কোনো ষোড়শী তরুণীকে নিজের কোলে পেলে নেহাত মন্দ হয় না, মোহের বশে ঘুণাক্ষরে কখনো হয়তো নিজ্ঞানে করে থাকব, কিন্তু সেই স্বপ্ন চুরমার হয়ে যেতে বেশি দেরি হলো না আমারা। ল্যান্সডাউন মার্কেটও পেরুইনি, আমি চিৎকার করে উঠেছি- এই রিকসাওলা! রোকো রোকো। রোকে। …একদম রোকে এই নাম, নামনাম তোরা সব।
নামবার পর রিকসাওলার প্রণামী গুনি–এই লেও তুহারা ভাড়া। যাও, ভাণো। ভাগো হিয়াসে। এই মহল্লাসে ভাগ যাও। আমি হল্লা করে উঠি–আউর কভি ইধর নেহী আনা।
হলো কী তোমার? পুতুল শুধোয় : হলোটা কী?
আর হলোটা কী! পায়ের হাড়গোড় সব গুঁড়ো হয়ে গেল আমার–বাবা! ইতু যে একটা আস্ত পাহাড় তা কে জানত।
তখনই বলেছিলাম না আমি? শুনলে না তো। সে বলে।
আমি কি বসতে চেয়েছিলুম তোমার কোলে? প্রতিবাদ করে ইতু: তুমিই আমার কোলে বসতে পারতে, ইচ্ছে করলে।
বা রে! ও দিদি হয়ে বসল না, আর আমি দাদা হয়ে বসতে যাব? মায়ের পেটের না হলেও, আমি তোদের দাদা না? আমার একটা আত্মসম্মান নেই?
তাহলে আমি আর কী করব?
কী সুখে যে মেয়েদের কোলে নিতে চায় লোকে! আমি বিরক্তি প্রকাশ করি।
আমি তো চাইনি। ও যা ভারী, জানি তো। পুতুল জানায় : ওকে কেন, কোনে। মেয়েকেই আমার কোলে নিতে চাই না আমি কক্ষনো।
তা সত্যি, মেয়েরা কখনো তা চায় না বটে। মেয়ে হয়ে তারা মেয়েদের মর্ম বোঝে না, সেই জন্যেই কিনা–নাকি, মর্মে মর্মে সেটা বোঝে বলেই,—তার মর্মোদ্ঘাটন করা আমার কম্মো না; তবে দেখেছি যে হাল্কা গোছের শিশুদেরই কোলে কাঁখে এমন কী গর্ভে ধারণ করতেও তারা গর্ববোধ করে, কিন্তু ভুলেও কক্ষনো কোনো মেয়েবে নিজের কুক্ষিগত করতে যায় না। চায়ও না। স্বভাবতই তারা বুদ্ধিমান।
কিন্তু হনুমানরা চায়। এমনকি, দারুণ দুরাকাঙক্ষায় তারা হনুমানকেও টেক্কা মাবতে যায়। এই যেমন আমি। স্বয়ং মহাবীর শুধু গন্ধমাদনই ঘাড়ে করেছিলেন, কাঞ্চনজঙ্ঘাকে কোলে করতে যাননি। কিন্তু হনুমত্তায় (নাকি, হনুমত্ততায়?) তাঁকেও ছাড়িয়ে গিয়েছি আমি।
তুই না চাইতে পারিস। জবাব দিই পুতুলকে। কিন্তু অনেকে চেয়ে থাকে।
কেউ চায় না। বাড়ি বাড়ি মেয়েকে কেউ কোলে নেয় নাকি? না, নিতে চায় আবার?
ছেলেরা চায়। …দুর্যোধন চেয়েছিল।
দুর্যোধন?
চায়নি দুর্যোধন? যার জন্যে অমন কুরুক্ষেত্র কাণ্ডটা বাধলো? দ্রৌপদীকে নিজের কোলে বসাতে চেয়েছিল বলেই না!
পুতুল চুপ করে যায়। পুরাতত্ত্বের গর্ভে হাবুডুবু খেতে চায় না হয়তো বা।
আহা, তখন যদি শ্ৰীমতী যাজ্ঞসেনী তার কোলে চেপে বসতেন গিয়ে! তখনই তো উরুভঙ্গ হয়ে যেত বেচারার। তাহলে আর অত কাণ্ড করে অত কাঠখড় পুড়িয়ে ভগ্নউক কুরুপতি করার জন্য ঐরকম কুরুক্ষেত্র বাধাতে হতো না।
কোলে বসালেই এই! আর, কোলে বসলে যে কী হয় তা তো চোখের সামনেই দেখছি—এই বাসেই। আর, তাও কিছু কম কুরুক্ষেত্র নয়।
..ছোটলোক!…আহাম্মোক!…যৎপোনাস্তি!…তখনো ভদ্রলোক গঞ্জনা দিযে চলেছেন সমানে। আর, উদ্দিষ্ট ব্যক্তিটি তখনো তেমনি নির্বিকার নীরব। বিলকুল স্পীক-টি-নট!
কিন্তু আমি আর প্রতিবাদ না-করে পারি না। বলি—যৎপরোনাস্তি কি একটা গাল নাকি মশাই? আপনি যে যা মুখে আসছে তাই বলে যাচ্ছেন!
যার-পর-নাই হয়ে যাবার পর পার্শ্বোপবিষ্ট ভদ্রলোকের বুঝি আর সহ্য হয় না। তিনি উঠে দাঁড়ান–
আমি নামব এবার। বলে মেয়েটিকে তিনি নমস্কার জানিয়ে ভদ্রলোকের দিকে একখানা কার্ড বাড়িয়ে দেন—
এই নিন আমার নাম-ঠিকানা। যাবেন একদিন আমার বাড়ি। আমার বৌয়ের কোলে বসে আসবেন ঘণ্টাখানেক।
চলে যাবার আগে বলে যান তিনি।
বন্ধুর মতন নেই আর!
বান্ধবীরা নিতুই নব। নিত্য নবীন। দর্শনে অদর্শনে নব নবরূপে দেখা দিয়ে থাকেন, আমি জানি।
কিন্তু বন্ধুরা চিরকালীন। তাদের রূপ গুণের বিশেষ হেরফের হয় না বোধহয় কোনো দিনই। এইতো জানতাম।
তাদের সেই চিরকেলে একঘেয়ে চেহারা আর ব্যবহারের কোন দিন ভোল পালটে কখনো যে তারা অভিনব রূপ ধরতে পারে এ ধারণা আমার ছিল না। সেই বদ্ধমূল ধারণা আমার বদলে গেল অকস্মাৎ। চিরঞ্জিতের কাছে চিরদিনের মতই হার হলো সেদিন আমার…আর আমার ধারণার।
বন্ধুর মতন হয় না সত্যিই!
প্রেসিডেন্সি হাসপাতালে পীড়িত এক আত্মীয়াকে দেখে রেসকোর্সের ধার ঘেঁষে পাশ কাটাচ্ছিলাম, ময়দানের সড়কে উঠে এসপ্ল্যানেডের ট্রাম বাস বার মতলবে। ইতিমধ্যে ঘোড়-দৌড়ের খেল খতম হয়ে মাঠের ভিড় ভেঙে রাস্তায় নেমে এসেছে।
ভিড়ের ভেতর চিরঞ্জিত। দেখতে পেয়ে আমার উপর এসে যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ল। এধারে যে? এমন অসময়ে? শুধায় সে।
সুখ লি কার্নানি থেকে ফিরছিলাম। আমি জানালাম।
সুখলাল থেকে? কেন হে? খাসা তো আছে। খাসীর মতই প্রায়। দেখে তো মনে হয় না তোমার কোনো অসুখ বিসুখ আছে। মনে হয় যে তোমার সুখের অবধি নেই…
অবধি নেই? আমি প্রতিবাদ করি—উচ্চরক্ত চাপে চাপিত। সর্বপ্রকার চাপল্য নিষেধ আমার—তা জানো?
আরে ব্লাডপ্রেসার কি আবার একটা অসুখ নাকি? চালু থাকলে কোনো ভয় নেই—বিলকুল নিরাপদ। চলতে ফিরতে পারলেই নিশ্চিন্তি। কিন্তু পড়লে কি মরলে।
তার মানে?
সেই যাত্রাপালার নায়কের মতই প্রায়। পতন আর মৃত্যু সঙ্গে সঙ্গে। বলে চিরঞ্জিত : তবে স্ট্রোক হলেই পড়ে, না, পড়লেই স্ট্রোকটা হয় তা আমি সঠিক বলতে পারব না।
ওর কথায়, নৈয়ায়িকদের সেই তাল পড়িয়া টিপ করে, না টিপ করিয়া তাল পড়ে–কথাটা মনে পড়ল আমার।