শুনে সে চুপ করে রইল। তারপর আমি আরও বললাম, দ্যাখ মাধবী, আমাদের দুজনেরই যৌবন পেরিয়ে গেছে। এই শেষ বয়সে দুজনকেই দুজনের দরকার আমাদের। আমাকে ছেড়ে তুমি কোথায় যাবে আর তোমাকে ছেড়েই কি আমি থাকতে পারব? পরস্পর মিলে-মিশে আমরা ঘর বাঁধি এস।
আর তারপরই তোমার এই ছাঁদনাতলা? আমি বলি, এখন তাহলে নতুন ঘরানায় তোমার নয়া সঙ্গীত? নতুন ঘরে নতুন সঙ্গী এখন?
মেয়েছেলের চোখকে কখনো ফাঁকি দেয়া যায় না ভাই! অবশ্যি, তার জন্য কোন আপসোস নেই আমার—তার প্রমাণ দেখ তো এই–
বলে ছাপানো কার্ডখানা আমার হাতে সে তুলে দিল।
এই কার্ডখানা তোমায় পাঠালেই কোন গলদ হতো না আর। তুমিও আমায় ধরতে রতে না তাহলে—আর কেউ যেমন পারেনি। কিন্তু ভাবলাম, তুমি আমার পুরনো ব্ধি, ছাপানো চিঠি দিয়ে ডেকে পাঠানো উচিত হবে না তোমায়। তাই হাতে লিখে বয়ের কথা জানাতে গেছি, আর তার ফলেই আগের অভ্যাসবশে নিজের সাবেক নামটাই মই করে বসেছি শেষটায়। তাই এই গলদটা হলো।
কিছু গলতি হয়নি। তোমার কোন ভাবনা নেই, কারু কাছে এ-কথা আমি ফাঁস করব না, তুমি নিশ্চিন্ত থেকো। তবে কোনদিন হয়তো তোমার কাহিনীটি, কাউকে গল্প না-করলেও, গল্পচ্ছলে লিখে বসতে পারি। তাহলেও কোন ভয় নেই তোমার। গল্প-কথায় কেউ কখনো বিশ্বাস করে না। আর, আমার গল্প তো ভাই, হেসেই উড়িয়ে দেয় সবাই। আমি তাকে বলি।——তুমি ভয় খেয়ো না ব্রজ।
না না না। আমি আর ব্রজ নই। ব্রজের লীলাখেলা আমার ফুরিয়ে গেছে। এখন আমি ধনু…ধনু…ধনু…।
বারংবার ওর ধনুষ্টঙ্কার শুনতে হয়।
বড়দিনের বাড়ন্ত দিন
চঞ্চল রায় আমার বন্ধু। ওর চঞ্চলতা একদা আমাকে ভিত করে দিয়েছিলো। সে ভাবটা অনেক স্তিমিত হয়ে এসেছে। ভীত হবার কথা এখন ওরই। পরপৈণী জিনিসকে যারা আত্মনেপদী করে নেয়—তাদের আত্মায় বিপদের আশঙ্কা থেকেই যায়। পরকীয়া রস পরখ করার রোখ, ভালো কি মন্দ জানিনে (বৈষ্ণবসাহিত্যে ওর গুণব্যাখ্যা দেখে ওটা অহিংস প্রেমের সগোত্র বলেই জ্ঞান হয়),—তবু এটা ঠিক যে, ওর আসল কথাটা হচ্ছে পরের সঙ্গে জড়ানো–এই কারণে, যেমন পরের প্রতি করতে য় তেমনি আবার পরেও নাকি করে থাকে। তরোয়ালটার দুধারেই বেশ ধার।
চঞ্চলের অসুখের খবর পেলাম–ইনফ্লুয়েঞ্জা না হুপিং কাশিতে বড্ডো ভুগছে নাকি। যাই হোক, মোটের উপর এখন সে বেশ কাহিল, এই খবর পেয়ে আমার মতো বন্ধুবৎস লোকের পক্ষে অচঞ্চল থাকা কঠিন। অতএব বড়োদিনের ছুটির সুযোগ পৌঁছতেই ছু দিলাম। বিকেলের ঢের আগেই রওনা হওয়া গেল। যদিও কাছেই থাকে, কাশীপুরে ওদের নিজেদের বাগান বাড়িতেই, তবু একজনের অসুখের সময়ে যাচ্ছি, কিছু সময়, হাতে নিয়ে যাওয়া ভালো। ভগবান না করুন, যদি কাশীপুর থেকে কাশী মিত্রে যেতে হয়! মিত্রতার বোঝা তো, এই ফাথে করেই বইতে হবেবাধ্য হয়েই।
শোকের অসুখবিসুখ সারাবার আমার নাকি আশ্চর্য ক্ষমতা আছে। আমার পদার্পণেই অনেক রোগ সেরে যায়, হস্তক্ষেপ করলে তো কথাই নেই। এমনিই জনরব। চঞ্চলের বেলাও তার অন্যথা হবে না, আমার আশা ছিল। এবং এ সম্বন্ধে (অর্থাৎ আমার আরোগ্যকারিতা সম্বন্ধে) লোকের ধারণা যে নিতান্ত ভুল নয় তার পুনঃ প্রমাণ পেলাম রাতারাতি ওর সেই ইনয়েঞ্জানা হুপিং কাশি—কেবল ওকে নয়, ওদের কাশীপুরের তল্লাট হেড়ে চম্পট দিল। কী করে এই মিরাকল ঘটল, অথবা আমি ঘটালাম শুনতে আপনারা অবাক হবেন।
ওদের গেটে পা দিতেই শ্রীমতী রায়কে দেখতে পেলাম, বাগানে ঘুরছেন। শ্ৰীমতী রায় আর আমি এককালে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলাম—অবশ্যি অনেকদিন আগে, তাঁর বিয়ে আগেই। কৌমার্যদশায় তখন উনি ছিলেন নিছক মায়া সেন। তখনো কোনো যাবজ্জীবনের রায় পাননি। আমাকে মায়াযুক্ত আর ওকে ইনসেন করার জন্য একমাত্র চঞ্চল ছাড় আর কাউকে আমি দায়ী করতে পারিনে। চঞ্চলই সেই মায়াবী।
অবশ্যি শ্রীমতী রায় এবং আমার মধ্যে এখন আর সেই সোহ যে নেই তা নয়। এখনো আমরা বন্ধুই বটে, তবু ঠিক ততটা অঙ্গ হয়তো বলা যায় না। সত্যি বলতে বিয়ের পরে মাত্র একবার আমাদের সাক্ষাৎ হয়েছিল। চঞ্চল এমনই হিংসুটে প্রকৃতির যে–কিন্তু না, সে কথা থাক।
শ্রীমতী রায়ের পুনরায় দেখা পেয়ে সত্যিই আমি পুলকিত হলাম। চিরকালই উনি মৎকার। বিয়ের পরে সেই চমৎকারিত্ব আরও যেন বেড়েছে। আমার তো মনে হলো আমাকে দেখে উনিও তদ্রুপ চমৎকৃত হয়েছেন। মেয়েদের চোখে আইবুড়োদের জন্যে একটুখানি মেহদৃষ্টি থাকেই। বেচারীরা নিজের বা যারই ক্ষতি করুক, মেয়েদের কোনো ক্ষতিকর তো নয়। মেয়েদের তো সাধারণতই দুঃখের জীবন, বু অন্ততঃ একটি মেয়েকে ইহলোকে তারা সুখী করতে পারে, যাকে তারা বিয়ে করে না। নিজের জীবনের অকূলে জলাঞ্জলি না দিয়ে যাকে বাঁচায়। যাকে না ভাসিয়েই চলে যায় তারা। পুণ্যকর্মের একটা প্রতিফল রয়েছেই, এই জন্যেই নিখিল নারীর একটু দরদ ওদের লভ্য।
একি, শ্ৰীমতী রায়, আমিও এলাম তুমিও বেরিয়ে যাচ্ছো? ওকে সুসজ্জিত দেখে আমি না বলে পারলাম না—না, এ কখনো হতে পারে না।
সত্যি যেন যাচ্ছি! সত্যিই যেন আমি যেতে পারি। হেসে উঠলেন মায়া রায়, হাসলে টোল খায় ওর গালে—এখনো সেই রকম—এমনি এই বাগানেই বেড়াচ্ছিলাম। এখানে বেড়াতেই আমার ভালো লাগে। সারাদিন এমনি সেজেগুজেই থাকি আমি। উনিও সেটা ভালোবাসেন।
হ্যাঁ, কেমন আছে চঞ্চল? —মায়ার সঙ্গে বেড়াতে বেড়াতে আমি খোঁজ নিলাম। কিন্তু খবর নেবার আগেই—বাঃ, কী চমৎকার গোলাপ ফুটেছে, বাঃ! ভারী সুন্দর তোমাদের এই বাগানটি তো!