সব ভালবাসায়ই সমান যন্ত্রণা। সব টানের একই পোড়ানি, টানাপোড়েনে সব মেহই সমান। কডলিভার তেলের মতই আঁশটে।
এমন কি, একদার প্রীতি যখন এক সময়ে স্মৃতিতে এসে পর্যবসিত হয় তখনো বুঝি মনের কোণে ধূপের মতই তা পুড়তে থাকে। অনুক্ষণকে সুরভিত করে রাখে পুড়ন্তকে।, আর, সেই জন্যেই ভুলে গিয়েও বুঝি ভোলা যায় না।-ভুলে থাকলেও ভোলানাথের ঝুলির মধ্যে থেকে যায়। হারিয়ে গিয়ে ফিরে ফিরে আসে ফের আবার।
তাই এখনো আমার মনে পড়ে, পূজোর সময়টায় বেশি বেশি আরো, মনের জুতোয় সেই পুরনো কাঁটাটা বেরয় যেন, এতদিনের এত তালি পড়ার পরও তলায়নি সেটা দেখা যায়, চলতে ফিরতেই কোথায় যেন খচ খচ করে।
সেবার পূজোর মুখে ওদের বাড়ি যেতেই ইতু বলে উঠল—জান শিব্রামদা, এবার আমরা মজা করে মোটরে চড়ে ঘুরে ঘুরে কলকাতার যত পূজো দেখব, মামাদের সঙ্গে বেরুব এবার, জান?।
তাই নাকি রে? আমি বললাম। বলতে বলতে একটা উজ্জ্বল মুখকে নিতে যেতে দেখা গেল সামনের আয়নায়। আমার নিজের। জবাদি আর তোমার সঙ্গে ট্যাং ট্যাং করে ঘুরবে না এবার। পুতুল জানায়, তুমি যে ওকে ল্যাজে বেঁধে নিয়ে কলকাতায় চষে বেড়াবে সেটি হচ্ছে না।
কে বললে? মোটেই আমি ওকে ল্যাজে বেঁধে নিয়ে ঘুরিনে। কথাটা যেন জবার পক্ষে মানহানিকর মনে হয় আমার কাছে, তাই আমি প্রতিবাদে সোচ্চার—বরং বলা রায়, আমিই ওর ল্যাজে বাঁধা হয়ে ঘুরে থাকি।
আমার,লেজস্বিতার বিপক্ষেই আমার ভোট।
ওই হলো। বলল পুতুল, তোমার লেজের প্রিভিলেজ জবা আর নেবে না এবার। তোমাকেও আর ওর লেজুড় হতে হবে না। এবার সবাই আমরা মজা করে আমাদের মোটরে চড়ে সার্বজনীনে সার্বজনীনে পূজো দেখে দেখে বেড়াব কেমন!
আহা! মোটরে বেড়াতে যে কী মজা! এই উঠলাম আর এই দুম করে পৌঁছে গেলাম—দেখতে না দেখতেই। দেখবার কত কী থেকে যায় কিছুই তার দেখা হয় না।
কলকাতার রাস্তায় দেখবার কী আছে ছাই! ঠোঁট ওলটায় ইতু, খালি ভিড় আর ভিড়!
আরে, সেই ভিড়েব গতীরেই তো যত মণিব খনি! যত রমণীয় মণি। সুন্দর মেয়েরা তো কলকাতার পথেই পড়ে আছে রে! রাস্তায়ই তাদের পাওয়া যায়। দেখতে দেখতে যাও আর দেখতে না দেখতেই হারাও। বলে আমার দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলি।
মেয়েদের আবার দেখবার কী আছে? পুতুলের প্রশ্ন।
তা বটে! তোদের দেখবার কী আছে আর! কিন্তু বলেছে না, যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখ তাই…বলেছে না কথায়? পেলেও পাইতে পার লুকানো রতন। মেয়েদের আশে-পাশেই ছেলেদেব পাবি—তাঁরা তো তোদের দেখবার বটে! কত সুন্দর সুন্দর ছেলে-তারাও ঐ পথেঘাটেই ছড়ানো। তাদের দেখতে পারিস।
বলে আমি পুনশ্চ যোগ করি-–তবে ছেলেদের মধ্যে তোরা যে কী দেখিস তা তোরাই জানিস। আমি তো ভাই ওদের ভেতর দেখবাব কিছু পাইনে। তোরা আবার তাদের দেখেই ভুলে যাস না কি—কে বলে?
তোমাকে বলেছে! পুতুলচন্দর ঠোঁট ওলটায় তার : ছেলে দেখতে বয়েই গেছে আমাদের।
আমাদের দেখতে হয় বাধ্য হযে। না-দেখে উপায় কী! পৃথিবীর আদ্ধেক মেয়ে হলেও, দুনিয়ার আর সব চীজের মতই মেয়ের মধ্যেও ভ্যাজাল। ঐ ছেলের ভ্যাজাল। পৃথিবীর অদ্ধেকটাই ভ্যাজাল বলতে গেলে। কিন্তু উপায় নেই, তাই পিতৃরূপে ভ্রাতৃরূপে আগলে রয়েছে মেয়েদের-দারোয়ানকে খুশি না করলে বাড়ির ভেতরে ঢোকার যো কী? আম খেতে হলে আঁঠিসমমতই নিতে হবে, তবে খাবার সময় আঁঠি বাদ দিয়ে খাও। তখন আর আঁঠিটি না দেখালেও চলে। দেওয়ানী আমে গিয়ে পৌঁছলে পর তখন আর আঁঠির দেওয়ানী করার দরকার করে না। যেমন…
একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে গিয়ে আমি থেমে যাই। .
যেমন? পুতুল থামে না।
যেমন, প্রথমে তো তোদের দাদার সঙ্গেই ভাব জমেছিল আমার। তাই গোরার সঙ্গেই বেড়াতাম গোড়ায়। তখন তোরা সব এই টুকুন টুকুন ছিলিস্। মিশবার মতন হসনি তখন। কিন্তু তারপরে তো…জবার সঙ্গেই ঘুরি এখন।
তোমার সঙ্গে টই টই করে ঘুরে আবার গায়ে গত্তি লাগল না ভাই! আক্ষেপ করে পুতুল।
ঘুরে ঘুরে আমরা কত কী খাই। খাই না রে জবা? চীনেবাদাম চানাচুর ঘুঘনিদানা আলুকাবলি ফুচকা–কত কী। কাজুবাদামও কখনো-সখনো। এক পা যাও, একটুখানি ধাও। পকেটে পয়সা থাকলে সন্দেশ-রসগোল্লাও।
রাস্তায় আবার খায় নাকি মানুষ? ইতু কটাক্ষ করে।
রাস্তাতেই তো খাওয়ার বেশি মজা রে। এমন কি, যে জিনিস মানুষ স্থির হয়ে খায় আর খেলে স্থির হয়ে যায় তাও রাস্তায়, চলতে চলতে খেলে, আরো বেশি মিষ্টি লাগে, তা জানিস? আমি জানাইঃ যেতে যেতে খাও আর খেতে খেতে যাও।
অতো লোকের চোখের ওপর? ইতুর চোখ বড় বড় হয়।
লোক কোথায় রে! ভিড় তো! ভিড়ের মধ্যে কারো কি কোন দিকে নজর দেবার যুরসত আহে? কেউ কারো দিকে তাকায়ও না। জনারণ্যের মতন নির্জন জায়গা নেই আর। আমি জানাই, পাবার যা কিছু ঐখানেই পাবে। খাবার যা কিছু ঐখানেই খাবে। আবার হারাবার যা কিছু হারাবে ঐখানেই। ঐ জনতার মধ্যেই।
আমরাও খাব গো। খালি মোটরে করেই যাব না। মামারাও খাওয়াবে আমাদের। গ্রাণ্ডে,—চাংগোয়ায়, কফি হাউসে কলকাতার নামজাদা যতো বড় বড় রেস্তরাঁয়। তোমার মতন চার পয়সার চানাচুর নয়—চপ কাটলেট ফিশফ্রাই কত কী খাব আমরা মজা করে কেমন!
তোদের খালি খাই খাই। খাওয়া আর খাওয়া। খাওয়াটাই কি জীবনের সব নাকি? দেখাটা কিছু না? অবশ্যি, নানারকম চেখে দেখা যে মন্দ, এমন কথা আমি বলিনে, কিন্তু নানাবিধ চোখে দেখাটা? বললাম না যে পৃথিবীতে আমাদের আধাআধি বখরা-আদ্ধেক ছেলে আর আদ্ধেক মেয়ে। ছেলেগুলো সব তোদের জন্যে…বললাম না?