তখন সে ছাড়ান দিল আমায়।
হাঁপ ছেড়ে দম নিয়ে আমার বাক্যস্ফূর্তি হলো তখন। আমি বললামঃ চিরঞ্জিত! চিরদিনই তোমার জিৎ, আর তোমার কাছে আমার হার। কিন্তু তাই বলে তোমার হাতে এমন মার আমি খাব কোনোদিন আমার ধারণা ছিল না। তোমাকে আমি বন্ধু বলেই জানতাম এতদিন। কিন্তু বন্ধুর কাছে এই ব্যবহার… আমার কণ্ঠরোধ হয়ে আসে।
বন্ধুর কাজ করিনি আমি? বন্ধু আবার বলে কাকে? বলল রিঞ্জিত: কেন, খারাপটা কী করেছি? মারার ছলনা করে থানার ফঁড়া থেকে কাটিয়ে, কেটে বেরিয়ে এসেছি তোমায় নিয়ে…
মারার ছলনা?…ওদের মারে আমার তেমন ধারা লাগেনি। গায়ে লাগলেও প্রাণে লাগেনি আমার…কিন্তু তোমার এই ছলনার মার কোনোদিন আমি ভুলব না ভাই, হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি আমি…এখন ঠিক না পেলেও বাড়ি গিয়ে টের পাব ঠিকই, যদি বাড়ি গিয়ে পৌঁছতে পারি। গায়ের ব্যথায় কাল বিছানা ছেড়ে উঠতে পারব কিনা কে জানে!
তাহলেও তুমি আস্তই রয়েছে দাদা! হাড়গোড় কিছুই বরবাদ যায়নি—সবই তোমার অটুট রয়েছে এখনো। এই এলাকার দারোগা আননবাবুকে তো জানো না ভাই! থানায় নিয়ে গেলে আর সেখানে রামধোলাই খেলে তোমার রামত্ব লোপহয়ে শিবত্বলাভ ঘটত।… গুন্ডারা পর্যন্ত আননবাবুর ভয়ে কাঁপে। তা জানো?
আমার ভয় কিসের? আমি কি গুণ্ডা?
বড়ো বড়ো গুণ্ডাকেও থানায় নিয়ে গিয়ে কম্বলধোলাই দিয়ে হাড় গুঁড়িয়ে গুণ্ডি বানিয়ে ছাড়েন তিনি। কিন্তু সে তো পরে…এহ বাহ…তার আগে তাঁর অন্তঘোতি আছে। নিজস্ব পেটেন্ট পঞ্চগব্য খাইয়ে পেটের কথা টেনে বের করেন তিনি আসামীর। পঞ্চগব্য কাকে বলে জানো?
কেন জানবো না? দই, ঘি, দুধ, গোবর আর গোরোচনা—কে না জানে? তাই খেয়ে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়, জানে সবাই।
পঞ্চগব্যের ঐ প্রথম তিনটে বাদ, তার বিকল্পে ঘোড়ার নাদ, কুইনিন, ছাগলনাদি যদি পাওয়া যায়, সেইসঙ্গে কেরোসিন আর ফিনাইল—পছন্দসই ফ্লেভার দেবার জন্যেই। ওই তিনি মুখ হাঁ করিয়ে গাঁট্টার চোটে ঢক্ করে গিলিয়ে দেন, তখন আপনার থেকেই পেটের কথা সব বেরিয়ে আসে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় তোলাস সামনেই ধরা থাকে তো, তাই দেখেই না!
আমার পেটের কথা টেনে বের করার কী আছে? আমি জিজ্ঞেস করি।
নেই-ইত। কাজেই কোনো কথাই বেরুবে না। বাধ্য হয়েই তোমায় পাঁচ সাত গেলাস গিলতে হবে। কথা কিছু না বেরুলেই, একটু আগে বিনেপয়সায় ভালো মন্দ যা খেয়েছো তার সবটাই তোমার বেরিয়ে আসত নির্ঘাত। সেটা কি ভালো হতো? তারপর সেই অন্তধৌতির পর, আসল সেই ধোলাইয়ের এহ বাহ্য তো রয়েই গেল; তার চোটে নির্বিকল্প সমাধি না হলেও অর্ধবাহ দশা তো হতেই তোমার আলবাৎ। গন্ধে গোটা পাড়া মাত হয়ে যেত তখন। প্রায় সবার বেলাই সেটা হয়ে থাকে শুনেছি, তেমন ধারণা-শক্তি ততা নেই সবার! তখন তোমার সেই হতজ্ঞান গন্ধমাদন ঘাড়ে করে তোমায় বাড়ি পৌঁছে দিতে হতো আমায়। তার বদলে এই একটুখানি মারামারি-কী এমনটা বাড়াবাড়ি হয়েছে শুনি?
মারামারি? মারামারিটা হলো কখন? কথাটার আমি মৃদু আপত্তি না করে পারি না: মারাই তো হয়েছে শুধু, মারি-টা হলো কোথায়? তোমরাই আমায় ঠেঙালে, আমি কি তোমাদের গায় হাত তুলেছি নাকি?
এই কথা! আচ্ছা, আমি তোমার গায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি… বলে আবার সে আমার গলায় পিঠে হস্তক্ষেপ করে…এবার মন্দাক্রান্তা ছন্দে। তাতে আমার জ্বলে যায় আরো! আমি ছিটকে ওর নাগাল থেকে সরে যাই।
রাগ হয়েছে? আচ্ছা, তাহলে মানো তুমি আমায় ঘা কতক, বেশ করে কসে মারো, খুব জোর জোর লাগাও। তাহলে হবে তো? বলে সে আমার সামনে পিঠ পেতে। দেয়।
খুব হয়েছে। আর ন্যাকামো করতে হবে না। এতক্ষণ হয়নি, কিন্তু এবার আমার সত্যিই রাগ হলো——আমার না উচ্চ রক্তের চাপ? পড়ে গেলেই পক্ষাঘাত না নির্ঘাত? তুমি নিজেই তো বলেছে।
সঙ্গে সঙ্গে তারও মনে পড়ে যায় কথাটা——তাই নাকি? তাই তো হে! মনেই ছিল না আমার। আশ্চর্য, তোমার তো খাবি খাবার-কথা এতক্ষণ! কিন্তু কই, খাবি
তো খাওনি! কতবার তো পড়লে হে! পক্ষাঘাতও হয়নি তো দেখছি।
আহা! হলে যেন খুব খুশি হতে মনে হচ্ছে।
আশ্চর্য! এখনো তুমি আস্ত আছে, সটান খাড়া রয়েছে সামনে! নো পক্ষাঘাত, নষ্ট কিছু। এই শক ট্রিটমেন্ট করে ব্যায়ামটা তোমার সারিয়ে দিলাম বোধ হচ্ছে। আমার এক ঘুষিতে…এক না হোক একাধিকই হলো…থানার পক্ষপাত আর নিশ্চিত পক্ষাঘাত দুটোর থেকেই এক চোটে বাঁচিয়ে দিয়েছি তোমায়। তাতেও তুমি খুশি নও ভাই? এটা কি বধুর কাজ করিনি আমি, বললা? নহলে তুমি কী বলতে চাও?
আমি আর কিছু বলতে চাই না তারপর। চুপ চাপ পা চালাই।
বন্ধুর মতন হয় না! সত্যি।
ব্রজবিহারীর ধনুর্ভঙ্গ
ব্রজবিহারীর ধনুর্ভঙ্গ পণ ছিল না মাধবীকে বিয়ে করার, ছিল সেটা ধনুর; তাই চিঠিটা পেয়ে একটু অবাক হয়েছিলাম বইকি।
বাড়ি-ঘর ছেড়ে এতকাল নিরুদ্দেশে থাকার পর ফিরে এসে অবশেষে মাধবীর মত একটা আধবুড়িকে তার বিয়ে করাটা আমার কাছে একটু অভূতপূর্ব বলেই মনে হয়।
ষাট বছর পেরিয়ে বিয়েব ছাঁদনাতলায় গিয়ে লটকানো কম বিস্ময়কর নয় তো।
অবাক তো হয়েছিলামই, আরো অবাক করে দিল সে নিজে এসে তার পরে।
চিঠির ল্যাজ ধরে ব্রজ হাজির হলো শেষে।
পাছে তুমি ভুল বোঝো ভাই, তাই চলে আসতে হলো আমায় এই সাত তাড়াতাড়ি… এসে বলল সে।
না, ভুলু বোঝাবুঝির কী আছে ভাই! এরকম তো হয়েই থাকে আকচার। আমি বলতে চাই, প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে, কে কোথায়…