আমি বললাম–প্রিসিলা বোস।
তোমার কোনো ভাই-টাই আছে আর?
আছে এক ভাই। টিক্লু তার নাম। টিক্লু মিত্তির।
মিত্তির? তুমি বোস আর সে মিত্তির কেন গো? তোমার তো বিয়ে হয়নি যদুর দেখছি। আমার কপালের ওপর কটাক্ষপাত করে তার বলা।
মাস্তুতো ভাই যে।
ওহো! তাইতো হবে। তোমাদের যে মাস্তুতো ভাই-ই হয়ে থাকে। তাই বটে—তাই হবে তো….তাহলে শোনো, তোমাদের নামটা আমি একটু পালটে দিচ্ছি, বুঝলে? তুমি হলে মিস্ টুটেন বোস, আর সে হলো গে মাস্টার টুটেন মিত্তির। টুটেন বোস আর টুটেন মিত্তির–এখন থেকে, কেমন?
টুটেন বোস আর টুটেন মিত্তির! তার মানে? কথাটার আমি মর্মভেদ করতে পারি নাযদিও কথাটা কেমন যেন মর্মভেদী বলেই আমার বোধ হতে থাকে।
তুমি ধরতে পারছনা মেজমামা? প্রিসিলা বলে—আমি তো বলবমাত্রই বুঝেছিলাম। তুমি অঙ্কে বেজায় কাঁচা মামা।
অঙ্কের সঙ্গে এর সম্পর্ক?
আহা, আমরা তোমার ভাগনে ভাগনি না? তোমার চরিত্রের ভাগ আমরা পেয়েছি তো? আর তোমাকে, মানে, ফোরটোয়েনটিকে দু-ভাগ করলে কী হয়? টু টেন টু টেন হয় না?
কথাটায় তাক লাগলেও অবাক হবার কিছু নেই, সত্যি! আমার গুণপনার ভাগাভাগি করলে তাই দাঁড়ায় বটে, আমি ভেবে দেখি। ফের ওদের দুজনের যোগবলে আমাকেই পাওয়া যায় বার বার।
টুটা ফুটা এই আমাকেই।
পৃথিবী গোল
পৃথিবী যে গোল তার পরিচয় পেলাম সেদিন।
আর গ্লোব-এর মত মানুষের মাথাও যে গোলাকার কিছু কম নয়, তার ভেতরেও গোলের কিছু কমতি নেই তাও আমি টের পেলাম সেই সঙ্গে।
অনেককাল পরে আমার বাল্যবন্ধু তারাপদর এক চিঠি এল হঠাৎ—তাতে লেখা—
জীবন-পরিক্রমার পথে ঘুরতে ঘুরতে তোমার ‘অদ্বিতীয় পুরস্কার’ গল্পগ্রন্থের সঙ্গে ধাক্কা লাগল। তাতে আমাদের ইস্কুলে পড়ার সময়কার সেই ভূত এখার গল্পটা লিখেছ দেখলাম। আমাদের সবার নাম-ধাম দিয়ে লিখেছ। তোমার সঙ্গে আমি-হেন লোকের আবাল্য পবিচয়টা আমার নিজ এবং পাড়াতুতো নাতি-নাতনীরা বিশ্বাসই করে না। তোমার ঐ গল্পটাতে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করায় তোমার ঐ সব ক্ষুদে ভক্তরা আমার সঙ্গে তোমার পরিচয়ের সুযোগে সশরীরে স্কুল শরীরে তোমার দর্শনের ভীষণ অভিলাষী।
জানি না এখনও মুক্ত-আরামে তুমি মুক্তারামে বিরাজ করছ কিনা। তোমার জবাব পেলে আমার এই নাতিবৃহৎ পরিবার নিয়ে তোমার ওখানে গিয়ে হাজির হব একদিন
চিঠির মাথায় ডায়মন্ড হারবার রোডের ওপরেই কাছাকাছি একটা জায়গার ঠিকানা।
চিঠিটা পড়ে আমার মনে হলো, আমি কখন কলকাতায়, কখন পাটনায়, কখন বা ঘাটশিলায় তার যখন কোন ঠিক-ঠিকানা নেই, তখন সপরিবার শ্রীতারাপদকে বিড়ম্বিত না করে বরং তার ঠিকানায় গিয়ে হানা দেওয়াটাই ঠিক হবে।
তাছাড়া, করবরতিরা কজু হয়, কে না জানে! অবশ্যি, চকরবরতিদের ভেতর যাঁরা রাজতুল্য সেই রাজচক্রবর্তীরা কেমন হয়ে থাকেন জানি না, তাঁদের কথা নিশ্চয়ই আলাদা। তাঁদের হৃদয় আর পকেট দুই-ই হয়তো বেশ দরাজ হবে। তবে আমি খোদ আমাকে তো জানি, খোদার ওপর খোদকারি-করা আমার আত্মানং বিদ্ধি হয়ে গেছে, তাই এই বাজারে নিজেকে বেশি করে আর বিদ্ধ করতে চাই না। ভেবে দেখলাম সেই নাতিবৃহৎ পরিবারের আতিথ্য করতে আমায় যতখানি আরাম থেকে বিমুক্ত হতে হবে, তার চেয়ে আগে-ভাগে আমিই যদি তাদের ঠিকানায় যাই তাহলে তাদের ঘরে এবং ঘাড়ে গোটাকতক সন্দেশ বসিয়ে আসতে পারি। তাতেই আমার লাভ বরং, অন্ততঃ কোনই লোকসান নেই।
চলে গেলাম পুতুলদের বাড়ি। বললাম, চ, তোদের গাড়ি করে ডায়মন্ড হারবার থেকে একটু ঘুবে আসবি চল। শহরতলীর শোভা দেখে আসা যাবে।
শহরের বাইরে যাবে তুমি? বল কি গো? পুতুল যেন হতবাক, তুমি না প্রকৃতির ওপর হাড়ে-হাড়ে চটা, প্রাকৃতিক সোন্দর্য একদম নাকি তোমার সথ হয় না? তোমার এমন বিমতি হলো যে হঠাৎ?
প্রকৃতির প্রতি হাড়ে চটা—আমি? কে বললে? সে হলো গে অচলা প্রকৃতি। যে প্রকৃতি নড়ে-চড়ে না, এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে ঠায়, যেমন গাছ-পালা পাহাড় -পর্বত ইত্যাদি পদার্থ জাতীয় এই সব। যাদের রূপ একটুখানি দেখলেই ফুরিয়ে যায়। কিন্তু প্রকৃতির লীলা কি সেইখানেই শেষ নাকি? সচলা প্রকৃতি নেই? তাদের প্রতি তো ভাই আমার অচলা ভক্তি। কবির প্রতিভার ন্যায় মুহূর্তে মুহূর্তে যার রূপের নব নবোন্মেষ সেই সব অপদার্থ প্রকৃতির প্রতি আমার টান তুই কখনো কিছু কম দেখেছিস?
কিন্তু অ্যাতো জায়গা থাকতে হঠাৎ ডায়মন্ড হারবার কেন দাদা? ইতু শুধোয়, কলকাতার আর কোনদিকে কি কোন শহরতলী নেইকো?
আমার এক বাল্যবন্ধুর খবর পেয়েছি। তার বাড়ি যাব। চিঠিখানা দেখালাম তাদের।
বাল্যবন্ধুর কাছে কেউ আবার যায় নাকি কখনো? ইতু দ্বিরুক্তি করে।
সে বন্ধুত্ব তো বাল্যকালেই খতম হয়ে যায়।
তার মানে?
তোমার বাল্যবন্ধুর কাছে যাবার আমাদের উৎসাহ হয় না। সে ব্যক্ত করে, সে তো তোমার বয়সীই হবে প্রায়। তার কাছে গিয়ে আমাদের লাভ?
আরে, যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দ্যাখো তাই, পেলেও পাইতে পার লুকনো রতন। কে বলেছিল একথা? আমি জানতে চাই।
আমি বলিনি।পুতুল বলে। আমি কাউকে এমনধারা কথা বলতে শুনিনি কখনো। ইতু জানায়।
কী করে শুনবি! তোদের কালে তো পাঠ্যবই পাল্টে গেছে। ইস্কুলে কি পদ্যপাঠ পড়ায় আর—জানবি কী করে! আমরা পড়েছি ইস্কুলে। কার ও কি মদনমোহন তকালকার এদের কেউ একজন বলে থাকরেন। বিদ্যাসাগর মশাইও হতে পারেন।