মানুষ মরলেই তো ভূত হয় জানি। ঘোড়া মরলে কি ভূত হয় নাকি? ঘোড়াদের কি আত্মা আছে? বলে আমি ওঁকে অভয় দিই—না না, ওসব কিছু নয়টয়। ভূতটুত নয় কিছু।
কিন্তু তাহলেও আমার ভয় হয়, সেই ঘোডাটা ভালবেসে ওকে কামড়ে দেয়নি তো? কণ্ঠলগ্ন হয়ে ওর ঘাড়ে যদি দাঁত বসিয়ে দিয়ে থাকে তাহলে কুকুরে কামড়ালে যেমনটা লোক ঘেউ ঘেউ করে আর জলাতঙ্ক দাঁড়ায়…আমার কেমন যেন সন্দেহ হতে থাকে।
ঘাস দিয়ে দেখেছেন? ওর মুখের সামনে ঘাস ধরে দিয়ে দেখবেন তো, খায় কিনা। যদি খেতে না চায়, আর চিহি চিঁহি ডাক ছাড়ে…।
কী যা তা বলছেন! ঘাস খেতে চাইবে সে! ডাল ভাতই তার মুখে রোচে না আজকাল! খেয়ে খেয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে দিনকের দিন! কী যে হলো ছোঁড়াটার।
তাহলে ডাক্তার দেখান এক্ষুনি। দেহের নয়, ওর মনের চিকিৎসা করানো দরকার। এমন ডাক্তার যিনি মনোবিকলন করতে পারেন…।
মনোবিকলন! সে আবার কী মশাই? হর্ষবর্ধন হতবাক হন।
মনের কলকজা বিগড়ে গেলে যিনি মেরামত করতে জানেন এমন ডাক্তার। আমি বিশদ করি : গোবরা ভায়ার বিকল মনকে যিনি আগের মত অবিকল করে দিতে পারবেন আবার।
এমন কোনো ডাক্তার কি জানা আছে আপনার?
কলকাতার থেকে কদিন হলো একজন এখানে বেড়াতে এসেছেন বলে শুনেছি, তার কাছে নিয়ে যাওয়া যায় এখুনি।
গেলাম তার কাছে গোবরাকে নিয়ে সহর্ষবর্ধন।
দেখুন তো ডাক্তারবাবু, আমার ভাইয়ের কী হয়েছে। দিনরাত কী সব আবোল-তাবোল বকে। তিনি বলেন-আর মাঝে মাঝে…সময়ে বিয়ে দিইনি, সেইজন্যেই কিনা কে জানে!
কী হয়েছে আপনার? শুধান ডাক্তারবাবু গোবরাকে।
আমি প্রেমে পড়েছি! মুক্তকণ্ঠে জানিয়ে দেয় গোবরা।
সে আর অবাক হবার কি? বললেন ডাক্তার : আপনার বয়সে সকলেই প্রেমে পড়ে। তাতে দোষের কিছু দেখি নে।
কিন্তু আমি—আমি যে একটা ঘোডাকে ভালবেসেছি মশাই।
তাতে কী! তাতেই বা কী? লক্ষ লক্ষ মানুষ জীবজন্তুদের ভালবাসে! কেউ পাখি, কেউ কুকুর, কেউ বা বেড়াল। ঘোড়ার প্রেমে পড়ে বাজি ধরে কত লোক ফতুর হয়ে যায় পর্যন্ত।
সে ভালবাসা নয় ডাক্তারবাবু! রীতিমতন গভীর প্রেম যাকে বলে। তার জন্যে প্রাণ কাঁদে আমার। রাত্তিবে সেই ঘোড়াটার আমি স্বপ্ন দেখি।
বটে? তা, সেটা মন্দা ঘোড়া না মাদী ঘোড়া?
আপনি পাগল হয়েছেন ডাক্তারবাবু? আমি পুরুষ মানুষ হয়ে একটা মদ্দা ঘোড়ার প্রতি আসক্ত হবো? বলেন কী আপনি? মেয়ে ঘোড়া আলবাৎ! আমার কি মাথা খারাপ হয়েছে নাকি? তাই আপনি ঠাউরেছেন আমায়…?
না, তা কেন ভাবব! তবে…
তবে আমার কী মনে হয় জানেন ডাক্তারবাবু? তাঁর কথার মাঝখানে বাধা দিয়েছেন দাদা : গোবরাটা ছোট বেলার থেকেই আমাকে ভীষণ ভালবাসে। ভ্ৰাতৃভক্ত বেজায়। আর আমার নাম হর্ষবর্ধন। আর জানেন তো——হর্ষ মানে হচ্ছে ঘোড়া…ছোঁড়াটা আমার প্রেমে পড়ে যায়নি তো? সেইটাই আমার সন্দেহ। সহর্ষ হয়ে তিনি জানান।
তা কী করে হবে! হতভম্ব হয়ে ঘাড় নাডেন ডাক্তার : হর্স মানে ঘোড়া বটে, কিন্তু যে ঘোডা ঘাস খায়…আপনি কি আর ঘাস খান? সেই হর্স কি আপনি নাকি?
তালগোল পাকিয়ে ডাক্তারেরই যেন মাথা খারাপ হয়ে যাবার মতন হয় তখন।
খট্টাঙ্গপুরাণ
বহুদিন পরে আবার ভাইদুটিকে দেখা গেল। আবির্ভাবের মতই দেখতে পেলাম। গোলদিঘী কফি হাউসের কোণ ঘেঁসে বসে।
আমিও ওদের কোল ঘেঁসে পাশের টেবিলে গিয়ে বসেছি। আমাকে দেখে হর্ষবর্ধন—ঠিক হর্ষধ্বনি নয়, প্রায় অর্ধপরিচিতের মতই অভ্যর্থনা করল—এই যে!
বলেই আবার ভাইয়ের সঙ্গে মশগুল হয়ে গেল সে গরে।
অনেকদিন পরে দেখা। মনে হলো, হয়তো আমায় চিনতে পারেনি ঠিক। কিংবা হয়তো বা হাড়েহাড়ে চিনেই? নইলে শুধু এই ভাষণ—এই শুক সভাবণ—এত কম ভাষণ নিতান্তই হর্ষবর্ধন-বিরুদ্ধ, কিন্তু ও নিয়ে আর মাথা না ঘামিয়ে নিজের কফির পেয়ালায় মন দিলাম। আর কান দিলাম ওদের কথায়….
বুঝলি গোবরা, এ রকমের আরেকটা কফি হাউস আছে কলকাতায় চৌরঙ্গীর কাছে। কিন্তু সাবধান, সেখানে যেন ভুলেও কখনো যাস না।
কেন, যাব না কেন? কানাড়াকরা তাই মাথা চাড়া দিয়েছে কী হয় গেলে?
গেছিস কি মরেছিস। এ কফি হাউস তো ভাল। এখানে খালি বাণী। বাঙালী ছেলে মেয়েরাই আসে। নিতান্ত নিরাপদ। কিন্তু সেখানে বাবা, যা মারাত্মক!
বলে মারাত্মক ভাবের চোখখানা তিনি ভাইয়ের ওপর রাখেন।
মারাত্মকটা কিসে শুনি?
মেমরা আসে সেখানে। হর্ষবর্ধন বিশদ হন–মেমরা দেখা দেয়।
দিলেই বা। মেম তো আর বাঘ নয় যে গিলে ফেলবে!
বাঘেরা বেশি না গিলেই হজম করতে পারে। তবে আর বলছি কী!…সেদিন একটা মেয়ের পাল্লায় পড়েছিলাম রে! ধরেছিলো আমায়।
কী করেছিলে তুমি?
কিছু না। সবেমাত্র সেখানে ঢুকে একটা খালি জায়গা পেয়ে বসেছি। অতো বড় হটা গিসগিস করছে মানুষে। বাঙালী, পাঞ্জাবী, চীনেম্যান, সায়ে মেমে ভর্তি। হলের মাঝামাঝি একটা থাম ঘেঁষে দুটি মাত্র চেয়ার খালি একখানা ছোট্ট টেবিল বিরে। তারই একটিতে গিয়ে বসেছি আমি। একটু পরেই একটা মেম এসে আমার সামনে চেয়ারটায় কালো।
ও এই ধরা! সে তোমাকে ধরবার জন্যে নয় গো দাদা, বসবার আর জায়গা ছিল না বলেই- বলতে যায় গোবর্ধন। নিজের দাদাকে সে ধর্তব্যের মধ্যে জ্ঞান করে না।
শোন্ না আগে। সবটা শোন্ তো, হর্ষবর্ধন বাধা দেন-মেমটা বসেই না আমাকে বললো—গুড় ইভিনিং মিষ্টার। আমি তার জবাব দিলাম—গুড নাইট মিসেস্।
তুমি গুড নাইট বলতে গেলে কেন? গুড নাইট তো বলে লোকে বিদায় নেবার সময়।