কী বললো সে ভেঁপোনা-ডোলো লোকটা? বলল যে, ঘোড়ার ডাক্তার আজ সকালে ডোপ দিয়েছিল ঠিকই, কি ভুল করে…ব্যাটা নিজেই নেশা করেছিল কিনা কে জানে! ..ভুল করে করেছে কী, ঘোড়াটাকে ইনজেকসন না দিয়ে ঐ ইনজেকসনটা দিয়ে বসেছে তার জকিকে। ফলে মাঠে নেমে ঘোড়াটা তেমন দৌড়চ্ছে না দেখে জকি…ডোপের মাথায় ছিল তো সে…ঘোড়াটাকে টেনে নিয়ে না নিজেই দৌড়তে শুরু করে দিয়েছে। লাগাম ধরে ঘোড়াটাকে টেনে নিয়ে এসেছে সে…রেকর্ড টাইমে…আর সব ঘোড়ার থেকে তিন লেংথে নয়, তিরিশ লেংথ আগে। কিন্তু তাকে তো আর ঘোড়ার জিত বলা যায় না।
নিশ্চিত না। তার কথায় সায় দিতে গিয়ে আমার ভিত কাঁপিয়ে দিয়ে পেল্লায় এক বের উঠল।
নাঃ, এতটা খাওয়া ভালো হয়নি ভাই! হাইব্লাডপ্রেসারে এত বেশি খাওয়ার ধকল সইবে না হয়তো। ভেজিটেবল চপটা অবশ্যি কিছু নয়, আমার পক্ষে নিরাপদ, ফ্রি-ফ্রায়েও কিছু যায় আসে না। কিন্তু মোগলাই পরোটা, মাটন চপ, চিকেনকাটলেট, অগির দোপেঁয়াজি, ভকয়োসট এত সব খাওয়া—রক্ত চাপের ওপর এতখানি খাদ্য চাপানো আমার ঠিক হয়নি। ডাক্তার বলেছে আমায় খাওয়ার খুব ধরাকাট করতে…।
ধরাকাট করতে? ডাক্তার বলেছে? তা তুমি তো টেবিলের কাঠ ধরেই খাচ্ছ হে? তোমার ভাষায় বলতে গেলে—এই তো যথেষ্ট খাওয়ার ধরাকাঠ।
এত খেয়ে এই বর্ধমান রক্তচাপের ওপর মাথা ঘুরে যদি রাস্তায় পড়ে যাই তাহলেই আমার কাল না, আমি কাটোয়া, মানে কাটলাম। পড়লাম কি মরলাম—তুমিই বলছে। না মরলেও পক্ষাঘাত তো নির্ঘাত!
সেকথা ঠিক। বলে আমার কথায় সায় দিয়ে সে বিলের দিকে তাকায়—তিরিশ টাকার বিল উঠেছে। যাঁহা উনত্রিশ তাঁহা ত্রিশ। এক টাকা তো টিপস-ই দিতে হবে বয়টাকে।
তাতো হবেই। আমিও টেবিলের দিকে তাকাই—তুমি নিশ্চয় বলছ না যে, হজ হুজ হিজ হিজ? যার যার তার তার। আমার ভাগেরটা আমাকে দিতে বলছ না নিশ্চয়? তাই বলছ নাকি? আমার কাছে কিন্তু আমার বাড়ি ফেরার ট্রাম ভাড়াটাই আছে কেবল।
আমার আবার তাও নেইকো। সে সখেদে জানায়। তবে আমার বাড়ি তো কাছেই। এটুকু আমি হেঁটেই মেরে দিতে পারব।
তুমি তো হেঁটে মারবে! কিন্তু টাকা না পেলে কি এরা রক্ষে রাখবে? আমাকেই পাকড়াবে। আমিই যে খাবারের সব কুম দিয়েছি আবার। এরা আমায় মারতে মারতে হাঁটাবে তাহলে।
তারপর বয় এসে আমার কাছে বিলের টাকা চাইতেই আমি তাকে পকেট উটে দেখিয়ে দিলাম—আমার কাছে এই সিকিটা শুধু আছে ভাই! আমার বাড়ি ফেরার ট্রাম ভাড়াটাই। তার বেশি আর কিছু নেই আমার।।
শুনে বয়টা আমাকে কিছু না বলে সেখান থেকেই এক হাঁক ছাড়ল। এক হারে
সমস্ত ব্যাপারটা বিশদ করে জানিয়ে দিল সে কাউন্টারে বসা রেস্তরাঁর মালিককে।
মালিক সেখান থেকে হাঁকলেন, দাঁড়া। যেতে দিসনি লোকটাকে। আমি গিয়ে উচিত শিক্ষা দিচ্ছি ওকে।
আস্তিন গুটিয়ে আমার সামনে এসে হাজির হলো সে-সিকি? সি কি বলছেন মশাই? বিরাশি সিকির ওপর সাঁটিয়ে সিকি দিচ্ছেন এখন? দাঁড়ান। উচিত শিক্ষা দেব আপনাকে। এই হাতের বিরাশি সিক্কার একখানা খেলেই ঠিকমত শিক্ষা হবে আপনার। আর কোনো রেস্তরাঁয় এভাবে সিকি পকেটে নিয়ে খেতে আসবেন না। অন্ততঃ, আমার এ রেস্তরাঁতে তো নয় আর।।
বলেই সে আমার জামার কলার ধরে টেনে তুলল। তবে আমার বীরোচিত চেহারা দেখে বোধ করি পাছে প্রাণে মারা পড়ি, সেই আশংকায় বিরাশির মাপের একখানা
দিয়ে উনিশ বিশ আন্দাজের চড়-চাপড়ের চোটে ঠেলে নিয়ে গেল আমায় দরজার দিকটায়। এক চোটে ঠিক না হলেও মোটের ওপর ওর মারগুলো সব টোট্যাল করলে বিরাশিকে ছাড়িয়ে যায় নি। এইভাবে অনেকগুলো সিকি ছাড়বার গব রেস্তর্বার দোর গোড়ায় এসে সে একখানা আধুলি ঝাড়ল। তার সেই অর্ধচন্দ্রের ধাক্কায় আমি রাস্তায় গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম।
আপনার বিলের টাকা তো আপনি উশুল করে নিলেন বাবু! বেশ করে হাতের সুখ মিটিয়ে। বলল তখন বয়টা, কিন্তু আমার বসিসের কী হবে? আমার টিপস্টা?
তোমার টিপ তুমি আদায় করে নাও বাপু। ঢালাও হুকুম মালিকের।
আমি গায়ের ধুলো ঝেড়ে সোজা হয়ে না দাঁড়াতেই আমাকে টিপসই করার মতলবে সে ঘুষি পাকিয়ে আমার সামনে এসে খাড়া হলো। বসিসের বদলে তার বকসিংয়ের চোট থেকে নিজের দাঁত চোখ নাক বাঁচাতে আমি পৃষ্ঠপ্রদর্শন করলাম। বাধ্য হয়ে সে তখন পৃষ্ঠদেশেই…আমার অপর পৃষ্ঠায় তার স্বহস্তের স্বাক্ষর রাখল। তার সেই অটোগ্রাফের দাপটে আমি সাত হাত এগিয়ে গেলাম সটান।
ধরে নিয়ে আয় লোকটাকে।কুম করলেন মালিক আমি এক্ষুনি ও-সিকে ফোন করে দিই—পাহারোলারা এসে পাকড়ে নিয়ে যাক থানায়। সেখানে দস্তুরমতম বোলাই হলে তবেই ওর থড়ে হাড়ে শিক্ষা হবে।
তার কোনো দরকার হবে না, চিরঞ্জিত আমাদের মাঝখানে এসে পড়ল এতক্ষণ বাদ—আমিই নিজের হাতে শিক্ষা দেব ওকে আজ–বাছাধন আর জীবনে এমন কম্মো করবে না। ভুলবে না আর জীবনে। নেমতন্ন করে নিয়ে এসে….ছি ছি…এমন অপমানিত আমি কোনো দিন হইনি।
এবার সে স্বয়ং এসে আমায় এক গলাধাক্কা লাগাল। গলদেশে তার সেই তাড়নায় আমার তলদেশ পর্যন্ত আলোড়িত হয়ে উঠল—আমি চোহাত এগিয়ে গিয়ে রাস্তার উপর উপুড় হয়ে পড়লাম। সে এসে ধরে তুলল আমায়, তারপর বেশ করে ঘা-কতক কসিয়ে আবার আমার গলার ওপর এক চোট…আবার আমায় তুলে ধরল, ফের ঘা-কতক…আবার আরেকখানা…এমনি দ্রুত তালে তার হস্তক্ষেপ আর আমার পদক্ষেপে চালু হয়ে…উঠতে পড়তে…পড়তে উঠতে…উঠে পড়ে আমি এই পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর পন্থাটা (বন্ধুর পন্থাই বটে!) পার হয়ে ট্রাম রাস্তার ওপর এসে দাঁড়ালাম।