগনেরা মামার মতই হয়ে থাকে নাকি, কিন্তু ভাগনেরা মামার চরিত্রের ভাগ পেলেও ভাগনিদের ভাগ্যে তেমনতরো দুর্ঘটনা ঘটে বলে আমি শুনিনি কখনো। বরাতের ফেরে এককালে কাগজ ফেরি করতে হয়েছে বটে, সেজন্যে আমি দুঃখিত নই আদপেই, কিন্তু আমার জীবনে সেসব ফের ফিরে আসবে—ভাগ্যের এতখানি ফেরোজি আমি ভাবতেই পারিনে।

তা কেন? খবরের কাগজ বেচতে যাব কেন? সে বলেঃ আমি ভাবছি গোয়েন্দাগিরি করলে কেমন হয়?

গোয়েন্দাগিরি করবি! তুই? বিস্ময়ে থই পাই না।

মানে, অ্যামেচার গোয়েন্দা আর কি! এই তোমার বিমল কুমাব কি ব্যোমকেশের মতই। দুম করে সে যেন আমার সামনে একটা বোমা ফাটায়। সখের গোয়েন্দাগিরিতেও তো পয়সা পাওয়া যায়। যায় না?

অ্যাঁ? তুই করবি গোয়েন্দাগিরি? আমার শক-টাও ব্যক্ত হয়ে পারে না? গোয়েন্দাগিরির জানিস কী তুই?

সবকিছু। বিস্তর পড়াশুনা করেছি এই বিষয়ে।

বলিস কিরে? কোথায় পড়লি? কোথায় শেখানো হয় এই গোয়েন্দাগিরি? আমি বিস্মিত হই : কই, আমি তো এর কিছু শুনিনি—জানিনে।।

কোথাও শেখায় না। বই পড়ে নিজে নিজে শিখতে হয়। আমি লাইব্রেরি থেকে বইটই আনিয়ে ঘরে বসে রপ্ত করলাম তো! পাঁচকড়ি দে-র থেকে শুরু করেছি, তারপর রবার্ট ব্লেক সিরিজ সারা করলাম, তারপরে দীনেন্দ্রকুমার রায় থেকে হেমেন্দ্রকুমার রায়ে চলে এলাম, বিমল কুমারদের সব কীতিকাহিনী পড়ার পর ব্যোমকেশে পড়লাম এসে। শেষটায়। এমন কি, তোমার ওই নীহার গুপ্ত, গৌরাঙ্গপ্রসাদ বসুকেও বাদ দিইনি।

তাহলে তো তুই পাকা গোয়েন্দা হয়ে গেছিস, মানতে হয় আমায়।

তাহলে এইবার আমায় লাগিয়ে দাও একজায়গায়। প্রিসিলা বলেঃ তোমার তো বিস্তর জায়গায় জানাশোনা…

কোথায় যে গোয়েন্দা লাগায় তাই আমি জানিনে, আমি কী লাগাব! আমি বলিঃ বিলেতে বড় বড় স্টোর হাউসে মেয়ে গোয়েন্দা রাখে বলে শুনেছি। সেখানে অনেক মেয়ে খদ্দের সেজে এসে দোকানের মালপত্র সরায়, তাদের ধরার জন্যে তারা গোয়েন্দা রাখে। কিন্তু এখানে তেমনটা রাখে কিনা তা তো আমার জানা নেই ভাই!

এখানকার বড় বড় স্টোরে কি চুরি যায় না জিনিস? গোয়েন্দা লাগায় না তারা?

কী করে বলব। তুই এক কাজ কর বরং, তুই নিজের থেকেই লেগে যা না কেন? কলকাতারনামকরা কোনোবড় স্টোর বেহেনিয়েছদ্মবেশে গিয়ে নিজের থেকেইখদ্দেরদের গতিবিধির ওপর নজর রাখতে থাক। তারপর হাতে নাতে কাউকে ধরতে পারলে বামাল সমেত ম্যানেজারের কাছে নিয়ে ছেড়ে দিবি। তখন নিশ্চয়ই তিনি খুশি হয়ে তোকে মোটা রকম পুরস্কার দেবেন। চাই কি, পুরস্কার স্বরূপ, মাস মাইনেয় গোয়েন্দাগিরির কাজটাও পাকাপাকি পেয়ে যেতে পারিস ওখানেই।

এ কথাটা মন্দ বলোনি তুমি। বলল প্রিসিলা। তোমার মাথায় বেশ আইডিয়া খ্যালে মেজমামা। সত্যি।

বলেই সে বেরিয়ে পড়ল—আইডিয়াটাকে আরো ভালো রকম খেলাবার জন্যেই বোধ করি।

কিন্তু আইডিয়াকে যেমন খেলানো যায় তেমনি আইডিয়ারও নিজের একটা খেলা থাকে—সেও আবার নিজের আইডিয়ামাফিক তার খেলোয়াডকে খেলায় কিনা।

সন্ধ্যেবেলায় প্রায় অদ্ভুত লোচনেই ফিরে এল প্রিসিলা।

প্রিসিলার আইডিয়া ছিল, কলকাতার নামজাদা বড় স্টোরগুলোর কোন একটায় সে খদ্দেরের ছদ্মবেশে প্রবেশ করবে। আমি অবশ্যি বলেছিলাম যে, খদ্দেরকে কোনো ছদ্মবেশ নিতে হয় না, খদ্দেরের বেশে গেলেই হয়।

তা জানি। তাহলেও আমি যে সত্যিকারের খদ্দের, কোনো গোয়েন্দা টোয়েন্দা নই সেটা জানাবার জন্যই কেনা-কাটার প্রয়োজন বোঝাতে বড় একটা ব্যাগ সঙ্গে নিয়েছিলাম। আসলে আমি গিয়েছি তো যত সন্দেহজনক চরিত্রের প্রতি তীক্ষ্ণ লক্ষ্য রাখতেই, তাহলেও তাদের সন্দেহ যেন ঘুণাক্ষরেও আমার ওপরে না পড়ে সেই জন্যেই, বুঝলে কিনা মেজমামা? সব লোকের ওপরেই লক্ষ্য রাখব, তাদের গতিবিধিতে নজর থাকবে আমার, আর যেমনি না তাদের কাউকে কোনো জিনিস অলক্ষ্যে সরাতে দেখেছি অমনি গিয়ে হাতে নাতে পাকড়েছি তাকে—আর তার পরেই তাকে সোজা নিয়ে স্টোরের ম্যানেজারের কাছে গিয়ে হাজির করে দেওয়া—এই তো আমার কাজ? তাই না?…

কলেজে দুটো ক্লাসের পরে বাকী দুই পিরিয়ডের প্রক্‌সির ব্যবস্থা করে প্রায় দুটো নাগাদ তো ঢুকলাম গিয়ে সেই স্টোরে। প্রথমেই স্টোরের সব কটি বিভাগ পুঙ্খানুপুঙ্খ খুঁটিয়ে দেখলাম। কোথাও ছোটদের পোষাক-আশাক, কোথাও শিশুদের খেলনা-সামগ্রী, কোনোখানে বড়দের শার্ট প্যান্ট ইত্যাদি, কোনখানে স্টেশনারি, কোথাও আবার মেয়েদের প্রসাধনদ্রব্য। বিভাগগুলো সব ঘুরে ঘুরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেই দুঘণ্টা কেটে গেল, কিন্তু সন্দেহজনক চরিত্রের একজনকেও চোখে পড়ল না আমার। সবাই আসছে, জিনিস দেখছে কিনহে, দাম ফেলে দিচ্ছে, ফ্যাশমেমো আর প্যাকেট নিয়ে চলে যাচ্ছে অলক্ষ্যে রাবার মতলব দেখা গেল না কারোই। দুঘণ্টা ধরে এইসব দেখেশুনে আমার উৎসাহ প্রায় নিবে যাবার মতন, এমন সময় একটা আঁদরেল গোহের মহিলাকে দেখতে পেলাম—আমার চেয়েও বড়ো এক ব্যাগ হাতে–সর্বত্র হাতড়ে বেড়াচ্ছেন।

ব্যাগ হাতে মেয়েটিকে দেখবার পরই ই বেশ ব্যগ্র হয়ে উঠলি বোথ হয়? আমি শুধাই।

নিশ্চয়। এত বড়ো ব্যাগ নিয়ে কেউ কি টুকিটাকি জিনিস কিনতে বেয়োয় নাকি কখনো? মোটা রকম মাল সরাবারতালেইরয়েছে মেয়েটা বুঝতে পারলাম একনজরেই। এতক্ষণে বলতে কি, একটুখানি আশার সঞ্চার হলো আমার।

মেয়েটা করছিল কি, প্রত্যেক কাউন্টারে গিয়ে সাজানো জিনিসগুলো নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল, দেখেশুনে আবার রেখে দিতে লাগল যথাস্থানে একটা জিনিসও নিজের ব্যাগের মধ্যে পাচার করতে দেখালাম না তাকে। তাহলেও আমি তাকে তাকে রইলাম। ফাঁকতালে সরাবার মতলবে রয়েছে বেশ দামী গোহের কিছু একটা ওর হাতের নাগালে এলেই সরিয়ে ফেলবে—টের পেলাম বেশ। সেই কারণেই নানান জিনিস এইভাবে পরীক্ষা করে দেখবার ওর হন।

সেও যেখান থেকে যেখানে যাচ্ছে, আমিও একটু দূর থেকে ওর অগোচরে পিছু পিছু রয়েছি ওর। দেখি না কোথায় যায় কী সরায় কোন জিনিস হাত সাফাই করে।

দেখা যাক ওর বাছবিচার শেষ পর্যন্ত। আমার কড়া নজর এড়াবার সাধ্য নেই ওর। এতক্ষণে একটা খাঁটি মেয়ে বদমাইস আমার হাতের মুঠোয় এসেছে বাবা! কিছুতেই ওর রেহাই নেই আজ আর।

মেয়েদের শাড়ি ব্লাউজের ডিপার্টমেন্ট থেকে বাচ্চাদের পোশাকের ডিপার্টমেন্টে গেল মেয়েটি। আমিও চলেছি ওর পিছু পিছু। ও যেমন একটা জিনিস তুলে নিয়ে দ্যাখে আমিও আরেকটা তুলে দেখিও যে-ধারে যায় আমিও সেইধারে।

যেতে যেতে যে-ধারটায় সারি সারি সব ওয়াটারপ্রুফ ঝুলছিল তার ভেতরে গিয়ে মেয়েটা যেন হারিয়ে গেল হঠাৎ। এতক্ষণে আমি ওর বিরূদ্ধে একটা প্রফ পেলাম।….

ওয়াটারপ্রুফ?

অপরাধীরাই তো গাঢাকা দিয়ে থাকে সাধারণতঃ। তাই না, মেজমামা? ও যদি তুক না হবে তো চোখের উপর থেকে উপে যাবে কেন এমন করে?

তা বটে। সায় দিতে হয় আমায়।

ওয়াটারপ্রফগুলো যেন ওকে গিলে ফেলল মনে হলো আমার। ওর ভেতরে কী রহস্য আছে পরীক্ষা করার জন্য ঝোলানো বর্ষাতিগুলো নেড়ে চেড়ে দেখতে গেছি আমি, এমন সময়ে আমার পেছন থেকে কে যেন চেঁচিয়ে উঠল—হ্যান্ডস্ আপ।

পেছন ফিরে দেখি ওমা! সেই মেয়েটাই!

আর তার পিস্তলের নল আমার দিকে বাগাননা।

এর মানে? আমি তাকে জিজ্ঞেস করি। হাত ফাত না তুলেই।

মানে এক্ষুনি তুমি বুতে পারবে কি! তোমাকে ম্যানেজারের কামরায় নিয়ে যাই আগে। বলল সে। টের পাবে তখন। বলে বেশ শক্ত করে আমায় পাকড়ে ধরে ম্যানেজারের সামনে নিয়ে গিয়ে সে খাড়া করল। এমন খারাপ লাগতে লাগলো আমার বেকী বলবো তোমায়!

এটা আপনাদের কীরকম তা মশাই? বললাম আমি ম্যানেজারকে এই মেয়েটা কোখেকে হঠাৎ মাটি খুঁড়ে উঠে এমন করে আমায় পাকড়ে আনল যে এখানে? এর মানে আমি জানতে চাই। আমায় থামিয়ে দিয়ে ম্যানেজার সেই মেয়েটির দিকে চোখ তুলে তাকালেন। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে।

আমায় দেখিয়ে সে বললে—এই মেয়েটাকে আমি প্রায় আড়াইটার সময় আমাদের স্টোরে ঢুকতে দেখেছি। কোনো কিছু কেনাকাটার নাম নেইকো, এঘরে ওঘরে ঘুরঘুর করছে খালি! তখন থেকেই আমার সন্দেহ হয়েছে, লুকিয়ে লুকিয়ে লক্ষ্য রেখেছি ওর ওপর। তারপর ও করেছে কী শুনুন!…।

কিছু করিনি আমি। প্রতিবাদ করতে হলো আমায়-আমিই বরং ওই মেয়েটার ওপর নজর রেখেছিলাম। কী করে ও, দেখছিলাম তাই। আপনার স্টোর থেকে মালপত্তর সরাবার মতলব ছিল ওর। আসলে ও হচ্ছে একটা আস্ত বদমায়েস। মেয়ে বদমায়েস।

বদমাস নয়, ডিটেকটিভ। বাধা দিয়ে জানালো ম্যনেজারঃ আমাদের স্টোরের তরফ থেকে নিযুক্ত। খদ্দেরদের কেউ কোনো জিনিসপত্র না সরায় সেদিকে লক্ষ্য রাখাই ওর কাজ।

ম্যানেজারের কথায় তখন তার আসল পরিচয় পেয়ে আমি আকাশ থেকে পড়লাম। আমায় থানায় নিয়ে জমা দেওয়া উচিত কি না সেই বিষয়ে ওদের মধ্যে আলোচনা চলল তখন।

থানায়! শোনা মাত্রই আমি চমকে উঠেছি। গোয়েন্দা যে থানায় সোপর হতে পারে তা আমার ধারণা ছিল না।

ম্যানেজার আমার পরিচয় জানতে হলে আমি তোমার নাম বললাম তখন।

শিব্রামের তুমি ভাগনি! সেকথা বলতে হয়!

তোমার নাম শুনে আমার পরিচয় জানবার পর থানায় না দিয়ে ছেড়ে দিল সে আমায়।

বলিস কী? নিজের নামডাকের গৌরবে আমি একটু গর্ব বোধ করি, বলতে কি!

শিব্রামের ভাগনি তুমি? ভারী আশ্চর্য তো! বলে সে হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে মইল খানিকক্ষণ।

মুগ্ধ দৃষ্টিতে?

মোটেই মুগ্ধ দৃষ্টি নয় মামা! বরং বেশ বিরূপ নেত্রেই তাকালো বলতে পারো। সবিস্ময়ে সে বলতে লাগল বার বার আশ্চর্য, ভারী আশ্চর্ম তো!

কেন, আশ্চর্যটা কিসের? আমার ভাগনি কি কেউ হতে পারে না নাকি? কতো কালো কালো ভূতদের আহামরি আহামরি ভাগনি হয়ে থাকে। তাতে অবাক হবার কী আছে! শুনে আমি নিজেই আশ্চর্য হই।

সেই শিব্রাম? আমার কথা শুনে যেন তাজ্জব হয়ে গেল সে—সেই চারশো বিশ? তুমি তার ভাগনি? সেই ফোরটোয়েটি শিবরামের ভাগনি তুমি? ভারি আশ্চর্য তো?

কিন্তু, এটা আবার কেমনতরো কথা যেন? এর মানে? প্রিসিলার খবরে আমিও যে একটু হতবাক হইনে তা নয়।

আমিও তো সেই কথাই শুধিয়েছিলাম, ম্যানেজারকে। তাতে তিনি বললেন-হেলেরাই তো মামার মতন হয়ে থাকে এই জানি। নরাণাং মাতুলক্রম, বলে থাকে কথায়। কিন্তু ভাগনিরাও যে মামার চরিত্রের ভাগ পায়, তাই নিয়ে জন্মায়, তা আমি এই প্রথম দেখলাম।

আমার মামাকে আপনি চারশো বিশ বলছেন যে, এ আপনার কেমনধারা কথা? আমি খাস্তা হয়ে উঠেছি তখন।

আমার কোন কথা নয়, এটা পেনালকোডের ধারা। বলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন আমায়—তোমার নাম কী শুনি?

আমি বললাম–প্রিসিলা বোস।

তোমার কোনো ভাই-টাই আছে আর?

আছে এক ভাই। টিক্‌লু তার নাম। টিক্‌লু মিত্তির।

মিত্তির? তুমি বোস আর সে মিত্তির কেন গো? তোমার তো বিয়ে হয়নি যদুর দেখছি। আমার কপালের ওপর কটাক্ষপাত করে তার বলা।

মাস্তুতো ভাই যে।

ওহো! তাইতো হবে। তোমাদের যে মাস্তুতো ভাই-ই হয়ে থাকে। তাই বটে—তাই হবে তো….তাহলে শোনো, তোমাদের নামটা আমি একটু পালটে দিচ্ছি, বুঝলে? তুমি হলে মিস্ টুটেন বোস, আর সে হলো গে মাস্টার টুটেন মিত্তির। টুটেন বোস আর টুটেন মিত্তির–এখন থেকে, কেমন?

টুটেন বোস আর টুটেন মিত্তির! তার মানে? কথাটার আমি মর্মভেদ করতে পারি নাযদিও কথাটা কেমন যেন মর্মভেদী বলেই আমার বোধ হতে থাকে।

তুমি ধরতে পারছনা মেজমামা? প্রিসিলা বলে—আমি তো বলবমাত্রই বুঝেছিলাম। তুমি অঙ্কে বেজায় কাঁচা মামা।

অঙ্কের সঙ্গে এর সম্পর্ক?

আহা, আমরা তোমার ভাগনে ভাগনি না? তোমার চরিত্রের ভাগ আমরা পেয়েছি তো? আর তোমাকে, মানে, ফোরটোয়েনটিকে দু-ভাগ করলে কী হয়? টু টেন টু টেন হয় না?

কথাটায় তাক লাগলেও অবাক হবার কিছু নেই, সত্যি! আমার গুণপনার ভাগাভাগি করলে তাই দাঁড়ায় বটে, আমি ভেবে দেখি। ফের ওদের দুজনের যোগবলে আমাকেই পাওয়া যায় বার বার।

টুটা ফুটা এই আমাকেই।

 পৃথিবী গোল

পৃথিবী যে গোল তার পরিচয় পেলাম সেদিন।

আর গ্লোব-এর মত মানুষের মাথাও যে গোলাকার কিছু কম নয়, তার ভেতরেও গোলের কিছু কমতি নেই তাও আমি টের পেলাম সেই সঙ্গে।

অনেককাল পরে আমার বাল্যবন্ধু তারাপদর এক চিঠি এল হঠাৎ—তাতে লেখা—

জীবন-পরিক্রমার পথে ঘুরতে ঘুরতে তোমার ‘অদ্বিতীয় পুরস্কার’ গল্পগ্রন্থের সঙ্গে ধাক্কা লাগল। তাতে আমাদের ইস্কুলে পড়ার সময়কার সেই ভূত এখার গল্পটা লিখেছ দেখলাম। আমাদের সবার নাম-ধাম দিয়ে লিখেছ। তোমার সঙ্গে আমি-হেন লোকের আবাল্য পবিচয়টা আমার নিজ এবং পাড়াতুতো নাতি-নাতনীরা বিশ্বাসই করে না। তোমার ঐ গল্পটাতে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করায় তোমার ঐ সব ক্ষুদে ভক্তরা আমার সঙ্গে তোমার পরিচয়ের সুযোগে সশরীরে স্কুল শরীরে তোমার দর্শনের ভীষণ অভিলাষী।

জানি না এখনও মুক্ত-আরামে তুমি মুক্তারামে বিরাজ করছ কিনা। তোমার জবাব পেলে আমার এই নাতিবৃহৎ পরিবার নিয়ে তোমার ওখানে গিয়ে হাজির হব একদিন

চিঠির মাথায় ডায়মন্ড হারবার রোডের ওপরেই কাছাকাছি একটা জায়গার ঠিকানা।

চিঠিটা পড়ে আমার মনে হলো, আমি কখন কলকাতায়, কখন পাটনায়, কখন বা ঘাটশিলায় তার যখন কোন ঠিক-ঠিকানা নেই, তখন সপরিবার শ্রীতারাপদকে বিড়ম্বিত না করে বরং তার ঠিকানায় গিয়ে হানা দেওয়াটাই ঠিক হবে।

তাছাড়া, করবরতিরা কজু হয়, কে না জানে! অবশ্যি, চকরবরতিদের ভেতর যাঁরা রাজতুল্য সেই রাজচক্রবর্তীরা কেমন হয়ে থাকেন জানি না, তাঁদের কথা নিশ্চয়ই আলাদা। তাঁদের হৃদয় আর পকেট দুই-ই হয়তো বেশ দরাজ হবে। তবে আমি খোদ আমাকে তো জানি, খোদার ওপর খোদকারি-করা আমার আত্মানং বিদ্ধি হয়ে গেছে, তাই এই বাজারে নিজেকে বেশি করে আর বিদ্ধ করতে চাই না। ভেবে দেখলাম সেই নাতিবৃহৎ পরিবারের আতিথ্য করতে আমায় যতখানি আরাম থেকে বিমুক্ত হতে হবে, তার চেয়ে আগে-ভাগে আমিই যদি তাদের ঠিকানায় যাই তাহলে তাদের ঘরে এবং ঘাড়ে গোটাকতক সন্দেশ বসিয়ে আসতে পারি। তাতেই আমার লাভ বরং, অন্ততঃ কোনই লোকসান নেই।

চলে গেলাম পুতুলদের বাড়ি। বললাম, চ, তোদের গাড়ি করে ডায়মন্ড হারবার থেকে একটু ঘুবে আসবি চল। শহরতলীর শোভা দেখে আসা যাবে।

শহরের বাইরে যাবে তুমি? বল কি গো? পুতুল যেন হতবাক, তুমি না প্রকৃতির ওপর হাড়ে-হাড়ে চটা, প্রাকৃতিক সোন্দর্য একদম নাকি তোমার সথ হয় না? তোমার এমন বিমতি হলো যে হঠাৎ?

প্রকৃতির প্রতি হাড়ে চটা—আমি? কে বললে? সে হলো গে অচলা প্রকৃতি। যে প্রকৃতি নড়ে-চড়ে না, এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে ঠায়, যেমন গাছ-পালা পাহাড় -পর্বত ইত্যাদি পদার্থ জাতীয় এই সব। যাদের রূপ একটুখানি দেখলেই ফুরিয়ে যায়। কিন্তু প্রকৃতির লীলা কি সেইখানেই শেষ নাকি? সচলা প্রকৃতি নেই? তাদের প্রতি তো ভাই আমার অচলা ভক্তি। কবির প্রতিভার ন্যায় মুহূর্তে মুহূর্তে যার রূপের নব নবোন্মেষ সেই সব অপদার্থ প্রকৃতির প্রতি আমার টান তুই কখনো কিছু কম দেখেছিস?

কিন্তু অ্যাতো জায়গা থাকতে হঠাৎ ডায়মন্ড হারবার কেন দাদা? ইতু শুধোয়, কলকাতার আর কোনদিকে কি কোন শহরতলী নেইকো?

আমার এক বাল্যবন্ধুর খবর পেয়েছি। তার বাড়ি যাব। চিঠিখানা দেখালাম তাদের।

বাল্যবন্ধুর কাছে কেউ আবার যায় নাকি কখনো? ইতু দ্বিরুক্তি করে।

সে বন্ধুত্ব তো বাল্যকালেই খতম হয়ে যায়।

তার মানে?

তোমার বাল্যবন্ধুর কাছে যাবার আমাদের উৎসাহ হয় না। সে ব্যক্ত করে, সে তো তোমার বয়সীই হবে প্রায়। তার কাছে গিয়ে আমাদের লাভ?

আরে, যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দ্যাখো তাই, পেলেও পাইতে পার লুকনো রতন। কে বলেছিল একথা? আমি জানতে চাই।

আমি বলিনি।পুতুল বলে। আমি কাউকে এমনধারা কথা বলতে শুনিনি কখনো। ইতু জানায়।

কী করে শুনবি! তোদের কালে তো পাঠ্যবই পাল্টে গেছে। ইস্কুলে কি পদ্যপাঠ পড়ায় আর—জানবি কী করে! আমরা পড়েছি ইস্কুলে। কার ও কি মদনমোহন তকালকার এদের কেউ একজন বলে থাকরেন। বিদ্যাসাগর মশাইও হতে পারেন।

নিজের বিদ্যার বহর শহর করি।

তোমার মার খবরে আমাদের কাজ নেই। ইতুর সাফ জবাব। -সাগরের খবরও চইনে।

তখন বাধ্য হয়ে আমি গুপ্তকথার সহজ ব্যাখ্যায় চলে আসি—মানে হচ্ছে কি, বিধাতা এই দুনিয়ায় ধানে-চালে মিশিয়ে দিয়েছেন। তোমাকে একটু কষ্ট করে সেটা বেছে নিতে হবে কেবল। তুই সেখানে একটা আধবুড়ো লোক আছে বলে ঘাবড়াচ্ছিস, ভাবছিস যে গিয়ে কী লাভ হবে। কিন্তু তার পেছনে এই নাতিবৃহৎ পরিবারটি রয়েছে, বৃহৎ বৃহৎ নাতিও রয়ে গেছে নিশ্চয়—সেদিকটা তো নজরে পড়ছে না তোদের।

বলে দৃষ্টান্তস্বরূপ আমি নিজেকেই উদাহরণ-স্থল করি, আগে তো আমি ছেলেদের গল্প লিখতাম কেবল। তাই ছেলেরাই গায়ে পড়ে মিশতে আসত আমার সঙ্গে। তাদের সতেই আলাপটা হতো প্রথম। তারপর ভাব জমলে তাদের বাড়ি গেলে মেয়েদের দেখা পেতাম না কি? যেমন বোনান্তরালে ভাইরা থাকে তেমনি ভাইরাস-এর পেছনে বোন। বিধাতার এই নিয়ম। ঘোড়া ডিঙিয়ে কি ঘাস খাওয়া যায় কখনন? এই তোদের বেলাই দ্যাখ না। প্রথমে তো তোদের দাদার সঙ্গেই ভাব হয়েছিল আমার। গোরাই আমায় ল্যাজে বেঁধে যোত গোড়ায়। তারপরে তো তোদের সঙ্গে মিশলাম। কিন্তু গোড়ায় তার সঙ্গে ভাব না হলে কি তোদের আর পাত্তা পেতাম কোনদিন! তারপরে যখন তোদের সঙ্গে ভাব হলো, তারপর থেকে তোদের সঙ্গেই ঘুরছি তো! গোরাকে নিয়ে কি সিনেমায় রেস্তরাঁয় যাচ্ছি আর? আর, গোরাই কি আমার সঙ্গে ঘুরছে আরো? সে তো এখন সবিতার সঙ্গে…

হয়েছে, হয়েছে। বুঝতে পেরেছি। তোমায় আর ব্যাখ্যান করতে হবে না।

 

ইতু আর পুতুলকে নিয়ে ওদের গাড়ি করে ডায়মণ্ড হারবার পাড়ি দেওয়া হলো।

অকুস্থলে পৌঁছে দেখা গেল, সেখানে এক চায়ের দোকান—নটবর কেবিন…রাস্তার ঠিক ওপরেই—চাতকদের অপেক্ষায়।

চৌরাস্তার মাথার ওপর দোকানটা—কোনদিকে যাই এখন?

ওই চা-ওয়ালাকে জিজ্ঞেস করে জেনে নাও না কেন? বাতলালো ইতু। এখানকার হদিশ ও-ই তো ভাল দিতে পারবে।

তা বটে। চায়ের দোকানে সবাইকে আসতে হয়। ওখানেই সব খবর, সবাব খবর মেলে।

নামলাম গাড়ির থেকে। শুধালাম গিয়ে দোকানীকে।

অশীতিপর এক ভদ্রলোক।

ঠিক সময়ে এসেছিলাম, ভাগ্যিস। এই শীতের পর আর ওঁর দেখা মিলত কিনা সন্দেহ।

কার ঠিকানা চান? ঘাড় নাড়তে নাড়তে তিনি বললেন।

তারাপদবাবু! এইখানেই কোথাও থাকেন। আমি জানালাম।

ও? তারাপদবাবু! বলে বৃদ্ধটি যেন কেমন গুম হয়ে গেলেন। আর কোন কথাটি নেই তাঁর।

তুমি আর লোক পেলে না—এই বুড়োর কাছে জানতে গেলে। ইতু ফিসফিস করে, একটা বাচ্চাটাচ্চা কারো কাছে জানতে হয় বরং!

বাচ্চারা কি বয়স্ক লোকের খোজ রাখে নাকি? ধার ধারে বয়সীদের? উনি সাবেক লোক, উনি বলতে পারবেন বরং। বলে আমি ভদ্রলোককে উসকে দিলাম আবার : প্রভাত-কুটিরটা এখানে কোথায় বলতে পারেন?

প্রভাত-কুটির, ও! বলে তিনি গম্ভীর হয়ে গেলেন আবার।—ও! সেই প্রভাত-কুটির।

হ্যাঁ, তার হদিশটা বাতলাতে পারেন আমাদের?

কার হদিশ?

প্রভাত-কুটির। তারাপদবাবুরা থাকেন যেখানে।

অ! তারা নতুন এসেছেন বুঝি?

না, না। গত যুদ্ধের সময় থেকেই আছেন মনে হয়।

গত যুদ্ধের সময় থেকে?

হ্যাঁ, তাই হবে। সায় দিই আমি।

তাহলে ঠিক হয়েছে। গত যুদ্ধের সময় থেকে। আবার তিনি ঘাড় নাডেন, হ্যাঁ, তারাপদবাবুই বটেন। আমরা এখনো তাদের সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানি না। তবে ওই নাম বটে।

তাঁরা এখন কোথায় আছেন সেইটে জানতে চাইছি।

আমি বলি। প্রভাত-কুটিরেই আছেন বটে। বেশিদিনের নয় বাড়িটা। হালেরই বলতে হয়। সন তেরোশো তিন সালে তৈরি। বাড়ির মাথাতেই খোদাই করা আছে তারিখটা। প্রভাত-কুটির। সেইখানেই তারা থাকেন।

বলে তিনি পিছন ফিরতেই আমরা তাকে ফিরে ডাকলাম, আজ্ঞে, দয়া করে তার বাড়ির পাত্তাটা যদি জানাতেন আমাদের।… প্রভাত-কুটির যেতে হলে…

প্রভাত-কুটিরে যেতে চান? তিনি ফিরে দাঁড়ালেন ফের : এই পাশের বাস্তাটা ধরে চলে যান সোজা। ইমদাদ আলির বাড়িটা পেরুলেই…

তা, সেই আলি সাহেবের বাড়িটা কোন্ জায়গায়? বাধা দিয়ে জিজ্ঞেস করতে হলো আবার।

আলিসাহেব? ও, ইমদাদ আলি!.. বলে বৃদ্ধলোকটি এক দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেনতিনি অব সেখানে থাকেন না। তার সঙ্গে যদি দেখা করতে এসে থাকেন তো মিছে বববাদ করলেন সময়টা। দুবছর হবে তিনি কবরখানায়। তাকে পেতে হলে আরো ঢেব আগে আসতে হতো।

তখন আমাদের বলতে হলো যে, না, আমরা ইমদাদ আলিকে চাইনে, কবরখানায় যাবারও ইচ্ছা নেই আমাদের, প্রভাত-কুটিরেই যেতে চাই আমরা।

ও! …তা, যদি প্রভাত-কুটিরেই যেতে চান তো এই পথ ধরে সোজা চলে যান, খানিকটা গিয়ে বাঁ দিকে ঘুরবেন—তারপর আবার খানিকটা গিয়ে ফের আবার বাঁ দিকে—সেই মোড়ের ওপরের বাড়িটাই হচ্ছে যেখানে ইমদাদ মিঞা থাকতেন। বললাম তো আমি।

মোড়ের ওপরেই? আমি আওড়ালাম। তারপর বাঁ দিকে টার নিতে হবে?

হ্যাঁ, যেখানে সেই সাইনবোর্ডটা ছিল। তিনি জানালেন তার থেকে আর খানিকটা গেলেই…না, ভুল হবার কিছু নেই।

সেই সাইনবোর্ড-বরাবর যাব বলছেন?

সেই সাইনবোর্ড কি আর সেখানে আছে মশাই? সেই আশ্বিনের ঝড়ে উড়ে গেছে কোকালে।

যাকগে, সেই স্বৰ্গত সাইনবোর্ডের পাশ দিয়ে খানিকটা গেলে তারপর?…

ডান দিকে লিচুগাছটা রেখে ফের আবার বাঁ দিকে ঘুরতে হবে।

লিচু গাছটা ডান দিকে পড়বে তো? জেনে আমার উৎসাহ হয়। লিচুগাছ চিনতে ভুল হবে না আমার কিছুতেই কত ওদের ডালে ডালে ঘুরেছি লিচু ফলার ঋতুতে। পেয়ারাগাছ না হয়েও সে আমার পেয়ারের গাছ। বছরের এ সময়টায় গাছটা একটু মাফলেষু হলেও পুরনো পরিচয় বিস্মৃত হবার নয়। চিনতে পারব ঠিক।

পড়ত, গাছটা সেখানে থাকত যদি। বলে তিনি আবার দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন—সেটাও সেই ঝড়ে পড়ে গেছে কিনা। তারপর কারা এসে তার ডাল-পালা কেটে-কুটে নিয়ে চলে গেছে কবে যেন। চিহ্নমাত্রও নেই এখন।

লিচুগাছটাও নেই! শুনে দীর্ঘনিশ্বাস পড়ল আমাণও।

না। তবে গাছের গুঁড়িটা আছে। পাশ দিয়ে যেতে নজরে পড়বে। ভুল হবার যে নেই।

বেশ। তারপর সেখান থেকে বাঁ ধারে বাঁক নেব আবার?

গোড়াগুড়ি সোজা বলেই মনে হচ্ছে পথটা—এই গোড়ার থেকে ওই গুঁড়ি পর্যন্ত অন্ততঃ।

বাঁ ধারেই বেঁকেছে রাস্তাটা। তারপর সেখান থেকে সোজা চলে যাবেন সেই শহীদ-স্তম্ভ অব্দি। পাড়ার ছেলেরা কোথাথেকে একটু উঁচু পাথর নিয়ে এসে খাড়া করেছিল সেখানে। বিয়াল্লিশের শহীদদের স্মৃতিচিহ্ন।

উঁচু পাথরের শহীদ-স্তম্ভ? আমি ঘাড় নাড়ি-না, এবার আর ভুল হবার কিছু নেই।

সেই শহীদ-স্তম্ভটাই কি আছে নাকি আর? লরির ধাক্কায় কাত হয়ে পড়েছিল কবে। ও-পাড়ার বনমালী মুদি সেটাকে তুলে নিয়ে গিয়ে তার মুদিখানার পৈঠা বানিয়েছে।

শহীদ-স্তম্ভের কথায় ইতু যাও বা একটু উৎফুল্ল হয়েছিল, বনমালীর কাণ্ডে মুদিত হয়ে গেল তৎক্ষণাৎ। প্রস্তরীভূত শহীদদের পরিণামে—পাদপীঠে এই পরিণতিতে আমিও স্তম্ভিত।—সেই পাথরটাও নেই আর!

না। তবে সেই জায়গাটা আছে। নেবার জো আছে কি না জানি না, তবে সেইখানটা হেড়ে বাঁ ধারে একটু গেলেই আপনার সেই প্রভাত-কুটির। সোজা রাস্তা, ভুল হবার কিছু নেই।

সোজা বলে তো বাতলালেন নটবরবাবু। কিন্তু যাওয়া মোটেই সোজা না, এমনি করে মোড় ঘুরে ঘুরে—এইভাবে বাঁ পারে চর নিতে নিতে যাওয়া কোনো চক্করবরতির পক্ষেও সহজ নয়। যাই হোক, দুরপাক খেতে খেতে এগুলাম।

ভালো লোক পাকড়েছিলে দাদা। বলল পুতুল।

লোকটার বয়সের গাছ-পাথর নেই! মুখ ব্যাঁকাল ইতু। বাব্‌বাঃ!

মিনিট পাঁচেক বাদে একটা মোড়ে এসে পৌঁছলাম, মনে হলো সেই বাড়িটার সামনেই এসে পড়েছি, আলিসাদ্যে যে বাড়িতে মরেছেন, তারপর সেখান থেকে বাঁ মোড় ধরে খানিক এগুতেই সেই যেখানে সেই সাইনবোর্ডটা হিল সে জায়গাটা পেলাম মনে হয়, তার খানিক বাদে বিয়াল্লিশের শহীদরা যেখানে দ্বিতীয়বার শহীদ হয়েছিলেন সেখানটাও পেরিয়ে গেল বোধ করি, ইতিমধ্যে কোনো ফাঁকে অন্তহিত সেই লিচুগাছটাও ছাড়িয়েছি সভবতঃ; তারপর আরেক চকরের পর সোজা এসে পড়লাম বড় রাস্তায় আবার। ডায়ম হারবার রোডে। সেই নটবর কেবিনের সামনেই সটান।

আমাদের দেখে নটবরবাবু নড়বড় করে এগুচ্ছেন দেখা গেল।

কিন্তু আমরা আর গাড়ি থামালাম না। নটবরকে নট করে দিয়ে কলকাতার পাড়ি ধরলাম সোজা।

প্রায়োপবেশন

যথাযথ বললে, প্রায়োপবেশনই বলতে হয়, সবদিক বিবেচনা করে।

সুতারকিন স্ট্রিটের কাজটা সেরে চিত্তরঞ্জন অ্যাভির কফি-হাউসের মোড়টায় এসে খাড়া হয়েছি, থ্রি-বি বাস ধরে নিউ আলিপুর পাড়ায় আমার বোন পুতুলের বাড়ি যাব বলে—কিন্তু বাস ধরাই তো দায়। একটার পর একটা থ্রি-বি আসতে লাগল ঠাসবোঝাই হয়ে—আর পাশ কাটিয়ে চলে যেতে লাগল ফ্রিলি-পা বাড়াবার সাহসই হলো না। আধঘণ্টা ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে-টু-বি আবার নট টু-বি—এই দোনামোনার মধ্যেই। শেষটায় মরিয়া হয়ে ঠিক করলাম এরপর যে থ্রি-বি-ই আসুক, যতই না ভিড় থাক—উঠে পড়ব লাফ দিয়ে যে করেই হোক, না হয় প্রাণ হাতে করে ঝুলতে ঝুলতেই যাব নেহাত।

এলো একটা থ্রি-বি, তেমনিতরই ভর্তি, তবুও কোনগতিকে হ্যাণ্ডেল ধরে উঠে পড়লাম।

একতলা থ্রি-বি-গুলোর দুমুখো দরজা। মাথার দিকের মেয়েলি তরফের হাতলটা ধরে উঠতে যাচ্ছি, ল্যাজার দিকের দরজার মুখে যে মুষ্টিমেয় ব্যক্তি ঝুলছিলেন তাদের একজনা কাতর স্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন—উঠবেন না, মশাই! উঠবেন না দোহাই।

ল্যাজার দিকে লোকটার কথায় ব্যাজার হতে হলো আমায় কেন মশাই, আমি তো এদিক দিয়ে উঠছি, আপনার তাতে কী হলো?

বলে ঠেলেঠুলে কোনোরকমে তো সেঁধিয়ে গেলাম ভেতরে। ঢুকতে না ঢুকতেই আওয়াজ পেলাম, ধপাস্! মুখ বাড়িয়ে দেখি অন্য দিকের দরজার সেই ঝুলন্ত লোকটি রাস্তার উপরে চিৎপাত হয়ে পড়েছেন। আমার দিকে কড়ানজরে তাকিয়ে ধরাশায়ী ভদ্রলোকটি বললেন—বারণ করলাম শুনলেন না, দেখলেন তো এখন কী হল!

সেই ঠাসবোঝাই বাসের এধার থেকে আমার ঠেলাতেই যে ওধার থেকে উনি বসে পড়েছেন সেটা বুঝতে আমি বেগ পাই না, কিন্তু তখন উদ্বেগ বোধ করার অবসর কই? ওঁর দিকে দেখব কি, এদিকে বাসের ভেতরেই আরেক দুর্ঘটনা! আমার এই অনুপ্রবেশের জন্যেই কিনা কে জানে, মেয়েদের গা ঘেঁষে যে ভদ্রলোক টায় টায় দাঁড়িয়ে ছিলেন ঠায়, তিনিও ধপাস্ করে ভদ্রমহিলার কোলের ওপরে বসে পড়েছেন।

সঙ্গে সঙ্গেই জিভ কেটে তার উঠে পড়ার অবশ্যি দেরি হয়নি, কিন্তু ক্ষমা চাইবার আগেই মেয়েটি তাকে আশ্বস্ত করে বসবার অনুরোধ জানিয়েছে। না, তার কোলে নয়, পাশেই-এবং নিজেও একটুখানি ধার ঘেঁষে সরে বসেছেন তিনি।

ভেবেছিলাম উনিও রোষকষায়িত নেত্রে আমার প্রতি তাকিয়ে অভিযোগের কটাক্ষ হানবেন, কিন্তু না, বরং তিনি কৃতার্থের মতই একটু জড়সড় হয়ে বসলেন দেখলাম। এবং মনে হলো একটু সকৃতজ্ঞের মতই যেন চাইলেন আমার পানে।

কিন্তু খাপ্‌পা হয়ে উঠলেন আরেক ভদ্রলোক।

ইতর, অভদ্র, ছোটলোক কোথাকার! গর্জে উঠলেন তিনি।

আজ্ঞে, মাপ করবেন, আমার ঘাট হয়েছে। আমি বলতে যাই—কিছুটা কৈফিয়তের সুরেই বোধহয়।

না, আপনাকে না, বলছি ঐ লোকটাকেই। কেমনধারা মানুষ দেখুন তো! বলা নেই কওয়া নেই, ঝুপ করে একটা মেয়ের কোলে বসে পড়লো হঠাৎ! কী ঘঘারতর লোক…অপদার্থ।

ওঁর আর দোষ কী? টাল সামলাতে না পেরে… ভদ্রলোকের পক্ষ-সমর্থনে এগোই আমি–যার ভেতরে আমার নিজের সাফাইটাও উহ্য রয়েছিল।

টাল সামলাবার কী আছেটা মশাই? বাসের মধ্যে আবার টাল-বেটাল কী। মাথার ওপর রড ছিল না ওর? দু-হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে থাকতে কী হয়েছিল? তিনি বলতে থাকেন—অমনি বসে পড়লেই হলো এক ভদ্রমহিলার কোলে?

সবার কব্জির জোর কি সমান? এবার আমার হাত সাফাই।  ত পিছলে মাথার রড ফসকেও তো যায় এক এক সময়।

রাখুন আপনি। নামি না আমি একবার। নামুক না লোকটা বাস থেকে, তারপর দেখিয়ে দেব লোকটাকে। মেয়েদের কোলে বসার মজাটা টের পাইয়ে দেব হাতে হাতে। কব্জির জোর কাকে বলে জানিয়ে দেব এক ঘুষিতে।

যার উদ্দেশে এত বাক্যবাণ, এমন তম্বি, তিনি কিন্তু স্থানুর ন্যায় নিথর নীরব। নিরাসক্ত। আমিও আর মাঝে পডে কথা না-বানিয়ে চুপ করে যাই।

ইস্টুপিট–রাস্‌কেল–রটন… আরো উগ্র হয়ে ওঠেন উনি তখন।

হটেনটট্‌…হনলুলু…হিপাপটেমাস! উগরে যান তার গরল একধার থেকে।

ওঁর আগেই তুমি এখানে বসলে কেন? বললেন এবার ভদ্রমহিলাটি : তাহলে তো উনি আর… তার বেশি তিনি এখোন না, কথাটা উহ্য রেখে দেন। মানে, তাহলে তো উনি ওঁর কোলে বসার সুযোগ না পেয়ে ঐ ভদ্রলোকের কোলেই বসতেন। এমনধারা কাণ্ড বাধতো না।

বসব কেন আমি? তুমি বললেই আমি বসব? মেয়েদের সীট না? মেয়েদের সীটে বসতে যাব কেন? একটি মেয়ে এলেই তো উঠে পড়তে হবে তক্ষুনি। কিন্তু আমি বসিনি বলেই ওঁর এমন কি এক্তিয়ার…পাজি, নচ্ছার, হতচ্ছাড়া! শূয়োর ভণ্ড! শুশুক কোথাকার!

উপবিষ্ট ব্যক্তিটি চুপ করে থাকেন। শুশুক শুনেও, (গালটা বলা বাহুল্য তেমন সুখকর নয়। তাঁর মুখভাবের কোনো বৈলক্ষণ্য দেখা যায় না। কিন্তু মেয়েটির গলায় প্রতিবাদের সুর অর্ধোচ্চারিত হয়-আহা, কেন মিথ্যে ভদ্রলোককে…

ভদ্রলোক! গর্জে ওঠেন ইনি : ভদ্রলোকের পোশাক গায়ে থাকলেই ভদ্রলোক হয় না। পরীর কোলে বসাটা কী রকমের ভদ্রতা? শুনি তো একবার?

এ-কথার কোনো জবাব না থাকলেও প্রশ্নটা আমাকেও যেন পীড়িত করে। পরস্ত্রীর কোলে বসা ভদ্র-অভদ্র কারো পক্ষেই উচিত নয় নিঃসন্দেহে, কিন্তু সত্যি করে বলতে, ভদ্রলোক বসতে আর পেলেন কোথায়? বসতে না বসতেই তো…খতিয়ে দেখলে তার লাভের দিকটায় zero। কোলে বসে জিরোবারও ফুরসত পাননি একটু। বসতে না বসতেই উঠে পড়তে হয়েছে। এটাকে প্রায়োপবেশনই বলা যায় ববং।

মেয়েদের সীটের গায়ে গা ঘেঁষে দাঁড়ানোর মানেটা কি কেউ বোঝে না নাকি? তাক খোঁজা হচ্ছিল, কখন টালটা আসে। ফাঁক পেতেই ধূপ করে বসে পড়া হয়েছে অমনি।

উনি নিরুত্তর। ইনি কিন্তু এর আগে যে রেটে এগুচ্ছিলেন, মনে হচ্ছিল, তাঁর স্ল্যাংলাপে শীগগিরই শ’কার বকারে গড়িয়ে আসবেন, কিন্তু কর্ণমর্দনের (নাকি, কর্নওয়ালিসের?) সেই দশশালা বন্দোবস্তে না গিয়ে, বোধহয় ভাষায় কুলিয়ে উঠতে না পেরেই, বাক্যের শালীনতায় ফিরে এসেছেন বাধ্য হয়ে। তবু ভালো যে, ভদ্রলোককে মার্জনা করতে না পারলেও তিনি নিজে অন্ততঃ ভদ্রভাষায় মার্জিত হয়েছেন।

মেয়েছেলের কোলে বসতে খুব আরাম লাগে, তাই না? আবার তার কামান-গর্জন হলেও, তার কথার শোনায় এবার যেন একটু সোহাগা মেশানো মনে হয়।

কথাটা শুনে আমার কেমন খটকা লাগে। বটু করে একটা কথা মনে পড়ে যায়… বসার কোল ঘেঁষাই কথাটা।

মেয়েদের কোলে বসাটা কেমন আরামের জানিনে, তবে মেয়েদের কোলে বসানোর আরামটা আমার জানা আছে বটে। হাড়ে হাড়েই জানা।

মারাত্মক আরাম। প্রায় কুরুক্ষেত্র কাণ্ডই বলা যায়। দ্বৈপায়ন হ্রদের ধারেই ঠিক যে-রকমটি ঘটেছিলনাকি একবার।

কুপার স্ট্রিট থেকে ম্যাটিনি শো-এর সিনেমা দেখতে যাব বলে বেরিয়েছি—আমার বোন ইতু, আমি আর পুতুল।

কুপারের থেকে দুপা এগিয়েই আমি কাহিল—না বাপু, এই দুপুর রোদে ঢ্যাং ট্যাং কবে অদূর আমি যেতে পারব না। হাঁটতে আমি পারিনে। হাঁটুর অত জোর নেইকো আমার।

এই কাছেই তো পূর্ণ সিনেমা! কর আর? ইতুচন্দর বলেন : এতে হাঁটুর আর খাটুনি কী! এইটুকুন তুমি হাঁটতে পারো না শিব্রামদা?

তুই হলি পাহাড়ে মেয়ে। তোর সঙ্গে হেঁটে আমি পারি? তোর পায়ের হাড় কতো শক্ত। তোর পায়ের কজি দ্যাখ, আর আমার পায়ের। তোর সঙ্গে পাঞ্জাতেই আমি পারব না, আর, হাঁটনের পাল্লায় পারব। এখান থেকে রস রোড অব্দি হাঁটতে হলেই আমার হয়েছে। না বাপু, তোমরা একটা রিকসা ডাকো বরং।

রিকসা এলো, কিন্তু পুতুল প্রশ্ন তুললো—রিকসায় কি তিন জন ধরবে?

একজন কারো কোলে বসুক নাহয়? বলে দিলাম আমি।

কে বসবে শুনি? পুতুলের পুনরপি প্রশ্ন থাকে।

আমার তো কোলে বসার কথাই ওঠে না। তোদের দুজনের কেউ কারো কোলে বসুক তাহলে।

না দাদা, আমি ইতুর কোলে বসে যাব না, আমি ওর দিদি না?

তাহালে ও-ই তোর কোলে বসে যাক। দেখা গেল, ইতুর তাতে কোন আপত্তি নেই, কিন্তু পুতুলের আপত্তি ঘোরতর—বাবা! ও যা ভারী! ওকে আমি কোলে বসাতে কিছুতেই রাজি নই। ইতুকে কোলে করে অদূর যেতে হলেই আমার ইতি।

তারপর? তারপর সেই পুরনো ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। পৌরাণিক পালার পুনরভিনয়। সেই কুরুক্ষেত্র কাণ্ড!

আমার কোলে বসারই কথা উঠল তখন। অম্লানবদনে ইতুই বসল আমার কোলে।

কোনো ষোড়শী তরুণীকে নিজের কোলে পেলে নেহাত মন্দ হয় না, মোহের বশে ঘুণাক্ষরে কখনো হয়তো নিজ্ঞানে করে থাকব, কিন্তু সেই স্বপ্ন চুরমার হয়ে যেতে বেশি দেরি হলো না আমারা। ল্যান্সডাউন মার্কেটও পেরুইনি, আমি চিৎকার করে উঠেছি- এই রিকসাওলা! রোকো রোকো। রোকে। …একদম রোকে এই নাম, নামনাম তোরা সব।

নামবার পর রিকসাওলার প্রণামী গুনি–এই লেও তুহারা ভাড়া। যাও, ভাণো। ভাগো হিয়াসে। এই মহল্লাসে ভাগ যাও। আমি হল্লা করে উঠি–আউর কভি ইধর নেহী আনা।

হলো কী তোমার? পুতুল শুধোয় : হলোটা কী?

আর হলোটা কী! পায়ের হাড়গোড় সব গুঁড়ো হয়ে গেল আমার–বাবা! ইতু যে একটা আস্ত পাহাড় তা কে জানত।

তখনই বলেছিলাম না আমি? শুনলে না তো। সে বলে।

আমি কি বসতে চেয়েছিলুম তোমার কোলে? প্রতিবাদ করে ইতু: তুমিই আমার কোলে বসতে পারতে, ইচ্ছে করলে।

বা রে! ও দিদি হয়ে বসল না, আর আমি দাদা হয়ে বসতে যাব? মায়ের পেটের না হলেও, আমি তোদের দাদা না? আমার একটা আত্মসম্মান নেই?

তাহলে আমি আর কী করব?

কী সুখে যে মেয়েদের কোলে নিতে চায় লোকে! আমি বিরক্তি প্রকাশ করি।

আমি তো চাইনি। ও যা ভারী, জানি তো। পুতুল জানায় : ওকে কেন, কোনে। মেয়েকেই আমার কোলে নিতে চাই না আমি কক্ষনো।

তা সত্যি, মেয়েরা কখনো তা চায় না বটে। মেয়ে হয়ে তারা মেয়েদের মর্ম বোঝে না, সেই জন্যেই কিনা–নাকি, মর্মে মর্মে সেটা বোঝে বলেই,—তার মর্মোদ্ঘাটন করা আমার কম্মো না; তবে দেখেছি যে হাল্কা গোছের শিশুদেরই কোলে কাঁখে এমন কী গর্ভে ধারণ করতেও তারা গর্ববোধ করে, কিন্তু ভুলেও কক্ষনো কোনো মেয়েবে নিজের কুক্ষিগত করতে যায় না। চায়ও না। স্বভাবতই তারা বুদ্ধিমান।

কিন্তু হনুমানরা চায়। এমনকি, দারুণ দুরাকাঙক্ষায় তারা হনুমানকেও টেক্কা মাবতে যায়। এই যেমন আমি। স্বয়ং মহাবীর শুধু গন্ধমাদনই ঘাড়ে করেছিলেন, কাঞ্চনজঙ্ঘাকে কোলে করতে যাননি। কিন্তু হনুমত্তায় (নাকি, হনুমত্ততায়?) তাঁকেও ছাড়িয়ে গিয়েছি আমি।

তুই না চাইতে পারিস। জবাব দিই পুতুলকে। কিন্তু অনেকে চেয়ে থাকে।

কেউ চায় না। বাড়ি বাড়ি মেয়েকে কেউ কোলে নেয় নাকি? না, নিতে চায় আবার?

ছেলেরা চায়। …দুর্যোধন চেয়েছিল।

দুর্যোধন?

চায়নি দুর্যোধন? যার জন্যে অমন কুরুক্ষেত্র কাণ্ডটা বাধলো? দ্রৌপদীকে নিজের কোলে বসাতে চেয়েছিল বলেই না!

পুতুল চুপ করে যায়। পুরাতত্ত্বের গর্ভে হাবুডুবু খেতে চায় না হয়তো বা।

আহা, তখন যদি শ্ৰীমতী যাজ্ঞসেনী তার কোলে চেপে বসতেন গিয়ে! তখনই তো উরুভঙ্গ হয়ে যেত বেচারার। তাহলে আর অত কাণ্ড করে অত কাঠখড় পুড়িয়ে ভগ্নউক কুরুপতি করার জন্য ঐরকম কুরুক্ষেত্র বাধাতে হতো না।

কোলে বসালেই এই! আর, কোলে বসলে যে কী হয় তা তো চোখের সামনেই দেখছি—এই বাসেই। আর, তাও কিছু কম কুরুক্ষেত্র নয়।

..ছোটলোক!…আহাম্মোক!…যৎপোনাস্তি!…তখনো ভদ্রলোক গঞ্জনা দিযে চলেছেন সমানে। আর, উদ্দিষ্ট ব্যক্তিটি তখনো তেমনি নির্বিকার নীরব। বিলকুল স্পীক-টি-নট!

কিন্তু আমি আর প্রতিবাদ না-করে পারি না। বলি—যৎপরোনাস্তি কি একটা গাল নাকি মশাই? আপনি যে যা মুখে আসছে তাই বলে যাচ্ছেন!

যার-পর-নাই হয়ে যাবার পর পার্শ্বোপবিষ্ট ভদ্রলোকের বুঝি আর সহ্য হয় না। তিনি উঠে দাঁড়ান–

আমি নামব এবার। বলে মেয়েটিকে তিনি নমস্কার জানিয়ে ভদ্রলোকের দিকে একখানা কার্ড বাড়িয়ে দেন—

এই নিন আমার নাম-ঠিকানা। যাবেন একদিন আমার বাড়ি। আমার বৌয়ের কোলে বসে আসবেন ঘণ্টাখানেক।

চলে যাবার আগে বলে যান তিনি।

বন্ধুর মতন নেই আর!

বান্ধবীরা নিতুই নব। নিত্য নবীন। দর্শনে অদর্শনে নব নবরূপে দেখা দিয়ে থাকেন, আমি জানি।

কিন্তু বন্ধুরা চিরকালীন। তাদের রূপ গুণের বিশেষ হেরফের হয় না বোধহয় কোনো দিনই। এইতো জানতাম।

তাদের সেই চিরকেলে একঘেয়ে চেহারা আর ব্যবহারের কোন দিন ভোল পালটে কখনো যে তারা অভিনব রূপ ধরতে পারে এ ধারণা আমার ছিল না। সেই বদ্ধমূল ধারণা আমার বদলে গেল অকস্মাৎ। চিরঞ্জিতের কাছে চিরদিনের মতই হার হলো সেদিন আমার…আর আমার ধারণার।

বন্ধুর মতন হয় না সত্যিই!

প্রেসিডেন্সি হাসপাতালে পীড়িত এক আত্মীয়াকে দেখে রেসকোর্সের ধার ঘেঁষে পাশ কাটাচ্ছিলাম, ময়দানের সড়কে উঠে এসপ্ল্যানেডের ট্রাম বাস বার মতলবে। ইতিমধ্যে ঘোড়-দৌড়ের খেল খতম হয়ে মাঠের ভিড় ভেঙে রাস্তায় নেমে এসেছে।

ভিড়ের ভেতর চিরঞ্জিত। দেখতে পেয়ে আমার উপর এসে যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ল। এধারে যে? এমন অসময়ে? শুধায় সে।

সুখ লি কার্নানি থেকে ফিরছিলাম। আমি জানালাম।

সুখলাল থেকে? কেন হে? খাসা তো আছে। খাসীর মতই প্রায়। দেখে তো মনে হয় না তোমার কোনো অসুখ বিসুখ আছে। মনে হয় যে তোমার সুখের অবধি নেই…

অবধি নেই? আমি প্রতিবাদ করি—উচ্চরক্ত চাপে চাপিত। সর্বপ্রকার চাপল্য নিষেধ আমার—তা জানো?

আরে ব্লাডপ্রেসার কি আবার একটা অসুখ নাকি? চালু থাকলে কোনো ভয় নেই—বিলকুল নিরাপদ। চলতে ফিরতে পারলেই নিশ্চিন্তি। কিন্তু পড়লে কি মরলে।

তার মানে?

সেই যাত্রাপালার নায়কের মতই প্রায়। পতন আর মৃত্যু সঙ্গে সঙ্গে। বলে চিরঞ্জিত : তবে স্ট্রোক হলেই পড়ে, না, পড়লেই স্ট্রোকটা হয় তা আমি সঠিক বলতে পারব না।

ওর কথায়, নৈয়ায়িকদের সেই তাল পড়িয়া টিপ করে, না টিপ করিয়া তাল পড়ে–কথাটা মনে পড়ল আমার।

হার্টফেল করলেই মরণ হয়, না, মরণদশা হলেই হার্টফেল করে অনেকটা সেই রকম আরকি। ওর কথায় আমার সায়।

ঠিক তাই। আর পড়লেই তোমার হার্ট ফেল হবে। নাও যদি হয় তা, পক্ষাঘাত তো নির্ঘাত। কেউ আটকাতে পারবে না। সে জানায়। তোমার পক্ষে হাঁটা চলাই নিরাপদ। তাহলেও খুব সাবধানে চলাফেরা করবে, ভিড়ের ভেতরে কদাপি যেয়ো না, কারো গায়ে ধাক্কা লেগে পড়ে যাও যদি তো সেটাই হবে তোমার নিরানব্বইয়ের ধাক্কা।

ভিড়ের মধ্যেই তো এসে পড়েছি এখন। একটা ট্যাসি ডাকো তাহলে… আমি বাতলাই।

এই বাজারে ট্যাকসি মেলে নাকি? সে অবাক হয়ে যায় আমার কথায়। আর, অ্যাতো খদ্দেরের ভিড়ে?

তাহলে ট্রাম বাস ধরা যাক, এসো। কিরকম বাদুড় ঝোলা হয়ে যাচ্ছে মানুষ দেখছ? ঐভাবে যেতে যেতে যদি পদস্খলন হয় তো আর রক্ষে আছে তোমার? নিজের দুশ্চরিত্রও খোয়াবে…নিজেও খোয়া যাবে সেই সঙ্গে। নিজেই হারিয়ে যাবে এই দুনিয়ার থেকে… সবার সঙ্গেই সঙ্গেই খসলে।

দরকার নেই। হাঁটাইযাক তাহলে, কিন্তু খিদে পেয়েছিল বেজায়।আমি বলি-হাঁটলে পরে আবার আমার খিদে বেড়ে যায় আরো।

চলো, কাছেই একটা রেস্তরাঁ আছে। পুলটার কাছাকাছি। সেখানে গিয়ে পেট ঠেসে খাওয়া যাবে দুজনে। সে আশ্বাস দেয়।

খিদিরপুরের ব্রিজ দিয়েই তো এসপ্ল্যানেডের ট্রাম যায়, ট্রাম তখন তুমি ফাঁকাই পাবে—খাওয়া দাওয়ার পর। যতো ভিড় এই এখানটাতেই…এখন এই রেস ভাঙবার মুখটায়। সে প্রায় আমার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়—দ্যাখো না, আপ ডাউন দুদিকের গাড়িতেই লোক উঠেছে এখন। ভিড়ে ভিড়াকার।

সত্যিই তাই। অগত্যা সেই রেসকোর্সের থেকে হাঁটতে হাঁটতে উঠলাম গিয়ে রেস্তরাঁয়। দুজনার ছোট্ট একটি টেবিল দখল করে চিরঞ্জিত খাদ্যতালিকাটা এগিয়ে দিলো আমার দিকে—নাও, ঢালাও হুকুম করো। যা খেতে চাও…যা খেতে তোমার প্রাণ চায়।

মাঠের থেকে মোটামুটি বেশ কিছু মেরেছে নিশ্চয় মনে হয়। পকেটে রেস্ত না থাকলে ওর মতন কঞ্জুষ কখনো রেস্তারাঁয় আসে না, তথাকথিত কোনো বন্ধুকে নিয়ে অন্ততঃ। প্রাণ ভরে খাওয়াতে চায় না অপরকে।

সুপ-এর থেকে কফি পর্যন্ত একগাদা ফরমাশ দিয়ে বসলাম পরম্পরায়।

রেসে আজ বেশ লাভ করেছে বোঝা যাচ্ছে। কটা বাজি মারলে শুনি? জিজ্ঞেস করি।

একটাই। একটা ঘোড়ার ওপরই যথাসর্বস্ব ধরে দিয়েছিলাম। মানে, পকেটে যা কিছু ছিল আমার। বলল সে। তবে বাজি জেতার কথা যদি বলল এমন জিত আর হয় না।

ক লেংথে জিতল তোমার ঘোড়া?

লেংথে কিহে? ফারলং বলো। দেড় ফার্লং এগিয়ে ছিল সবার থেকে…

বলো কি হে! সে কি সম্ভব? আমি অবাক হয়ে যাই। রেসের দিন ঘোড়াদের ডোপ দিয়ে থাকে জানো কি? কাকে ডোপ দেওয়া বলে তা জানো?

শুনেছি যেন কথাটা। মাছের টোপ ফেলার মতই কিছু একটা হবে বোধহয়? আরে না, ট্রেনাররা পালা করে নিজেদের স্টেবলের ঘোড়াদের জেতায় সব। এক এক দিনে কয়েকজনের জিতবার পালা। নিজেদের মধ্যে গোপনে সেটা ঠিক করে যেদিন যে ঘোড়াটাকে জেতাবে তাকে ডোপ দেয়। তার পরে সবাই মিলে সেই ঘোড়াটার ওপর মোটা টাকার বাজি ধরে। তাতে আর সব ঘোড়ার হার হলেও মাঠসুদ্ধ রেসুড়েরা সবাই মার খেলেও ট্রেনারদের, জকিদের আর জানাশোনার ভেতরের লোকদের লাভ হয় খুব। যেটার ওপর বাজি ধরেছিলাম তাকে আজ ডোপ দেবার কথা ছিল। একেই বলে ঘোড়ার মুখের খবর—খবরটা আমি পেয়েছিলাম।

ঘোড়াটা বুঝি বলেছিল তোমায়? আমি আরো অবাক হয়ে যাই: ঘোড়াটার সঙ্গে খুব ভাব ছিল বুঝি তোমার?

আরে, ঘোড়া বলবে কেন হে? ঘোড়ার মুখ দেখলেই তো বোঝা যায়। রেসের দিন সকালে যারা ঘোড়াদের স্মার্ট দেখতে ময়দানে যায় তাদের ভেতর যারা সমঝদার তারা ঘোড়াদের মুখ চোখ চাল চলন হাব ভাব দেখেই টের পায় কোনটার আজ জেতার পালা, কাকে সেদিন ডোপ দেওয়া হয়েছে।

বটে বটে?

ডোপ মানে, কী একটা উত্তেজক ইনজেকশন, ঘোড়াকে সকালে দিয়ে দেয়। তাতে দৌড়বার সময় তার খুব তাগদ হয়, খুব এনার্জি দেখা যায়। একেবারে অস্বাভাবিক রকমের। তাতে হয় কি, যে ঘোড়ার আগের দুটো বাজিতে হার হয়েছে পর পর, মানে জেতানো হয়নি যেটাকে, অবশ্যই মতলবমাফিক, সেই ঘোড়াটাই ডোপ নেবার দিন তিন লেংথে সবাইকে হারিয়ে বাজি মেরে দেয়—তার ফলে সব কিছু আপসেট হয়ে যায়। একেই বলে রেসের আপসেট। আগের হেরো ঘোড়র ওপর সেদিন তো কেউ বড়ো আর বাজি ধরে না—তাই। বহুত লোকের হার হলেও খবর পেয়ে যারা বাজি ধরেছিল মোটা টাকার টোট জেতে তারা তাদের বেলায় বাজিমাৎ!

আর ডিগবাজি-মাত বাকী সবার?

তা বলতে পারো। তবে আমারটা যে কী হলো তা আমি ঠিক বলতে পারব না, বাজিও বলা যায়। আবার ডিগবাজিও বলা যায়।

খাবার মুখে গল্প চলছিল আমাদের। বেয়ারা বিল রেখে গেল টেবিলে—খানার দাম ঊনত্রিশ টাকায় উঠেছে। উতুক গে, বিল মেটাবার দায় তো আমার নয় আর।

তার মানে? আমি শুধাই। তোমার ঘোড়াটা তিন লেংথে, না কি, তিন ফালংয়ে জিতেছে এইমাত্র বললে যে! তাহলে?

বলেছি ঠিকই। তিন ফার্সংয়ের এক ইঞ্চি কম নয়। বরং কিঞ্চিৎ বেশিই হতে পারে। কিন্তু হলে কী হবে, ওটাকে ঠিক বাজি জেতা হয়তো বলা যায় না…

মোটামুটি মেরেছ বেশ আজ। নইলে তুমি আমার মত রাক্ষসকে নিয়ে আজ এই রেস্তরাঁয় এসেছ! ওর কথায় আমি হাসি।

হয়েছে কী, বলি তোমায়। খেলাটা খতম্ হয়ে যাবার পরই খবরটা পেলাম ঐ মাঠেই একটু আগে। ঘোড়ার মুখের খবর নয় এবার, আমার মতই এক গাধার মুখ থেকে পেয়েছি খবরটা। সে-হতভাগাও বাজি ধরেছিল ঐ ঘোড়ার ওপরেই—ডোপের খবর পেয়েই বোধহয়।

কী বললো সে ভেঁপোনা-ডোলো লোকটা? বলল যে, ঘোড়ার ডাক্তার আজ সকালে ডোপ দিয়েছিল ঠিকই, কি ভুল করে…ব্যাটা নিজেই নেশা করেছিল কিনা কে জানে! ..ভুল করে করেছে কী, ঘোড়াটাকে ইনজেকসন না দিয়ে ঐ ইনজেকসনটা দিয়ে বসেছে তার জকিকে। ফলে মাঠে নেমে ঘোড়াটা তেমন দৌড়চ্ছে না দেখে জকি…ডোপের মাথায় ছিল তো সে…ঘোড়াটাকে টেনে নিয়ে না নিজেই দৌড়তে শুরু করে দিয়েছে। লাগাম ধরে ঘোড়াটাকে টেনে নিয়ে এসেছে সে…রেকর্ড টাইমে…আর সব ঘোড়ার থেকে তিন লেংথে নয়, তিরিশ লেংথ আগে। কিন্তু তাকে তো আর ঘোড়ার জিত বলা যায় না।

নিশ্চিত না। তার কথায় সায় দিতে গিয়ে আমার ভিত কাঁপিয়ে দিয়ে পেল্লায় এক বের উঠল।

নাঃ, এতটা খাওয়া ভালো হয়নি ভাই! হাইব্লাডপ্রেসারে এত বেশি খাওয়ার ধকল সইবে না হয়তো। ভেজিটেবল চপটা অবশ্যি কিছু নয়, আমার পক্ষে নিরাপদ, ফ্রি-ফ্রায়েও কিছু যায় আসে না। কিন্তু মোগলাই পরোটা, মাটন চপ, চিকেনকাটলেট, অগির দোপেঁয়াজি, ভকয়োসট এত সব খাওয়া—রক্ত চাপের ওপর এতখানি খাদ্য চাপানো আমার ঠিক হয়নি। ডাক্তার বলেছে আমায় খাওয়ার খুব ধরাকাট করতে…।

ধরাকাট করতে? ডাক্তার বলেছে? তা তুমি তো টেবিলের কাঠ ধরেই খাচ্ছ হে? তোমার ভাষায় বলতে গেলে—এই তো যথেষ্ট খাওয়ার ধরাকাঠ।

এত খেয়ে এই বর্ধমান রক্তচাপের ওপর মাথা ঘুরে যদি রাস্তায় পড়ে যাই তাহলেই আমার কাল না, আমি কাটোয়া, মানে কাটলাম। পড়লাম কি মরলাম—তুমিই বলছে। না মরলেও পক্ষাঘাত তো নির্ঘাত!

সেকথা ঠিক। বলে আমার কথায় সায় দিয়ে সে বিলের দিকে তাকায়—তিরিশ টাকার বিল উঠেছে। যাঁহা উনত্রিশ তাঁহা ত্রিশ। এক টাকা তো টিপস-ই দিতে হবে বয়টাকে।

তাতো হবেই। আমিও টেবিলের দিকে তাকাই—তুমি নিশ্চয় বলছ না যে, হজ হুজ হিজ হিজ? যার যার তার তার। আমার ভাগেরটা আমাকে দিতে বলছ না নিশ্চয়? তাই বলছ নাকি? আমার কাছে কিন্তু আমার বাড়ি ফেরার ট্রাম ভাড়াটাই আছে কেবল।

আমার আবার তাও নেইকো। সে সখেদে জানায়। তবে আমার বাড়ি তো কাছেই। এটুকু আমি হেঁটেই মেরে দিতে পারব।

তুমি তো হেঁটে মারবে! কিন্তু টাকা না পেলে কি এরা রক্ষে রাখবে? আমাকেই পাকড়াবে। আমিই যে খাবারের সব কুম দিয়েছি আবার। এরা আমায় মারতে মারতে হাঁটাবে তাহলে।

তারপর বয় এসে আমার কাছে বিলের টাকা চাইতেই আমি তাকে পকেট উটে দেখিয়ে দিলাম—আমার কাছে এই সিকিটা শুধু আছে ভাই! আমার বাড়ি ফেরার ট্রাম ভাড়াটাই। তার বেশি আর কিছু নেই আমার।।

শুনে বয়টা আমাকে কিছু না বলে সেখান থেকেই এক হাঁক ছাড়ল। এক হারে

সমস্ত ব্যাপারটা বিশদ করে জানিয়ে দিল সে কাউন্টারে বসা রেস্তরাঁর মালিককে।

মালিক সেখান থেকে হাঁকলেন, দাঁড়া। যেতে দিসনি লোকটাকে। আমি গিয়ে উচিত শিক্ষা দিচ্ছি ওকে।

আস্তিন গুটিয়ে আমার সামনে এসে হাজির হলো সে-সিকি? সি কি বলছেন মশাই? বিরাশি সিকির ওপর সাঁটিয়ে সিকি দিচ্ছেন এখন? দাঁড়ান। উচিত শিক্ষা দেব আপনাকে। এই হাতের বিরাশি সিক্কার একখানা খেলেই ঠিকমত শিক্ষা হবে আপনার। আর কোনো রেস্তরাঁয় এভাবে সিকি পকেটে নিয়ে খেতে আসবেন না। অন্ততঃ, আমার এ রেস্তরাঁতে তো নয় আর।।

বলেই সে আমার জামার কলার ধরে টেনে তুলল। তবে আমার বীরোচিত চেহারা দেখে বোধ করি পাছে প্রাণে মারা পড়ি, সেই আশংকায় বিরাশির মাপের একখানা

দিয়ে উনিশ বিশ আন্দাজের চড়-চাপড়ের চোটে ঠেলে নিয়ে গেল আমায় দরজার দিকটায়। এক চোটে ঠিক না হলেও মোটের ওপর ওর মারগুলো সব টোট্যাল করলে বিরাশিকে ছাড়িয়ে যায় নি। এইভাবে অনেকগুলো সিকি ছাড়বার গব রেস্তর্বার দোর গোড়ায় এসে সে একখানা আধুলি ঝাড়ল। তার সেই অর্ধচন্দ্রের ধাক্কায় আমি রাস্তায় গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম।

আপনার বিলের টাকা তো আপনি উশুল করে নিলেন বাবু! বেশ করে হাতের সুখ মিটিয়ে। বলল তখন বয়টা, কিন্তু আমার বসিসের কী হবে? আমার টিপস্টা?

তোমার টিপ তুমি আদায় করে নাও বাপু। ঢালাও হুকুম মালিকের।

আমি গায়ের ধুলো ঝেড়ে সোজা হয়ে না দাঁড়াতেই আমাকে টিপসই করার মতলবে সে ঘুষি পাকিয়ে আমার সামনে এসে খাড়া হলো। বসিসের বদলে তার বকসিংয়ের চোট থেকে নিজের দাঁত চোখ নাক বাঁচাতে আমি পৃষ্ঠপ্রদর্শন করলাম। বাধ্য হয়ে সে তখন পৃষ্ঠদেশেই…আমার অপর পৃষ্ঠায় তার স্বহস্তের স্বাক্ষর রাখল। তার সেই অটোগ্রাফের দাপটে আমি সাত হাত এগিয়ে গেলাম সটান।

ধরে নিয়ে আয় লোকটাকে।কুম করলেন মালিক আমি এক্ষুনি ও-সিকে ফোন করে দিই—পাহারোলারা এসে পাকড়ে নিয়ে যাক থানায়। সেখানে দস্তুরমতম বোলাই হলে তবেই ওর থড়ে হাড়ে শিক্ষা হবে।

তার কোনো দরকার হবে নাচিরঞ্জিত আমাদের মাঝখানে এসে পড়ল এতক্ষণ বাদআমিই নিজের হাতে শিক্ষা দেব ওকে আজবাছাধন আর জীবনে এমন কম্মো করবে না। ভুলবে না আর জীবনে। নেমতন্ন করে নিয়ে এসে….ছি ছিএমন অপমানিত আমি কোনো দিন হইনি।

এবার সে স্বয়ং এসে আমায় এক গলাধাক্কা লাগাল। গলদেশে তার সেই তাড়নায় আমার তলদেশ পর্যন্ত আলোড়িত হয়ে উঠল—আমি চোহাত এগিয়ে গিয়ে রাস্তার উপর উপুড় হয়ে পড়লাম। সে এসে ধরে তুলল আমায়, তারপর বেশ করে ঘা-কতক কসিয়ে আবার আমার গলার ওপর এক চোট…আবার আমায় তুলে ধরল, ফের ঘা-কতক…আবার আরেকখানা…এমনি দ্রুত তালে তার হস্তক্ষেপ আর আমার পদক্ষেপে চালু হয়ে…উঠতে পড়তে…পড়তে উঠতে…উঠে পড়ে আমি এই পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর পন্থাটা (বন্ধুর পন্থাই বটে!) পার হয়ে ট্রাম রাস্তার ওপর এসে দাঁড়ালাম।

তখন সে ছাড়ান দিল আমায়।

হাঁপ ছেড়ে দম নিয়ে আমার বাক্যস্ফূর্তি হলো তখন। আমি বললামঃ চিরঞ্জিত! চিরদিনই তোমার জিৎ, আর তোমার কাছে আমার হার। কিন্তু তাই বলে তোমার হাতে এমন মার আমি খাব কোনোদিন আমার ধারণা ছিল না। তোমাকে আমি বন্ধু বলেই জানতাম এতদিন। কিন্তু বন্ধুর কাছে এই ব্যবহার… আমার কণ্ঠরোধ হয়ে আসে।

বন্ধুর কাজ করিনি আমি? বন্ধু আবার বলে কাকে? বলল রিঞ্জিত: কেন, খারাপটা কী করেছি? মারার ছলনা করে থানার ফঁড়া থেকে কাটিয়ে, কেটে বেরিয়ে এসেছি তোমায় নিয়ে…

মারার ছলনা?…ওদের মারে আমার তেমন ধারা লাগেনি। গায়ে লাগলেও প্রাণে লাগেনি আমার…কিন্তু তোমার এই ছলনার মার কোনোদিন আমি ভুলব না ভাই, হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি আমি…এখন ঠিক না পেলেও বাড়ি গিয়ে টের পাব ঠিকই, যদি বাড়ি গিয়ে পৌঁছতে পারি। গায়ের ব্যথায় কাল বিছানা ছেড়ে উঠতে পারব কিনা কে জানে!

তাহলেও তুমি আস্তই রয়েছে দাদা! হাড়গোড় কিছুই বরবাদ যায়নি—সবই তোমার অটুট রয়েছে এখনো। এই এলাকার দারোগা আননবাবুকে তো জানো না ভাই! থানায় নিয়ে গেলে আর সেখানে রামধোলাই খেলে তোমার রামত্ব লোপহয়ে শিবত্বলাভ ঘটত।… গুন্ডারা পর্যন্ত আননবাবুর ভয়ে কাঁপে। তা জানো?

আমার ভয় কিসের? আমি কি গুণ্ডা?

বড়ো বড়ো গুণ্ডাকেও থানায় নিয়ে গিয়ে কম্বলধোলাই দিয়ে হাড় গুঁড়িয়ে গুণ্ডি বানিয়ে ছাড়েন তিনি। কিন্তু সে তো পরে…এহ বাহ…তার আগে তাঁর অন্তঘোতি আছে। নিজস্ব পেটেন্ট পঞ্চগব্য খাইয়ে পেটের কথা টেনে বের করেন তিনি আসামীর। পঞ্চগব্য কাকে বলে জানো?

কেন জানবো না? দই, ঘি, দুধ, গোবর আর গোরোচনা—কে না জানে? তাই খেয়ে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়, জানে সবাই।

পঞ্চগব্যের ঐ প্রথম তিনটে বাদ, তার বিকল্পে ঘোড়ার নাদ, কুইনিন, ছাগলনাদি যদি পাওয়া যায়, সেইসঙ্গে কেরোসিন আর ফিনাইল—পছন্দসই ফ্লেভার দেবার জন্যেই। ওই তিনি মুখ হাঁ করিয়ে গাঁট্টার চোটে ঢক্‌ করে গিলিয়ে দেন, তখন আপনার থেকেই পেটের কথা সব বেরিয়ে আসে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় তোলাস সামনেই ধরা থাকে তো, তাই দেখেই না!

আমার পেটের কথা টেনে বের করার কী আছে? আমি জিজ্ঞেস করি।

নেই-ইত। কাজেই কোনো কথাই বেরুবে না। বাধ্য হয়েই তোমায় পাঁচ সাত গেলাস গিলতে হবে। কথা কিছু না বেরুলেই, একটু আগে বিনেপয়সায় ভালো মন্দ যা খেয়েছো তার সবটাই তোমার বেরিয়ে আসত নির্ঘাত। সেটা কি ভালো হতো? তারপর সেই অন্তধৌতির পর, আসল সেই ধোলাইয়ের এহ বাহ্য তো রয়েই গেল; তার চোটে নির্বিকল্প সমাধি না হলেও অর্ধবাহ দশা তো হতেই তোমার আলবাৎ। গন্ধে গোটা পাড়া মাত হয়ে যেত তখন। প্রায় সবার বেলাই সেটা হয়ে থাকে শুনেছি, তেমন ধারণা-শক্তি ততা নেই সবার! তখন তোমার সেই হতজ্ঞান গন্ধমাদন ঘাড়ে করে তোমায় বাড়ি পৌঁছে দিতে হতো আমায়। তার বদলে এই একটুখানি মারামারি-কী এমনটা বাড়াবাড়ি হয়েছে শুনি?

মারামারি? মারামারিটা হলো কখন? কথাটার আমি মৃদু আপত্তি না করে পারি না: মারাই তো হয়েছে শুধু, মারি-টা হলো কোথায়? তোমরাই আমায় ঠেঙালে, আমি কি তোমাদের গায় হাত তুলেছি নাকি?

এই কথা! আচ্ছা, আমি তোমার গায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি… বলে আবার সে আমার গলায় পিঠে হস্তক্ষেপ করে…এবার মন্দাক্রান্তা ছন্দে। তাতে আমার জ্বলে যায় আরো! আমি ছিটকে ওর নাগাল থেকে সরে যাই।

রাগ হয়েছে? আচ্ছা, তাহলে মানো তুমি আমায় ঘা কতক, বেশ করে কসে মারো, খুব জোর জোর লাগাও। তাহলে হবে তো? বলে সে আমার সামনে পিঠ পেতে। দেয়।

খুব হয়েছে। আর ন্যাকামো করতে হবে না। এতক্ষণ হয়নি, কিন্তু এবার আমার সত্যিই রাগ হলো——আমার না উচ্চ রক্তের চাপ? পড়ে গেলেই পক্ষাঘাত না নির্ঘাত? তুমি নিজেই তো বলেছে।

সঙ্গে সঙ্গে তারও মনে পড়ে যায় কথাটা——তাই নাকি? তাই তো হে! মনেই ছিল না আমার। আশ্চর্য, তোমার তো খাবি খাবার-কথা এতক্ষণ! কিন্তু কই, খাবি

তো খাওনি! কতবার তো পড়লে হে! পক্ষাঘাতও হয়নি তো দেখছি।

আহা! হলে যেন খুব খুশি হতে মনে হচ্ছে।

আশ্চর্য! এখনো তুমি আস্ত আছে, সটান খাড়া রয়েছে সামনে! নো পক্ষাঘাত, নষ্ট কিছু। এই শক ট্রিটমেন্ট করে ব্যায়ামটা তোমার সারিয়ে দিলাম বোধ হচ্ছে। আমার এক ঘুষিতে…এক না হোক একাধিকই হলো…থানার পক্ষপাত আর নিশ্চিত পক্ষাঘাত দুটোর থেকেই এক চোটে বাঁচিয়ে দিয়েছি তোমায়। তাতেও তুমি খুশি নও ভাই? এটা কি বধুর কাজ করিনি আমি, বললা? নহলে তুমি কী বলতে চাও?

আমি আর কিছু বলতে চাই না তারপর। চুপ চাপ পা চালাই।

বন্ধুর মতন হয় না! সত্যি।

 ব্রজবিহারীর ধনুর্ভঙ্গ

ব্রজবিহারীর ধনুর্ভঙ্গ পণ ছিল না মাধবীকে বিয়ে করার, ছিল সেটা ধনুর; তাই চিঠিটা পেয়ে একটু অবাক হয়েছিলাম বইকি।

বাড়ি-ঘর ছেড়ে এতকাল নিরুদ্দেশে থাকার পর ফিরে এসে অবশেষে মাধবীর মত একটা আধবুড়িকে তার বিয়ে করাটা আমার কাছে একটু অভূতপূর্ব বলেই মনে হয়।

ষাট বছর পেরিয়ে বিয়েব ছাঁদনাতলায় গিয়ে লটকানো কম বিস্ময়কর নয় তো।

অবাক তো হয়েছিলামই, আরো অবাক করে দিল সে নিজে এসে তার পরে।

চিঠির ল্যাজ ধরে ব্রজ হাজির হলো শেষে।

পাছে তুমি ভুল বোঝো ভাই, তাই চলে আসতে হলো আমায় এই সাত তাড়াতাড়ি… এসে বলল সে।

না, ভুলু বোঝাবুঝির কী আছে ভাই! এরকম তো হয়েই থাকে আকচার। আমি বলতে চাই, প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে, কে কোথায়…

প্রেম ফ্রেম নয় ভাই, সে বাধা দেয় আমার কথায়—চিঠিটায় আমি ব্রজ বলে আমার নামসই করেছি তো, সেই জন্যেই আসতে হলো আমায়। শতং বদ মা লিখ, শাস্ত্রে বলেছে। সে কথাটা ভুলে গেছলাম বেমালুম। তাই ওই স্বাক্ষরটা আমার ঠিক হয়নি। কিসের থেকে কী দাঁড়ায়, ফৌজদারি আদালত অবধিই বা গড়ায় কি না কে জানে। এই বয়সে কি জেলে যেতে হবে শেষটায়, তাই…

বিয়ে করাও তো একরকমের জেলে যাওয়া ভাই, আমি শুধাই তাই নয় কি?

জেল যে, তা এর মধ্যেই টের পেয়েছি বিলক্ষণ। কিন্তু তাহলেও আলিপুরের সশ্রমের চেয়ে তো ঢের ভাল। আরামপ্রদ কারাবাসই বলা যায় একরকম।

তা বলতে পারে বটে। কিন্তু আমি অবাক হচ্ছি এই ভেবে যে, মাধবীকে বিয়ে করার কথা ছিল ধনুর। তোমার তো নয়; কিন্তু তুমি যে…

ধনুই তো বিয়ে করেছে। এই দ্যাখো না। বলে সে একটা ছাপানো নিমন্ত্রণপত্র আমার হাতে দিল, তাতে শ্রীধনুর্ধর রায়ের সঙ্গে কুমারী মাধবী বসুর বিয়ের কথাই হাপার অক্ষরে লেখা রয়েছে বটে।

তাহলে ধনুই বিয়ে করছে, তুমি নও। তাই বল তাহলে। আমি হাঁপ ছাড়ি।

ধনু ওরফে আমি। আমিই শ্রীব্রজবিহারী বর্মণ।

হেঁয়ালি রাখো। খোলসা করে বল সব।

হেঁয়ালি নয়, সত্যি কথাই। তুমি বন্ধুজন, তোমার কাছে প্রকাশ করতে বাধা নেই। জানি, তুমি আবার তা পুনঃপ্রকাশ করে আমায় জেলে পাঠাবার ব্যবস্থা করবে না। তাই খোলসা করে সব তোমাকে বলার জন্যই এতখানি আমার ছুটে আসা।

তুমি ব্রজ না ধনু, কে তাহলে, ঠিক করে বল দেখি। সঠিক ঠাওর না পেয়ে আমি বলি—আমার নিজেরই কেমন খটকা লাগছে। তোমাদের দুজনের চেহারায় এমন আশ্চর্য মিল ছিল যে কে কোষ্টা আমরা ঠাউরে উঠতে পারতাম না। তুমি ধনু, না, ব্রজ?

আমি ব্ৰজই। বলে সে করুণ সুর ধরে : কিন্তু, আর তো ব্ৰজে যাব না ভাই, যেতে মন নাহি চায়। মা পেয়েছি বাবা পেয়েছি… ব্রজের খেলা ভুলে গেছি…না, মা আমার মারা গেছে সম্প্রতি। এখন থেকে আর আমি ব্রজ নই। অতঃপর, আমি শ্রীধনুর্ধর—এখন থেকে বরাবর।

বুঝতে পারছি না কী ব্যাপার।

সবটাই আমার কাছে যেন ধাধার মতই লাগে। সে বলতে থাকে।

ভাওয়ালের মেজকুমারের সেই কেসটা, ভাওয়াল সন্ন্যাসীর মামলা গো! তোমার মনে আছে নিশ্চয়? আমার ব্যাপারটাও প্রায় সেই রকমই বলতে গেলে। তবে ভাওয়ালের বেলায় সন্ন্যাসীর নিজের সাধু হবার ইচ্ছা ছিল। আর এক্ষেত্রে আমার অনিচ্ছাসত্ত্বেও, ব্যাপারটা আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া। এই যা তফাত।

আইন-বিরুদ্ধ কোন কাজ করার বাসনা কোনদিনই আমার ছিল না, এক্ষেত্রে তো নয়ই, কিন্তু পাকচক্রে কেমন করে কী যে ঘটে যায়! ভবিতব্যের লিখন যাকে বলে আর কি!…

আমাদের সোনারপুর থেকে সেই কলেজে পড়বার সময় আমি আর ধনু নিরুদ্দেশ হয়ে গেলাম না? বছর চল্লিশেক হলো তো? তারপর থেকে আমাদের আর কোন খবর পাওনি তোমরা—রাখওনি তেমন। ভাগ্যান্বেষণে সারা ভারত তারপর ঘুরেছি আমরা দুজনে, তারপরে কোথাও কিছু সুবিধা করতে না পেরে কপাল ঠুকে বর্মা মুল্লুকে পাডি দিলাম আমরা। বর্ষায় গেলেই কপাল ফেরে, বলত লোকে তখন। অন্ততঃ শরৎবাবুর উপন্যাস পড়ে সেই রকমের একটা ধারণা জন্মেছিল আমাদের।

মাঝপথে সমুদ্রে ঝড়ের মুখে পড়ে আমাদের যাত্রী জাহাজটা ডুবে যায়—সেই থেকে ধনুর সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি। আরেকটা জাহাজ এসে নিমজ্জমান আমাদের কতকগুলোকে তুলে নেয়, তাদের ভেতরে ধনু ছিল না কিন্তু। মনে হয় সে তলিয়ে গেল সেই ঝড়ে।

যাক, আমি তো সেই জাহাজে বর্মায় গিয়ে পৌঁছলাম। এটাসেটা করতে করতে ঢাকের ব্যবসায় লেগে গেলাম শেষটায়। ঢীক এক রকমের দামী কাঠ, জান বোধহয়? টীকের কারবারে অনেক টাকা কামিয়ে ছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর টিকে থাকা গেল না…।

কেন? টীকের জঙ্গল সব সাফ হয়ে গেল বুঝি?

না না। আমরাই সাফ হয়ে গেলুম। বর্ষার নয়া বিপ্লবী সরকার এসে বিদেশীর যত ব্যবসাপত্তর বাজেয়াপ্ত করে নিল, নিঃসম্বল উদ্বাস্তু হয়েই ফিরে আসতে হলো স্বদেশে।

কোথায় যাই? ভাবলাম, বাড়িতেই ফিরে যাই, কিন্তু বাড়িঘর কি আছে আর আমার? মা ছোটবেলায় মৃত, তারপর মামার বাড়িতেই আমি মানুষ কিন্তু সেখানে যেতে মন চাইল না। ভেবেচিন্তে নিজের গ্রাম সোনারপুরেই ফিরলাম।

কিন্তু সোনারপুর আর সেই সোনার গ্রামটি নেই, শহরতলী হয়ে তার ভোল পালটে গেছে এখন। কোথায় যে আমাদের ভিটে ছিল তার কোন হদিশই মিলল না। আর মিললেই বা কী হতো? তিন কূলে তো কেউ ছিল না আমার। শুনলাম মামারাও সেখান থেকে উঠে গেছেন কোথায়।

ভাবলাম, আপাতত আমার ইস্কুলের বন্ধু পার্থর বাড়িতেই উঠি গিয়ে নাহয়। তারপর দিনকয়েক সেখানে কাটিয়ে ভাগ্যান্বেষণে বেরিয়ে পড়া যাবে আবার।

সোনারপুরে পার্থদের বর্ধিষ্ণু পরিবার। তারা নিশ্চয় উঠে যায়নি অন্য কোথাও।

গিয়ে দেখলাম, পার্থ তার বাড়ির বোয়াকেই বসে। কিন্তু সে আর সেই আগের পার্থটি নেই—ছিমছাম সুশ্রী চেহারার সেই পার্থ। ভুঁড়ি বাগিয়েছে এখন, বুড়িয়ে গেছে বেশ।

পার্থ, চিনতে পারছিস আমায়?

শুধোতেই না তার মুখ কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেল। তারপর তার হুঁড়ির পরিধিতে আন্দোলন দেখলাম।

-ওমা ধনু যে! অ্যাদ্দিন পরে। কী আশ্চর্য!

তারপরই সে হাঁক পাড়ল বাড়ির নেপথ্যে—মা! মা! নেমে এসে একবারটি। ধনু ফিরে এসেছে আবার—পরলোকের থেকে।

আর, এই ভাবেইনতুন নাটকের যবনিকা উঠল আমার জীবনে। আমি বলতে যাচ্ছিলাম,

না, আমি ধনু নই, ব্রজ। আমরা দুজনে যে দেখতে ঠিক একরকম ছিলাম তা কি তোমার মনে নেই? এমন কি মাস্টারদেরও ভুল হতো আমাদের দুজনকে নিয়ে। ধনুর অপরাধে আমাকেই বেত খেতে হয়েছিল কতবার। মনে পড়ছে না তোমার?… বলতে যাচ্ছি, কিন্তু বলতে দিলে তো! কই পেলাম না কথাটা বলবার।

ইতিমধ্যে পার্থর মা নেমে এসেছিলেন–আমাকে দেখে তার আনন্দ যেন উথলে উঠল। পাড়ার আরও লোক সব জড়ো হল এসে, যেন হারানো মানিক ফিরে পেয়েছে সবাই-কারো আর আনন্দের অবধি রইল না। সেই উল্লাসের তোড়ে আমার কথাটা কোথায় যেন তলিয়ে গেল। পাড়ার ফুরসতই হলো না আর।

এরই ভেতরে পার্থ আমায় আড়ালে ডেকে বলেছে—জান, তোমার মা ইতিমধ্যে লাখখানেক টাকা পেয়েছেন লটারিতে? তবে বুড়ি আর বেশিদিন টিকবে না ভাই! শরীর এমন ভেঙে পড়েছে তার। চোখেও ভাল দেখতে পান না আর।

খবরটা পেতেই আমি চেপে গেলাম একদম। আমার মত বদলে গেল সঙ্গে সঙ্গে। ব্রজকে সলিল-সমাধিতে পাঠিয়ে ধনু বনে গেলাম দেখতে না দেখতে। আর, সবাই যখন আমাকে ধনু বলেই ধরে নিয়েছে, চিনতে ভুল হচ্ছে না কারো—তখন বৃথা আর ব্রজবুলি আউড়ে আমার লাভ কী?

পার্থ আমাকে খবর দিল আরো। মাধবীর খবরটাও দিল আমায়। মাধবী আমাদের সঙ্গেই পড়ত স্কটিশ চার্চ কলেজে, তাকে বেশ মনে ছিল আমার যদিও আমার চাইতে ধনুর সঙ্গেই তার ভাব ছিল বেশি।

পার্থ বলল—মাধবী এখনো তোমার জন্যে অপেক্ষা করে বসে আছে। তাকে বিয়ে করবে বলে তুমি কথা দিয়েছিলে না? সেই কথা বিশ্বাস করে এখনো সে আর কাউকে বিয়ে করেনি।

তাই নাকি? কিন্তু এই বয়সে—সেটা কেমন হবে? …মানে, তাকে এই বিয়ে করাটা? আমি বলি পার্থকে।

সে তুমি যা ভাল বোঝ। আমার মতে, তোমার ওকে বিয়ে করাই উচিত। তোমার মাকে সে-ই এতদিন ধরে দেখাশুনা করছে—সেবা-যত্ন করছে ঠিক আপন শাশুড়ির মতই। তারও তো তিনকুলে কেউ নেই এখন আর। সে তোমার মা-র কাছে থাকে। ঠিক তার মেয়ের মতই।

ধনুর মাকে গিয়ে প্রণাম করতেই তিনি আমায় বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে বসলেন—জানতুম তুই ফিরে আসবি একদিন। ঠাকুর-দেবতার দোর ধরে তোকে পেয়েছিলাম, জাহাজডুবি হলেও তুই বেঁচে যাবি আমি জানতাম। নিশ্চয় আর কোন। জাহাজ তুলে নেবে তোকে।…

তাই হয়েছিল মা। আরেকটা জাহাজ কাছ দিয়েই যাচ্ছিল তখন–তুলে নিল আমাদের। কিন্তু ব্রজ-বেচারীর আর কোন পাত্তা পাওয়া গেল না তারপর।

আমার স্থির বিশ্বাস ছিল আমার মরবার আগে তোকে আমি দেখতে পাব। মাকে তোর মনে পড়বে একদিন। ফিরে আসবি তুই আমার কোলে আবার।

মাধবীকে নিয়ে একটু বেগ পেতে হবে ভেবেছিলাম কিন্তু সে কোন উচ্চবাচ্য করল; আর বিয়ে করার কথাটা পাড়লই না একেবারে। বেঁচে গেলাম আমি, বলতে কি!

শৈশবের থেকে মা-হারা, মাতৃস্নেহ কাকে বলে জানিনে, তার স্বাদ ষোল আনাই পেলাম ধনুর মা-র কাছে। নিজের মায়ের সেবা করার সুযোগ পাইনি, দুঃখ ছিল মনে, তারও কোন ত্রুটি রাখলাম না আমি। মাতৃসেবার চূড়ান্ত করে ছাড়লাম।

বেশ সুখেই কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো স্বপ্নের মতই প্রায়। ইতিমধ্যে…।

ইতিমধ্যে আমাদের তো ঘুণাক্ষরেও জানাওনি এসব কিছু। বাধা দিয়ে আমি শুধাই—কারণ কী? নতুন মা পেয়ে কি পুরনো বন্ধুদের ভুলে গেলে সব?

না। তা নয়। তবে আমার মা, মানে ধনুর মা মারা গেলেন কিনা হঠাৎ। তাঁর বিষয়-সম্পত্তির সাকসেশন সাটিফিকেট, ব্যাঙ্কের হিসেব-পত্তর এইসব নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়েছিল এতদিন। তার পরে সে-সব ঝঞ্ঝাট চুকে বুকে যাবার পর, শোন বলি কী হলো…।

বলে ব্রজ চুপ করে রইল। নিজের মনের সলিলসমাধিতে তলিয়ে গেল যেন।

কী হলো? আমি ওকে উসকে দিই। ব্রজের লীলাখেলার উপসংহারটা জানবার জন্য আমার আগ্রহ।

ভাবলাম, আর কেন? সবকিছু এবার বেচে-টেচে দিয়ে টাকা-কড়ি নিয়ে এখানকার পাত্তাড়ি গুটোই। অন্য কোথাও গিয়ে নতুন করে ব্যবসাপওর ফঁদি আবার। তাই ভেবে তার আগে মাধবীর একটা ব্যবস্থা করা দরকার বলে আমার মনে হলো। ও বেচারীর তো কেউ নেই কোথাও। আর এতদিন ধরে ধনুর মাকে দেখেছে-শুনেছে…সেই ভেবে না, একটা মোটা টাকা দিয়ে ওর কাছ থেকে বিদায় নিতে গেলাম।

কিন্তু মাধবী আমায় এককথায় চমকে দিল। বলল, ব্রজবাবু, আপনি কি ভেবেছেন যে আপনাকে আমি চিনতে পারিনি? কিন্তু ধনুর মা মনে কষ্ট পাবে বলে, সেই ভেবে এতদিন মুখ খুলিনি আমার। ভেবেছি যে মা যখন তার হারানো ছেলে ফিরে পেয়ে সুখে আছেন, তাঁর জীবনের শেষ কটা দিন তিনি সুখেই থাকুন। কেন আবার কষ্ট পান। তাই আমি কাউকে কিছু বলিনি। এমন কি, আপনাকেও আমি সে-কথা ঘুণাক্ষরে টের পেতে দিইনি। পাছে আপনি ধনুর মাকে ফেলে তাঁর প্রাণে দাগা দিয়ে আবার ফের কেটে পড়েন। কিন্তু এখন তো আমার মুখ খোলার কোন বাধা নেই। থানায় আমি খবর দিতে চললাম।

শুনেই না আমার হয়ে গেছে। আবার যেন আমি বঙ্গোপসাগরেই তলিয়ে যাচ্ছি…আমার সেই ভরাডুবির মধ্যে শুনতে পাই সে বলছে…ব্রজ, তোমার হয়তো মনে থাকতে পারে, কলেজের ক্লাসে আমি ঠিক তোমার পেছনের বেঞ্চটিতে বসতুম। তোমার মাথার পেছন দিকটা দেখে দেখে মুখস্থ হয়ে গেছল আমার। তাই, সামনে দেখে তোমাকে ঠিক চেনা না-গেলেও পেছন থেকে…যাক্, আর সবাইকে ফাঁকি দিতে পারলেও আমাকে তুমি ঠকাতে পারনি।

সলিল-সমাধি থেকে ভেসে উঠে আমি বললাম-ঠকাতে চাইও না আমি। ধনু তোমাকে বিয়ে করবে বলে কথা দিয়েছিল। ধনুর সেই কথাটা আমি রাখব। যখন ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক ধনুর ভূমিকা নিতে হয়েছে আমায়, তার কথাও আমায় রাখতে হবে তখন।

শুনে সে চুপ করে রইল। তারপর আমি আরও বললাম, দ্যাখ মাধবী, আমাদের দুজনেরই যৌবন পেরিয়ে গেছে। এই শেষ বয়সে দুজনকেই দুজনের দরকার আমাদের। আমাকে ছেড়ে তুমি কোথায় যাবে আর তোমাকে ছেড়েই কি আমি থাকতে পারব? পরস্পর মিলে-মিশে আমরা ঘর বাঁধি এস।

আর তারপরই তোমার এই ছাঁদনাতলা? আমি বলি, এখন তাহলে নতুন ঘরানায় তোমার নয়া সঙ্গীত? নতুন ঘরে নতুন সঙ্গী এখন?

মেয়েছেলের চোখকে কখনো ফাঁকি দেয়া যায় না ভাই! অবশ্যি, তার জন্য কোন আপসোস নেই আমার—তার প্রমাণ দেখ তো এই–

বলে ছাপানো কার্ডখানা আমার হাতে সে তুলে দিল।

এই কার্ডখানা তোমায় পাঠালেই কোন গলদ হতো না আর। তুমিও আমায় ধরতে রতে না তাহলে—আর কেউ যেমন পারেনি। কিন্তু ভাবলাম, তুমি আমার পুরনো ব্ধি, ছাপানো চিঠি দিয়ে ডেকে পাঠানো উচিত হবে না তোমায়। তাই হাতে লিখে বয়ের কথা জানাতে গেছি, আর তার ফলেই আগের অভ্যাসবশে নিজের সাবেক নামটাই মই করে বসেছি শেষটায়। তাই এই গলদটা হলো।

কিছু গলতি হয়নি। তোমার কোন ভাবনা নেই, কারু কাছে এ-কথা আমি ফাঁস করব না, তুমি নিশ্চিন্ত থেকো। তবে কোনদিন হয়তো তোমার কাহিনীটি, কাউকে গল্প না-করলেও, গল্পচ্ছলে লিখে বসতে পারি। তাহলেও কোন ভয় নেই তোমার। গল্প-কথায় কেউ কখনো বিশ্বাস করে না। আর, আমার গল্প তো ভাই, হেসেই উড়িয়ে দেয় সবাই। আমি তাকে বলি।——তুমি ভয় খেয়ো না ব্রজ।

না না না। আমি আর ব্রজ নই। ব্রজের লীলাখেলা আমার ফুরিয়ে গেছে। এখন আমি ধনু…ধনু…ধনু…।

বারংবার ওর ধনুষ্টঙ্কার শুনতে হয়।

বড়দিনের বাড়ন্ত দিন

চঞ্চল রায় আমার বন্ধু। ওর চঞ্চলতা একদা আমাকে ভিত করে দিয়েছিলো। সে ভাবটা অনেক স্তিমিত হয়ে এসেছে। ভীত হবার কথা এখন ওরই। পরপৈণী জিনিসকে যারা আত্মনেপদী করে নেয়—তাদের আত্মায় বিপদের আশঙ্কা থেকেই যায়। পরকীয়া রস পরখ করার রোখ, ভালো কি মন্দ জানিনে (বৈষ্ণবসাহিত্যে ওর গুণব্যাখ্যা দেখে ওটা অহিংস প্রেমের সগোত্র বলেই জ্ঞান হয়),—তবু এটা ঠিক যে, ওর আসল কথাটা হচ্ছে পরের সঙ্গে জড়ানো–এই কারণে, যেমন পরের প্রতি করতে য় তেমনি আবার পরেও নাকি করে থাকে। তরোয়ালটার দুধারেই বেশ ধার।

চঞ্চলের অসুখের খবর পেলাম–ইনফ্লুয়েঞ্জা না হুপিং কাশিতে বড্‌ডো ভুগছে নাকি। যাই হোক, মোটের উপর এখন সে বেশ কাহিল, এই খবর পেয়ে আমার মতো বন্ধুবৎস লোকের পক্ষে অচঞ্চল থাকা কঠিন। অতএব বড়োদিনের ছুটির সুযোগ পৌঁছতেই ছু দিলাম। বিকেলের ঢের আগেই রওনা হওয়া গেল। যদিও কাছেই থাকে, কাশীপুরে ওদের নিজেদের বাগান বাড়িতেই, তবু একজনের অসুখের সময়ে যাচ্ছি, কিছু সময়, হাতে নিয়ে যাওয়া ভালো। ভগবান না করুন, যদি কাশীপুর থেকে কাশী মিত্রে যেতে হয়! মিত্রতার বোঝা তো, এই ফাথে করেই বইতে হবেবাধ্য হয়েই।

শোকের অসুখবিসুখ সারাবার আমার নাকি আশ্চর্য ক্ষমতা আছে। আমার পদার্পণেই অনেক রোগ সেরে যায়, হস্তক্ষেপ করলে তো কথাই নেই। এমনিই জনরব। চঞ্চলের বেলাও তার অন্যথা হবে না, আমার আশা ছিল। এবং এ সম্বন্ধে (অর্থাৎ আমার আরোগ্যকারিতা সম্বন্ধে) লোকের ধারণা যে নিতান্ত ভুল নয় তার পুনঃ প্রমাণ পেলাম রাতারাতি ওর সেই ইনয়েঞ্জানা হুপিং কাশি—কেবল ওকে নয়, ওদের কাশীপুরের তল্লাট হেড়ে চম্পট দিল। কী করে এই মিরাকল ঘটল, অথবা আমি ঘটালাম শুনতে আপনারা অবাক হবেন।

ওদের গেটে পা দিতেই শ্রীমতী রায়কে দেখতে পেলাম, বাগানে ঘুরছেন। শ্ৰীমতী রায় আর আমি এককালে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলাম—অবশ্যি অনেকদিন আগে, তাঁর বিয়ে আগেই। কৌমার্যদশায় তখন উনি ছিলেন নিছক মায়া সেন। তখনো কোনো যাবজ্জীবনের রায় পাননি। আমাকে মায়াযুক্ত আর ওকে ইনসেন করার জন্য একমাত্র চঞ্চল ছাড় আর কাউকে আমি দায়ী করতে পারিনে। চঞ্চলই সেই মায়াবী।

অবশ্যি শ্রীমতী রায় এবং আমার মধ্যে এখন আর সেই সোহ যে নেই তা নয়। এখনো আমরা বন্ধুই বটে, তবু ঠিক ততটা অঙ্গ হয়তো বলা যায় না। সত্যি বলতে বিয়ের পরে মাত্র একবার আমাদের সাক্ষাৎ হয়েছিল। চঞ্চল এমনই হিংসুটে প্রকৃতির যে–কিন্তু না, সে কথা থাক।

শ্রীমতী রায়ের পুনরায় দেখা পেয়ে সত্যিই আমি পুলকিত হলাম। চিরকালই উনি মৎকার। বিয়ের পরে সেই চমৎকারিত্ব আরও যেন বেড়েছে। আমার তো মনে হলো আমাকে দেখে উনিও তদ্রুপ চমৎকৃত হয়েছেন। মেয়েদের চোখে আইবুড়োদের জন্যে একটুখানি মেহদৃষ্টি থাকেই। বেচারীরা নিজের বা যারই ক্ষতি করুক, মেয়েদের কোনো ক্ষতিকর তো নয়। মেয়েদের তো সাধারণতই দুঃখের জীবন, বু অন্ততঃ একটি মেয়েকে ইহলোকে তারা সুখী করতে পারে, যাকে তারা বিয়ে করে না। নিজের জীবনের অকূলে জলাঞ্জলি না দিয়ে যাকে বাঁচায়। যাকে না ভাসিয়েই চলে যায় তারা। পুণ্যকর্মের একটা প্রতিফল রয়েছেই, এই জন্যেই নিখিল নারীর একটু দরদ ওদের লভ্য।

একি, শ্ৰীমতী রায়, আমিও এলাম তুমিও বেরিয়ে যাচ্ছো? ওকে সুসজ্জিত দেখে আমি না বলে পারলাম না—না, এ কখনো হতে পারে না।

সত্যি যেন যাচ্ছি! সত্যিই যেন আমি যেতে পারি। হেসে উঠলেন মায়া রায়, হাসলে টোল খায় ওর গালে—এখনো সেই রকম—এমনি এই বাগানেই বেড়াচ্ছিলাম। এখানে বেড়াতেই আমার ভালো লাগে। সারাদিন এমনি সেজেগুজেই থাকি আমি। উনিও সেটা ভালোবাসেন।

হ্যাঁ, কেমন আছে চঞ্চল? —মায়ার সঙ্গে বেড়াতে বেড়াতে আমি খোঁজ নিলাম। কিন্তু খবর নেবার আগেই—বাঃ, কী চমৎকার গোলাপ ফুটেছে, বাঃ! ভারী সুন্দর তোমাদের এই বাগানটি তো!

—আমার উচ্ছ্বাসে আমার কথাটা চাপা পড়ে গেল আপনিই। তুমি বুঝি ফুলের ভারী ভক্ত হয়েছে আজকাল? আমি জিজ্ঞেস করি ওকে।

হ্যাঁ,—তা কিছুটা, শ্রীমতী রায় প্রকাশ করেন, বাগানে শখটা ওঁরই বেশি। আমার তেমন মন্দ লাগে না।

ও বাবা! এধারে যে বাঁধাকপিও দেখছি আবার। চমকে উঠতে হলো আমায়।

ফসল আরো ফলাও করার জন্যই। গ্রো মোর ফুড আন্দোলনের উনিও এক পাণ্ডা কিনা। ধানগাছও লাগানো হয়েছিলো ওধারটায়। কোথা থেকে তুলে এনে লাগিয়েছিলেন উনিই জানেন। ওঁর ধারণা এই ভাবে সাধ্যমত উনি দেশের সেবা করছেন! অবশ্যি ধানগাছগুলোয় ধান মোটেই ফললো না, কেন জানিনে। আর কপিগুলোও কেমন যেন দর্‌কচা মেরে গেছে, কদ্দুর ওতরাবে কে জানে।

বেড়াতে বেড়াতে বাগানের একধারের বেঞ্চে আমরা বসলাম।

বাঃ, বেশ সুখেই আহে চঞ্চল। আমার দীর্ঘনিঃশাস পড়লো; একাধারে দেশলক্ষ্মী আর এমন গহলীর সেবা করার সুযোগ যে পেয়েছে তার মতন সুখী কে? এমন লক্ষ্মীর দশা কজনার হয়?

মায়ার হাতখানা বেঞ্চির উপরে পড়েছিল। অকস্মাৎ, কিছু ইচ্ছে করে নয়, একান্তই দৈবাৎ আমার হাতখানা তার ঘরে গায় গিয়ে ঠেকল।

তারপর নেমে এল আশ্চর্য এক নীরবতা—ভাবালু এবং বাঙ্‌ময়—যার রহস্য নিয়ে কবিরা কবিতা লিখেছেন, গাক্সিকেরা গল্প জমিয়েছে, মনস্তাত্ত্বিকেরা পাগলামি করার কসু করেনি। ভাবগর্ভ সেই নীরব মুহূর্তগুলি লঘুপায়ে আনাগোনা করতে লাগলো।

এক এক সময়ে আমি ভাবি, বললেন ভূতপূর্ব মায়া সেন, কেন যে তুমি আর বিয়ে করলে না।

আমি বিষণ্ণ ভাবে ঘাড় নাড়লাম মানুষ জীবনে একবারই ভালোবাসে। বিয়ে অবশ্যি সে হাজার বার করতে পারে যখনতখন যাকে খুশি; কিন্তু ভালোবাসা সেইএকবারটিই হয়। আর আমার কথা যদি বলো, আমি লোকটা হচ্ছি একনিষ্ঠ। এক সময়ে—অর্থাৎ কিনা এক জীবনেদুজনের অনিষ্ট আমার দ্বারা হবার নয়। স্বভাবতই আমি অদ্বৈতবাদী, এক বই দুই জানিনে।

ঘাড় ফিরিয়ে আড়চোখে একটু তাকিয়ে নিলাম। না, আশপাশ চারধার ফঁকা। পাড়ার লোকেরা এখন চাল, চিনি, কেরোসিনের দরবারে সার বেঁধে দাঁড়াতে গেছে হয়তো। উকিঝুঁকি মারবার কেউ কোথাও নেই। সারা বাগানে খালি আমরা দুজন।

মায়ার হাতখানা আমার নাগালেই পড়েছিল, তেমনি অবস্থায়—তখনো। ঠিক একখানি আমন্ত্রণ-লিপির মতই।

আমন্ত্রণ আমি গ্রহণ করলাম। ললিত আঙুলগুলিকে ঈষৎ দলিত করে বললামঃ এই একনিষ্ঠ ধাতেব জন্যেই আমার মনে হয় এ জীবনে আমি কাউকে বিয়ে কবতে পারব না। এক যদি কবি, কোন বিধবাকে করব। কিন্তু ভেবে দেখলে সেও এখন আকাশ-কুসুমের স্বপ্ন…চঞ্চল অনেকটা সেরে উঠেছে তুমি বললে না?

অনেকটা ভালো এখন। যদিও জ্বর সম্পূর্ণ ছাডেনি, তবু কাশিটা অনেক কম। জানালো মায়া : চলো না, তোমাকে দেখলে উনি খুশি হবেন খুব।

হবেন বইকি, আমি সায় দিয়ে বলি : হবার কথাই। চঞ্চল আর আমি ছেলেবেলার বন্ধু। অবশ্যি, ওর বিয়ের পর থেকে আর তেমন ঘনিষ্ঠতা নেই। সাধারণতঃ কারো বিয়েব পর তা বড়ো থাকেও না আর। হয়, তার বৌ তোমাকে পছন্দ করে না, নয়তো তুমি তার বৌকে বেশি পছন্দ করো।

এই অবকাশে আমার চোখে মুখে একটা আলুথালু ভাব জেগে উঠল (আমি নিজে ঠিক দেখতে না পেলেও) আর আমার গলায় যেন আশাবরী সুর বাজতে লাগল (স্বকণেই শুনলাম) : মায়া, সেই আগের দিনগুলি তোমার মনে পড়ে? কী সুখের মুহূর্ত সব গেছে! সেই বিকেল বেলায় দুজনের গঙ্গার ধারে বেড়ানো?

এই কথা জিজ্ঞেস করবার জন্যে হাত ধরে থাকার কোনো দরকার করে না। হাত না ছাড়িয়েই বলল সেঃ তা ছাড়া এ হাত তোমার ধ্যই নয় আর। যা, আমার মনে পড়ে। কিন্তু আজকাল আমি আর গঙ্গার ধারে যাই না। উনি সেটা পছন্দ করেন না।

কেবল উনি আর উনি। এর মধ্যেই প্রায় উনিশ বার শুনতে হলো আমায়। প্রায় পড়-পড় দীর্ঘনিঃশাসকে কোনোরকমে আমি সামলে নিলাম। বাস্তবিক, অদ্ভুত এইমেয়েরা! বিনা অস্ত্রে কি নিপুণ লড়াই না এরা করে, এমন অকাতরে এত লোককে হতাহত করে যায়, ভাবলে তাক লাগে। যাক, ও যখন নিজেকে কাটিয়েছে, তখন আমারই বা আর মায়া বাড়িয়ে মরীচিকা লাভ করা কেন? আমিও কেটে পড়ি। অবশ্যি, আমি নেহাত একনিষ্ঠ লোক তা সত্যি। কিন্তু তাই বলে আমিও এই মায়া কাটাতে পারবো? আমার একনিষ্ঠার জের কি এতটাই অকাট্য? এতদূর জেরবার হবার পরেও…অ্যাঁ?

সত্যিই কি তুমি কোনদিন বিয়ে করবে না আর? সে বলে বসল হঠাৎ।

বিয়ে? বললাম তো, বিয়ে যদি কখনোকরি তো কোনো বিধবাকেইকরব।দীর্ঘনিঃশ্বাস মোন করে জানাই।–বুঝেছ মায়া?

তুমি মায়া বলে আর ডেকো না আমায়। ও তো আমার নাম নয়—ডাক নাম। হেলেবেলার নাম আমার। সেও যেন ফেঁস করে উঠল আমার কথায়।

কেন মায়া? মায়া নামটি তো মিষ্টি খুব। আমি আওড়াই। মায়ার ডাকে বুঝি বা নতুন করে ভোলাতে চাই তাকে।

আমার ভালো নাম কি নেই নাকি? আমার নাম তো নীলিমা। সে-নামটাই বা কী এমন খাবাপ?

না, খারাপ নয়। তবে আমার…আমার তবু সেই তোমার আগের নামটিই মনে জাগে কেবল। যে নামে আমি ডাকতুম তোমায় সেকালে। যখন তোমার সঙ্গে আমার ভাব ছিল…

এটা পোষমাস না? বড়দিন না আজ? অন্য প্রশ্নে মোড় ঘুরিয়ে প্রসঙ্গান্তরে আমার ভাবালুতাকে এড়িয়ে যেতে চায় সে।

আমার জীবনে আর বড়দিন এলো কোথায়? আমার সব দিনই তো বাড়ন্ত। আমার সব মাসই উপোসের মাস। পোমাস কি কোনদিন আর আসবে আমার এই জীবনে!

আবার আমার দীর্ঘশ্বাস : তবে এক পোষেই কিছু বড়দিন ফুরোয় না। আমার জীবনেও বড়দিন নিয়ে পোষ মাস হয়তো আসতে পারে একদিন।

আমার কথাটায় ও কেমন গম্ভীর হয়ে যায়। কিছু বলে না।

নীলিমা আমার কাছে আজ শূন্যতাই। সেই ফঁকা আকাশের অন্ধকারের দিকে তাকালে কোনো সুদূর নক্ষত্রের ক্ষীণ দীপ্তিটুকুই বুঝি চোখে পড়ে…যা নাকি কালের পারাবারে কবেই অস্তমিত হয়েছে।

তবু যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। আমি আর এক আশ্বাসে দুলে উঠি : চঞ্চল তো এখন অসুখ-শয্যায় শায়িত। জ্বরের ঘোরে অকাতরেই ঘুমুচ্ছে? এই ফাঁকে, এখানে এই কাশীপুরেও তো গঙ্গা কাছে,—আমরা একটু বেড়িয়ে আসতে পারতুম। সেই হারানো দিনগুলির পুরোনো স্বপ্ন ফিরে আসত আবার। বলতে বলতে আমার নজর পড়ল অদূরবর্তী দোতলার এক অলিন্দে। সেখানে ফুলের টবগুলোর আড়ালে কোনো অলি নয়, তার চেয়ে বলিষ্ঠতর হৃষ্টপুষ্ট বাহু আর কটমটে চোখ দেখা গেল যেন। কার যেন চাঞ্চল্য দেখলাম মনে হলো।

আচ্ছা আজ থাক। বলে উঠলাম আমি: অসুস্থ রুগীকে একলা ফেলে কোথাও যাওয়া হয়তো ঠিক হবে না। বেচারা জেগে উঠে তোমাকে দেখতে না পেয়ে যদি আরো চঞ্চল হয়ে ওঠে সেটা খুব খারাপ হবে। বন্ধুর অসুখ আর বাড়াতে চাইনে, ওর নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটাতেও আমি নারাজ। আমি চলি আজ। চল সেরে উঠলে একটা পোস্টকার্ডে আমাকে জানিও। নইলে খুব ভাবিত থাকব। বুঝেছো? এই বলে আমি উঠলাম। বেঞ্চির মায়া কাটিয়ে, নীলিমা ওরফে আমার মায়াকে সেইখানে রেখে, চঞ্চললগ্ন অলিন্দের ধার ঘেঁষে আসবার সময় আড়চোখে উপর পানে তাকালাম—একটা ফুলের টব হাতে করে ও তা করছে ওর নজর ভারী নীচু বলতে আমি বাধ্য।

এই শীতের রাত্রে এই বাগানে এসে অপেক্ষা করা–কিন্তু উপায় কী? কষ্ট না করলে কি কেষ্ট মেলে? রাধাও মেলে না। আপনা হতেই আমার মুখ থেকে ফসকে গেল যেন স্বগতোক্তির মতই।

সঙ্গে সঙ্গে ওর হাত থেকেও ফসকেছে। একটুর জন্যেই আমার মাথাটা ফসকে গেছে। আমিও একামী ছুঁড়েছি, ও-ও টবটা হেড়েচে। সামান্যর জন্য আমার কাশীপুরপ্রাপ্তি ঘটলো না। কাশীমিত্রতা-ও কান ঘেঁষে বেরিয়ে গেল নেহাত।

 

কদিন বাদে মায়ার একটা পোস্টকার্ড পেলাম।

 

আশ্চর্য, তুমি চলে যাবার পরই উনি চাঙ্গা হয়ে উঠলেন। শুনে অবাক হবে, এই পৌষের ঠাণ্ডায় সারারাত উনি বাগানের হাওয়া খেয়ে কাটালেন হাতে লোহার মুগুর নিয়ে তার ওপরে। বললেন, অক্সিজেন নেয়ার সাথে সাথে ব্যায়াম করলে শরীর ভাল হয়। সারারাত আমার ঘুম হলো না—কেবল তোমার পৌষ মাস আর নিজের সর্বনাশের। কথা ভাবলাম। যা হোক ফঁড়াটা কেটেছে। সকালে দেখা গেল উনি দিব্যি আরাম। সর্দি। কাশি জ্বরটর কিছু নেই, চেহারাও চকচকে। নেচার-কিওর জিনিসটা দেখছি মিথ্যে নয় একেবারে, তুমি কী বলে? বলতে কি, এইটেই আমায় সবচেয়ে বেশি অবাক করেছে। আরো।

ভালবাসার অনেক নাম

কডলিভার তেল মেখে মুড়ি খাওয়াটাকে আমি ভালবাসার বদনাম দিতে চাইনে, কিন্তু তাই একবার খেতে হয়েছিল মেয়েটার জন্যে আমায়।

কিছুতেই শরীর সারছিল না জবার, ডাক্তার ব্যবস্থা করলেন কডলিভারের। কিন্তু তাই কি খাবার পাত্রী সে! বলে যে, কী বিচ্ছিরি গন্ধ বাবা! ভাত খাবার পরে খাবার জিনিস নয় ও। তিন চামচ কেন, ওর এক চামচ মুখে তুললেও, তক্ষুনি তক্ষুনি ভাত-টাত সব বমি হয়ে উঠে আসবে। এমনকি, অন্নপ্রাশনের ভাত অব্দি।

শোন কথা! খাওয়ার আগে খেতে কি কোন বাধা আছে? তাহলেও তো হয়? তাহলে নাকি ওর খাওয়ার রুচিই চলে যাবে একদম।

তাহলে স শবীর সারবে কী করে!

এগুতে হলো তখন আমাকেই—নিয়ে আয় তোর কডলিভার। কেমন খেতে খারাপ দেখি তো! আমি যেন কখনো কডলিভার খাইনি আর! কডলিভার না খেয়েই যেন আমার এই শরীর হয়েছে—এমন হৃষ্ট-পুষ্ট মেদধী বপু কি অমনিই হলো নাকি আমার?

কডলিভার খেয়ে তুমি পুষ্ট হয়েছ একথা মানতে আমি রাজি আছি, কিন্তু হৃষ্ট তুমি কখনই হওনি, আমি দিব্যি-গেলে বলতে পারি দাদা? জবা বলে।

হৃষ্ট হইনি? এখুনি তোর সামনে হৃষ্ট হয়ে খাব,

আমি বললাম, কিন্তু তোকেও খেতে হবে তার পরে।

আচ্ছা, আগে খাও তো তুমি দেখি। বমি না করে খাও দেখি একটি চামচ একবার।

এল কডলিভাব।

আমি বললাম, কডলিভার কি আর শুধু শুধু খায় রে! কিছুর সঙ্গে খেতে হয়, নয় কিছু খাবার আগে বা পরে। বাড়িতে ভালমন্দ খাবার কী আছে নিয়ে আয়।

মুড়ি আছে। খাবে? সে বলে, রান্নাঘর থেকে ভাত নিয়ে আসব নাকি?

আরে ভাত হলে তো ভালই হয়। ইলিশমাছের তেল দিয়ে ভাত খেতে যেমন খাসা লাগে, কডলিভার দিয়ে মেখে খেতে তার চেয়ে কিছু কম উপাদেয় নয়। ও তো মাছের তেলই বটে রে, সামুদ্রিক মাছের। তবে এখন মুড়ি দিয়েই একটু জলযোগ করা যাক নাহয়।

কডলিভার মাখা মুড়ি তারিয়ে তারিয়ে খেতে লাগলাম আমি। বললাম-আরেক চামচ ঢেলে দে মুড়ির ওপর। আহা, খেতে কী ভালই না লাগছে রে! যেন আচারের তেল মেখে মুড়ি খাচ্ছি, ভাই!

দাও তে আমায় একগাল, চেখে দেখি। জবা হাত বাড়ায়। গালে দিয়ে বলে—না, ততটা খারাপ নয় তেমন।

ভাল লাগছে তো? বলেছিলাম না? দুদিন খা-না, তারপর দেখবি ঠিক নলেন গুড়ের মতই মনে হচ্ছে তোর। আমি মাকে লুকিয়ে চুরি করে কডলিভার খেতাম রে…দাঁড়া, কে যেন ডাকল না আমায়? তুই খেতে থাক, দেখে আসি কে ডাকছে আমাকে…

বলে এক ছুটে বাইরে গিয়ে বমি করে উদ্ধার পাই।

সৌভাগ্য কি দুর্ভাগ্য জানিনে, আমার সাত মাসির সৌজন্যে, জীবন আমার বনে। বনে অরণ্য এই অরণ্যবৃহ থেকে এ জীবনে বেরুতে পারব সে ভরসা আমার নেই। না থাক, তার জন্য কোন খেদ নেই আমার। বনের বাইরে যে ব্যক্তি কখনো উঁকি দেবার ফাঁক পায়নি, তার জীবনও নিছক ফাঁকি নয়, তার জন্য বনের মধ্যেই লাবণ্য; প্রকৃতির বদান্যতায় তার নিমিত্ত বনান্তরালেই বিচিত্র ফলফুল; বসন্তের সমারোহ। ঊষর মরুভূমির বাসিন্দার জন্যেও মরীচিকাই নয় কেবল, ওয়েসিসও রয়ে গেছে। পাহাড়ের শুষ্ক কাঠিন্য ভেদ করে ঝর্ণাধারা উৎসারিত হয়, কার জন্যে, কে জানে!

সব ভালবাসায়ই সমান যন্ত্রণা। সব টানের একই পোড়ানি, টানাপোড়েনে সব মেহই সমান। কডলিভার তেলের মতই আঁশটে।

এমন কি, একদার প্রীতি যখন এক সময়ে স্মৃতিতে এসে পর্যবসিত হয় তখনো বুঝি মনের কোণে ধূপের মতই তা পুড়তে থাকে। অনুক্ষণকে সুরভিত করে রাখে পুড়ন্তকে।, আর, সেই জন্যেই ভুলে গিয়েও বুঝি ভোলা যায় না।-ভুলে থাকলেও ভোলানাথের ঝুলির মধ্যে থেকে যায়। হারিয়ে গিয়ে ফিরে ফিরে আসে ফের আবার।

তাই এখনো আমার মনে পড়ে, পূজোর সময়টায় বেশি বেশি আরো, মনের জুতোয় সেই পুরনো কাঁটাটা বেরয় যেন, এতদিনের এত তালি পড়ার পরও তলায়নি সেটা দেখা যায়, চলতে ফিরতেই কোথায় যেন খচ খচ করে।

সেবার পূজোর মুখে ওদের বাড়ি যেতেই ইতু বলে উঠল—জান শিব্রামদা, এবার আমরা মজা করে মোটরে চড়ে ঘুরে ঘুরে কলকাতার যত পূজো দেখব, মামাদের সঙ্গে বেরুব এবার, জান?।

তাই নাকি রে? আমি বললাম। বলতে বলতে একটা উজ্জ্বল মুখকে নিতে যেতে দেখা গেল সামনের আয়নায়। আমার নিজের। জবাদি আর তোমার সঙ্গে ট্যাং ট্যাং করে ঘুরবে না এবার। পুতুল জানায়, তুমি যে ওকে ল্যাজে বেঁধে নিয়ে কলকাতায় চষে বেড়াবে সেটি হচ্ছে না।

কে বললে? মোটেই আমি ওকে ল্যাজে বেঁধে নিয়ে ঘুরিনে। কথাটা যেন জবার পক্ষে মানহানিকর মনে হয় আমার কাছে, তাই আমি প্রতিবাদে সোচ্চার—বরং বলা রায়, আমিই ওর ল্যাজে বাঁধা হয়ে ঘুরে থাকি।

আমার,লেজস্বিতার বিপক্ষেই আমার ভোট।

ওই হলো। বলল পুতুল, তোমার লেজের প্রিভিলেজ জবা আর নেবে না এবার। তোমাকেও আর ওর লেজুড় হতে হবে না। এবার সবাই আমরা মজা করে আমাদের মোটরে চড়ে সার্বজনীনে সার্বজনীনে পূজো দেখে দেখে বেড়াব কেমন!

আহা! মোটরে বেড়াতে যে কী মজা! এই উঠলাম আর এই দুম করে পৌঁছে গেলাম—দেখতে না দেখতেই। দেখবার কত কী থেকে যায় কিছুই তার দেখা হয় না।

কলকাতার রাস্তায় দেখবার কী আছে ছাই! ঠোঁট ওলটায় ইতু, খালি ভিড় আর ভিড়!

আরে, সেই ভিড়েব গতীরেই তো যত মণিব খনি! যত রমণীয় মণি। সুন্দর মেয়েরা তো কলকাতার পথেই পড়ে আছে রে! রাস্তায়ই তাদের পাওয়া যায়। দেখতে দেখতে যাও আর দেখতে না দেখতেই হারাও। বলে আমার দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলি।

মেয়েদের আবার দেখবার কী আছে? পুতুলের প্রশ্ন।

তা বটে! তোদের দেখবার কী আছে আর! কিন্তু বলেছে না, যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখ তাই…বলেছে না কথায়? পেলেও পাইতে পার লুকানো রতন। মেয়েদের আশে-পাশেই ছেলেদেব পাবি—তাঁরা তো তোদের দেখবার বটে! কত সুন্দর সুন্দর ছেলে-তারাও ঐ পথেঘাটেই ছড়ানো। তাদের দেখতে পারিস।

বলে আমি পুনশ্চ যোগ করি-–তবে ছেলেদের মধ্যে তোরা যে কী দেখিস তা তোরাই জানিস। আমি তো ভাই ওদের ভেতর দেখবাব কিছু পাইনে। তোরা আবার তাদের দেখেই ভুলে যাস না কি—কে বলে?

তোমাকে বলেছে! পুতুলচন্দর ঠোঁট ওলটায় তার : ছেলে দেখতে বয়েই গেছে আমাদের।

আমাদের দেখতে হয় বাধ্য হযে। না-দেখে উপায় কী! পৃথিবীর আদ্ধেক মেয়ে হলেও, দুনিয়ার আর সব চীজের মতই মেয়ের মধ্যেও ভ্যাজাল। ঐ ছেলের ভ্যাজাল। পৃথিবীর অদ্ধেকটাই ভ্যাজাল বলতে গেলে। কিন্তু উপায় নেই, তাই পিতৃরূপে ভ্রাতৃরূপে আগলে রয়েছে মেয়েদের-দারোয়ানকে খুশি না করলে বাড়ির ভেতরে ঢোকার যো কী? আম খেতে হলে আঁঠিসমমতই নিতে হবে, তবে খাবার সময় আঁঠি বাদ দিয়ে খাও। তখন আর আঁঠিটি না দেখালেও চলে। দেওয়ানী আমে গিয়ে পৌঁছলে পর তখন আর আঁঠির দেওয়ানী করার দরকার করে না। যেমন…

একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে গিয়ে আমি থেমে যাই। .

যেমন? পুতুল থামে না।

যেমন, প্রথমে তো তোদের দাদার সঙ্গেই ভাব জমেছিল আমার। তাই গোরার সঙ্গেই বেড়াতাম গোড়ায়। তখন তোরা সব এই টুকুন টুকুন ছিলিস্। মিশবার মতন হসনি তখন। কিন্তু তারপরে তো…জবার সঙ্গেই ঘুরি এখন।

তোমার সঙ্গে টই টই করে ঘুরে আবার গায়ে গত্তি লাগল না ভাই! আক্ষেপ করে পুতুল।

ঘুরে ঘুরে আমরা কত কী খাই। খাই না রে জবা? চীনেবাদাম চানাচুর ঘুঘনিদানা আলুকাবলি ফুচকা–কত কী। কাজুবাদামও কখনো-সখনো। এক পা যাও, একটুখানি ধাও। পকেটে পয়সা থাকলে সন্দেশ-রসগোল্লাও।

রাস্তায় আবার খায় নাকি মানুষ? ইতু কটাক্ষ করে।

রাস্তাতেই তো খাওয়ার বেশি মজা রে। এমন কি, যে জিনিস মানুষ স্থির হয়ে খায় আর খেলে স্থির হয়ে যায় তাও রাস্তায়, চলতে চলতে খেলে, আরো বেশি মিষ্টি লাগে, তা জানিস? আমি জানাইঃ যেতে যেতে খাও আর খেতে খেতে যাও।

অতো লোকের চোখের ওপর? ইতুর চোখ বড় বড় হয়।

লোক কোথায় রে! ভিড় তো! ভিড়ের মধ্যে কারো কি কোন দিকে নজর দেবার যুরসত আহে? কেউ কারো দিকে তাকায়ও না। জনারণ্যের মতন নির্জন জায়গা নেই আর। আমি জানাই, পাবার যা কিছু ঐখানেই পাবে। খাবার যা কিছু ঐখানেই খাবে। আবার হারাবার যা কিছু হারাবে ঐখানেই। ঐ জনতার মধ্যেই।

আমরাও খাব গো। খালি মোটরে করেই যাব না। মামারাও খাওয়াবে আমাদের। গ্রাণ্ডে,—চাংগোয়ায়, কফি হাউসে কলকাতার নামজাদা যতো বড় বড় রেস্তরাঁয়। তোমার মতন চার পয়সার চানাচুর নয়—চপ কাটলেট ফিশফ্রাই কত কী খাব আমরা মজা করে কেমন!

তোদের খালি খাই খাই। খাওয়া আর খাওয়া। খাওয়াটাই কি জীবনের সব নাকি? দেখাটা কিছু না? অবশ্যি, নানারকম চেখে দেখা যে মন্দ, এমন কথা আমি বলিনে, কিন্তু নানাবিধ চোখে দেখাটা? বললাম না যে পৃথিবীতে আমাদের আধাআধি বখরা-আদ্ধেক ছেলে আর আদ্ধেক মেয়ে। ছেলেগুলো সব তোদের জন্যে…বললাম না?

তোমার যেমন মেয়ে দেখবার ঝোঁক, আমাদের তত হেলে দেখার শখ নেই। সত্যি বলতে, রাস্তায় বেরুলে ছেলেদের দিকে তাকাইওনে বড় আমরা। মেয়েদেরকেই দেখি—আমরাও। তোমার চোখ নেইকো, তাই তোমার নজরে পড়ে না।

মেয়ে দেখিস! তোরা তো মেয়েদের শাড়িটাই দেখিস খালি। কে কী রকম শাড়ি পরেহে, কেমন করে পরেছে…এই সব তো দেখিস। আর আমরা দেখি শুধু মেয়েদের…তার শাড়ি-টাড়ি সব বাদ দিয়ে…আমাদের স্বভাবসিদ্ধ দিব্যদৃষ্টির সাহায্যে।

আর তোমরা বুঝি শাড়ি দ্যাখো না? চলে নীল শাড়ি নিঙাড়ি নিঙাড়ি…কে বলেছিল গো? চণ্ডীদাস, না, কোন চণ্ডীদাসী?

আরে, আমিও জে সেই কথাই বলছি রে। আমারও সেই কথা, তবে একটু অন্য বানানে…আহা, চলে nil শাড়ি নিঙাড়ি নিঙাড়ি পরাণ সহিত মোর…আহা!…

মুখের আহাকার দিয়ে মনের হাহাকার চেপে চলে এলাম, আর গেলাম না ওদের বাড়ি…পূজোর সময়টায় গেলাম না আর।

কী হবে গিয়ে? জবা কেমন তার বোনদের সঙ্গে মজা করে মামাদের মোটরে ঘুরে পূজো দেখে বেড়াচ্ছে…কত কী খাচ্ছে নামজেয়াদা যত রেস্তোরাঁয়…কী হবে তাকে সেই সুখের থেকে ছিনিয়ে কলকাতার পথে পথে আমার মতন হতভাগার সঙ্গে ট্যাং ট্যাং করে ঘুরিয়ে? গেলে হয়ত আসত…তেমন প্রতিবাদ করার স্বভাব নয় জবার, মুখ বুজে চলে আসত আমার সঙ্গে…কখনো কোন কথায় না বলে না…আহা, বেচারীর জন্যে আমার মায়া করে।

বাসা ফাঁকা, সবাই যে যার বাড়ি চলে গেছে পূজোর ছুটিতে। আমার তো আর বাড়ি-ঘর-দোর নেই, যাব কোথায়? সারা বাসায় একলাটি আমি। খোলা বারান্দায় ডেক-চেয়ারে শূন্য আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে কাটিয়ে দিলাম পূজোর কদিন।।

আমিও আর বেরুলাম না কোথাও। কোথায় যাব? রাস্তায় সুন্দর সুন্দর মেয়েরা আছে জানি, কিন্তু তারা তো বিলকুল কিছু না, সুন্দর সুন্দর শূন্য কেবল। যে একজন পাশে থাকলে তারা সত্যিকা সুন্দর হয়ে ওঠে, দেখবার মতন হয়, সেই একটিই তো আমার পাশে নেই। সেই একা থাকলেই তবেই না পৃথিবী সুন্দর…পৃথিবীর সবকিছু সুন্দর? সেই একটি পাশে থাকলেই তবেই না এইসব শূন্যের মূল্য বেড়ে যায়…দশগুণ…একশগুণ…হাজারগুণ?

অসহ্য ভিড় রাস্তায়। আর কী দারুণ হট্টগোল। তবে হ্যাঁ, সেই একজন পাশে থাকলে এই অসহনীয় ভিড়ও গভীর আনন্দে উদ্বেল হয়ে ওঠে। ভিড়ের ভেতর তাকে জড়িয়ে, আগলে নিয়ে যাবার সুযোগে চারধারের চাপে জর্জর হতে ভালই লাগে আরো বরং। সঙ্গীর মত সঙ্গী থাকলে সেই নিদারুণ সঙ্গীন অবস্থাও সঙ্গীতের মতই হয়ে ওঠে সত্যি।

সেই একজনের আলোতেই সব কিছু দেখা যায়…সমস্ত দর্শনীয় হয়ে ওঠে…সে-ই তো আলো। কিন্তু সে কোথায়?

পূজোর পবে বিজয়ার মিষ্টি কুড়োতে বেরুলাম। বিজয়ার পর দিগ্বিদিক-বিজয়ে।

প্রথমেই গেলাম ওদের বাড়ি।

দোরগোড়াতেইতুর সঙ্গে দেখা হতেই শুধালাম—কী রে! কী রকম কাটালি পূজোটা? ভারী মজায় কেটেছে শিব্রামদা। আজ এ মামার গাড়িতে কাল সে মামার গাড়িতে…কিন্তু এ-কদিনই তুমি এলে না কেন বল তো? দিদি পূজোর কদিন একদম বেরোয়নি, বাড়ির থেকে…কখন তুমি আসবে বলে বাড়িতে বসে ছিল সারাক্ষণ।

তাই নাকি রে জবা?

জবা কিছু বলল না, একটুখানি হাসল কেবল।

ওই চোখ আর অমন হাসি আর কোন মেয়ের আমি দেখিনি আমার জীবনে।

 যবনিকা পতন

লোকে কয় অভিনয় কভু নিন্দনীয় নয়, নিন্দার কারণ শুধু অভিনেতাগণ-বলে গেছেন নটগুরু গিরিশচন্দ্র। অভিনেতৃত্ব নিন্দার কারণ তো বটেই তার চেয়েও কিছু বেশিই বরং; বিতান্ত মারাত্মকভাবেই কথাটা ফলে গেল।টবর পুলকেশের জীবনে। সে নিজেই যেন উদাহরণস্বরূপ হয়ে দাঁড়ালো মহাকবির ঐ মহাবাক্যের।।

অভিনয় করার শখ তার বাল্যকালের থেকে। পেশাদারী রঙ্গমঞ্চে একটা সুযোগ পাবার জন্যে কতো না ঘোরাঘুরি করেছে একসময়; কিন্তু দুঃখের বিষয়, নেপথ্যে কোলাহল কিংবা জনতার একজনের ভূমিকার চেয়ে বেশিদূর আর এগুতে পারেনি। অবশেষে বিরক্ত হয়ে পাটের মত পার্ট পাবার আশায় যাত্রাদলে গিয়ে যোগ দিল সে।

যাত্রাপালায় এক আধটা পাট পেলেও তার পাট অব শীচই একটা বাধা হয়ে দাঁড়ালো–সংলাপাংশেই মার খেলে শেষটায়। মদ কি গাঁজা খাওয়ার হেতু নয়, হয়তো কানে একটু খাটো বলেই যাত্রার আসরে সে বেহুশ হয়ে পড়ল একদিন। অভিনয়ের শিক্ষানবিশির সূচনাতেই তার অভিনেতা-জীবন বিষিয়ে দিল সেই ঘটনায়।

প্রম্পটিং ঠিক ঠিক শুনে সেটা সঠিকভাবে ওগরাতে পারাটাই নবিশ (কিংবা নডি)দের অভিনয়-পটুতার গোড়ার কথা। নহুসের প্রেতাত্মা কাঁদিহে এই কথাটা বলতে গিয়ে সে বলেছিল বেহুশের প্রেতাত্মা কাঁদিছে। কথাটা নাকি ঠিক হয়নি। কিন্তু কেন যে হয়নি তা তার বোধগম্যের বাইরে। যাত্রাদলের অধিকারীকে সে তর্ক করে বোঝাতে গিয়েছিল যে, নহুস মানেও যা বেহুশ মানেও তাই। ওটা বলায় তার কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি, তারতম্য হয়নি এমন কিছু প্রেতাত্মার কোনো হুশ থাকবার কথা নয়, এইটেই এখানে আসল কথা।

অধিকারী আর কথা না বাড়িয়ে পত্রপাঠ আসর থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন তাকে।

আসর থেকে সরে আসতে হলেও অভিনয় থেকে সরবে না এই হচ্ছে তার প্রতিজ্ঞা। যে মাটিতে পড়ে লোক ওঠে তাই ধরে—এই অভিনয় ধরেই সে উঠবে, বাঁচবে, বিখ্যাতও হবে হয়তো বা কোনোদিন।

না, মুক্তাঙ্গনেই সে অভিনয় করবে এর পর থেকে। মুক্তাঙ্গন রঙ্গমঞ্চে নয়, পৃথিবীর মুক্ত অঙ্গনে।

কিন্তু কিছু টাকা তো চাই। পকেটে একটা কানাকড়িও নেই। অধিকারী তো মাইনে না দিয়েই ভাগিয়েছেন। কলকাতার পথে-ঘাটে ঘোরাফেরা করতেও পয়সা লাগে—ঘোরালো অভিনয়ের কথা তো পরে। পৃথিবীর অঙ্গন চারধারেই বিমুক্ত বটে, কিন্তু একটা টাকা ধার দেবার লোক কোনোবারেই নেইকো।

অগত্যা, সে তার এক কম্পাউণ্ডার বন্ধুর কাছে গিয়ে, না, কোনো টাকাকড়ি নয়, এক ফালি ব্যাণ্ডেজ মাত্র ধার চাইল কেবল। তারপর তার সাহায্যেই সেইটে নিজের মাথায় বেঁধে নিয়ে একটা নামকরা হাসপাতালের গেটে গিয়ে গাট হয়ে বসল সে।

একটু পরেই এক পথচারী এইভাবে ম্লানমুখে তাকে সেখানে বসে থাকতে দেখে সদয় হয়ে শুধালেন, কী হে! হাসপাতালে অ্যাডমিশন পাওনি বুঝি?

না স্যর। সেরে যাবার পর তারা বার করে দিয়েছে আজ আমায়।

হয়েছিল কী? কী করে চোট লাগল তোমার মাথায়?

আজ্ঞে, ট্রাম থেকে পা ফসকে পড়ে গিয়ে মাথা ফেটে গেল আমার। কার, স্বরে সে জানায়।

বিচিত্র নয়! যা ভিড় বাপু ঐ ট্রাম-বাসে আজকাল। ঝুলতে খুলতে যেতে একদিন আমিও তো প্রায় পড়ে যাই আর কি! পড়ে গেলে আমারও ঠিক ঐ দশাই হতো। কি, মারা যেতাম কিনা তাই বা কে বলবে! বলতে গিয়ে শিউরে উঠলেন ভদ্রলোক। তা, এখানে বসে আছো কেন এমন করে? বাড়ি যাও।

আজ্ঞে, ছাড়া পেয়েছি বটে, কিন্তু বাড়ি যাবার গাড়ি ভাড়া তো কাছে নেই, তাই… বলে সে চুপ করে বসে থাকে।

বাড়ি কোথায় তোমার?

খিদিরপুরের দিকটায়, সেই মোমিনপুরেই। আনা চার পাঁচ পেলেই আমি ট্রামে কি বাসে চেপে চলে যেতে পারি।

আবার ট্রাম! এই ব্যাণ্ডেজবাঁধা মাথা নিয়ে—অ্যাঁ? ফের সর্বাঙ্গ-শিহরণ হলো দ্রলোকের : এবার পড়লে আর তোমার বাঁচন নেই বাপু! তুমি বরং একটা ট্যাকসি নিয়ে চলে যাও তার চেয়ে।

পুলকেশ কোনো জবাব দেয় না। তাকে যেন আরো বেশি ম্লান দেখায়। আরো যেন সে দমে যায় কথাটায়।

মোমিনপুর যেতে হলে কত পড়বে ট্যাসিতে? যাইনি কখনো তো। আচ্ছা, এই নাও, পাঁচ টাকা ধরো। সদয় ভদ্রলোক পুলকেশের অনিচ্ছুক হাতে নোটখানা ধরিয়ে দিয়ে বলেন, নাও, নিতে কোনো কুষ্ঠাবোধ কোরো না। তুমি আজ আমায় খুব শিক্ষা দিয়েছ ভাই! তোমার দশা আমারো তো হতে পারত কোনোদিন। বাঁচিয়ে দিয়েছ তুমি আমায়। তার বিনিময়ে এই সামান্য পাঁচ টাকা মাত্র তোমায় দিলাম…না, আমি আর কোনোদিন ওই ট্রামে বাসে চাপছি না। অন্ততঃ ভিড়ের সময় ওই ভাবে ঝুলতে ঝুলতে তো কখনই নয়।

রোমাঞ্চিত হতে হতে বিদায় নিলেন ভদ্রলোক।

অন্তরে পুলকিত হলেও পুলকেশ আরও বেশি বিষণ্ণতর হয়ে বসে রইল। সেইখানেই। তার পরেও।

একটু পরে আরেক শিকার এসে পড়ল তার অভিনয়ের আসরে। তাঁকে তেড়ে গিয়ে ধরতে হলো না, তিনিই নিজগুণে ধরা দিলেন তার ফাঁদে।

সব শুনেটুনে একটা টাকা তার হাতে দিয়ে বললেন—নাও, বাড়ি যাও এবার। তার আগে কোথাও কিছু খেয়েটেয়ে নিয়ে, কেমন? তোমার ট্রামভাড়ার চাইতে কিছু বেশিই দিলাম সেইজন্যে।

এই করে এক বেলায়ই তার মন্দ রোজগার হলো না। তারপর রোদ একটু চড়ে উঠতেই চাড়া দিয়ে উঠল সেভার ভার মুখ ফেলে…বেশ ভার ভার পকেট নিয়ে।

সেরা এক হোটেলে গিয়ে খানাপিনা সেরে একটা সিনেমা দেখতে বেরিয়ে পড়ল পুলকেশ। মনের পুলকেই!

এমনি করে খোশখেয়ালে চলতে লাগল খাসা তার। দিনের পর দিন এই অভিনয় করেই।

ভালো ব্যবসা ফেঁদেছে সে! পালাযার আপিস থেকে বিদায় নিয়ে পালা করে নিত্য, নতুন এই যাত্রার পালা তার—শহরের বিভিন্ন আরোগ্যশালার মুক্তাঙ্গনে। অভিনয় নিয়ে ব্যবসা করে অনেকে, ব্যবসার অভিনয়ও করে বিস্তর-জনা, কিন্তু অভিনয় আর ব্যবসা একাকার করে একাধারে এই টু পাইস উপায় করতে একমাত্র সে-ই পেরেছে।

এই ব্যবসায় বাড়তি খরচাও নেই এখন। আপিস ভাড়া, কর্মচারীর বেতন ইত্যাদি লাগে না। হাসপাতাল বানিয়েছেন সরকার বাহাদুর, তার সামনের ফুটপাথ সবাইকার, সেই ফাঁকা ফুটপাথেই তার আপিস খোলা। ইস্টাব্লিশমেন্ট খরচা কিছু নেই, আর ওভারহেড এপেন, সধরতে গেলে, মাথার এই ব্যান্ডেজ।

এই মূলধন নিয়েই তার ফলাও কারবার।

মাথার ব্যাণ্ডেজটা কেবল পরিষ্কার করতে হয় মাঝে-সাঝেযাতে হাসপাতালের টাটকা-ছাড়া-পাওয়ার মতই তাকে দেখায়। সার্ক কিংবা লা পাউডার দিয়ে সাফ করতে হয় দু তিন দিন অন্তর—নিজের পক্ষে এইটুকুই তার সাফাই-এতখানিই মেহ্নত। তারপর দিনভোব এনতার লাক্সারি। রেস্তরাঁয় খাও, সিনেমায় যাও—ইতস্ততঃ গতিবিধি করো তোমার প্রাণ চায়।

হাসপাতালও কিছু কম নেই কলকাতায়। সরকারী বড় বড় হাসপাতাল কয়েকটা তো রয়েছেই, তাছাড়াও, শহরের এখানে সেখানে আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে বেসরকারী হোট মাঝারি আরো অনেকগুলো। দৈনন্দিন তার যাত্রাপালা পালটে পালা করে সেইসব মুক্তাঙ্গনের আসরে গিয়ে বসলেই হলো। শহরে সহৃদয় বোকা লোকের অভাব নেই বিশেষ।

নতুন নতুন ভূমিকায় নব নব রূপ ধরে অভিনয় করার প্রয়োজন সে অনুভব করেনি। একই দর্শক বা দাতার দুবাব দর্শনদানের সম্ভাবনা বিরলই ছিল। কলকাতার রাস্তায় নিজের তাড়াহুড়ায় ব্যস্ত সবাই! কে কার দিকে নজর দেয়? কে কাকে মনে করে রাখে? তাছাড়া তার নিজের নজব বেজায় সাফ, একব্যক্তিকে দুবার দোহন করে ধরা পড়ার ভয় ছিল না তার। এই বিরাট শহরে পঞ্চাশ লাখ লোক, একজনের ওপর দুবার কোপ মাবে এমন ব্যাড লাক হবার সাধ্য কি? বকরিদ-পরবের পরদিন কোন মুর্গি কি বরি-র বেঁচে থাকার মতই সেটা অবাস্তব।

শহরের প্রান্তে প্রান্তে তার অজান্তে ছোটখাট আরও কতো শিকারক্ষেত্র রয়ে গেছে। অচেনা এলাকায় ঘুরতে ঘুরতে একদিন এমনি একটা নজরে পড়ে গেল তার। প্রথমে সে খেয়াল করেনি, কিন্তু তার সামনে দিয়ে একটা অ্যাম্বুলেন্স গাড়ি সেখানে গিয়ে সেঁধুতেই সে ঠাওর করে দেখল, হ্যাঁ, একটা হাসপাতাল গোহেরই তো বটে ওই বাড়িটা।

ব্যান্ডেজ মাথায় বাঁধাই ছিল তার, শীর্ষদেশে তাই নিয়ে সে ঘুরে বেড়াত আজকাল, কোথায় কী তাক লেগে যায় কখন। কলকাতার পথেঘাটে তো টাকা ছড়ানো; ভালো করে তাকালেই হয় একবার। কিন্তু কোনো হাসপাতালের সামনে ছাড়া আর কোথাও কারো কাছে তার ওই মাথা খেলিয়ে সে হাত পাতে না যেও। বড়ো বড়ো গাইয়ে আসরের বাইরে গায় নাকি কখনো? অভিনয়সজা মাথায় আর অভিনয়বৃত্তি তার মজার। ভাবল, এই ফাঁকে একটুখানি বসে এখানে দু পয়সা উপায় করে নিলে মন্দ কী?

বসেহে খানিকক্ষণ, এমন সময় এক ভদ্রলোক হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন তার কাছে এসে-এখানে এমন করে বসে আছে যে বাপু?

আজ্ঞে, এই হাসপাতাল থেকে আজ ছাড়া পেয়েছি কিনা, বাড়ি যাবার গাড়িভাড়া কাছে নেই আমার, তাই…।

ও! সেইজন্যেই? তা কদ্দিন ছিলে এখানে?

দিন পনেরো থাকতে হয়েছে মশাই। ট্রাম থেকে পড়ে গিয়ে মাথাটা দু ফাঁক হয়ে গেছল আমার!

বটে? বলে অদূরে কী যেন দেখতে পেয়ে একটু আশান্বিত হয়েই তিনি বললেন-আচ্ছা, তোমার বাড়ি যাবার ব্যবস্থা আমি করে দিচ্ছি এক্ষুনি।

একটা পুলিস ভ্যান যাচ্ছিল এখন সেখান দিয়ে সেই সময়। হাত বাড়িয়ে গাড়িটাকে থামিয়ে, কাছে গিয়ে কী যেন তিনি বললেন তার ড্রাইভারকে।

যাও, ওঠোগে। ও-ই তোমায় বাড়িতে পৌঁছে দেবে এখন। পয়সা লাগবে না।

উঠতে হলো পুলকেশকে। নিখুঁত অভিনয়ের প্রয়োজনেই উঠতে হলো। অভিনয়ে যেমন প্রবেশ আছে, অবস্থান আছে, তমনি তার অঙ্গহিসেবে প্রস্থানও রয়েছে যে। অভিনয় সবাঙ্গীণ করতে হলে সেটাকে বাদ দেওয়া যায় না।

থানায় যেতেই যেন হাসির ধুম পড়ে গেল তাকে নিয়ে। বড় দারোগা মেজ দারোগা ছোট দারোগা সবাই হাসলেন খুব খানিক। এত হাসাহাসি তার খারাপ লাগলো তার। হাসপাতালেব সদ্য ছাড়া পাওয়া মাথায় চোট খাওয়া হতভাগ্য এক রুগী—তাকে দেখে এমন হাসবার কী আছে! হাসির অভিনয় তো করছিল না সে, করুণ-রসের ভূমিকাই তো ছিল তার। কিন্তু এই হাসির ধাক্কায় তা যেন ভূমিসাৎ হবার যোগাড়! পুলিসের লোকের কোনো রসকস নেই বলে যে, তা মিথ্যে নয়। সত্যি, এমন হৃদয়হীন হয় তারা যে…

হাসির চোট থামলে একজন তাকে জিজ্ঞেস করলেন—এমনধা, গর্ব করা তোমার ঠিক হয়নি বাপু হে! এই গর্ব তোমার কতদিনের?

গর্ব! কিসের গর্ব স্যর? কাঁচুমাচু হয়ে সে জানতে চায়।

পুরুষমানুষের কি গর্ব করা সাজে ভাই? এমনধারা গর্ব করা কি উচিত হয়েছে তোমার? সত্যি, তুমিই বলো না! আরেকজনের তলব।

আমি তো কোনো গর্ব করিনি হুজুর। তার করুণ সুর আরো যেন করুণতর শোনায় কেমন।

করোনি তো ওখানে মরতে গিয়েছিলে কেন? আবার এক চোট হাসি।

এই গর্বটা তোমার কতদিনের হে? শুনি তো একবার। আরেকজনের জিজ্ঞাসা। আরেক হাসির ধুম।

আমার গর্ব! গর্ব কোথায় দেখলেন স্যর আমার?

ছি ছি ছি! গর্ব কেবল মেয়েদেরই শোভা পায়…তুমি পুরষ-মানুষ হয়ে এই গর্ব করতে গেছ…সাতপুরুষে এমন কাণ্ড দেখিনি শুনিনি। বলেন ওসি পুলকেশকে : ভিক্ষে করবে করো কিন্তু তাই বলে কি কেউ বৃথা গর্ব করে ভিক্ষে করে নাকি?

ঠিক কথা সার। ভিখিরির আবার গর্ব কিসের। সায় দেয় সে তাঁর কথায়: গর্ব করেও ভিক্ষে করতে নেই, ভিক্ষে করেও গর্ব করা ঠিক নয় কারণ ভিক্ষে করাটা। গর্বের কিছু নয়।

তোমার এই গর্বটাই তোমার এই পতনের কারণ হলো, বুঝেছ?

পতনের কারণ হলো? পুলকেশ শুনে অবাক হয়।

তিনি জানানঃ হ্যাঁ, এর জন্যে হাজতে তো যাচ্ছই এখন–হয়তো বা জেলে যেতেও হতে পারে।

জেল! জেল কিসের জন্যে হুজুর? এবার যেন সে চমকে ওঠে: গর্ব করলে পতন হয় জানি, কিন্তু তাই বলে কি জেল? তাছাড়া, আমি যখন মোটেই কোনো গর্ব করিনি….

গর্ব করলে পতন হয় এটা যখন জানো…

অন্য একজন অফিসার মাঝখান থেকে ফোড়ন কাটেন—মেয়েদের বেলা অবশ্যি পতন বার পরই গর্বটা হয়ে থাকে…

তখন এটাও তোমার জানা উচিত ছিল যে, অধঃপতনের শেষ সীমায় জেল ফাটক অনিবার্যই।

গর্ব দূরে থাক আমি গর্বের কোনো ভানও করিনি স্যর…তবুও সে বলতে চায়।

আরে, গর্ব যদি তোমার নাই হয়ে থাকে তাহলে ওই বাড়িটার ধারে কাছে গিয়েছিল। কেন? দশ মাসের গর্ব হলেই তো যায় ওখানে কেউ…

তোমার এই গর্বটা ক মাসের ছিল হে? অন্য একজনের ওপর-টিনী। —নাকি তোমার গর্বপাতের জন্যেই গিয়েছিলে সেখানে?

গর্বপাতের কথাটায় পুলকেশের কোথায় যেন খটকা লাগে কেমন। ভাষাটা যেন কেমনতরো। তব সে খট করে কিছু বুঝতে পারে না। ওর গর্ভে আরো যে কী নিহিত আছে তার কোনো আঁচ পায় না সে। কিন্তু না আঁচালে, সে যে বিচ্ছিরি কিছু করে বসেছে তা সে বিশ্বাস করবে কী করে? তবু কিছু টের না পেয়েই সেই নাটের মধ্যে আরো সে এগিয়ে যায়

আপনারা গর্ব গর্ব বলছেন বটে হজুর কিন্তু আমি তো নিজের কোনো গর্ব দেখতে পাচ্ছি না। গর্ব কাকে বলে—গর্বের মানে কী, তাই আমি জানি না এখনো।

গর্ব কাকে বলে জানো না? বলে তিনি নিজের বিপুল উঁড়ির দিকে তার নজর টানেন—এই যে! এই হচ্ছে এর মানে। তুমি এটা জানো না?…একেই বলে থাকে গর্ব।

আপনার গর্বের কারণ আছে। আপনি পদস্থ কর্মচারী, আপনার গর্ব হতে পারে কিন্তু আমি সামান্য নগণ্য লোক, এহেন কথা বলে এমন করে আমায় অপদস্থ করা আপনাদে উচিত নয় কখননা। দয়া করে তা করবেন না স্যর। এই আমার বিনীত অনুরোধ।

পুলকেশ বিনয়ে গলে পড়লেও দারোগাবাবুদের আদৌ পুলকিত দেখা যায় না। তিনি খাপ্‌পা হয়ে ওঠেন—কী গর্ব গর্ব করছো তখন থেকে! গর্ব কাকে বলে জানো না? গর্বের মানে কী, তাও বুঝি তোমার জানা নেই? গর্ব বানান করতে পারো? নাকি, তাও একদম জানো না?

আচ্ছা গাধা তো! অপর দারোগার টিটকিরি : নাকি গাধা সেজে ন্যাকামো করা হচ্ছে এখানে।

লম্বকর্ণটাকে আচ্ছা করে ধোলাই দিয়ে ভাগিয়ে দিন স্যর। এই পাগলের নামে কেস করে আর কী হবে? কোর্টে পাঠালে তো সেখানে হাসাহাসি পড়ে যাবে একচোট। আর এমন অপদার্থকে পাঠানোর চোটটা শেষে সামলাতে হবে এই আমাদের।

লম্বকর্ণ-গালটায় পুলকেশের প্রাণে লাগে। কানে সে একটুখানি খাটো হতে পারে, কিন্তু তাই বলে তার কানকে সম্মা বলা, কেবল তার কানেরই নয়, তার নিজেরও যেন মানের লাঘব। দস্তুরমন মানহানি।

কিসের কেস হুজুর? সে জানতে চায় : কেন আমায় দায়রায় সোপর্দ করবেন? কিসের দায়ে? আমি তো কোনো কসর করিনি আপনাদের কাছে।

চিটিং কে। আবার কিসের দায়? চিটিং চার্জ রয়েছে তোমার নামে। চিটিংবাজি করলে জেলে যেতে হয় তা জানো না?

চিটিংঝজি? কাকে আমি চিট করতে গেলাম স্যর? এবার সে দস্তুরমতই হতভম্ব হয়।

কেন পাবলিককে। গর্বের কোনো কারণ না থাকলেও গর্ব করা–গর্ব বানিয়ে ভিক্ষে করা—সেটা কি একটা চিটিংবাজি নয়? নয়তো কী তাহলে?

এখনো আমি মুক্তকণ্ঠে বলছি স্যর, কারো কাছে আমি কোনো গর্ব করিনি।

ফের গর্ব গর্ব করছে, গর্ব বানান করো তো…

গ আর ব-য়ে রেফ…

গ আর ব-য়ে রেফ? আস্ত একটা গবেট তুমি…। তারপর তিনি প্রাঞ্জল করেন? গ আর ভ-য়ে রেফ দিলেই গর্ভ হয়। মেয়েদের হয়ে থাকে। পুরুষদের কখনই হয় না, হতে পারে না। তুমি যে-হাসপাতালের সামনে গিয়ে বসেছিলে, যেখান থেকে খালাস পেয়েছে বলছিলে তুমি, মেয়েরাই সেখানে গিয়ে থাকে কেবল। সেখানে গিয়ে খালাস হয়; দশ মাস হলেই যায়…এই এমনিতরটা হলেই…

বলে আবার তিনি নিজের সুবিপুল সুবিন্যস্ত খুঁড়ির দৃষ্টান্তে নিজেকে উদাহরণস্থল করেন।

থানায় এসে, অ্যাদুর এগিয়ে, এতক্ষণ পরে জানল পুলকেশ—যে কথা ঘুণাক্ষরেও জানা ছিল না তার নিজের প্রয়োগনৈপুণ্য প্রকট করে অভিনয়শিল্পের solo-কলা দেখাতে গিয়ে যেখানে সে আজ বসেছিল, হাসপাতাল হলেও আসলে সেটা একটা মেটার্নিটি হোম।

গব্‌বোযন্ত্রণা আর কাকে বলে?

শূন্যমার্গ

আমি পাকিস্তানী। আদাব করে জানালেন তিনি আমায়—আমি একজন শিয়া…

আমিও বেয়াদবি করলাম না, সালাম জানিয়ে বললাম—জানি। আপনাদের মধ্যে যে দুটি সম্প্রদায়—শিয়া আর সুন্নী তা আমার অজানা নয়।

না। সেদিক থেকে আমি সুন্নী। বললেন ভদ্রলোক : আপনি সাংবাদিক তো? অনেক খবর রাখেন, অনেকের খবর রাখেন। পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসেছি আমি কী কারণে তা বলছি—এখানে উঠেছি এই আপনাদের এলাকাতেই, ঠনঠনের পাশে ওই কলাবাগানের বস্তিতে। আপনি কাছাকাছি থাকেন জানতে পেরে খোঁজ নিতে এলাম…আপনার কাছেই খবরটা পাব বলে আমি আশা করি।

পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসেছেন? আমিই উল্টে খোঁজ করলাম–কিন্তু কেন? যদ্দুর জানি সেখানে তো অ-হিন্দুদের ওপরে তেমন কোনো অত্যাচার হয় না।

ব্যাপারটা বলি শুনুন তাহলে। তিনি শুরু করেন। আমি পূর্ব বাংলার মুসলমান। একজন বৈজ্ঞানিক। নিউক্লিয়ার ফিজিকস্ নিয়ে গবেষণা হচ্ছে আমার। অ্যাটম বম-টম নিয়ে মাথা ঘামিয়েছি বহু। কিন্তু সে কথা থাক, একটা জরুরি প্রয়োজনে আমাকে রাওয়ালপিণ্ডির সরকারী দপ্তরখানায় যেতে হয়—বিশেষ একটা আর্জি নিয়ে। সেখান, থেকে আমাকে পাক-বাহিনীর কমাণ্ডার ইন চীফ-এর কাছে পাঠিয়ে দিল তারা…।

জেনারেল মুসো না মেসো কে যেন সে? আমি শুধোলাম।

আপনার মেসো কি মুসো তা জানিনে, তবে মাসি যে নয় তা হলফ করে বলতে পারি মশাই। ইয়া ইয়া লম্বা-চৌড়া গোঁফ রয়েছে জনাবের।

বটে! বলেই আমার মনে পড়ল, পাকিস্তানের জেনারেল ইয়া-ইয়ার নামটা যেন শোনা আমার।

…এত্তেলা দিয়ে ঢুকলাম জেনারেলের কামরায়। বলতে লাগলেন পাকিস্তানী বিজ্ঞানী। তিনি সেখানে একলাই ছিলেন তখন। প্রকান্ড এক টেবিলের সামনে বসে নিজের গোঁফে তা দিচ্ছিলেন এক মনে। আমাকে দেখে তা থামিয়ে হাত বাড়িয়ে বললেন—বলুন, কী করতে পারি আপনার জন্যে? বাংলায় নয়, চোস্ত উর্দুতেই বললেন কথাটা। বাঙালী হলেও এবং উর্দু তেমন ভালো কইতে না পারলেও বুঝতে পারি মোটামুটি রম।

তার কথার জবাবে আমার নক্সার খোলটা আমি তাঁর টেবিলের এক পাশে রাখলাম। তিনি শুধোলেন—চীজটা কী? আমি বললাম, জনাব, এটা একটা গোপনাস্ত্রের নক্সা। এই অস্ত্রের সাহায্যে এক চোটে কলকাতা, দিল্লী, বোম্বাই উড়িয়ে দেওয়া যায়। ইয়াল্লা! ই কভি হো শকতা শুনে তিনি যেন আঁতকে উঠলেন মনে হলো।

আপনার কথায় শক পেলেন মনে হয়? আমি বলি।

হতে পারে। তখন আমি তাঁকে পরিষ্কার করে জানালাম। আমার আবিষ্কারের কাছে। রুশ-মার্কিনের ঐ অ্যাটম কমও একেবারে কিছু না।

আমার কথায় হাসতে লাগলেন জেনারেল—কী সব আজে বাজে বকছেন। ওদের আণবিক হাতিয়ারের ধারে কাছে আগামী দুশো বছরের ভেতর কাউকে আর আসতে হবে না। এমন কি আমাদের পরম দোস্ত ঐ চীনকেও নয়।

ঠিকই বলেছেন জনাব। কী করে আসবে। ওঁর কথায় সায় দিতে হলো আমায়—সেই সব দেশে তো এই বান্দার মত কেউ পয়দা হয়নি এখনো। এহেন অস্ত্রের আইডিয়া তাদের মগজেই আসেনি এখন তক।

বলে আমার নক্সার রোলটা খুলে তার টেবিলের ওপরে বিস্তারিত করে দিলাম তখন…তিনি নাক সিঁটকে তাকালেন তার ওপর।

আমি বললাম-এটা হচ্ছে, বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় প্রজেক্ট-জে। জে মানে আমি। আমার নাম জালালুদ্দিন। তাই আমার নামেই এটার পেটেন্ট। বলে আমি অস্ত্রটির সব বিষয় বিশদ করে তাঁর কাছে ব্যাখ্যা করতে লাগলাম।

শুনতে শুনতে তাঁর উৎসাহ জাগল। তিনি আগ্রহের সঙ্গে আমার কথার সঙ্গে মিলিয়ে নক্সাটার সব কিছু লক্ষ্য করতে লাগলেন। প্রজেক্ট-জেকে আরও বিস্তারিত করতে হলো আমায় তখন—সবটা খুলে টেবিলের ওপরে ছড়িয়ে দিলাম। টেবিল ছাড়িয়ে গেল নক্সাটা। তখন তিনি নক্সাটা নিয়ে মেজের কার্পেটের ওপরে বিছিয়ে নিজে তার ওপরে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন।

আধঘণ্টা ধরে নক্সাটার আগাপাশুলা সব কিছু দেখে শুনে বুঝে নিয়ে তিনি খাড়া হয়ে দাঁড়ালেন। আমার করমর্দন করে অভিনন্দন জানিয়ে বললেন—বাহাদুর আপনি! আপনার এই নয়া হাতিয়ারটা অদ্ভুত বটে সত্যিই…

হা। একচোটে দিল্লী কলকাতা বোম্বাই উড়িয়ে দেবার কিম্মত রাখে।

তা রাখে। তবে সেইখানেই যা একটু…তা সে কথা যাক। এর জন্যে কত দিতে হবে আপনাকে? দশ হাজার।

দশ? দশ কি বলছেন জনাব? একশ বলুন। বলে আমার প্ল্যান আমি গুটিয়ে নিলাম।

পঞ্চাশ হলে হয় না?

পঞ্চাশ! মাত্র পঞ্চাশ হাজার? বলেন কী জনাব? হিন্দুস্থানের মতন এক দুশমনকে রস্ত করতে মাত্র মোটে পঞ্চাশ হাজার? আমি পাঁচ লাখ টাকা পাবার আশা করে এসেছিলাম। পাঁচই আমার চাই, তার কমে ছাড়ব না।

আড়াই লাখ। বললেন তখন তিনি।

অলরাইট। আমি রাজি। বলে নক্সটা তাঁর হাতে আমি সঁপে দিলাম।

জেনারেল আড়াই লাখের একখানা কে লিখে আমার হাতে দিয়ে বললেন– এটা ট্রজারিতে জমা দিলেই ভাঙিয়ে দেবে। বলে তিনি আমার করমর্দন করলেন আবার।

করমর্দনের ফাঁকে আমি চেকের ওপরটায় চোখ বুলিয়ে দেখে নিয়েছি শূন্যিগুলো তিনি ঠিক ঠিক দিয়েছেন কিনা। না, পঁচিশের পর…পর চারটে শূন্যই রয়েছে বটে, দেখা গেল।

দরজা পর্যন্ত এগিয়ে আমাকে বিদায় দেবার আগে তিনি বললেন–আবার যদি এমনি বড়িয়া কিছু আবিষ্কার করতে পারেন, একটুও বিলম্ব না করে সোজা চলে আসবেন এখানে। আমরা উচিত মূল্যে তা কিনে নেব। এমনধারা যদি কিছু থাকে আপনার আর…।

আছে আমার। আমি জানালাম।

আছে আপনার?

আমার কাছেই আছে। বলে আমার ব্রিফ কেসটা খুলে আরেকটা নক্সা বার করলাম। -এ হাতিয়ারটা প্রজেক্ট-জের চেয়েও জববর।

সন্দিগ্ধ নেত্রে তাকালেন জেনারেল-তা কি কখনো হতে পারে? যেরকম বুঝলাম, এবং আপনি বোঝালেন তাতে মনে হলো প্রজেক্ট-জের ওপরে আর কোনো কথা নেই।

আছে বই কি! বিজ্ঞানের শেষ কথা কি কেউ বলতে পারে কখনো? আবিষ্কারের কি ইয়ত্তা আছে? বলে আমার নতুন নাটাকের চোখের সামনে মেলে ধরলাম—এটি হচ্ছে প্রজেক্ট-এম। প্রজেক্ট জালালুদ্দিনের সঙ্গে মোলাকাত করার এক্তিয়ার রাখে বলেই এর নাম প্রোজেক্ট-এম।

বটে? এর কেরামতিটা শুনি তো একবার?  শুধালেন জেনারেল তখন।

প্রজেক্ট-জের চেয়েও দ্রুতগতিতে যাবার ক্ষমতা আছে এর। ঐ প্রজেক্ট-জে তার টারগেটে গিয়ে পৌঁছবার আগেই এ গিয়ে শূন্য পথেই তাকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দেবে।

তাজ্জব! বলে খানিকক্ষণ তিনি হাঁ হয়ে রইলেন, তারপর বললেন-ও জিনিসের আমাদের দরকার হবে বলে আমি মনে করি না। কেননা, এই প্রজেক্ট-জের মতই কেউ কিছু বহুদিন বানাতে পারবে না, তারপরে তো তার সঙ্গে মোলাকাতের কথা।

ঠিকই বলেছেন জনাব। বললাম আমি তখন-কিন্তু লড়াইয়ের কায়দাকানুন নিশ্চয়ই আপনার জানা আছে—আমার চেয়ে ঢের ভালোই জানেন আপনি জনাব যে, যতক্ষণ সেই হাতিয়ারের জবাব আপনার হাতে নেই ততক্ষণ তা ব্যবহার করতে যাওয়াই উচিত নয় আপনার। কেননা, অপর পক্ষের হাতে আপনার সেই হাতিয়ারের জবাব থেকে যেতেও পারে হয়তো বা।

ইয়াল্লা! জেনারেলের মুখ অতঃপর আর আগের মতন মোলায়েম রইল না, দারুণ গভীর হয়ে গেল এবার–তার মানে, তোমার জাহান্নামের ঐ মোলাকাতও আমাকে হাত করতে হবে, নইলে হয়তো তুমি ঐ প্ল্যান অপর পক্ষকে গিয়ে বেচবে।

আমি তাঁর কথায় কোনো প্রতিবাদ না করে চুপ করে রইলাম। তিনিও চুপচাপ—অনেকক্ষণ। এই নীরবতার ভেতর নিজের গোঁফের দুই প্রান্ত তিনি চিবুতে লাগলেন চটেটে।

অবশেষে গুম্ফ চর্বণ থামিয়ে আরেকটা চেক লিখলেন তিনি—আড়াই লাখের।

আমার হাতে চেকটা দিয়ে তিনি বললেন—চলুন, এবার আমাদের অফিসারস ক্যানটিনে গিয়ে একটু খিনপিনা করা যাক এখন। এক কাপ কফি অন্তত।

লম্বা করিডর ধরে যাবার পথে একটা বিরাট হলঘরের সামনে এসে আমরা দাঁড়ালাম। ইস্পাতের কলাপসিবল গেট ছিল হাটার। জেনারেল দেওয়ালের একটা বোতাম টিপতেই গেটটা দুক হয়ে সরে গেল দুধারে। যমদূতের মতন দুজন লোক ভেতর থেকে বেরিয়ে এল। এসেই পাকড়ালো আমাকে।

একি! এরা আমায় ধরছে কেন হুজুর? ছেড়ে দিতে বলুন এদের! চেঁচিয়ে উঠেছি আমি।

আমার জবাব না দিয়ে তিনি লোক দুটোকে বললেন-হুঁশিয়ার! হরবখৎ নজর রাখতে হবে লোকটার ওপর। যেন পালাতে না পারে। তবে ভদ্রলোকের কোন তলিফও যাতে না হয়। খানাপিনা গোসল উসলের বিলকুল সুবন্দোবস্ত চাই। ইনি এখানে বরাবরের জন্য আমাদের মেহমান-সম্মানিত অতিথি। খেয়াল থাকে যেন।

চিরদিনের জন্য কয়েদখানায় পুরছেন আপনারা আমায়? কিন্তু কেন? কী ক্ষতি করেছি আমি আপনাদের? আমি তো আপনাদের ভালোর জন্যই…।

আমার কথা শেষ হতে পেল না, মোক্ষম জবাব পেলাম আমার কথার—আপনি ভয়ঙ্কর লেক। বললেন তিনি—আপনার মত মানুষকে বাইরে রাখা মোটেই নিরাপদ নয়। পাকিস্তানের স্বার্থেই আপনাকে এইভাবে ইনটার্ন করতে হচ্ছে আমায়।

কিন্তু আমি তো পাকিস্তানের স্বার্থেই…আমার এই আবিষ্কার তো পাকিস্তানের স্বার্থেই দিতে চেয়েছিলাম জনাব। আমাকে কয়েদ করে…আমার এই প্রজেক্টগুলি নিয়ে আপনারা কী করবেন?

কিচ্ছু করব না। তিনি আশ্বাস দিলেন আপনার কোনো ভয় নেই। এসব কোননা কাজেই লাগাবো না আমরা কাজেই লাগবে না আমাদের।

সে কী! দুষমন হিন্দুস্থানকে জবেহ করতে হলে…।

কে চাইছে জবেহ্ করতে? হিন্দুস্তান না থাকলে আমরাই কি থাকব? হিন্দুস্তানের আকাশ বাতাস যদি আণবিক বোমার ঘায় ঝলসে যায় তো তার আঁচে কি আমরাই বাঁচব? তা কি আমাদের পাকিস্তানকেও লাগবে না? একই বাতাস পূর্ব থেকে পশ্চিমে বইছে। পশ্চিম থেকে পূবে। একই নদীর জলধারায় দু দেশের মাঠে ফলছে ফসল। না না, হিন্দুস্থানের ধ্বংস আমরা চাই না। তার সঙ্গে লড়াই করেই আমরা বাঁচতে চাই বরাবর। কিন্তু হিন্দুস্থান যদি না থাকে তো লড়ব কী নিয়ে, লড়াই করব কার সঙ্গে? মিলিটারি ডিপার্টমেন্টই উঠে যাবে, আমাদের চাকরি বিলকুল খতম্।

তিনি আদাব জানিয়ে বিদায় নিতেই তারপর সেখান থেকে ছাড়ান পাবার জন্যে সেই যমদূত দুটোকে চেক দুখানা আমি ঘুষ দিয়েছি। সেখান থেকে বেরিয়ে সোজা চলে গেছি দিলীতে। যদি হিন্দুস্থানের প্রতিরক্ষা দপ্তরে বেচতে পারি আমার প্রজেক্ট। আরো চড়া দামে গহানো যায় যদি তাদের। কিন্তু না, দিল্লী আমায় হতাশ করেছে। সেখানকার কর্তাদের কারোই এ ব্যাপারে কোনো গা দেখা গেল না। আমার কোনো প্রজেক্ট সম্বন্ধেই আঁরা। আগ্রহী নন।

মা জালালুদ্দিন—না মোলাকাত? আমি শুধালাম।

না। এই জালালুদ্দিন মিঞা সবার সঙ্গেই মোলাকাত করেছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী—কিন্তু…কিন্তু কী আর বলব!

কাউকেই কাত করতে পারেননি? আমি বললাম।

একদম না। পাকিস্তানী জেনারেল তবু তো আমার প্রজেগুলি খুটিয়ে দেখেছিলেন, ঐবা একেবারে তাকাতেই চাইলেন না। নক্সটা খুলতেই দিলেন না কেউ। সবার মুখেই এক কথা। আমরা পাকিস্তানের ধ্বংস চাই না, তার শ্রীবৃদ্ধিই আমাদের কাম্য, তাদের সঙ্গে নিরচ্ছিন্ন শান্তিতে সহাবস্থান করতে চাই আমরা। একজন তো দস্তুরমত সদুপদেশই দিলেন আমায়। বললেন, আপনার এসব পাগলামি ছাড়ুন, এ পথ ভালো নয়।

এই কথা বললেন?

শুনুন কথা! বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারকে, বিজ্ঞানের জয়যাত্রাকে বলে কিনা পাগলামি? যাক, এখানে কেউ আমায় গারদে দেবার চেষ্টা করেনি এটাই ভালো বলতে হবে। …বোধ হয় সেটা গণতন্ত্রের গলদ।…তারপরেই আমি সেখান থেকে চলে এসেছি এই কলকাতায় …দিল্লীর থেকে সটান।

উঠেছেন আমাদের কলাবাগানের বস্তিতে? আমি বললাম : তা ওটা তো পাকিস্তানই প্রায়, বলতে গেলে।

এসে অব্দি একজন সাংবাদিকের খোঁজে আছি, যিনি তামাম দুনিয়ার খবর রাখেন। সব কিছুর…সবাইকার খোঁজ-খবর। আই ওয়ান্ট এ সিয়া…সিয়ার খবব পেতে চাই।

তাহলে বড় ভুল জায়গায় এসেছেন মশাই। সংবাদপত্র পড়ে থাকি বটে, প্রত্যহই পড়তে হয়, অল্পবিস্তর লিখেও থাকি কাগজে, তবে সত্যি বলতে আমি সাংবাদিক নই। একান্তই এক বিসম্বাদিক। বাংলা মুল্লুকের খবর দূরে থাক, এই কলকাতারই খবর আমি রাখি না। এসিয়ার খবর আপনাকে আমি কী বাতলাব!

আপনি কি প্রখ্যাত সাংবাদিক এম শিবরাম নন তাহলে?

কী বললেন? এম শিবরাম? তিনি আবার কে? আমি ঘাড় নাড়লাম–না মশাই। আমার কোনো এম নেই-–না নামে না জীবনে। আমি শুধুই শিবরাম।

বস্তির লোকরা কি তাহলে ভুল বাতলেছে আমায়। তিনি যেন অবাক হয়ে গেলেন—শিবরাম কি নানারকমের হয়ে থাকে নাকি?

কে জানে! কেউ কেউ আমাদের মধ্যে হয়তো এমবিশাস থাকতেও পারেন। তবে আমি নই। আমি নিতান্তই শিবরাম। সামান্য…নামমাত্র।

আপনি শিয়ার কোনো খবর রাখেন না তাহলে? শিয়ার কিছু জানেন না আপনি?

জানব না কেন? খবরও পাই মাঝে মাঝে। শিয়া সুন্নীর লড়াই তো বেধেই থাকে। প্রায়। এমন কি আপনাদের পাকিস্তানেও তো লেগে যায় বলে শুনেছি।

আহা, সে শিয়া নয় মশাই! মার্কিন মুল্লুকের সিয়া। সি আই এ-সিয়া! নাম শোনেননি তার? তামাম দুনিয়া জুড়ে দু হাতে যারা টাকা ছড়াচ্ছে, রাজা উজীর মারছে, পলিটিক্যাল পাটিদের কিনছে, রাজ্য লোপাট করছে—শোনেননি নাকি?

শুনেছি বটে! তবে ঐ খবরের কাগজেই। তাদের কাউকে চাক্ষুষ করিনি কখনো।

তাদের এজেন্টদের একজনকেই আমি খুঁজছিলাম। আমার এইসব প্রজেক্ট কিনতে পারে তারাই কেবল। দু পাঁচ লাখ কি, এমন জিনিস পেলে ক্রোড়খানেক টাকা ঢালতেও তারা কসুর করবে না।

ওঃ, সেই CIA-র খোঁজ করছেন? বরাত ফেরাতে সবাই তাদের খোঁজে ফিরছে বলে শুনতে পাই, কিন্তু আমার জানাশোনার মধ্যে কেউ তাদের কৃপালাভ দূরে থাক, দর্শন পেয়েছেন বলে আমি জানি না। বিধাতার মতই তারা সর্বদা অন্তরালে; হয়তো কৃপা করে কিংবা কৃপা করবার জন্যই কোনো কোনো ভক্তকে কখনো-কদাচ দর্শন দেন। তবে চেষ্টা করে তাঁদের পাত্তা পাওয়া যায় না, নিজগুণে দেখা দিলেই দেখা মেলে। এই রকম শুনেছি।

সেই সিয়ার কোনো খবর তাহলে আপনি আমায় দিতে পারলেন না! বলে তিনি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন।

গোড়াতেই আপনি বললেন না যে শিয়া নন, আপনি সুন্নী; সেই কথাই আমি বলতে চাই আপনাকে শেষটায়। সিয়ার দিক থেকে আমিও শুন্যি! লাখ লাখ টাকা দেনেওয়ালা কেউ আমার ত্রিসীমানায় নেই—চারধারেই শূন্য আমার, বুঝেছেন?

Exit mobile version