কিছু না বুঝেও আমি ঘাড় নাড়ি—কেন এমনটা হয় মশাই?
নিছক মায়া বাড়াতে গিয়েই। আবার কী?
তিনি কিন্তু আপনার যোগবলের কথাও বলছিলেন। সোমনাথ বলল।
যোগবলের চেয়ে বড় হচ্ছে বিয়োগবল। যোগ হচ্ছে বিধাতার। মানুষের নয়। কেন না যোগানদার তিনিই। আমাদের সব কিছুই বিয়োগান্তক। ভগবতী দশ হাতে আমাদের যুগিয়ে যাবেন, আর আমরা দশ দিকে ত বিলিয়ে যাব। যাবার রাস্তা পরিষ্কার না এলে আসার পথ বন্ধ। উত্তরে বাতাস ঘরে ঢুকতেই পারবে না যদি না আমরা দক্ষিণের জানালাটা খুলে রাখিবাইরে যত ঝড়ই বয়ে যাক না কেন। তার কৃপায় উত্তরণ তখনই সম্ভব যখন দক্ষিণার দ্বার মুক্ত থাকবে আমাদের। ধন, ঐশ্বর্য, অর্থসামর্থ্য, স্নেহ ভালবাসা যাই বলুন—সবই আমাদের অপরকে দিয়ে দিয়ে পেতে হবে না দিয়ে পাওয়ার কোনো উপায় নেইপেয়েছি কি না সত্যিই, দিলে পরে তবেই তো সেটা টের পাই। পুঁজি করে রাখলে সেটা পুঁজ হয়ে থাকে—তার থেকেই যতো আধিব্যাধি—কি দেহের—কি সমাজের—কি রাষ্ট্রের…তামাম দুনিয়ার।
কিন্তু তার সঙ্গে বয়স না বাড়বার সম্বন্ধটা কী? সোমনাথ শুধায়।
বয়স বাড়ে ঠিকই, কিন্তু তার কোনো দাগ পড়ে না কেবল। বহতা নদী যেমন, তার কি কোনো বয়স আছে? পর্বতশীর্ষে তার জলযোগ আর ঘাটে ঘাটে জল বিলিয়ে সমুদ্রগর্তে গিয়ে সেই জলবিয়োগ—যেমন পাওয়া তেমনি তার দেওয়া—এই জন্যেই সে ফুরোয় না কখননা, অফুরন্ত, কানায় কানায় ভরা সব সময়—সময়ের কি কোনো ছাপ আছে তার গায়?
কিন্তু ঐ মায়া বাড়ানোর কথাটা বললেন যে… আমি ওঁকে মনে করিয়ে দিই তখন। শূন্যবিন্দুর থেকে যে-বৃত্তই টানি—যে বৃত্তিতেই যাই না, সবই তো শূন্যাকার। শূন্যর থেকে শূন্যেরই সৃষ্টি হয় বৃত্তাকার ধারণ করলেও তা শূন্যবিন্দুরই সমষ্টি মাত্র। সবই শূন্যকার, মায়া। ফাঁকি ফক্কিকার। উপনিষদের সেই বিখ্যাত বচনটা বদলে নিয়ে হয়ত বলা যায়—শূন্যমদঃ শূন্যমিদং শূন্যাৎ শূন্যমদুচ্যতে। শূন্যস্য শূন্যমাদায় শূন্যমেবাবশিষ্যতে।
কিন্তু ঐ বৃত্তাকার? সোমনাথ তর্কে প্রবৃত্ত।
সবই হচ্ছে আমাদের দানবৃত্ত—আত্মদানের প্রবৃত্তি। শূন্য তো আসলে পূর্ণ-ই, অলরাউন্ডার, সম্পূর্ণ। শূন্যের আত্মপ্রসার থেকেই তো বৃত্ত। তাই নিছক মায়া হলেও, যে কোনো বৃত্তিই, তা আমাদের কলাবৃত্তিই হোক যৌন প্রবৃত্তিই হোক, দেহদানই কি আর স্নেহদানই কি, সবই আমাদের নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া ছাড়া তো কিছু নয়। যেতে যেতে দেওয়া, দিতে দিতে যাওয়া—পেয়ে পেয়ে দেওয়া আর দিয়ে দিয়ে পাওয়া—সব বৃত্তের সব বৃত্তিই সেই এক বৃত্তান্ত।
দেওয়ার কথাটা যা বলেছেন সায় দেয় সোমনাথ ডাক্তার : না দিলে তো ব্রিবনে কিছুই মেলে না মশাই। না হৃদয়, না ভিজিট।
আসলে মেলা মানেই তো দেওয়া নেওয়া, আদানপ্রদান। মেলাই কথার ওপর আমার এক কথা।।
আর এ সমস্তই আমাদের মায়া বাড়ানো মাত্র। যোগেনবাবু যোগ দেন : মায়া তো ব্রহ্মের সম্প্রসারণ ছাড়া কিছু নয়; ব্রহ্মের নানারূপে নানন বৃত্তিলাভ। ব্রহ্মের আত্মদান। আপনাকে দেওয়া। আর সেই আত্মদানে তাঁর আত্মচরিতার্থত। তাঁর এই দানযোগে যদি আমরা ঠিক ঠিক যোগদান করতে পারি তাহলে এর সব কিছুই শূন্যমাত্ৰ হলেও, শেষ ফল সেই শূন্য হলেও, সেই শূন্যতার মধ্যেই আমরা পূর্ণতার স্বাদ পাব। দেশকালপাত্রের সীমানা উপচে সেই পরিতৃপ্তি। বলে তিনি নিঃশ্বাস ফ্যালেন : আর ভেবে দেখুন, ভূয়ো হলেও সেই স্বাদটুকুই তো আমার–জীবনের সহস্র যন্ত্রণা, হাজার বিষাদের মধ্যেও।
তত্ত্বকথার এই সব গোঁজামিলের গর্তে আর মাথা না গুজে সোমনাথ তার ডাক্তারি সত্তায় ফিরে আসে এবার। –আচ্ছা, এই দীর্ঘজীবনে কি কোনো অসুখবিসুখ করেনি আপনার? জিজ্ঞেস করে বসে হঠাৎ।
করেনি আবার? শরীরম ব্যাধিমন্দিরম। কোন অসুখটা করেনি। যে অসুখ একবার এসেছে সে আর যায়নি, যেতে চায়নি, খুঁটি গেড়ে বসেছে এই দেহে। কোন অসুখটা নেই বলুন আমার? বাত আছে, হাঁপানি আছে, ডায়াবিটিসও চাগাড় দেয় মাঝে মাঝে, উচ্চরক্তের চাপ তো রয়েইছে—আর এর কোনোটাই ভূয়ো নয়। ভূয়োদশী ব্যক্ত করেন : তবে হ্যাঁ, রক্তচাপ থাকলেও, বক্তের সেই চাপল্যটা ততটা নেই আর।
অ্যাতো অসুখ আছে আপনার? আমি হতবাক হই। কিন্তু কই, দেখে তো তা মনে হয় না মোটেই।
অসুখও যেমন আছে তেমনি তার ওষুধও রয়েছে যে! সবই আছে তবে প্রশমিত হয়ে আছে।
কী করে দমিয়ে রেখেছেন এত সব অসুখ? আমার প্রশ্ন।
ওষুধ খেয়ে—আবার কী করে? অসুখের আঁচ পেতেই ওষুধ খাই, শরীরকে বেশি তোগাই না। সুখভোগে অরুচি না থাকলেও অসুখভোগে আমার নিতান্ত অনীহা। আমার দেহে অসুখ আর ওষুধের সহাবস্থান– বলে তিনি সোমনাথের দিকে কটাক্ষ করেন—আপনারা ডাক্তাররা অসুখ হলে তার পরে ওষুধ দিয়ে তা সারান, আর আমি, অসুখের সম্ভাবনা দেখলেই ওষুধ খেয়ে তাকে সরিয়ে রাখি। আমার ঐ দেরাজটার দিকে চেয়ে দেখুন না একবার! এফিড্রিন, অ্যাড্রিনালিন, প্যাথিডিন, ইসিড্রেকস উইথ অ্যাডেলফিন, ইনসুলিন, আর যতো রাজ্যের ভিটামিন–এ বি সি ডি থেকে ঈ পর্যন্ত কী নেই?
সোমনাথ সেদিকে তাকাল না। মার কাছে মামার বাড়ির গল্পের মত ডাক্তারের কাছে ওষুধের তত্ত্ব ব্যাখ্যানা তার ভালো লাগল না বোধহয়। আচ্ছা, এবার আমরা আসি তাহলে। বলে সে উঠে পড়ল। নমস্কার ঠুকে বিদায় নিলাম আমরা।
ফিরে এলাম ফের সেই ভট্টশালীর সমীপে।