পড়ত, গাছটা সেখানে থাকত যদি। বলে তিনি আবার দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন—সেটাও সেই ঝড়ে পড়ে গেছে কিনা। তারপর কারা এসে তার ডাল-পালা কেটে-কুটে নিয়ে চলে গেছে কবে যেন। চিহ্নমাত্রও নেই এখন।
লিচুগাছটাও নেই! শুনে দীর্ঘনিশ্বাস পড়ল আমাণও।
না। তবে গাছের গুঁড়িটা আছে। পাশ দিয়ে যেতে নজরে পড়বে। ভুল হবার যে নেই।
বেশ। তারপর সেখান থেকে বাঁ ধারে বাঁক নেব আবার?
গোড়াগুড়ি সোজা বলেই মনে হচ্ছে পথটা—এই গোড়ার থেকে ওই গুঁড়ি পর্যন্ত অন্ততঃ।
বাঁ ধারেই বেঁকেছে রাস্তাটা। তারপর সেখান থেকে সোজা চলে যাবেন সেই শহীদ-স্তম্ভ অব্দি। পাড়ার ছেলেরা কোথাথেকে একটু উঁচু পাথর নিয়ে এসে খাড়া করেছিল সেখানে। বিয়াল্লিশের শহীদদের স্মৃতিচিহ্ন।
উঁচু পাথরের শহীদ-স্তম্ভ? আমি ঘাড় নাড়ি-না, এবার আর ভুল হবার কিছু নেই।
সেই শহীদ-স্তম্ভটাই কি আছে নাকি আর? লরির ধাক্কায় কাত হয়ে পড়েছিল কবে। ও-পাড়ার বনমালী মুদি সেটাকে তুলে নিয়ে গিয়ে তার মুদিখানার পৈঠা বানিয়েছে।
শহীদ-স্তম্ভের কথায় ইতু যাও বা একটু উৎফুল্ল হয়েছিল, বনমালীর কাণ্ডে মুদিত হয়ে গেল তৎক্ষণাৎ। প্রস্তরীভূত শহীদদের পরিণামে—পাদপীঠে এই পরিণতিতে আমিও স্তম্ভিত।—সেই পাথরটাও নেই আর!
না। তবে সেই জায়গাটা আছে। নেবার জো আছে কি না জানি না, তবে সেইখানটা হেড়ে বাঁ ধারে একটু গেলেই আপনার সেই প্রভাত-কুটির। সোজা রাস্তা, ভুল হবার কিছু নেই।
সোজা বলে তো বাতলালেন নটবরবাবু। কিন্তু যাওয়া মোটেই সোজা না, এমনি করে মোড় ঘুরে ঘুরে—এইভাবে বাঁ পারে চর নিতে নিতে যাওয়া কোনো চক্করবরতির পক্ষেও সহজ নয়। যাই হোক, দুরপাক খেতে খেতে এগুলাম।
ভালো লোক পাকড়েছিলে দাদা। বলল পুতুল।
লোকটার বয়সের গাছ-পাথর নেই! মুখ ব্যাঁকাল ইতু। বাব্বাঃ!
মিনিট পাঁচেক বাদে একটা মোড়ে এসে পৌঁছলাম, মনে হলো সেই বাড়িটার সামনেই এসে পড়েছি, আলিসাদ্যে যে বাড়িতে মরেছেন, তারপর সেখান থেকে বাঁ মোড় ধরে খানিক এগুতেই সেই যেখানে সেই সাইনবোর্ডটা হিল সে জায়গাটা পেলাম মনে হয়, তার খানিক বাদে বিয়াল্লিশের শহীদরা যেখানে দ্বিতীয়বার শহীদ হয়েছিলেন সেখানটাও পেরিয়ে গেল বোধ করি, ইতিমধ্যে কোনো ফাঁকে অন্তহিত সেই লিচুগাছটাও ছাড়িয়েছি সভবতঃ; তারপর আরেক চকরের পর সোজা এসে পড়লাম বড় রাস্তায় আবার। ডায়ম হারবার রোডে। সেই নটবর কেবিনের সামনেই সটান।
আমাদের দেখে নটবরবাবু নড়বড় করে এগুচ্ছেন দেখা গেল।
কিন্তু আমরা আর গাড়ি থামালাম না। নটবরকে নট করে দিয়ে কলকাতার পাড়ি ধরলাম সোজা।
প্রায়োপবেশন
যথাযথ বললে, প্রায়োপবেশনই বলতে হয়, সবদিক বিবেচনা করে।
সুতারকিন স্ট্রিটের কাজটা সেরে চিত্তরঞ্জন অ্যাভির কফি-হাউসের মোড়টায় এসে খাড়া হয়েছি, থ্রি-বি বাস ধরে নিউ আলিপুর পাড়ায় আমার বোন পুতুলের বাড়ি যাব বলে—কিন্তু বাস ধরাই তো দায়। একটার পর একটা থ্রি-বি আসতে লাগল ঠাসবোঝাই হয়ে—আর পাশ কাটিয়ে চলে যেতে লাগল ফ্রিলি-পা বাড়াবার সাহসই হলো না। আধঘণ্টা ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে-টু-বি আবার নট টু-বি—এই দোনামোনার মধ্যেই। শেষটায় মরিয়া হয়ে ঠিক করলাম এরপর যে থ্রি-বি-ই আসুক, যতই না ভিড় থাক—উঠে পড়ব লাফ দিয়ে যে করেই হোক, না হয় প্রাণ হাতে করে ঝুলতে ঝুলতেই যাব নেহাত।
এলো একটা থ্রি-বি, তেমনিতরই ভর্তি, তবুও কোনগতিকে হ্যাণ্ডেল ধরে উঠে পড়লাম।
একতলা থ্রি-বি-গুলোর দুমুখো দরজা। মাথার দিকের মেয়েলি তরফের হাতলটা ধরে উঠতে যাচ্ছি, ল্যাজার দিকের দরজার মুখে যে মুষ্টিমেয় ব্যক্তি ঝুলছিলেন তাদের একজনা কাতর স্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন—উঠবেন না, মশাই! উঠবেন না দোহাই।
ল্যাজার দিকে লোকটার কথায় ব্যাজার হতে হলো আমায় কেন মশাই, আমি তো এদিক দিয়ে উঠছি, আপনার তাতে কী হলো?
বলে ঠেলেঠুলে কোনোরকমে তো সেঁধিয়ে গেলাম ভেতরে। ঢুকতে না ঢুকতেই আওয়াজ পেলাম, ধপাস্! মুখ বাড়িয়ে দেখি অন্য দিকের দরজার সেই ঝুলন্ত লোকটি রাস্তার উপরে চিৎপাত হয়ে পড়েছেন। আমার দিকে কড়ানজরে তাকিয়ে ধরাশায়ী ভদ্রলোকটি বললেন—বারণ করলাম শুনলেন না, দেখলেন তো এখন কী হল!
সেই ঠাসবোঝাই বাসের এধার থেকে আমার ঠেলাতেই যে ওধার থেকে উনি বসে পড়েছেন সেটা বুঝতে আমি বেগ পাই না, কিন্তু তখন উদ্বেগ বোধ করার অবসর কই? ওঁর দিকে দেখব কি, এদিকে বাসের ভেতরেই আরেক দুর্ঘটনা! আমার এই অনুপ্রবেশের জন্যেই কিনা কে জানে, মেয়েদের গা ঘেঁষে যে ভদ্রলোক টায় টায় দাঁড়িয়ে ছিলেন ঠায়, তিনিও ধপাস্ করে ভদ্রমহিলার কোলের ওপরে বসে পড়েছেন।
সঙ্গে সঙ্গেই জিভ কেটে তার উঠে পড়ার অবশ্যি দেরি হয়নি, কিন্তু ক্ষমা চাইবার আগেই মেয়েটি তাকে আশ্বস্ত করে বসবার অনুরোধ জানিয়েছে। না, তার কোলে নয়, পাশেই-এবং নিজেও একটুখানি ধার ঘেঁষে সরে বসেছেন তিনি।
ভেবেছিলাম উনিও রোষকষায়িত নেত্রে আমার প্রতি তাকিয়ে অভিযোগের কটাক্ষ হানবেন, কিন্তু না, বরং তিনি কৃতার্থের মতই একটু জড়সড় হয়ে বসলেন দেখলাম। এবং মনে হলো একটু সকৃতজ্ঞের মতই যেন চাইলেন আমার পানে।
কিন্তু খাপ্পা হয়ে উঠলেন আরেক ভদ্রলোক।
ইতর, অভদ্র, ছোটলোক কোথাকার! গর্জে উঠলেন তিনি।
আজ্ঞে, মাপ করবেন, আমার ঘাট হয়েছে। আমি বলতে যাই—কিছুটা কৈফিয়তের সুরেই বোধহয়।