ব্যান্ডেজ মাথায় বাঁধাই ছিল তার, শীর্ষদেশে তাই নিয়ে সে ঘুরে বেড়াত আজকাল, কোথায় কী তাক লেগে যায় কখন। কলকাতার পথেঘাটে তো টাকা ছড়ানো; ভালো করে তাকালেই হয় একবার। কিন্তু কোনো হাসপাতালের সামনে ছাড়া আর কোথাও কারো কাছে তার ওই মাথা খেলিয়ে সে হাত পাতে না যেও। বড়ো বড়ো গাইয়ে আসরের বাইরে গায় নাকি কখনো? অভিনয়সজা মাথায় আর অভিনয়বৃত্তি তার মজার। ভাবল, এই ফাঁকে একটুখানি বসে এখানে দু পয়সা উপায় করে নিলে মন্দ কী?
বসেহে খানিকক্ষণ, এমন সময় এক ভদ্রলোক হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন তার কাছে এসে-এখানে এমন করে বসে আছে যে বাপু?
আজ্ঞে, এই হাসপাতাল থেকে আজ ছাড়া পেয়েছি কিনা, বাড়ি যাবার গাড়িভাড়া কাছে নেই আমার, তাই…।
ও! সেইজন্যেই? তা কদ্দিন ছিলে এখানে?
দিন পনেরো থাকতে হয়েছে মশাই। ট্রাম থেকে পড়ে গিয়ে মাথাটা দু ফাঁক হয়ে গেছল আমার!
বটে? বলে অদূরে কী যেন দেখতে পেয়ে একটু আশান্বিত হয়েই তিনি বললেন-আচ্ছা, তোমার বাড়ি যাবার ব্যবস্থা আমি করে দিচ্ছি এক্ষুনি।
একটা পুলিস ভ্যান যাচ্ছিল এখন সেখান দিয়ে সেই সময়। হাত বাড়িয়ে গাড়িটাকে থামিয়ে, কাছে গিয়ে কী যেন তিনি বললেন তার ড্রাইভারকে।
যাও, ওঠোগে। ও-ই তোমায় বাড়িতে পৌঁছে দেবে এখন। পয়সা লাগবে না।
উঠতে হলো পুলকেশকে। নিখুঁত অভিনয়ের প্রয়োজনেই উঠতে হলো। অভিনয়ে যেমন প্রবেশ আছে, অবস্থান আছে, তমনি তার অঙ্গহিসেবে প্রস্থানও রয়েছে যে। অভিনয় সবাঙ্গীণ করতে হলে সেটাকে বাদ দেওয়া যায় না।
থানায় যেতেই যেন হাসির ধুম পড়ে গেল তাকে নিয়ে। বড় দারোগা মেজ দারোগা ছোট দারোগা সবাই হাসলেন খুব খানিক। এত হাসাহাসি তার খারাপ লাগলো তার। হাসপাতালেব সদ্য ছাড়া পাওয়া মাথায় চোট খাওয়া হতভাগ্য এক রুগী—তাকে দেখে এমন হাসবার কী আছে! হাসির অভিনয় তো করছিল না সে, করুণ-রসের ভূমিকাই তো ছিল তার। কিন্তু এই হাসির ধাক্কায় তা যেন ভূমিসাৎ হবার যোগাড়! পুলিসের লোকের কোনো রসকস নেই বলে যে, তা মিথ্যে নয়। সত্যি, এমন হৃদয়হীন হয় তারা যে…
হাসির চোট থামলে একজন তাকে জিজ্ঞেস করলেন—এমনধা, গর্ব করা তোমার ঠিক হয়নি বাপু হে! এই গর্ব তোমার কতদিনের?
গর্ব! কিসের গর্ব স্যর? কাঁচুমাচু হয়ে সে জানতে চায়।
পুরুষমানুষের কি গর্ব করা সাজে ভাই? এমনধারা গর্ব করা কি উচিত হয়েছে তোমার? সত্যি, তুমিই বলো না! আরেকজনের তলব।
আমি তো কোনো গর্ব করিনি হুজুর। তার করুণ সুর আরো যেন করুণতর শোনায় কেমন।
করোনি তো ওখানে মরতে গিয়েছিলে কেন? আবার এক চোট হাসি।
এই গর্বটা তোমার কতদিনের হে? শুনি তো একবার। আরেকজনের জিজ্ঞাসা। আরেক হাসির ধুম।
আমার গর্ব! গর্ব কোথায় দেখলেন স্যর আমার?
ছি ছি ছি! গর্ব কেবল মেয়েদেরই শোভা পায়…তুমি পুরষ-মানুষ হয়ে এই গর্ব করতে গেছ…সাতপুরুষে এমন কাণ্ড দেখিনি শুনিনি। বলেন ওসি পুলকেশকে : ভিক্ষে করবে করো কিন্তু তাই বলে কি কেউ বৃথা গর্ব করে ভিক্ষে করে নাকি?
ঠিক কথা সার। ভিখিরির আবার গর্ব কিসের। সায় দেয় সে তাঁর কথায়: গর্ব করেও ভিক্ষে করতে নেই, ভিক্ষে করেও গর্ব করা ঠিক নয় কারণ ভিক্ষে করাটা। গর্বের কিছু নয়।
তোমার এই গর্বটাই তোমার এই পতনের কারণ হলো, বুঝেছ?
পতনের কারণ হলো? পুলকেশ শুনে অবাক হয়।
তিনি জানানঃ হ্যাঁ, এর জন্যে হাজতে তো যাচ্ছই এখন–হয়তো বা জেলে যেতেও হতে পারে।
জেল! জেল কিসের জন্যে হুজুর? এবার যেন সে চমকে ওঠে: গর্ব করলে পতন হয় জানি, কিন্তু তাই বলে কি জেল? তাছাড়া, আমি যখন মোটেই কোনো গর্ব করিনি….
গর্ব করলে পতন হয় এটা যখন জানো…
অন্য একজন অফিসার মাঝখান থেকে ফোড়ন কাটেন—মেয়েদের বেলা অবশ্যি পতন বার পরই গর্বটা হয়ে থাকে…
তখন এটাও তোমার জানা উচিত ছিল যে, অধঃপতনের শেষ সীমায় জেল ফাটক অনিবার্যই।
গর্ব দূরে থাক আমি গর্বের কোনো ভানও করিনি স্যর…তবুও সে বলতে চায়।
আরে, গর্ব যদি তোমার নাই হয়ে থাকে তাহলে ওই বাড়িটার ধারে কাছে গিয়েছিল। কেন? দশ মাসের গর্ব হলেই তো যায় ওখানে কেউ…
তোমার এই গর্বটা ক মাসের ছিল হে? অন্য একজনের ওপর-টিনী। —নাকি তোমার গর্বপাতের জন্যেই গিয়েছিলে সেখানে?
গর্বপাতের কথাটায় পুলকেশের কোথায় যেন খটকা লাগে কেমন। ভাষাটা যেন কেমনতরো। তব সে খট করে কিছু বুঝতে পারে না। ওর গর্ভে আরো যে কী নিহিত আছে তার কোনো আঁচ পায় না সে। কিন্তু না আঁচালে, সে যে বিচ্ছিরি কিছু করে বসেছে তা সে বিশ্বাস করবে কী করে? তবু কিছু টের না পেয়েই সেই নাটের মধ্যে আরো সে এগিয়ে যায়
আপনারা গর্ব গর্ব বলছেন বটে হজুর কিন্তু আমি তো নিজের কোনো গর্ব দেখতে পাচ্ছি না। গর্ব কাকে বলে—গর্বের মানে কী, তাই আমি জানি না এখনো।
গর্ব কাকে বলে জানো না? বলে তিনি নিজের বিপুল উঁড়ির দিকে তার নজর টানেন—এই যে! এই হচ্ছে এর মানে। তুমি এটা জানো না?…একেই বলে থাকে গর্ব।
আপনার গর্বের কারণ আছে। আপনি পদস্থ কর্মচারী, আপনার গর্ব হতে পারে কিন্তু আমি সামান্য নগণ্য লোক, এহেন কথা বলে এমন করে আমায় অপদস্থ করা আপনাদে উচিত নয় কখননা। দয়া করে তা করবেন না স্যর। এই আমার বিনীত অনুরোধ।
পুলকেশ বিনয়ে গলে পড়লেও দারোগাবাবুদের আদৌ পুলকিত দেখা যায় না। তিনি খাপ্পা হয়ে ওঠেন—কী গর্ব গর্ব করছো তখন থেকে! গর্ব কাকে বলে জানো না? গর্বের মানে কী, তাও বুঝি তোমার জানা নেই? গর্ব বানান করতে পারো? নাকি, তাও একদম জানো না?