অগত্যা, সে তার এক কম্পাউণ্ডার বন্ধুর কাছে গিয়ে, না, কোনো টাকাকড়ি নয়, এক ফালি ব্যাণ্ডেজ মাত্র ধার চাইল কেবল। তারপর তার সাহায্যেই সেইটে নিজের মাথায় বেঁধে নিয়ে একটা নামকরা হাসপাতালের গেটে গিয়ে গাট হয়ে বসল সে।
একটু পরেই এক পথচারী এইভাবে ম্লানমুখে তাকে সেখানে বসে থাকতে দেখে সদয় হয়ে শুধালেন, কী হে! হাসপাতালে অ্যাডমিশন পাওনি বুঝি?
না স্যর। সেরে যাবার পর তারা বার করে দিয়েছে আজ আমায়।
হয়েছিল কী? কী করে চোট লাগল তোমার মাথায়?
আজ্ঞে, ট্রাম থেকে পা ফসকে পড়ে গিয়ে মাথা ফেটে গেল আমার। কার, স্বরে সে জানায়।
বিচিত্র নয়! যা ভিড় বাপু ঐ ট্রাম-বাসে আজকাল। ঝুলতে খুলতে যেতে একদিন আমিও তো প্রায় পড়ে যাই আর কি! পড়ে গেলে আমারও ঠিক ঐ দশাই হতো। কি, মারা যেতাম কিনা তাই বা কে বলবে! বলতে গিয়ে শিউরে উঠলেন ভদ্রলোক। তা, এখানে বসে আছো কেন এমন করে? বাড়ি যাও।
আজ্ঞে, ছাড়া পেয়েছি বটে, কিন্তু বাড়ি যাবার গাড়ি ভাড়া তো কাছে নেই, তাই… বলে সে চুপ করে বসে থাকে।
বাড়ি কোথায় তোমার?
খিদিরপুরের দিকটায়, সেই মোমিনপুরেই। আনা চার পাঁচ পেলেই আমি ট্রামে কি বাসে চেপে চলে যেতে পারি।
আবার ট্রাম! এই ব্যাণ্ডেজবাঁধা মাথা নিয়ে—অ্যাঁ? ফের সর্বাঙ্গ-শিহরণ হলো দ্রলোকের : এবার পড়লে আর তোমার বাঁচন নেই বাপু! তুমি বরং একটা ট্যাকসি নিয়ে চলে যাও তার চেয়ে।
পুলকেশ কোনো জবাব দেয় না। তাকে যেন আরো বেশি ম্লান দেখায়। আরো যেন সে দমে যায় কথাটায়।
মোমিনপুর যেতে হলে কত পড়বে ট্যাসিতে? যাইনি কখনো তো। আচ্ছা, এই নাও, পাঁচ টাকা ধরো। সদয় ভদ্রলোক পুলকেশের অনিচ্ছুক হাতে নোটখানা ধরিয়ে দিয়ে বলেন, নাও, নিতে কোনো কুষ্ঠাবোধ কোরো না। তুমি আজ আমায় খুব শিক্ষা দিয়েছ ভাই! তোমার দশা আমারো তো হতে পারত কোনোদিন। বাঁচিয়ে দিয়েছ তুমি আমায়। তার বিনিময়ে এই সামান্য পাঁচ টাকা মাত্র তোমায় দিলাম…না, আমি আর কোনোদিন ওই ট্রামে বাসে চাপছি না। অন্ততঃ ভিড়ের সময় ওই ভাবে ঝুলতে ঝুলতে তো কখনই নয়।
রোমাঞ্চিত হতে হতে বিদায় নিলেন ভদ্রলোক।
অন্তরে পুলকিত হলেও পুলকেশ আরও বেশি বিষণ্ণতর হয়ে বসে রইল। সেইখানেই। তার পরেও।
একটু পরে আরেক শিকার এসে পড়ল তার অভিনয়ের আসরে। তাঁকে তেড়ে গিয়ে ধরতে হলো না, তিনিই নিজগুণে ধরা দিলেন তার ফাঁদে।
সব শুনেটুনে একটা টাকা তার হাতে দিয়ে বললেন—নাও, বাড়ি যাও এবার। তার আগে কোথাও কিছু খেয়েটেয়ে নিয়ে, কেমন? তোমার ট্রামভাড়ার চাইতে কিছু বেশিই দিলাম সেইজন্যে।
এই করে এক বেলায়ই তার মন্দ রোজগার হলো না। তারপর রোদ একটু চড়ে উঠতেই চাড়া দিয়ে উঠল সেভার ভার মুখ ফেলে…বেশ ভার ভার পকেট নিয়ে।
সেরা এক হোটেলে গিয়ে খানাপিনা সেরে একটা সিনেমা দেখতে বেরিয়ে পড়ল পুলকেশ। মনের পুলকেই!
এমনি করে খোশখেয়ালে চলতে লাগল খাসা তার। দিনের পর দিন এই অভিনয় করেই।
ভালো ব্যবসা ফেঁদেছে সে! পালাযার আপিস থেকে বিদায় নিয়ে পালা করে নিত্য, নতুন এই যাত্রার পালা তার—শহরের বিভিন্ন আরোগ্যশালার মুক্তাঙ্গনে। অভিনয় নিয়ে ব্যবসা করে অনেকে, ব্যবসার অভিনয়ও করে বিস্তর-জনা, কিন্তু অভিনয় আর ব্যবসা একাকার করে একাধারে এই টু পাইস উপায় করতে একমাত্র সে-ই পেরেছে।
এই ব্যবসায় বাড়তি খরচাও নেই এখন। আপিস ভাড়া, কর্মচারীর বেতন ইত্যাদি লাগে না। হাসপাতাল বানিয়েছেন সরকার বাহাদুর, তার সামনের ফুটপাথ সবাইকার, সেই ফাঁকা ফুটপাথেই তার আপিস খোলা। ইস্টাব্লিশমেন্ট খরচা কিছু নেই, আর ওভারহেড এপেন, সধরতে গেলে, মাথার এই ব্যান্ডেজ।
এই মূলধন নিয়েই তার ফলাও কারবার।
মাথার ব্যাণ্ডেজটা কেবল পরিষ্কার করতে হয় মাঝে-সাঝেযাতে হাসপাতালের টাটকা-ছাড়া-পাওয়ার মতই তাকে দেখায়। সার্ক কিংবা লা পাউডার দিয়ে সাফ করতে হয় দু তিন দিন অন্তর—নিজের পক্ষে এইটুকুই তার সাফাই-এতখানিই মেহ্নত। তারপর দিনভোব এনতার লাক্সারি। রেস্তরাঁয় খাও, সিনেমায় যাও—ইতস্ততঃ গতিবিধি করো তোমার প্রাণ চায়।
হাসপাতালও কিছু কম নেই কলকাতায়। সরকারী বড় বড় হাসপাতাল কয়েকটা তো রয়েছেই, তাছাড়াও, শহরের এখানে সেখানে আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে বেসরকারী হোট মাঝারি আরো অনেকগুলো। দৈনন্দিন তার যাত্রাপালা পালটে পালা করে সেইসব মুক্তাঙ্গনের আসরে গিয়ে বসলেই হলো। শহরে সহৃদয় বোকা লোকের অভাব নেই বিশেষ।
নতুন নতুন ভূমিকায় নব নব রূপ ধরে অভিনয় করার প্রয়োজন সে অনুভব করেনি। একই দর্শক বা দাতার দুবাব দর্শনদানের সম্ভাবনা বিরলই ছিল। কলকাতার রাস্তায় নিজের তাড়াহুড়ায় ব্যস্ত সবাই! কে কার দিকে নজর দেয়? কে কাকে মনে করে রাখে? তাছাড়া তার নিজের নজব বেজায় সাফ, একব্যক্তিকে দুবার দোহন করে ধরা পড়ার ভয় ছিল না তার। এই বিরাট শহরে পঞ্চাশ লাখ লোক, একজনের ওপর দুবার কোপ মাবে এমন ব্যাড লাক হবার সাধ্য কি? বকরিদ-পরবের পরদিন কোন মুর্গি কি বরি-র বেঁচে থাকার মতই সেটা অবাস্তব।
শহরের প্রান্তে প্রান্তে তার অজান্তে ছোটখাট আরও কতো শিকারক্ষেত্র রয়ে গেছে। অচেনা এলাকায় ঘুরতে ঘুরতে একদিন এমনি একটা নজরে পড়ে গেল তার। প্রথমে সে খেয়াল করেনি, কিন্তু তার সামনে দিয়ে একটা অ্যাম্বুলেন্স গাড়ি সেখানে গিয়ে সেঁধুতেই সে ঠাওর করে দেখল, হ্যাঁ, একটা হাসপাতাল গোহেরই তো বটে ওই বাড়িটা।