নিজের বিদ্যার বহর শহর করি।
তোমার মার খবরে আমাদের কাজ নেই। ইতুর সাফ জবাব। -সাগরের খবরও চইনে।
তখন বাধ্য হয়ে আমি গুপ্তকথার সহজ ব্যাখ্যায় চলে আসি—মানে হচ্ছে কি, বিধাতা এই দুনিয়ায় ধানে-চালে মিশিয়ে দিয়েছেন। তোমাকে একটু কষ্ট করে সেটা বেছে নিতে হবে কেবল। তুই সেখানে একটা আধবুড়ো লোক আছে বলে ঘাবড়াচ্ছিস, ভাবছিস যে গিয়ে কী লাভ হবে। কিন্তু তার পেছনে এই নাতিবৃহৎ পরিবারটি রয়েছে, বৃহৎ বৃহৎ নাতিও রয়ে গেছে নিশ্চয়—সেদিকটা তো নজরে পড়ছে না তোদের।
বলে দৃষ্টান্তস্বরূপ আমি নিজেকেই উদাহরণ-স্থল করি, আগে তো আমি ছেলেদের গল্প লিখতাম কেবল। তাই ছেলেরাই গায়ে পড়ে মিশতে আসত আমার সঙ্গে। তাদের সতেই আলাপটা হতো প্রথম। তারপর ভাব জমলে তাদের বাড়ি গেলে মেয়েদের দেখা পেতাম না কি? যেমন বোনান্তরালে ভাইরা থাকে তেমনি ভাইরাস-এর পেছনে বোন। বিধাতার এই নিয়ম। ঘোড়া ডিঙিয়ে কি ঘাস খাওয়া যায় কখনন? এই তোদের বেলাই দ্যাখ না। প্রথমে তো তোদের দাদার সঙ্গেই ভাব হয়েছিল আমার। গোরাই আমায় ল্যাজে বেঁধে যোত গোড়ায়। তারপরে তো তোদের সঙ্গে মিশলাম। কিন্তু গোড়ায় তার সঙ্গে ভাব না হলে কি তোদের আর পাত্তা পেতাম কোনদিন! তারপরে যখন তোদের সঙ্গে ভাব হলো, তারপর থেকে তোদের সঙ্গেই ঘুরছি তো! গোরাকে নিয়ে কি সিনেমায় রেস্তরাঁয় যাচ্ছি আর? আর, গোরাই কি আমার সঙ্গে ঘুরছে আরো? সে তো এখন সবিতার সঙ্গে…
হয়েছে, হয়েছে। বুঝতে পেরেছি। তোমায় আর ব্যাখ্যান করতে হবে না।
ইতু আর পুতুলকে নিয়ে ওদের গাড়ি করে ডায়মণ্ড হারবার পাড়ি দেওয়া হলো।
অকুস্থলে পৌঁছে দেখা গেল, সেখানে এক চায়ের দোকান—নটবর কেবিন…রাস্তার ঠিক ওপরেই—চাতকদের অপেক্ষায়।
চৌরাস্তার মাথার ওপর দোকানটা—কোনদিকে যাই এখন?
ওই চা-ওয়ালাকে জিজ্ঞেস করে জেনে নাও না কেন? বাতলালো ইতু। এখানকার হদিশ ও-ই তো ভাল দিতে পারবে।
তা বটে। চায়ের দোকানে সবাইকে আসতে হয়। ওখানেই সব খবর, সবাব খবর মেলে।
নামলাম গাড়ির থেকে। শুধালাম গিয়ে দোকানীকে।
অশীতিপর এক ভদ্রলোক।
ঠিক সময়ে এসেছিলাম, ভাগ্যিস। এই শীতের পর আর ওঁর দেখা মিলত কিনা সন্দেহ।
কার ঠিকানা চান? ঘাড় নাড়তে নাড়তে তিনি বললেন।
তারাপদবাবু! এইখানেই কোথাও থাকেন। আমি জানালাম।
ও? তারাপদবাবু! বলে বৃদ্ধটি যেন কেমন গুম হয়ে গেলেন। আর কোন কথাটি নেই তাঁর।
তুমি আর লোক পেলে না—এই বুড়োর কাছে জানতে গেলে। ইতু ফিসফিস করে, একটা বাচ্চাটাচ্চা কারো কাছে জানতে হয় বরং!
বাচ্চারা কি বয়স্ক লোকের খোজ রাখে নাকি? ধার ধারে বয়সীদের? উনি সাবেক লোক, উনি বলতে পারবেন বরং। বলে আমি ভদ্রলোককে উসকে দিলাম আবার : প্রভাত-কুটিরটা এখানে কোথায় বলতে পারেন?
প্রভাত-কুটির, ও! বলে তিনি গম্ভীর হয়ে গেলেন আবার।—ও! সেই প্রভাত-কুটির।
হ্যাঁ, তার হদিশটা বাতলাতে পারেন আমাদের?
কার হদিশ?
প্রভাত-কুটির। তারাপদবাবুরা থাকেন যেখানে।
অ! তারা নতুন এসেছেন বুঝি?
না, না। গত যুদ্ধের সময় থেকেই আছেন মনে হয়।
গত যুদ্ধের সময় থেকে?
হ্যাঁ, তাই হবে। সায় দিই আমি।
তাহলে ঠিক হয়েছে। গত যুদ্ধের সময় থেকে। আবার তিনি ঘাড় নাডেন, হ্যাঁ, তারাপদবাবুই বটেন। আমরা এখনো তাদের সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানি না। তবে ওই নাম বটে।
তাঁরা এখন কোথায় আছেন সেইটে জানতে চাইছি।
আমি বলি। প্রভাত-কুটিরেই আছেন বটে। বেশিদিনের নয় বাড়িটা। হালেরই বলতে হয়। সন তেরোশো তিন সালে তৈরি। বাড়ির মাথাতেই খোদাই করা আছে তারিখটা। প্রভাত-কুটির। সেইখানেই তারা থাকেন।
বলে তিনি পিছন ফিরতেই আমরা তাকে ফিরে ডাকলাম, আজ্ঞে, দয়া করে তার বাড়ির পাত্তাটা যদি জানাতেন আমাদের।… প্রভাত-কুটির যেতে হলে…
প্রভাত-কুটিরে যেতে চান? তিনি ফিরে দাঁড়ালেন ফের : এই পাশের বাস্তাটা ধরে চলে যান সোজা। ইমদাদ আলির বাড়িটা পেরুলেই…
তা, সেই আলি সাহেবের বাড়িটা কোন্ জায়গায়? বাধা দিয়ে জিজ্ঞেস করতে হলো আবার।
আলিসাহেব? ও, ইমদাদ আলি!.. বলে বৃদ্ধলোকটি এক দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেনতিনি অব সেখানে থাকেন না। তার সঙ্গে যদি দেখা করতে এসে থাকেন তো মিছে বববাদ করলেন সময়টা। দুবছর হবে তিনি কবরখানায়। তাকে পেতে হলে আরো ঢেব আগে আসতে হতো।
তখন আমাদের বলতে হলো যে, না, আমরা ইমদাদ আলিকে চাইনে, কবরখানায় যাবারও ইচ্ছা নেই আমাদের, প্রভাত-কুটিরেই যেতে চাই আমরা।
ও! …তা, যদি প্রভাত-কুটিরেই যেতে চান তো এই পথ ধরে সোজা চলে যান, খানিকটা গিয়ে বাঁ দিকে ঘুরবেন—তারপর আবার খানিকটা গিয়ে ফের আবার বাঁ দিকে—সেই মোড়ের ওপরের বাড়িটাই হচ্ছে যেখানে ইমদাদ মিঞা থাকতেন। বললাম তো আমি।
মোড়ের ওপরেই? আমি আওড়ালাম। তারপর বাঁ দিকে টার নিতে হবে?
হ্যাঁ, যেখানে সেই সাইনবোর্ডটা ছিল। তিনি জানালেন তার থেকে আর খানিকটা গেলেই…না, ভুল হবার কিছু নেই।
সেই সাইনবোর্ড-বরাবর যাব বলছেন?
সেই সাইনবোর্ড কি আর সেখানে আছে মশাই? সেই আশ্বিনের ঝড়ে উড়ে গেছে কোকালে।
যাকগে, সেই স্বৰ্গত সাইনবোর্ডের পাশ দিয়ে খানিকটা গেলে তারপর?…
ডান দিকে লিচুগাছটা রেখে ফের আবার বাঁ দিকে ঘুরতে হবে।
লিচু গাছটা ডান দিকে পড়বে তো? জেনে আমার উৎসাহ হয়। লিচুগাছ চিনতে ভুল হবে না আমার কিছুতেই কত ওদের ডালে ডালে ঘুরেছি লিচু ফলার ঋতুতে। পেয়ারাগাছ না হয়েও সে আমার পেয়ারের গাছ। বছরের এ সময়টায় গাছটা একটু মাফলেষু হলেও পুরনো পরিচয় বিস্মৃত হবার নয়। চিনতে পারব ঠিক।