—আমার উচ্ছ্বাসে আমার কথাটা চাপা পড়ে গেল আপনিই। তুমি বুঝি ফুলের ভারী ভক্ত হয়েছে আজকাল? আমি জিজ্ঞেস করি ওকে।
হ্যাঁ,—তা কিছুটা, শ্রীমতী রায় প্রকাশ করেন, বাগানে শখটা ওঁরই বেশি। আমার তেমন মন্দ লাগে না।
ও বাবা! এধারে যে বাঁধাকপিও দেখছি আবার। চমকে উঠতে হলো আমায়।
ফসল আরো ফলাও করার জন্যই। গ্রো মোর ফুড আন্দোলনের উনিও এক পাণ্ডা কিনা। ধানগাছও লাগানো হয়েছিলো ওধারটায়। কোথা থেকে তুলে এনে লাগিয়েছিলেন উনিই জানেন। ওঁর ধারণা এই ভাবে সাধ্যমত উনি দেশের সেবা করছেন! অবশ্যি ধানগাছগুলোয় ধান মোটেই ফললো না, কেন জানিনে। আর কপিগুলোও কেমন যেন দর্কচা মেরে গেছে, কদ্দুর ওতরাবে কে জানে।
বেড়াতে বেড়াতে বাগানের একধারের বেঞ্চে আমরা বসলাম।
বাঃ, বেশ সুখেই আহে চঞ্চল। আমার দীর্ঘনিঃশাস পড়লো; একাধারে দেশলক্ষ্মী আর এমন গহলীর সেবা করার সুযোগ যে পেয়েছে তার মতন সুখী কে? এমন লক্ষ্মীর দশা কজনার হয়?
মায়ার হাতখানা বেঞ্চির উপরে পড়েছিল। অকস্মাৎ, কিছু ইচ্ছে করে নয়, একান্তই দৈবাৎ আমার হাতখানা তার ঘরে গায় গিয়ে ঠেকল।
তারপর নেমে এল আশ্চর্য এক নীরবতা—ভাবালু এবং বাঙ্ময়—যার রহস্য নিয়ে কবিরা কবিতা লিখেছেন, গাক্সিকেরা গল্প জমিয়েছে, মনস্তাত্ত্বিকেরা পাগলামি করার কসু করেনি। ভাবগর্ভ সেই নীরব মুহূর্তগুলি লঘুপায়ে আনাগোনা করতে লাগলো।
এক এক সময়ে আমি ভাবি, বললেন ভূতপূর্ব মায়া সেন, কেন যে তুমি আর বিয়ে করলে না।
আমি বিষণ্ণ ভাবে ঘাড় নাড়লাম মানুষ জীবনে একবারই ভালোবাসে। বিয়ে অবশ্যি সে হাজার বার করতে পারে যখনতখন যাকে খুশি; কিন্তু ভালোবাসা সেইএকবারটিই হয়। আর আমার কথা যদি বলো, আমি লোকটা হচ্ছি একনিষ্ঠ। এক সময়ে—অর্থাৎ কিনা এক জীবনেদুজনের অনিষ্ট আমার দ্বারা হবার নয়। স্বভাবতই আমি অদ্বৈতবাদী, এক বই দুই জানিনে।
ঘাড় ফিরিয়ে আড়চোখে একটু তাকিয়ে নিলাম। না, আশপাশ চারধার ফঁকা। পাড়ার লোকেরা এখন চাল, চিনি, কেরোসিনের দরবারে সার বেঁধে দাঁড়াতে গেছে হয়তো। উকিঝুঁকি মারবার কেউ কোথাও নেই। সারা বাগানে খালি আমরা দুজন।
মায়ার হাতখানা আমার নাগালেই পড়েছিল, তেমনি অবস্থায়—তখনো। ঠিক একখানি আমন্ত্রণ-লিপির মতই।
আমন্ত্রণ আমি গ্রহণ করলাম। ললিত আঙুলগুলিকে ঈষৎ দলিত করে বললামঃ এই একনিষ্ঠ ধাতেব জন্যেই আমার মনে হয় এ জীবনে আমি কাউকে বিয়ে কবতে পারব না। এক যদি কবি, কোন বিধবাকে করব। কিন্তু ভেবে দেখলে সেও এখন আকাশ-কুসুমের স্বপ্ন…চঞ্চল অনেকটা সেরে উঠেছে তুমি বললে না?
অনেকটা ভালো এখন। যদিও জ্বর সম্পূর্ণ ছাডেনি, তবু কাশিটা অনেক কম। জানালো মায়া : চলো না, তোমাকে দেখলে উনি খুশি হবেন খুব।
হবেন বইকি, আমি সায় দিয়ে বলি : হবার কথাই। চঞ্চল আর আমি ছেলেবেলার বন্ধু। অবশ্যি, ওর বিয়ের পর থেকে আর তেমন ঘনিষ্ঠতা নেই। সাধারণতঃ কারো বিয়েব পর তা বড়ো থাকেও না আর। হয়, তার বৌ তোমাকে পছন্দ করে না, নয়তো তুমি তার বৌকে বেশি পছন্দ করো।
এই অবকাশে আমার চোখে মুখে একটা আলুথালু ভাব জেগে উঠল (আমি নিজে ঠিক দেখতে না পেলেও) আর আমার গলায় যেন আশাবরী সুর বাজতে লাগল (স্বকণেই শুনলাম) : মায়া, সেই আগের দিনগুলি তোমার মনে পড়ে? কী সুখের মুহূর্ত সব গেছে! সেই বিকেল বেলায় দুজনের গঙ্গার ধারে বেড়ানো?
এই কথা জিজ্ঞেস করবার জন্যে হাত ধরে থাকার কোনো দরকার করে না। হাত না ছাড়িয়েই বলল সেঃ তা ছাড়া এ হাত তোমার ধ্যই নয় আর। যা, আমার মনে পড়ে। কিন্তু আজকাল আমি আর গঙ্গার ধারে যাই না। উনি সেটা পছন্দ করেন না।
কেবল উনি আর উনি। এর মধ্যেই প্রায় উনিশ বার শুনতে হলো আমায়। প্রায় পড়-পড় দীর্ঘনিঃশাসকে কোনোরকমে আমি সামলে নিলাম। বাস্তবিক, অদ্ভুত এইমেয়েরা! বিনা অস্ত্রে কি নিপুণ লড়াই না এরা করে, এমন অকাতরে এত লোককে হতাহত করে যায়, ভাবলে তাক লাগে। যাক, ও যখন নিজেকে কাটিয়েছে, তখন আমারই বা আর মায়া বাড়িয়ে মরীচিকা লাভ করা কেন? আমিও কেটে পড়ি। অবশ্যি, আমি নেহাত একনিষ্ঠ লোক তা সত্যি। কিন্তু তাই বলে আমিও এই মায়া কাটাতে পারবো? আমার একনিষ্ঠার জের কি এতটাই অকাট্য? এতদূর জেরবার হবার পরেও…অ্যাঁ?
সত্যিই কি তুমি কোনদিন বিয়ে করবে না আর? সে বলে বসল হঠাৎ।
বিয়ে? বললাম তো, বিয়ে যদি কখনোকরি তো কোনো বিধবাকেইকরব।দীর্ঘনিঃশ্বাস মোন করে জানাই।–বুঝেছ মায়া?
তুমি মায়া বলে আর ডেকো না আমায়। ও তো আমার নাম নয়—ডাক নাম। হেলেবেলার নাম আমার। সেও যেন ফেঁস করে উঠল আমার কথায়।
কেন মায়া? মায়া নামটি তো মিষ্টি খুব। আমি আওড়াই। মায়ার ডাকে বুঝি বা নতুন করে ভোলাতে চাই তাকে।
আমার ভালো নাম কি নেই নাকি? আমার নাম তো নীলিমা। সে-নামটাই বা কী এমন খাবাপ?
না, খারাপ নয়। তবে আমার…আমার তবু সেই তোমার আগের নামটিই মনে জাগে কেবল। যে নামে আমি ডাকতুম তোমায় সেকালে। যখন তোমার সঙ্গে আমার ভাব ছিল…
এটা পোষমাস না? বড়দিন না আজ? অন্য প্রশ্নে মোড় ঘুরিয়ে প্রসঙ্গান্তরে আমার ভাবালুতাকে এড়িয়ে যেতে চায় সে।
আমার জীবনে আর বড়দিন এলো কোথায়? আমার সব দিনই তো বাড়ন্ত। আমার সব মাসই উপোসের মাস। পোমাস কি কোনদিন আর আসবে আমার এই জীবনে!
আবার আমার দীর্ঘশ্বাস : তবে এক পোষেই কিছু বড়দিন ফুরোয় না। আমার জীবনেও বড়দিন নিয়ে পোষ মাস হয়তো আসতে পারে একদিন।