আমার কথাটায় ও কেমন গম্ভীর হয়ে যায়। কিছু বলে না।
নীলিমা আমার কাছে আজ শূন্যতাই। সেই ফঁকা আকাশের অন্ধকারের দিকে তাকালে কোনো সুদূর নক্ষত্রের ক্ষীণ দীপ্তিটুকুই বুঝি চোখে পড়ে…যা নাকি কালের পারাবারে কবেই অস্তমিত হয়েছে।
তবু যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। আমি আর এক আশ্বাসে দুলে উঠি : চঞ্চল তো এখন অসুখ-শয্যায় শায়িত। জ্বরের ঘোরে অকাতরেই ঘুমুচ্ছে? এই ফাঁকে, এখানে এই কাশীপুরেও তো গঙ্গা কাছে,—আমরা একটু বেড়িয়ে আসতে পারতুম। সেই হারানো দিনগুলির পুরোনো স্বপ্ন ফিরে আসত আবার। বলতে বলতে আমার নজর পড়ল অদূরবর্তী দোতলার এক অলিন্দে। সেখানে ফুলের টবগুলোর আড়ালে কোনো অলি নয়, তার চেয়ে বলিষ্ঠতর হৃষ্টপুষ্ট বাহু আর কটমটে চোখ দেখা গেল যেন। কার যেন চাঞ্চল্য দেখলাম মনে হলো।
আচ্ছা আজ থাক। বলে উঠলাম আমি: অসুস্থ রুগীকে একলা ফেলে কোথাও যাওয়া হয়তো ঠিক হবে না। বেচারা জেগে উঠে তোমাকে দেখতে না পেয়ে যদি আরো চঞ্চল হয়ে ওঠে সেটা খুব খারাপ হবে। বন্ধুর অসুখ আর বাড়াতে চাইনে, ওর নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটাতেও আমি নারাজ। আমি চলি আজ। চল সেরে উঠলে একটা পোস্টকার্ডে আমাকে জানিও। নইলে খুব ভাবিত থাকব। বুঝেছো? এই বলে আমি উঠলাম। বেঞ্চির মায়া কাটিয়ে, নীলিমা ওরফে আমার মায়াকে সেইখানে রেখে, চঞ্চললগ্ন অলিন্দের ধার ঘেঁষে আসবার সময় আড়চোখে উপর পানে তাকালাম—একটা ফুলের টব হাতে করে ও তা করছে ওর নজর ভারী নীচু বলতে আমি বাধ্য।
এই শীতের রাত্রে এই বাগানে এসে অপেক্ষা করা–কিন্তু উপায় কী? কষ্ট না করলে কি কেষ্ট মেলে? রাধাও মেলে না। আপনা হতেই আমার মুখ থেকে ফসকে গেল যেন স্বগতোক্তির মতই।
সঙ্গে সঙ্গে ওর হাত থেকেও ফসকেছে। একটুর জন্যেই আমার মাথাটা ফসকে গেছে। আমিও একামী ছুঁড়েছি, ও-ও টবটা হেড়েচে। সামান্যর জন্য আমার কাশীপুরপ্রাপ্তি ঘটলো না। কাশীমিত্রতা-ও কান ঘেঁষে বেরিয়ে গেল নেহাত।
কদিন বাদে মায়ার একটা পোস্টকার্ড পেলাম।
আশ্চর্য, তুমি চলে যাবার পরই উনি চাঙ্গা হয়ে উঠলেন। শুনে অবাক হবে, এই পৌষের ঠাণ্ডায় সারারাত উনি বাগানের হাওয়া খেয়ে কাটালেন হাতে লোহার মুগুর নিয়ে তার ওপরে। বললেন, অক্সিজেন নেয়ার সাথে সাথে ব্যায়াম করলে শরীর ভাল হয়। সারারাত আমার ঘুম হলো না—কেবল তোমার পৌষ মাস আর নিজের সর্বনাশের। কথা ভাবলাম। যা হোক ফঁড়াটা কেটেছে। সকালে দেখা গেল উনি দিব্যি আরাম। সর্দি। কাশি জ্বরটর কিছু নেই, চেহারাও চকচকে। নেচার-কিওর জিনিসটা দেখছি মিথ্যে নয় একেবারে, তুমি কী বলে? বলতে কি, এইটেই আমায় সবচেয়ে বেশি অবাক করেছে। আরো।
ভালবাসার অনেক নাম
কডলিভার তেল মেখে মুড়ি খাওয়াটাকে আমি ভালবাসার বদনাম দিতে চাইনে, কিন্তু তাই একবার খেতে হয়েছিল মেয়েটার জন্যে আমায়।
কিছুতেই শরীর সারছিল না জবার, ডাক্তার ব্যবস্থা করলেন কডলিভারের। কিন্তু তাই কি খাবার পাত্রী সে! বলে যে, কী বিচ্ছিরি গন্ধ বাবা! ভাত খাবার পরে খাবার জিনিস নয় ও। তিন চামচ কেন, ওর এক চামচ মুখে তুললেও, তক্ষুনি তক্ষুনি ভাত-টাত সব বমি হয়ে উঠে আসবে। এমনকি, অন্নপ্রাশনের ভাত অব্দি।
শোন কথা! খাওয়ার আগে খেতে কি কোন বাধা আছে? তাহলেও তো হয়? তাহলে নাকি ওর খাওয়ার রুচিই চলে যাবে একদম।
তাহলে স শবীর সারবে কী করে!
এগুতে হলো তখন আমাকেই—নিয়ে আয় তোর কডলিভার। কেমন খেতে খারাপ দেখি তো! আমি যেন কখনো কডলিভার খাইনি আর! কডলিভার না খেয়েই যেন আমার এই শরীর হয়েছে—এমন হৃষ্ট-পুষ্ট মেদধী বপু কি অমনিই হলো নাকি আমার?
কডলিভার খেয়ে তুমি পুষ্ট হয়েছ একথা মানতে আমি রাজি আছি, কিন্তু হৃষ্ট তুমি কখনই হওনি, আমি দিব্যি-গেলে বলতে পারি দাদা? জবা বলে।
হৃষ্ট হইনি? এখুনি তোর সামনে হৃষ্ট হয়ে খাব,
আমি বললাম, কিন্তু তোকেও খেতে হবে তার পরে।
আচ্ছা, আগে খাও তো তুমি দেখি। বমি না করে খাও দেখি একটি চামচ একবার।
এল কডলিভাব।
আমি বললাম, কডলিভার কি আর শুধু শুধু খায় রে! কিছুর সঙ্গে খেতে হয়, নয় কিছু খাবার আগে বা পরে। বাড়িতে ভালমন্দ খাবার কী আছে নিয়ে আয়।
মুড়ি আছে। খাবে? সে বলে, রান্নাঘর থেকে ভাত নিয়ে আসব নাকি?
আরে ভাত হলে তো ভালই হয়। ইলিশমাছের তেল দিয়ে ভাত খেতে যেমন খাসা লাগে, কডলিভার দিয়ে মেখে খেতে তার চেয়ে কিছু কম উপাদেয় নয়। ও তো মাছের তেলই বটে রে, সামুদ্রিক মাছের। তবে এখন মুড়ি দিয়েই একটু জলযোগ করা যাক নাহয়।
কডলিভার মাখা মুড়ি তারিয়ে তারিয়ে খেতে লাগলাম আমি। বললাম-আরেক চামচ ঢেলে দে মুড়ির ওপর। আহা, খেতে কী ভালই না লাগছে রে! যেন আচারের তেল মেখে মুড়ি খাচ্ছি, ভাই!
দাও তে আমায় একগাল, চেখে দেখি। জবা হাত বাড়ায়। গালে দিয়ে বলে—না, ততটা খারাপ নয় তেমন।
ভাল লাগছে তো? বলেছিলাম না? দুদিন খা-না, তারপর দেখবি ঠিক নলেন গুড়ের মতই মনে হচ্ছে তোর। আমি মাকে লুকিয়ে চুরি করে কডলিভার খেতাম রে…দাঁড়া, কে যেন ডাকল না আমায়? তুই খেতে থাক, দেখে আসি কে ডাকছে আমাকে…
বলে এক ছুটে বাইরে গিয়ে বমি করে উদ্ধার পাই।
সৌভাগ্য কি দুর্ভাগ্য জানিনে, আমার সাত মাসির সৌজন্যে, জীবন আমার বনে। বনে অরণ্য এই অরণ্যবৃহ থেকে এ জীবনে বেরুতে পারব সে ভরসা আমার নেই। না থাক, তার জন্য কোন খেদ নেই আমার। বনের বাইরে যে ব্যক্তি কখনো উঁকি দেবার ফাঁক পায়নি, তার জীবনও নিছক ফাঁকি নয়, তার জন্য বনের মধ্যেই লাবণ্য; প্রকৃতির বদান্যতায় তার নিমিত্ত বনান্তরালেই বিচিত্র ফলফুল; বসন্তের সমারোহ। ঊষর মরুভূমির বাসিন্দার জন্যেও মরীচিকাই নয় কেবল, ওয়েসিসও রয়ে গেছে। পাহাড়ের শুষ্ক কাঠিন্য ভেদ করে ঝর্ণাধারা উৎসারিত হয়, কার জন্যে, কে জানে!