শুনতে শুনতে তাঁর উৎসাহ জাগল। তিনি আগ্রহের সঙ্গে আমার কথার সঙ্গে মিলিয়ে নক্সাটার সব কিছু লক্ষ্য করতে লাগলেন। প্রজেক্ট-জেকে আরও বিস্তারিত করতে হলো আমায় তখন—সবটা খুলে টেবিলের ওপরে ছড়িয়ে দিলাম। টেবিল ছাড়িয়ে গেল নক্সাটা। তখন তিনি নক্সাটা নিয়ে মেজের কার্পেটের ওপরে বিছিয়ে নিজে তার ওপরে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন।
আধঘণ্টা ধরে নক্সাটার আগাপাশুলা সব কিছু দেখে শুনে বুঝে নিয়ে তিনি খাড়া হয়ে দাঁড়ালেন। আমার করমর্দন করে অভিনন্দন জানিয়ে বললেন—বাহাদুর আপনি! আপনার এই নয়া হাতিয়ারটা অদ্ভুত বটে সত্যিই…
হা। একচোটে দিল্লী কলকাতা বোম্বাই উড়িয়ে দেবার কিম্মত রাখে।
তা রাখে। তবে সেইখানেই যা একটু…তা সে কথা যাক। এর জন্যে কত দিতে হবে আপনাকে? দশ হাজার।
দশ? দশ কি বলছেন জনাব? একশ বলুন। বলে আমার প্ল্যান আমি গুটিয়ে নিলাম।
পঞ্চাশ হলে হয় না?
পঞ্চাশ! মাত্র পঞ্চাশ হাজার? বলেন কী জনাব? হিন্দুস্থানের মতন এক দুশমনকে রস্ত করতে মাত্র মোটে পঞ্চাশ হাজার? আমি পাঁচ লাখ টাকা পাবার আশা করে এসেছিলাম। পাঁচই আমার চাই, তার কমে ছাড়ব না।
আড়াই লাখ। বললেন তখন তিনি।
অলরাইট। আমি রাজি। বলে নক্সটা তাঁর হাতে আমি সঁপে দিলাম।
জেনারেল আড়াই লাখের একখানা কে লিখে আমার হাতে দিয়ে বললেন– এটা ট্রজারিতে জমা দিলেই ভাঙিয়ে দেবে। বলে তিনি আমার করমর্দন করলেন আবার।
করমর্দনের ফাঁকে আমি চেকের ওপরটায় চোখ বুলিয়ে দেখে নিয়েছি শূন্যিগুলো তিনি ঠিক ঠিক দিয়েছেন কিনা। না, পঁচিশের পর…পর চারটে শূন্যই রয়েছে বটে, দেখা গেল।
দরজা পর্যন্ত এগিয়ে আমাকে বিদায় দেবার আগে তিনি বললেন–আবার যদি এমনি বড়িয়া কিছু আবিষ্কার করতে পারেন, একটুও বিলম্ব না করে সোজা চলে আসবেন এখানে। আমরা উচিত মূল্যে তা কিনে নেব। এমনধারা যদি কিছু থাকে আপনার আর…।
আছে আমার। আমি জানালাম।
আছে আপনার?
আমার কাছেই আছে। বলে আমার ব্রিফ কেসটা খুলে আরেকটা নক্সা বার করলাম। -এ হাতিয়ারটা প্রজেক্ট-জের চেয়েও জববর।
সন্দিগ্ধ নেত্রে তাকালেন জেনারেল-তা কি কখনো হতে পারে? যেরকম বুঝলাম, এবং আপনি বোঝালেন তাতে মনে হলো প্রজেক্ট-জের ওপরে আর কোনো কথা নেই।
আছে বই কি! বিজ্ঞানের শেষ কথা কি কেউ বলতে পারে কখনো? আবিষ্কারের কি ইয়ত্তা আছে? বলে আমার নতুন নাটাকের চোখের সামনে মেলে ধরলাম—এটি হচ্ছে প্রজেক্ট-এম। প্রজেক্ট জালালুদ্দিনের সঙ্গে মোলাকাত করার এক্তিয়ার রাখে বলেই এর নাম প্রোজেক্ট-এম।
বটে? এর কেরামতিটা শুনি তো একবার? শুধালেন জেনারেল তখন।
প্রজেক্ট-জের চেয়েও দ্রুতগতিতে যাবার ক্ষমতা আছে এর। ঐ প্রজেক্ট-জে তার টারগেটে গিয়ে পৌঁছবার আগেই এ গিয়ে শূন্য পথেই তাকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দেবে।
তাজ্জব! বলে খানিকক্ষণ তিনি হাঁ হয়ে রইলেন, তারপর বললেন-ও জিনিসের আমাদের দরকার হবে বলে আমি মনে করি না। কেননা, এই প্রজেক্ট-জের মতই কেউ কিছু বহুদিন বানাতে পারবে না, তারপরে তো তার সঙ্গে মোলাকাতের কথা।
ঠিকই বলেছেন জনাব। বললাম আমি তখন-কিন্তু লড়াইয়ের কায়দাকানুন নিশ্চয়ই আপনার জানা আছে—আমার চেয়ে ঢের ভালোই জানেন আপনি জনাব যে, যতক্ষণ সেই হাতিয়ারের জবাব আপনার হাতে নেই ততক্ষণ তা ব্যবহার করতে যাওয়াই উচিত নয় আপনার। কেননা, অপর পক্ষের হাতে আপনার সেই হাতিয়ারের জবাব থেকে যেতেও পারে হয়তো বা।
ইয়াল্লা! জেনারেলের মুখ অতঃপর আর আগের মতন মোলায়েম রইল না, দারুণ গভীর হয়ে গেল এবার–তার মানে, তোমার জাহান্নামের ঐ মোলাকাতও আমাকে হাত করতে হবে, নইলে হয়তো তুমি ঐ প্ল্যান অপর পক্ষকে গিয়ে বেচবে।
আমি তাঁর কথায় কোনো প্রতিবাদ না করে চুপ করে রইলাম। তিনিও চুপচাপ—অনেকক্ষণ। এই নীরবতার ভেতর নিজের গোঁফের দুই প্রান্ত তিনি চিবুতে লাগলেন চটেটে।
অবশেষে গুম্ফ চর্বণ থামিয়ে আরেকটা চেক লিখলেন তিনি—আড়াই লাখের।
আমার হাতে চেকটা দিয়ে তিনি বললেন—চলুন, এবার আমাদের অফিসারস ক্যানটিনে গিয়ে একটু খিনপিনা করা যাক এখন। এক কাপ কফি অন্তত।
লম্বা করিডর ধরে যাবার পথে একটা বিরাট হলঘরের সামনে এসে আমরা দাঁড়ালাম। ইস্পাতের কলাপসিবল গেট ছিল হাটার। জেনারেল দেওয়ালের একটা বোতাম টিপতেই গেটটা দুক হয়ে সরে গেল দুধারে। যমদূতের মতন দুজন লোক ভেতর থেকে বেরিয়ে এল। এসেই পাকড়ালো আমাকে।
একি! এরা আমায় ধরছে কেন হুজুর? ছেড়ে দিতে বলুন এদের! চেঁচিয়ে উঠেছি আমি।
আমার জবাব না দিয়ে তিনি লোক দুটোকে বললেন-হুঁশিয়ার! হরবখৎ নজর রাখতে হবে লোকটার ওপর। যেন পালাতে না পারে। তবে ভদ্রলোকের কোন তলিফও যাতে না হয়। খানাপিনা গোসল উসলের বিলকুল সুবন্দোবস্ত চাই। ইনি এখানে বরাবরের জন্য আমাদের মেহমান-সম্মানিত অতিথি। খেয়াল থাকে যেন।
চিরদিনের জন্য কয়েদখানায় পুরছেন আপনারা আমায়? কিন্তু কেন? কী ক্ষতি করেছি আমি আপনাদের? আমি তো আপনাদের ভালোর জন্যই…।
আমার কথা শেষ হতে পেল না, মোক্ষম জবাব পেলাম আমার কথার—আপনি ভয়ঙ্কর লেক। বললেন তিনি—আপনার মত মানুষকে বাইরে রাখা মোটেই নিরাপদ নয়। পাকিস্তানের স্বার্থেই আপনাকে এইভাবে ইনটার্ন করতে হচ্ছে আমায়।
কিন্তু আমি তো পাকিস্তানের স্বার্থেই…আমার এই আবিষ্কার তো পাকিস্তানের স্বার্থেই দিতে চেয়েছিলাম জনাব। আমাকে কয়েদ করে…আমার এই প্রজেক্টগুলি নিয়ে আপনারা কী করবেন?