কী বললেন যোগেনবাবু? শুধালেন শ্রীভট্টশালী।
আসল কথা ফাঁস করলেন না কিছু। জানাল সোমনাথ : তবে আমাদের জ্ঞান দিলেন বটে বহুত।
উনি ঐ রকমই। মচকান তো ভাঙেন না। সহাস্যে বললেন ভট্টশালী: কারো কাহে ভাঙেন না কিছু কখননা। ওঁর রহস্য উনিই জানেন কেবল।
কিন্তু জীবনরহস্যের আসল কথাটা তো… সোমনাথ বলতে যায়।
আসল কথা আপনারা আমার কাছে শুনুন। বাধা দিয়ে তিনি বললেন—দীর্ঘজীবন যদি পেতে চান তো আমার পথ ধরুন। সংযত জীবনযাপন করুন, নেশা-ভাও করবেন না, বিড়ি-সিগ্রেট খাবেন না, মদ ছোঁবেন না কখনো…
এমন সময় সদর রাস্তার দারুণ একটা সোরগোল তাঁর কথার মাঝখানে এসে বাধা দিল।
ঐ যে ভট্টশালা! ভট্টশালা! ভট্টশালা কিঞ্জয়।
নিজের জয়ধ্বনি শুনেই কি না কে জানে, উনি মুখ বিকৃত করে সদুপদেশ বিতরণে ক্ষান্ত হলেন।
ব্যাপার কী? জানতে চাইলাম আমরা।
ও কিছু না। আমার বাবা আসছেন।
অ্যাঁ? আপনার বাবা? অবাক হয়ে যাই আমরা : উনি বেঁচে আছেন এখনো?
আছেন বলে আছেন! রীতিমতন সজীব। ওঁর জ্বালায় আমরা তো বটেই, পাড়াপড়শী—ভাটপাড়ার ইতরভদ্র সবাই অস্থির। বলে তিনি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন—আরো কতোকাল জ্বালাবেন কে জানে!
ওঁব নামটি কি আমরা জানতে পারি?
শ্রীশ্রীভট্টশালী। আমার শ্রী একটা, ওঁর দুটো শ্রী—উনি নিজেই এটা নিয়েছেন। কিন্তু মশাই, শ্রীশ্রী না বলে ওঁকে বিশ্রী বলাই উচিত বরং। পাড়ার ছোঁড়ারা ওঁকে ভট্টশালা বলে খ্যাপায়। এককালের ভারতবিশ্রুত মহামহোপাধ্যায় জীবন ন্যায়রত্নমশায়ের এই দশা—তার ছেলে হয়ে নিজের চোখে আমায় দেখে যেতে হলো…
তাঁর খেদোক্তি শুনতে হয় আমাদের…পিতৃনিন্দা মহাপাপ জানি, কিন্তু ওঁর যা আচাব ব্যবহার…আমরা মুখ দেখাতে পারি না লোকসমাজে। বলা উচিত নয়, কিন্তু হেন নেশা নেই যা ওঁর নেইকো। বিড়ি সিগ্রেট তো মুখে লেগেই আছে। তা ছাড়া গাঁজা আফিং চরস গুলি ভাঙ কিছু বাদ যায় না। কোকেন পেলেও খেতে ছাড়বেন না উনি…
তাহলে তো ওঁর জীবনটাই নিতে হয় সব আগে। সোমনাথকে আমি উসকালাম : জীবন সম্বন্ধে জীবনবাবুর বক্তব্যটাই জানা দরকার আমাদের।
বাইরের সেই হলাটা ক্রমেই আরো বেড়ে চলল।
সারা পাড়া জ্বালাতে জ্বালাতে ফিরছেন এখন উনি সেই ভাটিখানার থেকে…
টলতে টলতে ঘরের ভেতরে এসে ব্যক্ত হলেন একদা ভারত-বিক্ষত শ্রীশ্রীভট্টশালী মশায়। আমাদের কোনো প্রশ্ন তোলার সুযোগ না দিয়েই নিজের বক্তব্য-প্রকাশে আপনার থেকেই তিনি সোচ্চার হয়ে উঠলেন—
সভাপতিমশায়, সমবেত জনমণ্ডলী ও বন্ধুগণ! আমি প্রতিবাদ করছি…ঘোরতর প্রতিবাদ করছি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আপনারা শুনুন সবাই। আমার প্রতি কী দারুণ অন্যায় আচরণ করা হয়েছে কান পেতে আপনারা শুনুন একবার।
আমরা তটস্থ হয়ে দাঁড়ালাম উৎকীর্ণ হয়ে….
হ্যাঁ, আমি…আমি এহেন অসদাচরণের প্রতিবাদ করি। আপনারা বলবেন আমি কেন প্রতিবাদ করছি। কিন্তু প্রতিবাদ ছাড়া আমি আর কী করতে পারি? আমি বলব যে প্রতিবাদ ছাড়া আমি আর কিছুই করতে পারি না। সেই কারণেই আমি প্রতিবাদ করছি। শুনুন তাহলে আপনারা…আমার প্রতিবাদটা শুনে রাখুন সবাই…আমি ভাটিখানার মালিকের কাছে একের এক চেয়েছি, বলেছি তুমি আমায় একের এক দাও। সে আমাকে একের এক দিয়েছে…আমি একের এক খেয়েছি কিন্তু…কিন্তু…কিন্তু…।
বলতে বলতে এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় তাঁর সারা মুখ যেন কেমনধারা হয়ে যায়-–
কিন্তু ও আমাকে সত্যি সত্যি একের এক দেয়নি, আমি একের এক খাইনি, বলুন আপনারা, আমি একের এক খেয়েছি কি? আপনারাই বলুন একবার?…।
তিনি জিজ্ঞাসু নেত্রে আমাদের দিকে তাকান। ন্যাযরত্ন মশায়ের ন্যাযেব কূটতর্কে সবাই আমরা বিড়ম্বিত বোধ করি।
না, খাইনি। প্রকৃতপক্ষে আমি একেব এক খাইনি। প্রমাণ চান তাব? একেব এক যে কী বস্তু নিশ্চয় তা আপনাদেব অজানা নয়…
আমার জানা ছিল না। একের এক-টা কী হে? সোমনাথকে আমি শুধালাম। এমন কী চীজ?
একশা নম্বর ওয়ান-এর এক বোতল। সোমনাথ জানাল—মা, নদেব পরিভাষায় ঐ একের এক।
একশা নম্বর ওয়ান? তাহলে তো উনি বমি করে এখনি সব একশা কববেন। বলে আমি আঁতকে উঠে ওঁর সামনে থেকে সরে দাঁড়াই।
তার প্রমাণস্বরূপ আমি বলি… বলতে থাকেন ন্যায়রত্ন–সত্যি সত্যি একের এক খেলে আমি এরকম দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করতে পারতাম না। আপনারা বলবেন প্রতিবাদ না করে তাহলে আমি কী করতাম? আমি বলব একের এক খেলে আমি এইরকম কবে মাটিতে পড়ে যেতাম সটান…
বলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ধড়াস করে পড়ে গেলেন মেজেয়। আর উঠলেন না। তারপর আর কোনো উচ্চবাচ্য নেই তব।
সোমনাথ ডাক্তার তাড়াতাড়ি গিয়ে তার নাড়ি টিপে দেশে স্টেথিসকোপ বসিয়ে বুক পরীক্ষায় লাগলো।
বাধা দিলেন শ্রীভট্টশালা আপাতত হবে না ওকে। কিছু হয়নি ওর। মদ খেয়ে বেহুশ হয়ে পড়েছেন মাত্র। দিনে দশবার উনি অমন পড়ছেন, উঠছেন, আবার ছুটছেন ওই ভাটিখানার দিকে। একের এক না হলে তাঁর একদণ্ড চলে না।
একবাক্যে উভয় ভট্টশালীকে নমস্কার জানিয়ে আমরা ভট্টশালার থেকে বের হলাম।
সোমনাথ চুপ। আমিও। ওর চোখে নির্বাক জিজ্ঞাসা—??? (জীবনের একি রহস্য?)
আমার চোখে তার অবাক জবাব!!! (জীবন-রহস্যই বুঝি এই ভাই!)
কিন্তু একের এক কি সে পেয়েছিল? জীবনরহস্যের সব কিছু ছাপিয়ে জীবনন্যায়রত্নের সেই প্রশ্নটাই যন কানে বাজতে থাকে আমাদের।
জীবনজিজ্ঞাসার সেই প্রশ্নমীমাংসা কোথায়? হায়রে, তা কি কখনো পাওয়া যায়। সেই একের একটিকে। সেই মাতাল করা তাকে? মিতা-কে।
ঢং থাকলেই দমকল হয় না
আগুনটা লাগতেই গোবর্ধন ক্যাশবাক্সটা হাতিয়ে আর হর্ষবর্ধন ভাইকে বগলদাবাই করে বেরিয়ে এসেছেন কারখানাব থেকে।