বড়ো হয়েছি? বয়সে বড় কিন্তু কার্যত নয়। তখন খবর কাগজ বেচে দিনগুজরান করতাম এখনও সেই খবর কাগজের দৌলতে বেঁচে রয়েছি—এই মাত্র। তা, তুইও কি সেই খবর কাগজ বেচতেই চাস নাকি?
কথাটা আমার কেমনতরো লাগে যেন। শাস্তরে নরানাং মাতুলক্রম বলে বটে, ভাগনেরা মামার মতই হয়ে থাকে নাকি, কিন্তু ভাগনেরা মামার চরিত্রের ভাগ পেলেও ভাগনিদের ভাগ্যে তেমনতরো দুর্ঘটনা ঘটে বলে আমি শুনিনি কখনো। বরাতের ফেরে এককালে কাগজ ফেরি করতে হয়েছে বটে, সেজন্যে আমি দুঃখিত নই আদপেই, কিন্তু আমার জীবনে সেসব ফের ফিরে আসবে—ভাগ্যের এতখানি ফেরোজি আমি ভাবতেই পারিনে।
তা কেন? খবরের কাগজ বেচতে যাব কেন? সে বলেঃ আমি ভাবছি গোয়েন্দাগিরি করলে কেমন হয়?
গোয়েন্দাগিরি করবি! তুই? বিস্ময়ে থই পাই না।
মানে, অ্যামেচার গোয়েন্দা আর কি! এই তোমার বিমল কুমাব কি ব্যোমকেশের মতই। দুম করে সে যেন আমার সামনে একটা বোমা ফাটায়। সখের গোয়েন্দাগিরিতেও তো পয়সা পাওয়া যায়। যায় না?
অ্যাঁ? তুই করবি গোয়েন্দাগিরি? আমার শক-টাও ব্যক্ত হয়ে পারে না? গোয়েন্দাগিরির জানিস কী তুই?
সবকিছু। বিস্তর পড়াশুনা করেছি এই বিষয়ে।
বলিস কিরে? কোথায় পড়লি? কোথায় শেখানো হয় এই গোয়েন্দাগিরি? আমি বিস্মিত হই : কই, আমি তো এর কিছু শুনিনি—জানিনে।।
কোথাও শেখায় না। বই পড়ে নিজে নিজে শিখতে হয়। আমি লাইব্রেরি থেকে বইটই আনিয়ে ঘরে বসে রপ্ত করলাম তো! পাঁচকড়ি দে-র থেকে শুরু করেছি, তারপর রবার্ট ব্লেক সিরিজ সারা করলাম, তারপরে দীনেন্দ্রকুমার রায় থেকে হেমেন্দ্রকুমার রায়ে চলে এলাম, বিমল কুমারদের সব কীতিকাহিনী পড়ার পর ব্যোমকেশে পড়লাম এসে। শেষটায়। এমন কি, তোমার ওই নীহার গুপ্ত, গৌরাঙ্গপ্রসাদ বসুকেও বাদ দিইনি।
তাহলে তো তুই পাকা গোয়েন্দা হয়ে গেছিস, মানতে হয় আমায়।
তাহলে এইবার আমায় লাগিয়ে দাও একজায়গায়। প্রিসিলা বলেঃ তোমার তো বিস্তর জায়গায় জানাশোনা…
কোথায় যে গোয়েন্দা লাগায় তাই আমি জানিনে, আমি কী লাগাব! আমি বলিঃ বিলেতে বড় বড় স্টোর হাউসে মেয়ে গোয়েন্দা রাখে বলে শুনেছি। সেখানে অনেক মেয়ে খদ্দের সেজে এসে দোকানের মালপত্র সরায়, তাদের ধরার জন্যে তারা গোয়েন্দা রাখে। কিন্তু এখানে তেমনটা রাখে কিনা তা তো আমার জানা নেই ভাই!
এখানকার বড় বড় স্টোরে কি চুরি যায় না জিনিস? গোয়েন্দা লাগায় না তারা?
কী করে বলব। তুই এক কাজ কর বরং, তুই নিজের থেকেই লেগে যা না কেন? কলকাতারনামকরা কোনোবড় স্টোর বেহেনিয়েছদ্মবেশে গিয়ে নিজের থেকেইখদ্দেরদের গতিবিধির ওপর নজর রাখতে থাক। তারপর হাতে নাতে কাউকে ধরতে পারলে বামাল সমেত ম্যানেজারের কাছে নিয়ে ছেড়ে দিবি। তখন নিশ্চয়ই তিনি খুশি হয়ে তোকে মোটা রকম পুরস্কার দেবেন। চাই কি, পুরস্কার স্বরূপ, মাস মাইনেয় গোয়েন্দাগিরির কাজটাও পাকাপাকি পেয়ে যেতে পারিস ওখানেই।
এ কথাটা মন্দ বলোনি তুমি। বলল প্রিসিলা। তোমার মাথায় বেশ আইডিয়া খ্যালে মেজমামা। সত্যি।
বলেই সে বেরিয়ে পড়ল—আইডিয়াটাকে আরো ভালো রকম খেলাবার জন্যেই বোধ করি।
কিন্তু আইডিয়াকে যেমন খেলানো যায় তেমনি আইডিয়ারও নিজের একটা খেলা থাকে—সেও আবার নিজের আইডিয়ামাফিক তার খেলোয়াডকে খেলায় কিনা।
সন্ধ্যেবেলায় প্রায় অদ্ভুত লোচনেই ফিরে এল প্রিসিলা।
প্রিসিলার আইডিয়া ছিল, কলকাতার নামজাদা বড় স্টোরগুলোর কোন একটায় সে খদ্দেরের ছদ্মবেশে প্রবেশ করবে। আমি অবশ্যি বলেছিলাম যে, খদ্দেরকে কোনো ছদ্মবেশ নিতে হয় না, খদ্দেরের বেশে গেলেই হয়।
তা জানি। তাহলেও আমি যে সত্যিকারের খদ্দের, কোনো গোয়েন্দা টোয়েন্দা নই সেটা জানাবার জন্যই কেনা-কাটার প্রয়োজন বোঝাতে বড় একটা ব্যাগ সঙ্গে নিয়েছিলাম। আসলে আমি গিয়েছি তো যত সন্দেহজনক চরিত্রের প্রতি তীক্ষ্ণ লক্ষ্য রাখতেই, তাহলেও তাদের সন্দেহ যেন ঘুণাক্ষরেও আমার ওপরে না পড়ে সেই জন্যেই, বুঝলে কিনা মেজমামা? সব লোকের ওপরেই লক্ষ্য রাখব, তাদের গতিবিধিতে নজর থাকবে আমার, আর যেমনি না তাদের কাউকে কোনো জিনিস অলক্ষ্যে সরাতে দেখেছি অমনি গিয়ে হাতে নাতে পাকড়েছি তাকে—আর তার পরেই তাকে সোজা নিয়ে স্টোরের ম্যানেজারের কাছে গিয়ে হাজির করে দেওয়া—এই তো আমার কাজ? তাই না?…
কলেজে দুটো ক্লাসের পরে বাকী দুই পিরিয়ডের প্রক্সির ব্যবস্থা করে প্রায় দুটো নাগাদ তো ঢুকলাম গিয়ে সেই স্টোরে। প্রথমেই স্টোরের সব কটি বিভাগ পুঙ্খানুপুঙ্খ খুঁটিয়ে দেখলাম। কোথাও ছোটদের পোষাক-আশাক, কোথাও শিশুদের খেলনা-সামগ্রী, কোনোখানে বড়দের শার্ট প্যান্ট ইত্যাদি, কোনখানে স্টেশনারি, কোথাও আবার মেয়েদের প্রসাধনদ্রব্য। বিভাগগুলো সব ঘুরে ঘুরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেই দুঘণ্টা কেটে গেল, কিন্তু সন্দেহজনক চরিত্রের একজনকেও চোখে পড়ল না আমার। সবাই আসছে, জিনিস দেখছে কিনহে, দাম ফেলে দিচ্ছে, ফ্যাশমেমো আর প্যাকেট নিয়ে চলে যাচ্ছে অলক্ষ্যে রাবার মতলব দেখা গেল না কারোই। দুঘণ্টা ধরে এইসব দেখেশুনে আমার উৎসাহ প্রায় নিবে যাবার মতন, এমন সময় একটা আঁদরেল গোহের মহিলাকে দেখতে পেলাম—আমার চেয়েও বড়ো এক ব্যাগ হাতে–সর্বত্র হাতড়ে বেড়াচ্ছেন।
ব্যাগ হাতে মেয়েটিকে দেখবার পরই ই বেশ ব্যগ্র হয়ে উঠলি বোথ হয়? আমি শুধাই।