না, আমি ধনু নই, ব্রজ। আমরা দুজনে যে দেখতে ঠিক একরকম ছিলাম তা কি তোমার মনে নেই? এমন কি মাস্টারদেরও ভুল হতো আমাদের দুজনকে নিয়ে। ধনুর অপরাধে আমাকেই বেত খেতে হয়েছিল কতবার। মনে পড়ছে না তোমার?… বলতে যাচ্ছি, কিন্তু বলতে দিলে তো! কই পেলাম না কথাটা বলবার।
ইতিমধ্যে পার্থর মা নেমে এসেছিলেন–আমাকে দেখে তার আনন্দ যেন উথলে উঠল। পাড়ার আরও লোক সব জড়ো হল এসে, যেন হারানো মানিক ফিরে পেয়েছে সবাই-কারো আর আনন্দের অবধি রইল না। সেই উল্লাসের তোড়ে আমার কথাটা কোথায় যেন তলিয়ে গেল। পাড়ার ফুরসতই হলো না আর।
এরই ভেতরে পার্থ আমায় আড়ালে ডেকে বলেছে—জান, তোমার মা ইতিমধ্যে লাখখানেক টাকা পেয়েছেন লটারিতে? তবে বুড়ি আর বেশিদিন টিকবে না ভাই! শরীর এমন ভেঙে পড়েছে তার। চোখেও ভাল দেখতে পান না আর।
খবরটা পেতেই আমি চেপে গেলাম একদম। আমার মত বদলে গেল সঙ্গে সঙ্গে। ব্রজকে সলিল-সমাধিতে পাঠিয়ে ধনু বনে গেলাম দেখতে না দেখতে। আর, সবাই যখন আমাকে ধনু বলেই ধরে নিয়েছে, চিনতে ভুল হচ্ছে না কারো—তখন বৃথা আর ব্রজবুলি আউড়ে আমার লাভ কী?
পার্থ আমাকে খবর দিল আরো। মাধবীর খবরটাও দিল আমায়। মাধবী আমাদের সঙ্গেই পড়ত স্কটিশ চার্চ কলেজে, তাকে বেশ মনে ছিল আমার যদিও আমার চাইতে ধনুর সঙ্গেই তার ভাব ছিল বেশি।
পার্থ বলল—মাধবী এখনো তোমার জন্যে অপেক্ষা করে বসে আছে। তাকে বিয়ে করবে বলে তুমি কথা দিয়েছিলে না? সেই কথা বিশ্বাস করে এখনো সে আর কাউকে বিয়ে করেনি।
তাই নাকি? কিন্তু এই বয়সে—সেটা কেমন হবে? …মানে, তাকে এই বিয়ে করাটা? আমি বলি পার্থকে।
সে তুমি যা ভাল বোঝ। আমার মতে, তোমার ওকে বিয়ে করাই উচিত। তোমার মাকে সে-ই এতদিন ধরে দেখাশুনা করছে—সেবা-যত্ন করছে ঠিক আপন শাশুড়ির মতই। তারও তো তিনকুলে কেউ নেই এখন আর। সে তোমার মা-র কাছে থাকে। ঠিক তার মেয়ের মতই।
ধনুর মাকে গিয়ে প্রণাম করতেই তিনি আমায় বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে বসলেন—জানতুম তুই ফিরে আসবি একদিন। ঠাকুর-দেবতার দোর ধরে তোকে পেয়েছিলাম, জাহাজডুবি হলেও তুই বেঁচে যাবি আমি জানতাম। নিশ্চয় আর কোন। জাহাজ তুলে নেবে তোকে।…
তাই হয়েছিল মা। আরেকটা জাহাজ কাছ দিয়েই যাচ্ছিল তখন–তুলে নিল আমাদের। কিন্তু ব্রজ-বেচারীর আর কোন পাত্তা পাওয়া গেল না তারপর।
আমার স্থির বিশ্বাস ছিল আমার মরবার আগে তোকে আমি দেখতে পাব। মাকে তোর মনে পড়বে একদিন। ফিরে আসবি তুই আমার কোলে আবার।
মাধবীকে নিয়ে একটু বেগ পেতে হবে ভেবেছিলাম কিন্তু সে কোন উচ্চবাচ্য করল; আর বিয়ে করার কথাটা পাড়লই না একেবারে। বেঁচে গেলাম আমি, বলতে কি!
শৈশবের থেকে মা-হারা, মাতৃস্নেহ কাকে বলে জানিনে, তার স্বাদ ষোল আনাই পেলাম ধনুর মা-র কাছে। নিজের মায়ের সেবা করার সুযোগ পাইনি, দুঃখ ছিল মনে, তারও কোন ত্রুটি রাখলাম না আমি। মাতৃসেবার চূড়ান্ত করে ছাড়লাম।
বেশ সুখেই কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো স্বপ্নের মতই প্রায়। ইতিমধ্যে…।
ইতিমধ্যে আমাদের তো ঘুণাক্ষরেও জানাওনি এসব কিছু। বাধা দিয়ে আমি শুধাই—কারণ কী? নতুন মা পেয়ে কি পুরনো বন্ধুদের ভুলে গেলে সব?
না। তা নয়। তবে আমার মা, মানে ধনুর মা মারা গেলেন কিনা হঠাৎ। তাঁর বিষয়-সম্পত্তির সাকসেশন সাটিফিকেট, ব্যাঙ্কের হিসেব-পত্তর এইসব নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়েছিল এতদিন। তার পরে সে-সব ঝঞ্ঝাট চুকে বুকে যাবার পর, শোন বলি কী হলো…।
বলে ব্রজ চুপ করে রইল। নিজের মনের সলিলসমাধিতে তলিয়ে গেল যেন।
কী হলো? আমি ওকে উসকে দিই। ব্রজের লীলাখেলার উপসংহারটা জানবার জন্য আমার আগ্রহ।
ভাবলাম, আর কেন? সবকিছু এবার বেচে-টেচে দিয়ে টাকা-কড়ি নিয়ে এখানকার পাত্তাড়ি গুটোই। অন্য কোথাও গিয়ে নতুন করে ব্যবসাপওর ফঁদি আবার। তাই ভেবে তার আগে মাধবীর একটা ব্যবস্থা করা দরকার বলে আমার মনে হলো। ও বেচারীর তো কেউ নেই কোথাও। আর এতদিন ধরে ধনুর মাকে দেখেছে-শুনেছে…সেই ভেবে না, একটা মোটা টাকা দিয়ে ওর কাছ থেকে বিদায় নিতে গেলাম।
কিন্তু মাধবী আমায় এককথায় চমকে দিল। বলল, ব্রজবাবু, আপনি কি ভেবেছেন যে আপনাকে আমি চিনতে পারিনি? কিন্তু ধনুর মা মনে কষ্ট পাবে বলে, সেই ভেবে এতদিন মুখ খুলিনি আমার। ভেবেছি যে মা যখন তার হারানো ছেলে ফিরে পেয়ে সুখে আছেন, তাঁর জীবনের শেষ কটা দিন তিনি সুখেই থাকুন। কেন আবার কষ্ট পান। তাই আমি কাউকে কিছু বলিনি। এমন কি, আপনাকেও আমি সে-কথা ঘুণাক্ষরে টের পেতে দিইনি। পাছে আপনি ধনুর মাকে ফেলে তাঁর প্রাণে দাগা দিয়ে আবার ফের কেটে পড়েন। কিন্তু এখন তো আমার মুখ খোলার কোন বাধা নেই। থানায় আমি খবর দিতে চললাম।
শুনেই না আমার হয়ে গেছে। আবার যেন আমি বঙ্গোপসাগরেই তলিয়ে যাচ্ছি…আমার সেই ভরাডুবির মধ্যে শুনতে পাই সে বলছে…ব্রজ, তোমার হয়তো মনে থাকতে পারে, কলেজের ক্লাসে আমি ঠিক তোমার পেছনের বেঞ্চটিতে বসতুম। তোমার মাথার পেছন দিকটা দেখে দেখে মুখস্থ হয়ে গেছল আমার। তাই, সামনে দেখে তোমাকে ঠিক চেনা না-গেলেও পেছন থেকে…যাক্, আর সবাইকে ফাঁকি দিতে পারলেও আমাকে তুমি ঠকাতে পারনি।
সলিল-সমাধি থেকে ভেসে উঠে আমি বললাম-ঠকাতে চাইও না আমি। ধনু তোমাকে বিয়ে করবে বলে কথা দিয়েছিল। ধনুর সেই কথাটা আমি রাখব। যখন ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক ধনুর ভূমিকা নিতে হয়েছে আমায়, তার কথাও আমায় রাখতে হবে তখন।