কী রকম? খুলে বলুন!
তুমি যদি ওর ঘোড়াটিকে ভালবাসো, তার সঙ্গে ভাব জমাতে যাও, মেয়েটি তাতে মোটেই অবাক হবে না। সন্দেহের চক্ষে দেখবে না তোমায়। ঈর্ষান্বিতও হবে না। কেননা, সেও তো তার ঘোড়াকে ভালবাসে, ভালবাসার পাত্র বলেই মনে করে। সুতরাং তোমাদের দুজনের অনুভূতি এক হয়ে গেল এইখানের নাম হলো গিয়ে সহানুভূতি। আর ওই সহানুভূতির থেকেই হয়ে থাকে ভালবাসার সূত্রপাত! বুঝতে পেরেছ?
গোবরার কতখানি বোধগম্য হয় সেই জানে, কিন্তু এক ঘাড় মাথা নেড়ে দেয়।
উৎসাহিত হয়ে আমি আরও বলি—ঘোড়া এগুলে মেয়েটাকেও এগুতে হবে; ঘোড়াও সঙ্গে সঙ্গে বাধ্য হয়েই—মেয়েটা কিছু ঘোড়া ছাড়া নয় যেকালে। ঘোড়া হাতে এলে মেয়েটি কি আর তোমার তফাতে থাকবে?
যা বলেছেন। হাসিখুশির মলাট হয়ে সে চলে যায়।
আমি কিন্তু ভাবনায় পড়ি। ভাব জমাতে গিয়ে ঘোড়ার হাতে হাতে না বলে পায়ে বলাই উচিত, বেচারা না অপঘাতে মারা যায়। এর আগে সে কোনো মানবের প্রেমে পড়েনি, কোনো মানবকও পড়েনি তার প্রেমে। কিন্তু এখন সেই প্রেমের দাবিই সইতে হবে প্রাণীটিকে। এই ধকল কি সইবে তার? এহেন বিটকেল ব্যাপার হয়ত সে বরদাস্ত নাও করতে পারে।
তবে কি না, প্রেমকে সর্বজয়ী বলে থাকে…সেইখানেই যা ভরসা! বিশ্বজয়ী প্রেম কি আর অশ্বজয়ী হতে পারে না?
তাহলেও, গোবরা যে কী কবে এগুবে তা আমি ভেবেই পাই না। ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওযা…মেয়েটির সঙ্গে ভাব জমানো, মনে হয় কষ্টসাধাই। বলতে কি, অসুবিধাটা আমি নিজেও যে বোধ করিনি তা নয়। মেয়েটি ভাব করবার মতই সত্যি, কিন্তু তার পথে ভাবনাও পদে পদে। ঘোড়ার সঙ্গে ঘোরাঘুরি করে কাঁহাতক ভাব জমানো পোষায়? আর যদি গোড়াগুড়ির থেকেই তা করতে হয়…একটু কষ্টকর নয় কি? পথ কেবলই যে দুর্গম তাই না। রীতিমতন অশ্বক্ষুরলাঞ্ছিত। পরব্রহ্মের মত পরি-ব্রহ্মের পথও যদি ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা হয়, পাশাপাশি চলতে গিয়ে পাছে ঘোড়ার পায়ের চোট লাগে সেই ভয়ে পদে পদে হোঁচট খেয়ে চলতে হয়, তাহলে অবশ্যই বলতে হয়, হে দেবি, তোমার ক্ষুরে ক্ষুরে দণ্ডবৎ! আমি সটকালাম।
দিন কতক আর গোবরার দেখা নেই। অবশেষে একদিন দেখি সে কলার কাদি কাঁধে নিয়ে দাহিগড়ার দিকে চলেছে।
কোথায় চলেছ গোবরা ভায়া? আমি শুধাই : এত কলা কিসের জন্যে হে?
ভালবাসার জন্যে। সে সংক্ষেপে সারে।
প্রেমে শেষ পর্যন্ত দিতে হয় জানা কথা, কিন্তু তা কি এই কলার কাঁদিতে? ওর কথায় আমি বিস্ময় মানি।
প্রেমে বিস্তর হলা কলা আছে, জানি তা, প্রেম একটা কলাবিদ্যাও বটে, আমি বললাম। কিন্তু প্রেমিকাকে কি কেউ কলা দেখায় নাকি কখনো?
প্রেমিকাকে কেন মশাই, ঘোড়াটাকেই দেখাব তো! সে বলে: ঘোড়াটা ফল খেতে ওস্তাদ। কলা খাইয়ে খাইয়ে পটিয়েছি ঘোড়াটাকে। কলা দেখলেই সে দৌড়ে আসে। গোবরা তার পটিয়সী বিদ্যা প্রকাশ করে।
মেয়েটাও তার পিঠোপিঠি দৌড়য় তো? মানে, তার পিঠে চেপে মেয়েটাকেও আসতে হয় নিশ্চয়?
নিশ্চয়! মেয়েটাও যে হড়ার থেকে দুয়েকটা খায় না তা নয়।
কেমন? বলেছিলাম না? ঘোড়াকে পটাতে পারলে মেয়েটাও পটবে। ঘোড়ার সঙ্গে এগুতে হবে মেয়েকেও কেমন হল কিনা? কী কৌশলে ঘোড়াটাকে তুমি কাবু করবে আমি ভাবছিলাম, যাক তোমার কাজ হাসিল হয়েছে তাহলে। তোমাকে কলাকুশল বলতে হয় ভায়া।
ঘোড়াটাও আমার বেশ কলারসিক দাদা! গোবরার একগাল হাসি।–কিরকম পুরুষ্ট পুরুষ্ট মর্তমান কলা সব দেখছেন?
তা তো দেখছি! …মেয়েটাও তো তোমার কলা খায় বলছ আবার। তা মেয়েটাকে এইভাবে কলাৎকার করলেও তোমার আসল কাজ কদ্দুর এগুলো? গোধূলি লগ্নের দিকে কতটা এগিয়েছ শুনি?
বুঝতে পারছিনে ঠিক। মেয়েদের কিছু বোঝা যায় না দাদা! তবে মেয়েটার না হলেও ঘোড়াটার আমি হৃদয় জয় করেছি ঠিকই।
গোবরার হ্যত ঠিকে ভুল হয়নি। রমণীর মন সহস্র বর্ষের সাধনার ধন হলেও, এবং তার জন্যে কেউ কেউ সমরখন্দ আর বোখারা বিলিয়ে দিতে চাইলেও, কেউ আবাব ঘোড়ার জন্যও কি তাঁর রাজত্ব বিকিয়ে দিতে চাননি? হর্স! হর্স! মাই কিংডম ফব এ হর্স-বলেছিল কে? নিশ্চয় সে গোবর্ধনের চেয়ে কোনো অংশে নূ্যন ছিল না। ভালবাসার নানান রূপ-হাজার চেহারা। মোটের ওপর, হৃদয় একটা কারও পেলেই হলো! সেইটেই নেট লাভ! তা অশ্বিনী বা আ-মোহিণী যারই হোক না!
তারপর আর গোবরার দেখা পাই না। দেখা পেলাম হর্ষবর্ধনের।
কাঁচুমাচু মুখ করে তিনি হাজির।
গোবরাকে নিয়ে ভারী ভাবনায় পড়েছি মশাই! কাঁদো কাঁদো সুরে তিনি আওড়ান।
কী হয়েছে? অ্যাঁ?
কী যে তার হয়েছে তাই তো আমরা ঠাওর পাচ্ছিনে। সব সময় কেমন যেন আনমনা হয়ে থাকে। আর মাঝে মাঝে…
প্রেমে পড়েনি তো কারো?
কে জানে! কিছু তো বলে না। মাঝে মাঝে কেবল চিঁ হিঁ চিঁ হিঁ করে ওঠে। তিনি বললেন—প্রেমে পড়লে কি মানুষ চিঁ হিঁ চিঁ হিঁ করে নাকি?
চিঁ চিঁ করে বটে অনেকে, শুনেছি আমি। আমি বলি—তবে প্রেমের চিৎকার তো কতো রকমই হতে পারে। কিছু কি তার বলা যায়?
তার চালচলন কেমন ধারা যেন। এরকম বেচাল তার কখনো আমি দেখিনি। কি রকমের পাগলাটে পাগলাটে ভাব।
ঠিক সময়ে ওর বিয়ে না হওয়ার জন্যই এমনটা হয়েছে মনে হচ্ছে। যথাসময়ে যদি ওর গলায় একটাকে ঝুলিয়ে দিতেন… একজন কেউ কণ্ঠলগ্ন হলে আজ আর এমনটা হতে পারত না।
তা যখন হয়নি, এখন কী করা যায়? রাতবিরেতে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ওর ওই চিহি চিহি করে ওঠাটাই আমার খারাপ লাগছে আরো। ওই বিটকেল আওয়াজে আমাদের ঘুম ভেঙে যায় মশাই! একটুও ঘুমোতে পারি না আমরা, না আমি না আমার স্ত্রী। পাশের ঘর থেকে দেয়াল ছুঁড়ে যেন তেড়ে আসে আওয়াজটা। আমার স্ত্রী বলছিলেন কোনো ঘোড়াভূতে ওকে ধরেছ হয়ত…?