না, আপনাকে না, বলছি ঐ লোকটাকেই। কেমনধারা মানুষ দেখুন তো! বলা নেই কওয়া নেই, ঝুপ করে একটা মেয়ের কোলে বসে পড়লো হঠাৎ! কী ঘঘারতর লোক…অপদার্থ।
ওঁর আর দোষ কী? টাল সামলাতে না পেরে… ভদ্রলোকের পক্ষ-সমর্থনে এগোই আমি–যার ভেতরে আমার নিজের সাফাইটাও উহ্য রয়েছিল।
টাল সামলাবার কী আছেটা মশাই? বাসের মধ্যে আবার টাল-বেটাল কী। মাথার ওপর রড ছিল না ওর? দু-হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে থাকতে কী হয়েছিল? তিনি বলতে থাকেন—অমনি বসে পড়লেই হলো এক ভদ্রমহিলার কোলে?
সবার কব্জির জোর কি সমান? এবার আমার হাত সাফাই। ত পিছলে মাথার রড ফসকেও তো যায় এক এক সময়।
রাখুন আপনি। নামি না আমি একবার। নামুক না লোকটা বাস থেকে, তারপর দেখিয়ে দেব লোকটাকে। মেয়েদের কোলে বসার মজাটা টের পাইয়ে দেব হাতে হাতে। কব্জির জোর কাকে বলে জানিয়ে দেব এক ঘুষিতে।
যার উদ্দেশে এত বাক্যবাণ, এমন তম্বি, তিনি কিন্তু স্থানুর ন্যায় নিথর নীরব। নিরাসক্ত। আমিও আর মাঝে পডে কথা না-বানিয়ে চুপ করে যাই।
ইস্টুপিট–রাস্কেল–রটন… আরো উগ্র হয়ে ওঠেন উনি তখন।
হটেনটট্…হনলুলু…হিপাপটেমাস! উগরে যান তার গরল একধার থেকে।
ওঁর আগেই তুমি এখানে বসলে কেন? বললেন এবার ভদ্রমহিলাটি : তাহলে তো উনি আর… তার বেশি তিনি এখোন না, কথাটা উহ্য রেখে দেন। মানে, তাহলে তো উনি ওঁর কোলে বসার সুযোগ না পেয়ে ঐ ভদ্রলোকের কোলেই বসতেন। এমনধারা কাণ্ড বাধতো না।
বসব কেন আমি? তুমি বললেই আমি বসব? মেয়েদের সীট না? মেয়েদের সীটে বসতে যাব কেন? একটি মেয়ে এলেই তো উঠে পড়তে হবে তক্ষুনি। কিন্তু আমি বসিনি বলেই ওঁর এমন কি এক্তিয়ার…পাজি, নচ্ছার, হতচ্ছাড়া! শূয়োর ভণ্ড! শুশুক কোথাকার!
উপবিষ্ট ব্যক্তিটি চুপ করে থাকেন। শুশুক শুনেও, (গালটা বলা বাহুল্য তেমন সুখকর নয়। তাঁর মুখভাবের কোনো বৈলক্ষণ্য দেখা যায় না। কিন্তু মেয়েটির গলায় প্রতিবাদের সুর অর্ধোচ্চারিত হয়-আহা, কেন মিথ্যে ভদ্রলোককে…
ভদ্রলোক! গর্জে ওঠেন ইনি : ভদ্রলোকের পোশাক গায়ে থাকলেই ভদ্রলোক হয় না। পরীর কোলে বসাটা কী রকমের ভদ্রতা? শুনি তো একবার?
এ-কথার কোনো জবাব না থাকলেও প্রশ্নটা আমাকেও যেন পীড়িত করে। পরস্ত্রীর কোলে বসা ভদ্র-অভদ্র কারো পক্ষেই উচিত নয় নিঃসন্দেহে, কিন্তু সত্যি করে বলতে, ভদ্রলোক বসতে আর পেলেন কোথায়? বসতে না বসতেই তো…খতিয়ে দেখলে তার লাভের দিকটায় zero। কোলে বসে জিরোবারও ফুরসত পাননি একটু। বসতে না বসতেই উঠে পড়তে হয়েছে। এটাকে প্রায়োপবেশনই বলা যায় ববং।
মেয়েদের সীটের গায়ে গা ঘেঁষে দাঁড়ানোর মানেটা কি কেউ বোঝে না নাকি? তাক খোঁজা হচ্ছিল, কখন টালটা আসে। ফাঁক পেতেই ধূপ করে বসে পড়া হয়েছে অমনি।
উনি নিরুত্তর। ইনি কিন্তু এর আগে যে রেটে এগুচ্ছিলেন, মনে হচ্ছিল, তাঁর স্ল্যাংলাপে শীগগিরই শ’কার বকারে গড়িয়ে আসবেন, কিন্তু কর্ণমর্দনের (নাকি, কর্নওয়ালিসের?) সেই দশশালা বন্দোবস্তে না গিয়ে, বোধহয় ভাষায় কুলিয়ে উঠতে না পেরেই, বাক্যের শালীনতায় ফিরে এসেছেন বাধ্য হয়ে। তবু ভালো যে, ভদ্রলোককে মার্জনা করতে না পারলেও তিনি নিজে অন্ততঃ ভদ্রভাষায় মার্জিত হয়েছেন।
মেয়েছেলের কোলে বসতে খুব আরাম লাগে, তাই না? আবার তার কামান-গর্জন হলেও, তার কথার শোনায় এবার যেন একটু সোহাগা মেশানো মনে হয়।
কথাটা শুনে আমার কেমন খটকা লাগে। বটু করে একটা কথা মনে পড়ে যায়… বসার কোল ঘেঁষাই কথাটা।
মেয়েদের কোলে বসাটা কেমন আরামের জানিনে, তবে মেয়েদের কোলে বসানোর আরামটা আমার জানা আছে বটে। হাড়ে হাড়েই জানা।
মারাত্মক আরাম। প্রায় কুরুক্ষেত্র কাণ্ডই বলা যায়। দ্বৈপায়ন হ্রদের ধারেই ঠিক যে-রকমটি ঘটেছিলনাকি একবার।
কুপার স্ট্রিট থেকে ম্যাটিনি শো-এর সিনেমা দেখতে যাব বলে বেরিয়েছি—আমার বোন ইতু, আমি আর পুতুল।
কুপারের থেকে দুপা এগিয়েই আমি কাহিল—না বাপু, এই দুপুর রোদে ঢ্যাং ট্যাং কবে অদূর আমি যেতে পারব না। হাঁটতে আমি পারিনে। হাঁটুর অত জোর নেইকো আমার।
এই কাছেই তো পূর্ণ সিনেমা! কর আর? ইতুচন্দর বলেন : এতে হাঁটুর আর খাটুনি কী! এইটুকুন তুমি হাঁটতে পারো না শিব্রামদা?
তুই হলি পাহাড়ে মেয়ে। তোর সঙ্গে হেঁটে আমি পারি? তোর পায়ের হাড় কতো শক্ত। তোর পায়ের কজি দ্যাখ, আর আমার পায়ের। তোর সঙ্গে পাঞ্জাতেই আমি পারব না, আর, হাঁটনের পাল্লায় পারব। এখান থেকে রস রোড অব্দি হাঁটতে হলেই আমার হয়েছে। না বাপু, তোমরা একটা রিকসা ডাকো বরং।
রিকসা এলো, কিন্তু পুতুল প্রশ্ন তুললো—রিকসায় কি তিন জন ধরবে?
একজন কারো কোলে বসুক নাহয়? বলে দিলাম আমি।
কে বসবে শুনি? পুতুলের পুনরপি প্রশ্ন থাকে।
আমার তো কোলে বসার কথাই ওঠে না। তোদের দুজনের কেউ কারো কোলে বসুক তাহলে।
না দাদা, আমি ইতুর কোলে বসে যাব না, আমি ওর দিদি না?
তাহালে ও-ই তোর কোলে বসে যাক। দেখা গেল, ইতুর তাতে কোন আপত্তি নেই, কিন্তু পুতুলের আপত্তি ঘোরতর—বাবা! ও যা ভারী! ওকে আমি কোলে বসাতে কিছুতেই রাজি নই। ইতুকে কোলে করে অদূর যেতে হলেই আমার ইতি।
তারপর? তারপর সেই পুরনো ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। পৌরাণিক পালার পুনরভিনয়। সেই কুরুক্ষেত্র কাণ্ড!
আমার কোলে বসারই কথা উঠল তখন। অম্লানবদনে ইতুই বসল আমার কোলে।