তোমার যেমন মেয়ে দেখবার ঝোঁক, আমাদের তত হেলে দেখার শখ নেই। সত্যি বলতে, রাস্তায় বেরুলে ছেলেদের দিকে তাকাইওনে বড় আমরা। মেয়েদেরকেই দেখি—আমরাও। তোমার চোখ নেইকো, তাই তোমার নজরে পড়ে না।
মেয়ে দেখিস! তোরা তো মেয়েদের শাড়িটাই দেখিস খালি। কে কী রকম শাড়ি পরেহে, কেমন করে পরেছে…এই সব তো দেখিস। আর আমরা দেখি শুধু মেয়েদের…তার শাড়ি-টাড়ি সব বাদ দিয়ে…আমাদের স্বভাবসিদ্ধ দিব্যদৃষ্টির সাহায্যে।
আর তোমরা বুঝি শাড়ি দ্যাখো না? চলে নীল শাড়ি নিঙাড়ি নিঙাড়ি…কে বলেছিল গো? চণ্ডীদাস, না, কোন চণ্ডীদাসী?
আরে, আমিও জে সেই কথাই বলছি রে। আমারও সেই কথা, তবে একটু অন্য বানানে…আহা, চলে nil শাড়ি নিঙাড়ি নিঙাড়ি পরাণ সহিত মোর…আহা!…
মুখের আহাকার দিয়ে মনের হাহাকার চেপে চলে এলাম, আর গেলাম না ওদের বাড়ি…পূজোর সময়টায় গেলাম না আর।
কী হবে গিয়ে? জবা কেমন তার বোনদের সঙ্গে মজা করে মামাদের মোটরে ঘুরে পূজো দেখে বেড়াচ্ছে…কত কী খাচ্ছে নামজেয়াদা যত রেস্তোরাঁয়…কী হবে তাকে সেই সুখের থেকে ছিনিয়ে কলকাতার পথে পথে আমার মতন হতভাগার সঙ্গে ট্যাং ট্যাং করে ঘুরিয়ে? গেলে হয়ত আসত…তেমন প্রতিবাদ করার স্বভাব নয় জবার, মুখ বুজে চলে আসত আমার সঙ্গে…কখনো কোন কথায় না বলে না…আহা, বেচারীর জন্যে আমার মায়া করে।
বাসা ফাঁকা, সবাই যে যার বাড়ি চলে গেছে পূজোর ছুটিতে। আমার তো আর বাড়ি-ঘর-দোর নেই, যাব কোথায়? সারা বাসায় একলাটি আমি। খোলা বারান্দায় ডেক-চেয়ারে শূন্য আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে কাটিয়ে দিলাম পূজোর কদিন।।
আমিও আর বেরুলাম না কোথাও। কোথায় যাব? রাস্তায় সুন্দর সুন্দর মেয়েরা আছে জানি, কিন্তু তারা তো বিলকুল কিছু না, সুন্দর সুন্দর শূন্য কেবল। যে একজন পাশে থাকলে তারা সত্যিকা সুন্দর হয়ে ওঠে, দেখবার মতন হয়, সেই একটিই তো আমার পাশে নেই। সেই একা থাকলেই তবেই না পৃথিবী সুন্দর…পৃথিবীর সবকিছু সুন্দর? সেই একটি পাশে থাকলেই তবেই না এইসব শূন্যের মূল্য বেড়ে যায়…দশগুণ…একশগুণ…হাজারগুণ?
অসহ্য ভিড় রাস্তায়। আর কী দারুণ হট্টগোল। তবে হ্যাঁ, সেই একজন পাশে থাকলে এই অসহনীয় ভিড়ও গভীর আনন্দে উদ্বেল হয়ে ওঠে। ভিড়ের ভেতর তাকে জড়িয়ে, আগলে নিয়ে যাবার সুযোগে চারধারের চাপে জর্জর হতে ভালই লাগে আরো বরং। সঙ্গীর মত সঙ্গী থাকলে সেই নিদারুণ সঙ্গীন অবস্থাও সঙ্গীতের মতই হয়ে ওঠে সত্যি।
সেই একজনের আলোতেই সব কিছু দেখা যায়…সমস্ত দর্শনীয় হয়ে ওঠে…সে-ই তো আলো। কিন্তু সে কোথায়?
পূজোর পবে বিজয়ার মিষ্টি কুড়োতে বেরুলাম। বিজয়ার পর দিগ্বিদিক-বিজয়ে।
প্রথমেই গেলাম ওদের বাড়ি।
দোরগোড়াতেইতুর সঙ্গে দেখা হতেই শুধালাম—কী রে! কী রকম কাটালি পূজোটা? ভারী মজায় কেটেছে শিব্রামদা। আজ এ মামার গাড়িতে কাল সে মামার গাড়িতে…কিন্তু এ-কদিনই তুমি এলে না কেন বল তো? দিদি পূজোর কদিন একদম বেরোয়নি, বাড়ির থেকে…কখন তুমি আসবে বলে বাড়িতে বসে ছিল সারাক্ষণ।
তাই নাকি রে জবা?
জবা কিছু বলল না, একটুখানি হাসল কেবল।
ওই চোখ আর অমন হাসি আর কোন মেয়ের আমি দেখিনি আমার জীবনে।
যবনিকা পতন
লোকে কয় অভিনয় কভু নিন্দনীয় নয়, নিন্দার কারণ শুধু অভিনেতাগণ-বলে গেছেন নটগুরু গিরিশচন্দ্র। অভিনেতৃত্ব নিন্দার কারণ তো বটেই তার চেয়েও কিছু বেশিই বরং; বিতান্ত মারাত্মকভাবেই কথাটা ফলে গেল।টবর পুলকেশের জীবনে। সে নিজেই যেন উদাহরণস্বরূপ হয়ে দাঁড়ালো মহাকবির ঐ মহাবাক্যের।।
অভিনয় করার শখ তার বাল্যকালের থেকে। পেশাদারী রঙ্গমঞ্চে একটা সুযোগ পাবার জন্যে কতো না ঘোরাঘুরি করেছে একসময়; কিন্তু দুঃখের বিষয়, নেপথ্যে কোলাহল কিংবা জনতার একজনের ভূমিকার চেয়ে বেশিদূর আর এগুতে পারেনি। অবশেষে বিরক্ত হয়ে পাটের মত পার্ট পাবার আশায় যাত্রাদলে গিয়ে যোগ দিল সে।
যাত্রাপালায় এক আধটা পাট পেলেও তার পাট অব শীচই একটা বাধা হয়ে দাঁড়ালো–সংলাপাংশেই মার খেলে শেষটায়। মদ কি গাঁজা খাওয়ার হেতু নয়, হয়তো কানে একটু খাটো বলেই যাত্রার আসরে সে বেহুশ হয়ে পড়ল একদিন। অভিনয়ের শিক্ষানবিশির সূচনাতেই তার অভিনেতা-জীবন বিষিয়ে দিল সেই ঘটনায়।
প্রম্পটিং ঠিক ঠিক শুনে সেটা সঠিকভাবে ওগরাতে পারাটাই নবিশ (কিংবা নডি)দের অভিনয়-পটুতার গোড়ার কথা। নহুসের প্রেতাত্মা কাঁদিহে এই কথাটা বলতে গিয়ে সে বলেছিল বেহুশের প্রেতাত্মা কাঁদিছে। কথাটা নাকি ঠিক হয়নি। কিন্তু কেন যে হয়নি তা তার বোধগম্যের বাইরে। যাত্রাদলের অধিকারীকে সে তর্ক করে বোঝাতে গিয়েছিল যে, নহুস মানেও যা বেহুশ মানেও তাই। ওটা বলায় তার কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি, তারতম্য হয়নি এমন কিছু প্রেতাত্মার কোনো হুশ থাকবার কথা নয়, এইটেই এখানে আসল কথা।
অধিকারী আর কথা না বাড়িয়ে পত্রপাঠ আসর থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন তাকে।
আসর থেকে সরে আসতে হলেও অভিনয় থেকে সরবে না এই হচ্ছে তার প্রতিজ্ঞা। যে মাটিতে পড়ে লোক ওঠে তাই ধরে—এই অভিনয় ধরেই সে উঠবে, বাঁচবে, বিখ্যাতও হবে হয়তো বা কোনোদিন।
না, মুক্তাঙ্গনেই সে অভিনয় করবে এর পর থেকে। মুক্তাঙ্গন রঙ্গমঞ্চে নয়, পৃথিবীর মুক্ত অঙ্গনে।
কিন্তু কিছু টাকা তো চাই। পকেটে একটা কানাকড়িও নেই। অধিকারী তো মাইনে না দিয়েই ভাগিয়েছেন। কলকাতার পথে-ঘাটে ঘোরাফেরা করতেও পয়সা লাগে—ঘোরালো অভিনয়ের কথা তো পরে। পৃথিবীর অঙ্গন চারধারেই বিমুক্ত বটে, কিন্তু একটা টাকা ধার দেবার লোক কোনোবারেই নেইকো।