কানে আঙুল দিয়ে? তিনি অবাক হন? সে আবার কী রকম দেখানো?
হ্যাঁ, ঐ ঘচাং ঘচ্! ঐটা করতে পারেন বটে। ঐ ঘচাং ঘচ্।
ঘচাং ঘচ্?
হ্যাঁ। আপনারা চারজন আছেন বললেন না? কর্তা, গিন্নী, দেওর আর বাড়ির চাকর, চারজন তো রয়েছেন। বাড়ির দেউড়িতে থাকবে তো গাড়ি, গাড়ির চার দরজায় আপনারা চারজনা দাঁড়াবেন। তারপর ঐ ঘচাং ঘচ্।
ঘচাং ঘচটা কী মশাই? বারংবার শুনে বিরক্ত হন হর্ষবর্ধন।
আপনারা চারজনায় মিলে গাড়ির চারটে দরজা কেবল খুলুন আর লাগান—ঘন্টায় ঘণ্টায়—ঘণ্টার পর ঘণ্টা! ঘচাং ঘচঘচাং ঘচ…ঘচাং ঘচ…চলতে থাকুক পরম্পয। রীতিমতন কানে আঙুল দিয়ে টের পেতে হবে পড়শীদের…যে হ্যাঁ, গাড়ি একখানা আছে বটে পাড়ায়। চালান সারাদিন ঐ ঘচাং ঘচ।
কিন্তু নাহক ঘচাং ঘচ করাটা কি ভালো?
তাহলে ঘচাং ঘচের ফাঁকে ফাঁকে প্যাঁ পোঁ চালাবেন। তাও করতে পারেন ইচ্ছে করলে–সেও মন্দ নয় কিছু।
প্যাঁ পোঁ? একটু যেন ভড়কেই যান তিনি।
হ্যাঁ। ঐ প্যাঁ পোঁ, গাড়ির সবকিছু বাজে হলেও ওর হর্নটা কিন্তু নিখুঁত। সেটাও বেশ বাজে। মাঝে মাঝে তাই বাজান। চলুক ঐ পা পোঁ আর ঘচাং ঘচ্।
দূর মশাই ঘচাং ঘচ। আমি এক্ষুনি চললাম অর্ডার ক্যানসেল করতে—অমন ঘচাং ঘচে গাড়ি চাই নে আমার।
চুল না হেঁটেই তীর বেগে বেরিয়ে পড়লেন হর্ষবর্ধন। বাড়ি ফিরলেন গাড়ি খারিজ করে দিয়ে তারপর।
না গিন্নী! ঘচাং ঘচ করা পোষাল না আমার পক্ষে!
বলে বাড়ি ফিরে গিন্নীর কাছে পাড়তে গেছেন গাড়ির কথাটা, তিনি তো বাড়ি মাথায় করে তুললেন। কতর বোকামির বহর মাপতে না পেরে কিছু আর বাকী রাখলেন না তাঁর।
বৌয়ের বকুনি খেয়ে আজ সকালেই আবার তিনি মুখ চুন করে গেছেন সেই এজেন্টের কাছে—গাড়িটা চাই মশাই! আমি মত পালটেছি আমার।
গাড়ি আর কোথায়! আপনি অর্ডার ক্যানসেল করে যাবার পর যিনি দু-নম্বরে হিলেন—আপনার ঠিক পরেই ছিলেন যিনি-পেয়ে গেছেন গাড়িটা। ঐ যে তিনি ডেলিভারি নিয়ে বেরিয়ে আসছেন এখন। তিনি দেখিয়ে দেন—তবে যদি বলেন, আপনার নাম আমি দ্বিতীয় স্থানে রাখতে পাবি অতঃপর। এব পবেব পব যে গাড়ি আসবে সেইটা আপনি পাবেন। ফেব আবার তিন বছরের ধাক্কা হয়ত বা।
হর্ষবর্ধনের চোখের ওপর দিয়ে প্যাঁ প্যোঁ করতে করতে চলে গেল গাড়িটা। তাঁর মুখ দিয়ে বেরুতে শোনা যায় শুধু—সেই ভদ্রলোক দেখছ সেলুনের আলাপী কালকের সেই ঘচাং ঘচ্…!
অ-দ্বিতীয় সেই ভদ্রলোককে দেখে আপন মনেই তিনি খচখচ করেন।
জীবন-জিজ্ঞাসা
জীবনরহস্যের কোনো হদিশ পেলাম না ভাই, দুঃখ করছিল আমার বন্ধু সোমনাথ ডাক্তার : সারাজীবন ধরে এত চেষ্টা করেও।
তোমাদের পাবার তো কথা নয়, তার খেদোক্তিতে আমি বাধা দিই- ওতো আমাদের…লেখকদেরই একচেটে এলাকা ভাই! তলিয়ে যাবার ভয় থাকলেও, ওর গভীরে আমরাই তো ডুব দেব…থই না পেলেও…থ হয়ে গেলেও। তোমাদের কারবার তো জীবন্মতদের নিয়েই। জীবনসংশয়ের সঙ্গেই তো যতো সম্পর্ক তোমাদের।
জীবনরহস্য মানে দীর্ঘ জীবনের রহস্য। বলে সে প্রাণীমাত্রের আদিমতম প্রাণের কথাটি প্রাঞ্জল করে—কী করে দীর্ঘ জীবন লাভ করা যায়, অনেকদিন বেঁচে থাকা যায়—সেই সমস্যার কথাই আমি বলছিলাম।
ও, এই কথা! বলে আমি হাঁফ ছাড়লাম।
অবশ্যি কিছু কিছু কিনারা যে পাওয়া না গেছে তা নয়। মিতাহারী মিতাচারী হলে মানুষ দীর্ঘকাল বাঁচে, পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সেটা প্রকাশ পেয়েছে। আহার-বিহারে সংযমীদের অকালমৃত্যুর আশঙ্কা ঢের কম। এই মিতাহারের কথাটাই ধরা যাক না…মিতাহার মানে পরিমিত আহার…
মিতাহারের কথায় আমার দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়ল।
সত্যি, পরীর মতই মেয়ে ছিল বটে মিতা। কিন্তু ওই মিতাহারের চেষ্টাতেই…পরিমিত পরিমাণেই, বলতে কি…
হ্যাঁ, মিতাহারী হবার সুযোগ পেলে আমি দীর্ঘজীবী…আরো একটু দীর্ঘজীবী হতে পারতাম হয়ত। এই যৎকিঞ্চিৎ জীবনে যে কটা দিন বেঁচেছি তার ভেতরেই আরো একটু বেশি দিন বাঁচা যেত, অনেক দিন অনেক রাত আরো অনেক বেশি জীবন্ত হতো, সেই তঙ্গভাগনীকে ক্ষণকালের জন্যেও সঙ্গিনীরূপে পেলেও এই এক জীবনেই অনেক জীবন-যাপন করা যেত, এই জনমেই জন্ম-জন্মান্তর লাভেরও কোনো অন্তরায় ছিল না। কিন্তু মিতালীর মুখপাতেই যেভাবে চডচিত হতে হলো মনে পড়ায় এতদিন পরেও দীর্ঘনিঃশাস পড়ল আমার।
মিতাহারের কথা তো বলছ! আমি ফোঁস করে উঠলাম। কিন্তু মিতাচার কিরূপ অম্লমধুর জানতে যদি! আঙুর ফলের মতই ভারী টক ভাই! ওর talk পর্যন্তই ভালো, তার বেশি এগুলেই মারাত্মক।
সেই বিপজ্জনক আচার-ব্যবহারের কথা স্মরণ করে এতদিন পরেও আমি শিউরে উঠি।
সে হাতের কাগজের একটা অংশে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল–আজকের এই খবরটা পড়েছ? এইটে পড়েই ওই দীর্ঘজীবনের প্রশ্নটা আমার মাথায় উঠেছে আবার নতুন করে।
খবরটায় নজর দিলাম—খবরের মত খবর বটে।
একালের এক দীর্ঘজীবী মানুষ—গতকাল ভট্টপল্লীর শ্রীভট্টশালী মহাশয়ের ১০৬তম জন্মাৎসব হয়ে গেল। তাঁর নিজের বিবেচনায় তার বর্তমান বয়স ১০৯ বছর, প্রাথমিক গণনার ভুলহেতু তিন বছর বাদ পড়ে গেছে..
ইস! লোকটা নিজের জীবনটাকে নিয়ে নয়-ছয় করেছে। খবরটা পড়ে আমি বিরক্তি প্রকাশ করি—অ্যাদ্দিন ধরে বেঁচে থেকে কী যে হয়! বুড়ো হয়ে বেঁচে থাকার কি কোন মানে আছে?
আরে, আজ যদি আমরা দীর্ঘজীবনের কিনারা করতে পারি তো কাল দীর্ঘ যৌবনলাভের কিনারে গিয়ে পৌঁছব, তা জানো? বলল সোমনাথ : চলে যাই ভাটপাড়ায়। ভদ্রলোকের ইনটারভিউ নিইগে। জীবনরহস্যের যদি কোন হদিশ পাওয়া যায় তার থেকে।