ইঁদুর ধরবার ফিকিরেই ঘুরছিল বুঝি?
তা নয়। কী দরকারে এসেছে তাকে শুধাতে, সে একটা চিরকুট আমার হাতে দিয়ে বলল, এই ঠিকানার একটি মেয়ে কয়েকটা ইঁদুর চেয়েছিলেন…।
সে কী? কাগজখানা পড়ে দেখি—পার্বতীর নাম ঠিকানা তাতে লেখা।
আমি আরো অবাক হলাম যখন সে বললে, মেয়েটি মাসখানেক আগে একটা ইঁদুর কিনেছিল তার কাছে, আর দিন কয়েক আগেই নিয়েছে আরেকটা। আরো বলেছে যে হয়তো আবারও কয়েকটার দরকার হতে পারে, তাই আমি তার খোঁজ নিতে এসেছিলাম বাবু!
না, না, ইঁদুরের আর দরকার হবে না, আমি বলে দিলাম তাকে। বলল উৎস: ইঁদুর ধরা পড়েছেদরকার নেই আর ইঁদুরের। ইঁদুর দিয়ে ইঁদুর ধরেছে মেয়েটা।কথাটায়, মনে হল, উৎস নিজের প্রতিই যেন কটাক্ষপাত করল— পার্বতীই মূষিক প্রসব করল, মূষিকটাই পার্বতী প্রসব করল!–এখনও আমি ঠিক ঠাওর করতে পারছি না, দাদা।
একটি মেয়ের জন্য
অনেক দিনের পর শ্রীমান অশোক চট্টোপাধ্যায়ের দর্শন মিললো আমার আস্তানায়। অশোক আমার ভাগনে-রত্নদের একজন।
কোথায় ছিলিরে অ্যানি? আমি শুধালাম।
এলাহাবাদ গেহলাম মামা।
ও বুঝেছি। তাজমহল দেখতেই! আমি ঘাড় নাড়ি।
তাজমহল কি এলাহাবাদে নাকি গো? আমার কথায় সে ভারী অবাক হয়, তাজমহল তো আগ্রায়। তোমার ভূগোল জ্ঞান তো খুব-টনটনে দেখছি মামা!
ও—তাই নাকি রে! আমার ধারণা ছিল ফতেপুর সিক্রিতেই। তা, তুই যখন বলছিস, তাহলে আগ্রাতেই হবে হয়ত। আমি মেনে নিই।
আমার ভূগোল জ্ঞান সত্যি ভারী গোলমেলে। ভূগোলের সঙ্গে একেবারেই মেলে না।যথার্থ বলতে, সানফ্রান্সিসকো যে কোথায়, কলঙ্করূপে সূর্যে, না নিষ্কলঙ্করূপে ফ্রান্সে—তাও আমি সঠিক বলতে পারব না। তবে নায়াগ্রাপ্রপাত যে আগ্রায় না, তা আমার জানা আছে বেশ।
কী জন্যে গেছলি এলাহাবাদ—এত খরচা করে এই সময়? এমনি বেড়াতেই–না কী?
বেড়াতেই, তবে একপয়সা খরচা না করে। বিলকুল মুফৎ, মামা।
বটে? বটে? শুনে আমার উৎসাহ হয়। বিনা টিকিটেই সেরেছিস বুঝি?
না মামা! ইনফ্যান্ট্রি মিলিটারি কমিশনে একটা ইন্টারভিউ দিতে গেছলাম যে!
অ্যাঁ? শুনেই আমার পিলে চমকায়। যুদ্ধ করতে? বলিস কি রে তুই?
না না, যুদ্ধ করতে নয় ঠিক, তবে কি জানো মামা, সৈনিক জীবনলাভের কোনো সুযোগ এলে সেটা আমার ছাড়তে ইচ্ছে করে না। সৈন্যদলে, কি বিমানবহরে, কি নৌবাহিনীর জন্যে সরকার লোক চেয়ে বিজ্ঞাপন দিলেই অমনি আমি একটা আবেদন ঠুকে দিই —যদিও আমি ভালোমতই জানি তেমন কাজ পাবাব সৌভাগ্য আমার কোনদিনই হবে না।
কী করে জানলি?
জানি যে ইন্টারভিউয়ের প্রথম ধাপই আমি উৎরাতে পাব না। প্রথম পরীক্ষা পাশ করতে পারলে তবেই তো সৈনিকের চাকরী—তারপরেই না যুদ্ধটুদ্ধ? অতদূর আমায় এগুতেই দেবে না ওরা।
একেবারে দেবে না? একদম বদ্ধপরিকর?
কই আর দিচ্ছে। এই নিয়ে তো চারবার ইন্টারভিউ দেওয়া হলো চার জায়গায়—হলো আর কই! তবে একটা হলো বটে, সরকারী খরচায় যাওয়া আসা থাকা খাওয়া…নানা দেশ-দেশই বলো আর প্রদেশই বলে—ঘুরে ঘুরে দেখে আসা হলো বেশ। এইটেই যথালাভ। বলে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল, তবে খুব ভালো কাজ ছিল এটা মামা, কমিশনের চাকরি, বেশ মোটা মাইনের…।
এটাও হলো না? •
না। বলে সে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল, আর হোলো না শুধু তোমার জন্যই।
আমার জন্যে? শুনে তো আমি হতবাক।
হ্যাঁ। নরানাং মাতুলক্রমঃ বলেছে না একটা কথা? তোমার ঐ ক্রম-টা আমার মধ্যেও সংক্রামিত হয়েছে, কী করে হলো কে জানে!
আমি কোনো কথাটি না বলে ওর ধারাবাহিকের ক্রমশ প্রকাশ্যর আশায় উদ্গ্রীব হয়ে থাকি।
??? মুখে কিছু না বলে স্বচক্ষে আমার প্রশ্নটা তুলি।
সত্যি, ভারী সংক্রামক ব্যায়রাম এই মামারা!… আমার ইন্টারভিউ ছিল সাড়ে আটটায়। অশোক প্রকাশ করে, আমি হাজির হয়েছি গিয়ে সাড়ে নটায়। ইন্টারভিউ-এ একঘন্টা লেট। বোর্ডের একজন মেম্বর আমায় জিজ্ঞেস করল—এত দেরি হলো কেন? আমি বললাম-আজ্ঞে, স্যর, ঘুম ভাঙতে দেরি হয়ে গেছে। রোজই দেরী করে ওঠার অভ্যেস কিনা! এ অভ্যেস কোথা থেকে পেয়েছি তা আর বললাম না, তোমার কথা কি বলা যায় সেখানে? তোমার পদাঙ্ক অনুসরণ করেই যে এই দশা আমার হয়েছে তা আমি বলি কী করে? তাই চেপে গেলুম বেমালুম।
বেশ করেছিস চেপে গিয়েছিস। আমি সায় দিই—নইলে হয়ত আমায় ডি-আই-রুলে পাকড়াও করত এখন।
তখন ভদ্রলোক বললেন, ধরো যুদ্ধ বেধে গেল ফ্রন্টে। তখন এই বদ অভ্যেসের জন্য লড়াইয়ে যোগ দেবার দেরি হয়ে গেল তোমার, তাহলে…?
আমি জবাব দিলাম-আজ্ঞে, তাতো হতেই পারে…। ঘুমের ওপর কি কারো জোর আছে?
তারপর আমাকে আরো শুধালো—ধরো, তুমি যদি লটাবিতে হঠাৎ হাজার বারো টাকা পাও তাহলে সেই টাকা দিয়ে কী করবে তুমি? আমি বললাম, খেয়ে দেয়ে ফুর্তি করে উড়িয়ে দেব টাকাটা। একটা পয়সাও জমাবো না তার। এরকম জবাব তারা প্রত্যাশা করেনি। শুনেই না পত্রপাঠ বিদায় করে দিল আমায়। চাকরির অগই ডিসমিস হয়ে গেল আমার।।
কী রকম জবাবের প্রত্যাশা ছিল তাদের? আমি জানতে চাই।
তারা আশা করেছিল যে, ওর মোটা অংশ দিয়ে আমি ডিফেন্স বণ্ড কিনব আর বাকীটা দিয়ে দেব প্রধানমন্ত্রীর আর্তত্রাণ তহবিলে। এই রকম ধারার একটা কিছু বোধ হয়। কিন্তু তেমন জবাব আমার এই পাপ জিভের ডগায় জোগাবে কী করে? সেই ছোট্ট বেলার থেকে তোমার দৃষ্টান্ত দেখে দেখে মানুষ তো! তুমিই আমাদের মাথা খেয়ে রেখেছ মামা!