হার্টফেল করলেই মরণ হয়, না, মরণদশা হলেই হার্টফেল করে অনেকটা সেই রকম আরকি। ওর কথায় আমার সায়।
ঠিক তাই। আর পড়লেই তোমার হার্ট ফেল হবে। নাও যদি হয় তা, পক্ষাঘাত তো নির্ঘাত। কেউ আটকাতে পারবে না। সে জানায়। তোমার পক্ষে হাঁটা চলাই নিরাপদ। তাহলেও খুব সাবধানে চলাফেরা করবে, ভিড়ের ভেতরে কদাপি যেয়ো না, কারো গায়ে ধাক্কা লেগে পড়ে যাও যদি তো সেটাই হবে তোমার নিরানব্বইয়ের ধাক্কা।
ভিড়ের মধ্যেই তো এসে পড়েছি এখন। একটা ট্যাসি ডাকো তাহলে… আমি বাতলাই।
এই বাজারে ট্যাকসি মেলে নাকি? সে অবাক হয়ে যায় আমার কথায়। আর, অ্যাতো খদ্দেরের ভিড়ে?
তাহলে ট্রাম বাস ধরা যাক, এসো। কিরকম বাদুড় ঝোলা হয়ে যাচ্ছে মানুষ দেখছ? ঐভাবে যেতে যেতে যদি পদস্খলন হয় তো আর রক্ষে আছে তোমার? নিজের দুশ্চরিত্রও খোয়াবে…নিজেও খোয়া যাবে সেই সঙ্গে। নিজেই হারিয়ে যাবে এই দুনিয়ার থেকে… সবার সঙ্গেই সঙ্গেই খসলে।
দরকার নেই। হাঁটাইযাক তাহলে, কিন্তু খিদে পেয়েছিল বেজায়।আমি বলি-হাঁটলে পরে আবার আমার খিদে বেড়ে যায় আরো।
চলো, কাছেই একটা রেস্তরাঁ আছে। পুলটার কাছাকাছি। সেখানে গিয়ে পেট ঠেসে খাওয়া যাবে দুজনে। সে আশ্বাস দেয়।
খিদিরপুরের ব্রিজ দিয়েই তো এসপ্ল্যানেডের ট্রাম যায়, ট্রাম তখন তুমি ফাঁকাই পাবে—খাওয়া দাওয়ার পর। যতো ভিড় এই এখানটাতেই…এখন এই রেস ভাঙবার মুখটায়। সে প্রায় আমার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়—দ্যাখো না, আপ ডাউন দুদিকের গাড়িতেই লোক উঠেছে এখন। ভিড়ে ভিড়াকার।
সত্যিই তাই। অগত্যা সেই রেসকোর্সের থেকে হাঁটতে হাঁটতে উঠলাম গিয়ে রেস্তরাঁয়। দুজনার ছোট্ট একটি টেবিল দখল করে চিরঞ্জিত খাদ্যতালিকাটা এগিয়ে দিলো আমার দিকে—নাও, ঢালাও হুকুম করো। যা খেতে চাও…যা খেতে তোমার প্রাণ চায়।
মাঠের থেকে মোটামুটি বেশ কিছু মেরেছে নিশ্চয় মনে হয়। পকেটে রেস্ত না থাকলে ওর মতন কঞ্জুষ কখনো রেস্তারাঁয় আসে না, তথাকথিত কোনো বন্ধুকে নিয়ে অন্ততঃ। প্রাণ ভরে খাওয়াতে চায় না অপরকে।
সুপ-এর থেকে কফি পর্যন্ত একগাদা ফরমাশ দিয়ে বসলাম পরম্পরায়।
রেসে আজ বেশ লাভ করেছে বোঝা যাচ্ছে। কটা বাজি মারলে শুনি? জিজ্ঞেস করি।
একটাই। একটা ঘোড়ার ওপরই যথাসর্বস্ব ধরে দিয়েছিলাম। মানে, পকেটে যা কিছু ছিল আমার। বলল সে। তবে বাজি জেতার কথা যদি বলল এমন জিত আর হয় না।
ক লেংথে জিতল তোমার ঘোড়া?
লেংথে কিহে? ফারলং বলো। দেড় ফার্লং এগিয়ে ছিল সবার থেকে…
বলো কি হে! সে কি সম্ভব? আমি অবাক হয়ে যাই। রেসের দিন ঘোড়াদের ডোপ দিয়ে থাকে জানো কি? কাকে ডোপ দেওয়া বলে তা জানো?
শুনেছি যেন কথাটা। মাছের টোপ ফেলার মতই কিছু একটা হবে বোধহয়? আরে না, ট্রেনাররা পালা করে নিজেদের স্টেবলের ঘোড়াদের জেতায় সব। এক এক দিনে কয়েকজনের জিতবার পালা। নিজেদের মধ্যে গোপনে সেটা ঠিক করে যেদিন যে ঘোড়াটাকে জেতাবে তাকে ডোপ দেয়। তার পরে সবাই মিলে সেই ঘোড়াটার ওপর মোটা টাকার বাজি ধরে। তাতে আর সব ঘোড়ার হার হলেও মাঠসুদ্ধ রেসুড়েরা সবাই মার খেলেও ট্রেনারদের, জকিদের আর জানাশোনার ভেতরের লোকদের লাভ হয় খুব। যেটার ওপর বাজি ধরেছিলাম তাকে আজ ডোপ দেবার কথা ছিল। একেই বলে ঘোড়ার মুখের খবর—খবরটা আমি পেয়েছিলাম।
ঘোড়াটা বুঝি বলেছিল তোমায়? আমি আরো অবাক হয়ে যাই: ঘোড়াটার সঙ্গে খুব ভাব ছিল বুঝি তোমার?
আরে, ঘোড়া বলবে কেন হে? ঘোড়ার মুখ দেখলেই তো বোঝা যায়। রেসের দিন সকালে যারা ঘোড়াদের স্মার্ট দেখতে ময়দানে যায় তাদের ভেতর যারা সমঝদার তারা ঘোড়াদের মুখ চোখ চাল চলন হাব ভাব দেখেই টের পায় কোনটার আজ জেতার পালা, কাকে সেদিন ডোপ দেওয়া হয়েছে।
বটে বটে?
ডোপ মানে, কী একটা উত্তেজক ইনজেকশন, ঘোড়াকে সকালে দিয়ে দেয়। তাতে দৌড়বার সময় তার খুব তাগদ হয়, খুব এনার্জি দেখা যায়। একেবারে অস্বাভাবিক রকমের। তাতে হয় কি, যে ঘোড়ার আগের দুটো বাজিতে হার হয়েছে পর পর, মানে জেতানো হয়নি যেটাকে, অবশ্যই মতলবমাফিক, সেই ঘোড়াটাই ডোপ নেবার দিন তিন লেংথে সবাইকে হারিয়ে বাজি মেরে দেয়—তার ফলে সব কিছু আপসেট হয়ে যায়। একেই বলে রেসের আপসেট। আগের হেরো ঘোড়র ওপর সেদিন তো কেউ বড়ো আর বাজি ধরে না—তাই। বহুত লোকের হার হলেও খবর পেয়ে যারা বাজি ধরেছিল মোটা টাকার টোট জেতে তারা তাদের বেলায় বাজিমাৎ!
আর ডিগবাজি-মাত বাকী সবার?
তা বলতে পারো। তবে আমারটা যে কী হলো তা আমি ঠিক বলতে পারব না, বাজিও বলা যায়। আবার ডিগবাজিও বলা যায়।
খাবার মুখে গল্প চলছিল আমাদের। বেয়ারা বিল রেখে গেল টেবিলে—খানার দাম ঊনত্রিশ টাকায় উঠেছে। উতুক গে, বিল মেটাবার দায় তো আমার নয় আর।
তার মানে? আমি শুধাই। তোমার ঘোড়াটা তিন লেংথে, না কি, তিন ফালংয়ে জিতেছে এইমাত্র বললে যে! তাহলে?
বলেছি ঠিকই। তিন ফার্সংয়ের এক ইঞ্চি কম নয়। বরং কিঞ্চিৎ বেশিই হতে পারে। কিন্তু হলে কী হবে, ওটাকে ঠিক বাজি জেতা হয়তো বলা যায় না…
মোটামুটি মেরেছ বেশ আজ। নইলে তুমি আমার মত রাক্ষসকে নিয়ে আজ এই রেস্তরাঁয় এসেছ! ওর কথায় আমি হাসি।
হয়েছে কী, বলি তোমায়। খেলাটা খতম্ হয়ে যাবার পরই খবরটা পেলাম ঐ মাঠেই একটু আগে। ঘোড়ার মুখের খবর নয় এবার, আমার মতই এক গাধার মুখ থেকে পেয়েছি খবরটা। সে-হতভাগাও বাজি ধরেছিল ঐ ঘোড়ার ওপরেই—ডোপের খবর পেয়েই বোধহয়।