প্রেম ফ্রেম নয় ভাই, সে বাধা দেয় আমার কথায়—চিঠিটায় আমি ব্রজ বলে আমার নামসই করেছি তো, সেই জন্যেই আসতে হলো আমায়। শতং বদ মা লিখ, শাস্ত্রে বলেছে। সে কথাটা ভুলে গেছলাম বেমালুম। তাই ওই স্বাক্ষরটা আমার ঠিক হয়নি। কিসের থেকে কী দাঁড়ায়, ফৌজদারি আদালত অবধিই বা গড়ায় কি না কে জানে। এই বয়সে কি জেলে যেতে হবে শেষটায়, তাই…
বিয়ে করাও তো একরকমের জেলে যাওয়া ভাই, আমি শুধাই তাই নয় কি?
জেল যে, তা এর মধ্যেই টের পেয়েছি বিলক্ষণ। কিন্তু তাহলেও আলিপুরের সশ্রমের চেয়ে তো ঢের ভাল। আরামপ্রদ কারাবাসই বলা যায় একরকম।
তা বলতে পারে বটে। কিন্তু আমি অবাক হচ্ছি এই ভেবে যে, মাধবীকে বিয়ে করার কথা ছিল ধনুর। তোমার তো নয়; কিন্তু তুমি যে…
ধনুই তো বিয়ে করেছে। এই দ্যাখো না। বলে সে একটা ছাপানো নিমন্ত্রণপত্র আমার হাতে দিল, তাতে শ্রীধনুর্ধর রায়ের সঙ্গে কুমারী মাধবী বসুর বিয়ের কথাই হাপার অক্ষরে লেখা রয়েছে বটে।
তাহলে ধনুই বিয়ে করছে, তুমি নও। তাই বল তাহলে। আমি হাঁপ ছাড়ি।
ধনু ওরফে আমি। আমিই শ্রীব্রজবিহারী বর্মণ।
হেঁয়ালি রাখো। খোলসা করে বল সব।
হেঁয়ালি নয়, সত্যি কথাই। তুমি বন্ধুজন, তোমার কাছে প্রকাশ করতে বাধা নেই। জানি, তুমি আবার তা পুনঃপ্রকাশ করে আমায় জেলে পাঠাবার ব্যবস্থা করবে না। তাই খোলসা করে সব তোমাকে বলার জন্যই এতখানি আমার ছুটে আসা।
তুমি ব্রজ না ধনু, কে তাহলে, ঠিক করে বল দেখি। সঠিক ঠাওর না পেয়ে আমি বলি—আমার নিজেরই কেমন খটকা লাগছে। তোমাদের দুজনের চেহারায় এমন আশ্চর্য মিল ছিল যে কে কোষ্টা আমরা ঠাউরে উঠতে পারতাম না। তুমি ধনু, না, ব্রজ?
আমি ব্ৰজই। বলে সে করুণ সুর ধরে : কিন্তু, আর তো ব্ৰজে যাব না ভাই, যেতে মন নাহি চায়। মা পেয়েছি বাবা পেয়েছি… ব্রজের খেলা ভুলে গেছি…না, মা আমার মারা গেছে সম্প্রতি। এখন থেকে আর আমি ব্রজ নই। অতঃপর, আমি শ্রীধনুর্ধর—এখন থেকে বরাবর।
বুঝতে পারছি না কী ব্যাপার।
সবটাই আমার কাছে যেন ধাধার মতই লাগে। সে বলতে থাকে।
ভাওয়ালের মেজকুমারের সেই কেসটা, ভাওয়াল সন্ন্যাসীর মামলা গো! তোমার মনে আছে নিশ্চয়? আমার ব্যাপারটাও প্রায় সেই রকমই বলতে গেলে। তবে ভাওয়ালের বেলায় সন্ন্যাসীর নিজের সাধু হবার ইচ্ছা ছিল। আর এক্ষেত্রে আমার অনিচ্ছাসত্ত্বেও, ব্যাপারটা আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া। এই যা তফাত।
আইন-বিরুদ্ধ কোন কাজ করার বাসনা কোনদিনই আমার ছিল না, এক্ষেত্রে তো নয়ই, কিন্তু পাকচক্রে কেমন করে কী যে ঘটে যায়! ভবিতব্যের লিখন যাকে বলে আর কি!…
আমাদের সোনারপুর থেকে সেই কলেজে পড়বার সময় আমি আর ধনু নিরুদ্দেশ হয়ে গেলাম না? বছর চল্লিশেক হলো তো? তারপর থেকে আমাদের আর কোন খবর পাওনি তোমরা—রাখওনি তেমন। ভাগ্যান্বেষণে সারা ভারত তারপর ঘুরেছি আমরা দুজনে, তারপরে কোথাও কিছু সুবিধা করতে না পেরে কপাল ঠুকে বর্মা মুল্লুকে পাডি দিলাম আমরা। বর্ষায় গেলেই কপাল ফেরে, বলত লোকে তখন। অন্ততঃ শরৎবাবুর উপন্যাস পড়ে সেই রকমের একটা ধারণা জন্মেছিল আমাদের।
মাঝপথে সমুদ্রে ঝড়ের মুখে পড়ে আমাদের যাত্রী জাহাজটা ডুবে যায়—সেই থেকে ধনুর সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি। আরেকটা জাহাজ এসে নিমজ্জমান আমাদের কতকগুলোকে তুলে নেয়, তাদের ভেতরে ধনু ছিল না কিন্তু। মনে হয় সে তলিয়ে গেল সেই ঝড়ে।
যাক, আমি তো সেই জাহাজে বর্মায় গিয়ে পৌঁছলাম। এটাসেটা করতে করতে ঢাকের ব্যবসায় লেগে গেলাম শেষটায়। ঢীক এক রকমের দামী কাঠ, জান বোধহয়? টীকের কারবারে অনেক টাকা কামিয়ে ছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর টিকে থাকা গেল না…।
কেন? টীকের জঙ্গল সব সাফ হয়ে গেল বুঝি?
না না। আমরাই সাফ হয়ে গেলুম। বর্ষার নয়া বিপ্লবী সরকার এসে বিদেশীর যত ব্যবসাপত্তর বাজেয়াপ্ত করে নিল, নিঃসম্বল উদ্বাস্তু হয়েই ফিরে আসতে হলো স্বদেশে।
কোথায় যাই? ভাবলাম, বাড়িতেই ফিরে যাই, কিন্তু বাড়িঘর কি আছে আর আমার? মা ছোটবেলায় মৃত, তারপর মামার বাড়িতেই আমি মানুষ কিন্তু সেখানে যেতে মন চাইল না। ভেবেচিন্তে নিজের গ্রাম সোনারপুরেই ফিরলাম।
কিন্তু সোনারপুর আর সেই সোনার গ্রামটি নেই, শহরতলী হয়ে তার ভোল পালটে গেছে এখন। কোথায় যে আমাদের ভিটে ছিল তার কোন হদিশই মিলল না। আর মিললেই বা কী হতো? তিন কূলে তো কেউ ছিল না আমার। শুনলাম মামারাও সেখান থেকে উঠে গেছেন কোথায়।
ভাবলাম, আপাতত আমার ইস্কুলের বন্ধু পার্থর বাড়িতেই উঠি গিয়ে নাহয়। তারপর দিনকয়েক সেখানে কাটিয়ে ভাগ্যান্বেষণে বেরিয়ে পড়া যাবে আবার।
সোনারপুরে পার্থদের বর্ধিষ্ণু পরিবার। তারা নিশ্চয় উঠে যায়নি অন্য কোথাও।
গিয়ে দেখলাম, পার্থ তার বাড়ির বোয়াকেই বসে। কিন্তু সে আর সেই আগের পার্থটি নেই—ছিমছাম সুশ্রী চেহারার সেই পার্থ। ভুঁড়ি বাগিয়েছে এখন, বুড়িয়ে গেছে বেশ।
পার্থ, চিনতে পারছিস আমায়?
শুধোতেই না তার মুখ কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেল। তারপর তার হুঁড়ির পরিধিতে আন্দোলন দেখলাম।
-ওমা ধনু যে! অ্যাদ্দিন পরে। কী আশ্চর্য!
তারপরই সে হাঁক পাড়ল বাড়ির নেপথ্যে—মা! মা! নেমে এসে একবারটি। ধনু ফিরে এসেছে আবার—পরলোকের থেকে।
আর, এই ভাবেইনতুন নাটকের যবনিকা উঠল আমার জীবনে। আমি বলতে যাচ্ছিলাম,