কুণ্ডলী পাকানো ইঁদুরের পুঁটুলিটা হাতে নিয়ে রাস্তা পেরিয়ে ওধারের পার্কে ছেডে দিয়ে এল উৎস।
ঝাড়নটা নিয়ে ফিরে আসতে দেখল, পার্বতী দেবী তাদের দুজনের জন্যে দুপেয়ালা কফি বানিয়ে বিস্কুটের বাক্স বার করেছে।
কিন্তু ঐ কফির পেয়ালা পর্যন্তই। তার বেশি আর এগুতে পারেনি উৎস।
কতোবার ভেবেছে যে সে শুধোয় বিকেল বেলায় ঘরে বসে বসে করেন কী? চলুন না কোথাও একটু বেড়িয়ে আসি গিয়ে। কিংবা, সামনের পার্কটায় আসুন একটু হাওয়া খাওয়া যাক। সিনেমায় যাওয়ার কথাও তার মনে হয়েছে, কিন্তু কোথায় যেন আটকায়। মেয়েটার মধ্যেই, না, তার নিজের মনেই কোথায় যেন বাধা রয়েছে। কেমন বাধ বাধ ঠেকে।
তার মনে হতে থাকে যে নিজের সুবর্ণ সুযোগটা সে ফসূকে যেতে দিয়েছে। ভাব জমাবার সেই মাহেন্দ্রক্ষণ সে হারিয়েছে কখন যে!
অনেকবার তার মনে হয়েছে সেই ইঁদুরটা ফিরে এসে যদি তার ভ্রষ্ট লগ্ন আবার তাকে ফিরিয়ে দেয়? দ্বিতীয়বার কফিপানের অবকাশে কফির পেয়ালায় তুফান তুলবার সুযোগ কি আর হবে তার? ভাবতে ভাবতে কত রাত সে ঘুমিয়ে পড়েছে।
অবশেষে এক সুপ্রভাতে ঘুম থেকে উঠতেই তার মাথায় একটা আইডিয়া খেলল।
সটান সে চলে গেল নিউ মার্কেটে। পোয্য পশুপক্ষীর এলাকাটায়।
একটা ইঁদুর চাই আমার। পঙ্কশ্ব এক বুড়ো দোকানীর কাছে গিয়ে বলল।
একটা ইঁদুর? নিশ্চয়। এই যে, দেখুন না, কী চমৎকার ইঁদুর সব। দেখছেন?
খাঁচা তর্তি সুশ্রী সাদা রোমশ যত ইঁদুর—দেখলে চোখ জুড়োয়, সত্যি! মনে হয় যেন খরগোসের বাচ্চারা।
না, না। এ ইঁদুর নয়। এরা তো বিলিতি ইঁদুর। আমি চাচ্ছি আমাদের দেশী বাঙালী ইদর। আমাদের ঘরে বাইরে যাদের দেখতে পাই—সেই রকম ঘরোয়া জিনিস।
আজ্ঞে, সে আমাদের কাছে আপনি পাবেন না। রাখিনে আমরা। অবজ্ঞায় নাক কুঁচকে বলল দোকানদারঃ কেউ আবার চায় নাকি সে ইঁদুর! বাড়িতে দেখতে পেলে মেরে তাড়ায়।
তাই একটা আমার চাই যে। জানাল উৎস: ভয়ঙ্কর দরকার ছিল। যা দাম লাগে দেব।
দিয়ে যান দাম। চেষ্টা করে দেখব। আশপাশের বাড়ির বাচ্চা চাকরদের বলে-কয়ে যদি যোগাড় করতে পারি একটা।
উৎস তক্ষুনি তার হাতে দশ টাকার একখানা নোট ধরে দিল।
আপনার ঠিকানাটা দিয়ে যান বাবু! বলল দোকানীটা : আপনার বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসব ইঁদুর।
দিন কয়েক বাদেই পেছিল এসে ইঁদুরটা।
তারপর পার্বতীর কক্ষে ইঁদুরটার অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় মুহূর্ত গুনতে লাগল উৎস—নিজের বিছানায় শুয়ে শুয়ে কান খাড়া করে।
যখন তার বাথরুমে যাবার আওয়াজ এল তার কানে, স্নানের ঘরে কল খোলার শব্দ পেল সে–আস্তে আস্তে উপরে গিয়ে, ঘরের দরজা একটুখানি ফাঁক করে, ইঁদুরটাকে ঢুকিয়ে দিয়েই, দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে চুপ চাপ ফিরে চলে এল উৎস নীচে। নিজের ঘরে বসে পার্বতীর চিৎকারের প্রতীক্ষায় রইল নিঃশব্দে।
একটু পরেই, সেই আগের দিনটির মতই, ধুপধাপ পায়ের আওয়াজ তীরবেগে নেমে এল তার দরজায়। দুয়ার ঠেলে তার ঘরে সদ্যমাতা পার্বতীর আবির্ভাব হল।
উৎস বাবু! আসুন আসুন! চট করে একবারটি আসুন ওপরে। রুদ্ধশ্বাসে বলল সে-আমার ঘরে আবার একটা ইঁদুর! সেই ইঁদুরটাই ফিরে এল কিনা কে জানে!
তাই নাকি? কী সর্বনাশ! উৎসমুখ উন্মুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উৎসর পা-ও চঞ্চল হয়ে উঠল।
উঠল গিয়ে একেবারে পার্বতীর ঘরে।
কোথায় সে হতভাগা? দেখিয়ে দিন তো।
ঐ যে—ঐ টিপয়ের তলায়।
দেখেই চিনতে পাবল উৎস। তারই সদ্য আমদানি-কৃত নেংটি!
পূর্ব পরিচযের জনাই কিনা কে জানে, ইঁদুরটা উৎসকে দেখে ভয়ে যেন শিটিযে গেল। সহজেই ধরা দিল তার হাতে।
বিজয়গর্বে তাকে করকবলিত করে যেই না উৎস উঠে দাঁড়িয়েছে, অমনি অপর কোণ থেকে আরেকটা ধেড়ে ইঁদুর তেড়ে এল টিপয়ের দিকটায়।
ও বাবা! এ আবার কে! আরেকটা ইঁদুর দেখছি যে! লাফিয়ে উঠেছে উৎস। পার্বতীও তৎক্ষণাৎ নিজের বিছানায় গিয়ে উঠেছে—কী হবে উৎস বাবু! এটা যে আরো সর্বনেশে চেহারার।
একটা কেঁদো ইঁদুর! উৎস বলল, গেরস্থ বাড়ি সচরাচর তো দেখা যায় না এমনটা। সরকারী গুদামের চালমারা ইঁদুর মনে হচ্ছে—খেয়ে দেয়ে বেশ নাদুস নুদুস হয়েছে।
কেঁদো ইঁদুরটাকে ধরতে রীতিমত বেগ পেতে হলো উৎসকে। তারপর কেঁদো আর কঁদো কাঁদো দুটোকেই পাকড়ে ঝাড়ন জড়িয়ে ছেড়ে দিয়ে এলো সেই পার্কটায়।
ঝাড়নটা ফিরিয়ে দিতে এসে আবার দেখল টিপয়ের ওপরে কফির পেয়ালা সাজানো—সেই আগের বারের মতই।
এবারকার সুযোগ সে আর হাতছাড়া করল না।
কফি পানের ফাঁকে ফাঁকে পাড়ল কথাটা—আপনার ঘরে যেমন ইঁদুরের উপদ্রব, তাতে দেখছি, ইঁদুর তাড়াবার জন্যই একটা লোক না রাখতে হয় আপনাকে।
ভাবছি তাই। কিছু না ভেবেই জবাব দিয়েছে পার্বতী!
যদি রাখেনই কোনো লোক, বলল উৎস, তাহলে আমার আবেদনটা করে রাখছি সবার আগে এই ফাঁকে। আমাকেই রাখতে পারেন।
পার্বতী এর কোন উত্তর দিল না, তারা সারামুখ সিঁদুরের মত টকটকে হয়ে নিজের নিরুক্তিটি জানাল।
তারপরে ইঁদুর-লগ্ন থেকে গোধূলির সিঁদুর-লগ্নে পৌঁছতে আর বিশেষ দেরি হলো উৎসর।
সেদিন উৎস এসে আমন্ত্রণ জানাল আমায়-আমাদের বিয়ের উৎসবে আসবেন দাদা! রীতিমতন প্রেম করে বিয়ে, বুঝলেন? বলে সে পুনশ্চ যোগ করে–তা প্রেম করেই বলুন বা ইঁদুর ধরে বিয়ে করাই বলুন!
প্রেম করা তো ইঁদুর ধরার মতই দুঃসাধ্য ব্যাপার ভাই! আমি বলি : শুনি তো ব্যাপারটা।
তারপর থেকে যা উৎসারিত হলো সেই কাহিনীটাই উদ্ধৃত করেছি এখানে। কিন্তু আসল কথাটাই আপনাকে বলা হয়নি দাদা! তার উৎসার শেষ হবার পর সারাংশ সে নিবেদন করে : আজ সকালে যখন আপনাকে নেমন্তন্ন করতে বেরুচ্চি, দেখি যে নিউ মার্কেটের সেই লোকটা ঘুর ঘুর করছে আমাদের বাড়ির সামনে—যার কাছ থেকে ইঁদুরটা আমি কিনেছিলাম।