ভাটপাড়ায় পা দিয়েই একজনের কাছে শ্রীভট্টশালীর বাড়ির ঠিকানাটা শুধালাম।
অ্যাঁ? ভট্টশালার বাড়ি খুঁজছেন নাকি আপনারা? লোকটা যেন খেঁকিয়ে উঠল কেমন।
ভট্টশালা। তার মানে। আমরা তো হতবাক।
এক নম্বরের বদলোক মশাই। আমারা ওকে ভট্টশালাই বলি। শ্রীশ্রী ভট্টশালা।
এমন কথা বলছেন কেন? সোমনাথ একটু মৃদু প্রতিবাদ জানায় : এত দীর্ঘদিন ধরে বেঁচে রয়েছেন—উনি তো আপনাদের ভট্টপল্লীর গৌরব মশাই।
গৌরব! গৌরবই বটে লোকটার মুখভঙ্গি দেখবার মতই খেয়ে না খেয়ে অ্যান্দিন ধরে খালি বেঁচেই রয়েছেন, এ ছাড়া আর কী করেছেন উনি? শুনি তত একবার?
কিছুই করেননি? ভদ্রলোকের কথায় আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কী কী করা উচিত ছিল উক্ত ভট্টশালীর মনে মনে তাই খতাই। সুদীর্ঘকাল ধরে কেবল বেঁচে থাকাটা কি কোন কথাই নয়?
দীর্ঘজীবনবাবুর কথা আর বলবেন না। এই কথা বলে বিষবৎ আমাদের পবিত্যাগ করে চলে যায় লোকটা।
ঘুরতে ঘুরতে শেষ পর্যন্ত আমরা ভট্টশালী মশায়ের আটচালায় গিয়ে পৌঁছলাম।
চতুম্পাঠীতেই বসেছিলেন ভট্টশালী। নমস্কার করেই কথাটা পাড়া গেল-কলকাতাব থেকে আসছি আমরা। আজকের কাগজে খবরটা পডেই ছুটে এলাম, আপনার দীর্ঘজীবনলাভের কারণগুলো আমরা জানতে চাই যদি দয়া করে আমাদের জানান…
আমি একজন ডাক্তার। ইনি লেখক।
আজ্ঞে হ্যাঁ। দীর্ঘজীবনলাভের যদি কোনো শর্টকাট থাকে… সঙ্গে সঙ্গে আমারও অনুযোগ।
আসুন আসুন। বসুন আপনারা। আমাদের অভ্যর্থনা করে বললেন ভট্টশালী। —দেখুন, দীর্ঘজীবনের রহস্য কিছু নেই। দীর্ঘজীবনলাভের সোজা পথ হচ্ছে সহজ পথ। জীবনের আঁকা বাঁকা চোরা গলিতে না যাওয়া-ভুল পথগুলো এড়িয়ে চলা। সর্বদা সোজা পথে চলবেন—সেইটেই হচ্ছে সহজ পথ। সহজভাবে জীবন-যাপন কবলেই দীর্ঘায়ু হওয়া যায়। মিতাহার, মিতাচার, আহার-বিহারে সংযম, নিদ্বিয় নিশ্চিন্ত জীবন—এইগুলিই দীর্ঘায়ুলাভের সহায়ক। সংযত জীবন-যাপন কবলে যে পরমায়ু বাডে সেকথা আর না জানে কে?
আজ্ঞে, আমিও সেই কথাই বলছিলাম আমার বন্ধুকে, এই মিতাচারের কথাই। এখন আপনিও আবার সেই কথাই বলছেন। দ্বিরুক্তি করল সোমনাথ।
দেখুন আমি আজীবন নিরামিষাশী, জীবনে মদ্যমাংস স্পর্শ করিনি, কোনো নেশাভা নেই আমার, কিছুর জন্যেই কৈানো উদ্বেগ দুশ্চিন্তা নেইকো, মনে হয় এই সবই হয়ত আমার দীর্ঘজীবনলাভের হেতু হবে। বলে তিনি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন : তবে আমার এ আর কী দীর্ঘজীবন। আমার চেয়েও দীর্ঘতরজীবী ব্যক্তি এই অঞ্চলেই রয়েছেন। এই ভট্টপল্লীতেই।
বলেন কী! কই তাঁর খবর তো…
পাবেন কী করে, তিনি কখনো নিজের পরমায়ু কারো কাছে প্রকাশ করেন না। কিন্তু আমি তো জানি। এইটুকুন বয়স থেকে দেখে আসছি তাঁকে।
তার বয়স কত এখন? আমি জানতে চাই।
তিনি তো বলেন চুরাশী। ভট্টশালী বললেন, কিন্তু তাঁর এই চুরাশীই আমি চুরাশী বছর ধরে শুনে আসছি। আমার আট বছর বয়সে যেমনটি তাঁকে দেখেছিলাম, এখন এই একশো আটের পৈঠা পেবিয়েও ঠিক তেমনটিই দেখছি তাঁকে। কোনো বৈলক্ষণ্য নেই। কিছুমাত্র না। ডবোল আশী পার করে দিয়েও তিনি…
বলেন কী! শুনেই আমি আঁতকে উঠি : ডবোল আশীর চুড়ায় চুর হয়ে বসে আছেন—তার চিরকালের চুরাশীতে? আশীআশীকরেও আসেননি এতদিনেও! আর্ম! দীর্ঘজীবনের চূড়ান্ত যদি বলতে হয় তো বোধকরি এইটেই তার পরাকাষ্ঠা।।
শুধু তার চুলগুলো পেকেছে কেবল। বলে ভট্টশালী নিজের বক্তব্য সম্পূর্ণ করলেন।
এক চুলের তফাত মাত্র! আমার টিপপনি কাটলাম।
নামটি কী তাঁর? সোমনাথ শুধায়।
কেউ তাঁর নাম জানে না। কাউকে বলেনও না তিনি। তবে আমরা সবাই তাকে যোগেন্দ্রজী বলে থাকি। ঐ নামেই ডাকি আড়ালে। যোগবলেই তার এহেন দীর্ঘজীবন—আমাদের এই ধারণা।
হিন্দুস্থানী সাধক-ফাধক বুঝি?
না না, সাধক-ফাধক নয়। হিন্দুস্থানীও না। সাধারণ বাঙালী ভদ্রলোক। তবে ওঁর দীর্ঘজীবনের কোন কিনারা করতে না পেরে, হয়ত তান্ত্রিক ক্রিয়া-টিয়া যোগ-টোগ কিছু করে থাকেন, এই ধারণায় সবাই ওঁর ওই নাম দিয়েছে। এই আর কি! বলেন শ্রীভট্টশালী : তাহলেও তার কাছে যান না একবার। হয়ত এখানে আসাটা আপনাদের সার্থক হতে পারে তাহলে। যে গুহ্য রহস্যের সন্ধানী আপনার তাঁর চাবিকাঠি হয়ত তার কাছেই রয়েছে।
গেলাম তাঁর কাছে।
যোগেনবাবুকে দেখে কিন্তু চুরাশী দূরে থাক, চৌষট্টির বেশি বলে মনে হয় না কিছুতেই। নাদুস-নুদুস দেহ-স্বাস্থ্যখানা রেখেছেন মন্দ না। পঁয়ষট্টি দেবার এখনো কোনো লক্ষণ নেই, তার বেশ দেরি আছে বলেই মনে হয়।
এখানকার একজন বলছিলেন— কথায় কথায় ভট্টশালীর কথাটা পাড়া গেল——যে আপনি নাকি চুরাশীবছর ধরে চুরাশীতেই রয়ে গেছেন, দেখতেও রয়েছেন সেই একরকমটিই প্রায়, বয়স নাকি আপনার বাড়ছে না আদপেই।
শুনে তিনি হো হো করে হাসলেন। বললেন—দেখুন, অস্তিত্বের একটা স্থিরবিন্দু আছে—তাকে ঈশ্বরই বলুন আর অজ্ঞেয়ই বলুন—তার সঙ্গে কোনরকমে যুক্ত হতে পারলে—সময় তখন আপনার থেকেই স্তব্ধ হয়ে যায়। অস্তিত্বের সেই বিন্দুমাত্রায় বিন্দুমাত্রই অবস্থিতি থাকে কেবল। দেশকালাতীত ত্রিশূন্যে কি বয়স বাড়ে? আপনাদের বিজ্ঞানও কি এই কথায় সায় দেয় না? কিন্তু আমরা তো আর তা পারি না, সেই কেন্দ্রবিন্দুর থেকে প্রকৃতির বশীভূত হয়ে প্রবৃত্তির বশে ক্রমাগত বৃত্ত টেনে টেনে বৃত্তান্তরে গিয়ে পড়ি—তখন তার অনিবার্য পরিণামে নানান পরিণতি এসে দাঁড়ায় স্বভাবতই। সেই বৃত্ত-বৃত্তান্তই আমাদের এই ধারাবাহিক জীবদ্দশা।