যাক, না হয়েছে ভালোই হয়েছে…। আমি সান্ত্বনাচ্ছলে বলি—কোথায় কবে কোন্ লড়াইয়ে গিয়ে বেঘোরে ই মারা পড়তিস…।
আমার এক মুসলিম বন্ধু কিন্তু পেয়ে গেল চাকরিটা। ঠিক সময়ে হাজিরা দিয়েছিল, ঠিক ঠিক জবাব দিয়েছিল সে। কিন্তু সেজন্যে নয়, শেষ পর্যন্ত একটা মেয়ের জন্যই চাকরিটা হলো তার।
ও, বুঝেছি। সমঝদারের মতন আমি সমঝে নিই, সেই ইন্টারভিউ বোর্ডে মেয়েরাও ছিল বুঝি তোর?
মিলিটারি ইন্টারভিউ বোর্ডে কারা থাকে তার কোনো ধারণা আছে তোমার? ভূগোল জ্ঞানের পরিচয় পাবার পর সে আমার সাধারণ জ্ঞানের বহর বিচার করে। জানো, লেফটেনান্ট কমাণ্ডার, কম্যাণ্ডিং অফিসার এঁরাই সব থাকেন ইন্টারভিউ বোর্ডে। এরা সব মেয়ে নাকি?
মেয়েই তো মনে হয়। আমি জানাই।
!…!…অশোক মুখে কিছু বলে না, তার জবাবটা কেবল তার আর আমার চক্ষুগোচর করে দেয়। একটু আগে আমার চোখে যেমন–???–আমার প্রশ্নপত্র প্রকাশিত হয়েছিল তেমনি এবার ওর অবাক চক্ষে দুটি বিস্ময়চিহ্ন বিমুদ্রিত হতে দেখলাম।
যদি না হয়ে থাকে তো জানি না, আমার সাফাই গাই—কিন্তু মেয়েরাই হবে আমার ধারণা। লেফটেনান্টকে যে কম্যাৎ করে সেই তো লেফটেনান্ট কম্যান্ডার? তার ঝে ছাড়া আর কে তাকে কম্যাণ্ড করার ক্ষমতা রাখে? তেমনি কোনো অফিসারকে যেকম্যাণ্ডকরতে পারে এবং করেও, যারকথায় সেই অফিসার ওঠ-বোস করে লেফট-রাইট করে থাকে, সে তার বৌ ছাড়া আর কে হবে আবার?
খুব হয়েছে। এক কথায় আমার এতবড় কথাটা সে উড়িয়ে দেয়—কমিশনের ইন্টারভিউ বোর্ডের—জেনে রাখো মামা, ত্রিসীমানায় কোনো মেয়েটেয়ে থাকে না।
তুই-ই বলছিস মেয়ের জন্যই চাকরিটা হলো তার, আবার তুই নিজেই ফের বলছিস বোর্ডের কোথাও কোনো মেয়ে ছিল না—উল্টোপাল্টা গাইছিস তো তুই নিজেই!
রশিদুল হকের গল্পটা শোনো আগে, তবেই না বুঝবে। অশোক বলে, বোর্ডের ইন্টারভিউয়ে ভারী ভারী মিলিটারি অফিসাররা থাকেন সব। …তারপর, রশিদের মুখে যা শুনেছি পরে, যেমন যেমনটা শুনলাম…বলছি তোমায়…।
ওর বিবৃতির জন্য আমি উৎকর্ণ হই।
ইন্টারভিউ নেয়া হয়ে যাবার পর, বলতে থাকে অশোক, আপনাকে আমরা নেব কিনা চিঠি দিয়ে পরে জানাব আপনাকে, বলে বোর্ড যখন রশিদুলকে প্রায় বিদায় করে দিচ্ছে তখন সে বোর্ডকে বলল, যাবার আগে আমার দু-একটা কথা কি আপনাদের জানাতে পারি? তারা বলেছেন, হ্যাঁ বলুন বলুন! বাধা কী? তখন রশিদুল বলেছে, দেখুন স্যর, ইন্টারভিউ দেবার পর আমি দুটো সম্ভাবনার কথা ভাবছি, প্রথমত, আমি চাকরিটা পেতে পাঁরি, দ্বিতীয়ত, চাকরিটা না পেতে পারি। চাকরি যদি নাই পাই, তাহলে আমার বলার কিছু নেই। কিন্তু চাকরিটা পেলে আরো দুটো প্রশ্ন তখন আমার মনে জাগবে—এক-আপনারা আমাকে হেড কোয়াটার্সে রাখতে পারেন, দুই—আপনারা আমায় সীমান্তে পাঠাতে পারেন…
বোর্ডের একজন বলেছেন—তাতে পারি। তবে প্রপার ট্রেনিং দেবার পরই সে কথা।
সেই কথা ভেবেই আমি বলেছি, বলল রশিদুল, তারপর যদি আপনারা আমায় হেড কোয়াটার্সে রাখেন তাহলে আমার আর বলার কিছু নেই। কিন্তু যদি আপনারা আমায় সীমান্তে পাঠান তখন আরো দুটি সম্ভাবনা দেখা দেবে। প্রথমত, আপনারা আমায় পাকিস্তান-সীমান্তে পাঠাতে পারেন, দ্বিতীয়ত, আমাকে চীন-সীমান্তে পাঠাতে পারেন। যদি আমাকে পাক-সীমান্তে পাঠান তাহলে কিছু বলার নেই। কেননা তারা আমায় মারতে পারবে না, সেখানে ভয়ের কোনো কারণ নেই আমার…।
এ কথা বলছ কেন? বোর্ডের এক সদস্য বাধা দিয়ে তাকে শুধিয়েছেন, তুমি মুসলমান বলে পাকিস্তানীরা তোমায় রেহাই দেবে ভেবেছ? মারবে না তোমাকে?
আজ্ঞে না, মারবার কোনো ক্ষমতাই হবে না তাদের। উলটে তারাই মার খাবে আমাদের কাছে। পাকিস্তানীদের আমরা ভয় করিনে, কিন্তু যদি আপনারা আমায় চীন-সীমান্তে পাঠান তাহলে আরো দুটো সম্ভাবনার কথা আমি ভাবছি…প্রথম, চীন ভারত আক্রমণ করতে পারে, দ্বিতীয়, নাও করতে পারে।
চীনাকে চেনা কঠিন। মন্তব্য করলেন বোর্ডের একজন।
আজ্ঞে যা, স্যর। কিন্তু চীন যদি ভারত আক্রমণ না করে তাহলে কোনো কথাই নেই, কিন্তু যা আক্রমণ করে তাহলে আরো দুটি সম্ভাবনার কথা ওঠে। যুদ্ধে আমি মারা যেতেও পারি আবার না যেতেও পারি। যদি মারা না যাই তাহলে আমার কিছু বলার নেই, কিন্তু মারা গেলে আরো দুটি প্রশ্ন দাঁড়ায়—আমার মৃতদেহ পাওয়া যেতে পারে, আবার নাও পাওয়া যেতে পারে…।
না পাওয়া যাবে কেন? বোর্ডের একজন শুধাল। মৃতদেহ তো আর পালিয়ে যায় না।
চীনেরা আমায় খেয়ে ফেলতে পারে। শুনেছি ওরা মানুষ খায়। কিন্তু চীনেরা যদি আমায় খেয়েই ফেলে তার জন্যে মোটেই আমি চিন্তিত নই। কিন্তু যদি না খায় আর আমার মৃতদেহ পাওয়া যায় তখন আরো দুটো সমস্যা ওঠে। হয় আর মৃতদেহ আমার আত্মীয়দের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হবে, নয় আমার শবদেহ সীমান্তেই কবরস্থ করা হবে। যদি আমার আত্মীয়-স্বজনের কাছে আমার দেহ পাঠানো হয় তাহলে আমার বলার কিছু নেই। কিন্তু যদি আমায় সীমান্তেই কবর দেওয়া হয় তাহলে আমি আরো দুটি সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দিতে পারি না। এক নম্বর সম্ভাবনা, আমার কবরের জমির ওপর ঘাস গজাতে পারে, নম্বর, আবার ঘাস নাও গজাতে পারে। ঘাস না গজালে আমি কিছু বলতে চাই না, কিন্তু যদি ঘাস গজায় তাহলে আরো দুটি সম্ভাবনা দেখা যায় আবার… গরুতে সে ঘাস খেয়ে ফেলতে পারে, আবার নাও খেতে পারে। গরুর পেটে সে ঘাস—গরু যদি ঘাস খেয়ে ফেলল তো ল্যাঠা চুকেই গেল, কিন্তু যদি সে সুযোগ সে না পায় তাহলে সেই ঘাসের থেকে আরো দুটো জিনিস ঘটতে পারে। এক, সেই ঘাস কোনো খাদ্যদ্রব্যের ভেজাল হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে—শুনেছি প্রোটিনের বিকল্প রূপে ঘাস নাকি বেশ পুষ্টিকর নয়তো কাগজ তৈরি হতে পারে সেই ঘাসের থেকে। কাগজ তৈরি হলে আবার দুটি সম্ভাবনা দেখা দেয়—একনম্বর, লেখার কাগজ, দুনম্বর, টয়লেটের কাগজ। লেখার কাগজ হলে তার যা গতি হয় তোক গে, বই ছাপা হোক বা হিসেবের খাতা হোক তা নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই, কিন্তু যদি তার থেকে টয়লেটের কাগজ তৈরি হয়…মানে আমি যদি টয়লেট পেপার হই তাহলে আমার ভাবনার কারণ। আছে। হয় কোনো ছেলে সেই টয়লেট কাগজ ব্যবহার করবে নয়তো কোনো মেয়ে… বলে রশিদুল হক একটু থামে… এইবার আমার শেষ কথাটি আমি বলতে চাই। বলতে পারি স্যর আপনাদের কাছে? জিজ্ঞেস করে রশিদ।