কেন, গাড়ি কি চলবে না নাকি?
কেন চলবে না! চালালেই চলবে। ঠেলেঠুলে চালাতে হবে। ঠেলেঠুলে চালালে কী না চলে বলুন? বাড়িতে আপনারা কজনা আছেন বললেন? ড্রাইভারকে বাদ দিয়ে অবশ্যি সে তো ধর্তব্যের বাইরে, কেননা, সে তো স্টিয়ারিং ধরে বসে থাকবে। কজনা আছেন বললেন আপনারা?
আমি, আমার বৌ, আমার ভাই—তাছাড়া একটা বাচ্চা চাকর—এই চারজন।
চারজনা মিলে ঠেললে গাড়ি চলবেনা আবার! চারজনায় চার্জ করলে, বলে, ঠেলেঠুলে হাতিকেও চালিয়ে দেওয়া যায়।
ঠেলেঠুলে নিয়ে যেতে হবে গাড়ি, তার মানে? ঠেলাগাড়ি নাকি মশাই? অবাক হন হর্ষবর্ধন।
না না, তা কেন? মোটর গাড়িই, আর, দম দিয়ে চালাবার মত না হলেও, একটু উদ্যম লাগবে বইকি!… তবে একটু ঠেলা আছে। তিনি বিশদ করেন—
ঐ গোড়াতেই যা একটু ঠেলতে হবে। তারপর একবার ইঞ্জিন চালু হয়ে গেলে গড গড করে গড়িয়ে চলবে গাড়ি। এগুলোর অ্যাকসেলেটার ততো ভালো নয় কি না, তাই এরকমটা। আপনার থেকে স্টার্ট নেয় না তাই।
নতুন গাড়ির এমন দশা কেন মশাই? হর্ষবর্ধন জিজ্ঞাসু।
নতুন গাড়ি কি এদেশে পাঠায় নাকি ওরা? সব সেকেণ্ডহ্যাণ্ড। জানান ভদ্রলোক : বলে সেকেণ্ডহ্যাণ্ড, আসলে কতো হাত ঘুরে এসেছে কে জানে! তাকেই আনকোরা বলে চালায় এখানে বাজারে।
এই রকম! জানতাম না তো। হর্ষবর্ধনকে একটু ম্রিয়মাণ দেখা যায়। ওদের শো রুমে ঐ ফিয়াট ছিল আরো দু-একখানা। এজেন্ট ভদ্রলোক নমুনা দেখালেন আমায়—ঝকঝকে নতুন—খাসা চমৎকার দেখতে কিন্তু।
ঐ ওপর ওপর। সমঝদারের হাসি হাসেন ভদ্রলোক। -উপরে চাকন-চিকন ভিতরে খড়ের আঁটি। উপরটা ঝকঝকে, ভিতরটা ঝরঝরে। একটু দম নিয়ে তিনি নবোদ্যমে লাগেন আবার—তা ছাড়া এই গাড়িগুলোর আরেকটা দোষ এই যে পেট্রল কনজাম্পসন বড্ড বেশি। পেট্রল খায় খুব।
তা খা। খাইয়ে লোকেদের আমরা পছন্দ করি। আমরাও খুব খাই মশাই।
শুধুই কি পেট্রল? তাছাড়া হোঁচোট—?
হোঁচোট? হর্ষবর্ধন বুঝতে পারেন না। চোট খান হঠাৎ।
যেতে যেতে হোঁচট খায় যে গাড়ি। ভয়ঙ্কর স্কিড্ করে।
ছাগলছানা সামনে পড়লে আর রক্ষে নেই বুঝি? হর্ষবর্ধন শুধান : চাপা দিয়ে চলে যায় বলছেন তাই?
ছাগলছানা পাচ্ছেন কোথা থেকে? ভদ্রলোক হতবাক।
ঐ যে বললেন ইসকিড? ইকিড মানে তো ছাগলছানা। বিড এ ম্যান গো টু দি ইসকি। পড়িনি নাকি ফাস্টবুকে?
ছাগলছানা অব্দি যে তাঁর বিদ্যের দৌড় সেকথা অম্লানবদনে প্রকাশ করতে তিনি দ্বিধা করেন না।
না না। সে তো হলো গিয়ে কিড। এটা স্কিড। তার মানে, যেতে যেযে হঠাৎ লাফিয়ে যায় গাড়িটা। টক করে বেটরে গিয়ে পড়ে। বেঘোরে মানুষ খুন করেও বসে মাঝে মাঝে।
অ্যাঁ? আঁতকে ওঠেন হর্ষবর্ধন।
মারাত্মক গাড়ি মশাই—তবে আর বলছি কী!
কী সর্বনাশ!
সর্বনাশ–বলতে! গাড়ির ব্রেকটাই আসলে খারাপ। হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে দেবে আপনাকে। রাস্তায় যত খুন জখম হবে আপনার গাড়ির তলায়, তার খেসারত গুনতে গুনতে দুদিনেই আপনি ফতুর হয়ে যাবেন।
লাখ লাখ টাকা ফাঁক হয়ে যাবে ঐ গাড়ির জন্যেই? আপনি বলছেন?
ঐ ব্রেকের জন্যই ব্রোক হতে হবে আপনাকে শেষতক। ভদ্রলোকের শেষ কথা।
ব্রোক হবার আগেই যেন ব্রেক ডাউন হয় হর্ষবর্ধনের, ভেঙে পড়েন তিনি-শুনেই না!
আর কলিশন হলেই তো হয়েছে। যদি আর কোনো গাড়ি কি ল্যাম্পপোস্টের সঙ্গে একটু ধাক্কা লাগে তাহলেই ভেঙে তক্ষুনি চুরমার! যা ঠুনকো গাড়ি মশাই!
তাহলে আমরাও তো খতম্ হয়ে যাবো সেই সঙ্গে?
খতম না হলেও জখম তো বটেই। তবে গাড়িটা কিনেই ইনসিওর করিয়ে নেবেন, আপনারাও লাইফ ইনসিওর করে রাখবেন নিজেদের—তাহলেই কোনো ভয় নেইকো আর। দুদিকই রক্ষা পাবে তাহলে। কোম্পানির থেকে দুটোরই খেসারত পেয়ে যাবেন তখন।
মারা গিয়ে ঢাকা পাওয়ার কোনো মানে হয়? তাঁর কথায় হর্ষবর্ধন তেমন ভরসা পান না : আর নাই যদি বা মরি, কেবল হাত পা-ই হারাই—কিন্তু তা হারিয়ে অর্থলাভ করাটা কি একটা লাভ নাকি?
সেটা দৃষ্টিভঙ্গির তারতম্য। যে যেমনটা দ্যাখে। কেউ টাকা উপায় করার জন্য সারা জীবন ব্যয় করে। কেউ বা জীবন রক্ষা করতে গিয়ে দু হাতে টাকা ওড়ায়। যার যেমন অভিরুচি।
ইস্! ফেঁসে গিয়েছিলাম তো আবেকটু হলেই। ফাসিয়ে দিয়েছিল গাড়িটা। কী ভাগ্যি আপনার সঙ্গে দেখা হলো আজ, আপনি বাঁচিয়ে দিলেন মশায়। আমাকেও—আমার টাকাকেও।
না না, তাতে কী হয়েছে। আপনি ঘাবড়াবেন না। চাপবার জন্যে কি আর গাড়ি? তার জন্যে তো ট্যাক্সিই রয়েছে। রাস্তায় পা দিয়েই যদি ট্যাক্সি পাওয়া যায় তার চেয়ে ভালো আর হয় না। আর তা সস্তাও ঢের। আর এধারে দেখুন, এসব গাড়ির পেছনে ধৰ্চাটা কম নাকি? ঠুনকো গাড়ি, পচা কলকজা, একটুতেই বিকল। আর্ধেক দিন কারখানার গ্যারেজেই পড়ে থাকবে—তারপর মেরামত হয়ে এলেও, দুদিনেই আবার যে কে সেই।
এমন গাড়িতে আমার কাজ নেই। এ গাড়ি আমি নেব না।
না না, নেবেন না কেন? বললাম না, চাপবার জন্য তো গাড়ি নয়। গাড়ি হচ্ছে বাড়ির শোভা, বাড়ির ইজ্জৎ বাড়াবার। বাড়ির মনে গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকলে পাড়াপড়শীর কাছে মান বেড়ে যায় কতো।
আমার গিন্নীও সেই কথা বলেন বটে। বলেন যে, একটা গাড়ি নেই বলে পাড়াপড়শীর কাছে মুখ দেখানো যাচ্ছে না।
ঠিকই বলেন তিনি। বাড়ি গাড়ি এসব তো লোককে দেখানোর জন্যেই মশাই! দেখে যাতে পাড়ার সবার চোখ টাটায়। তবে এ যা গাড়ি—চোখে আঙুল দিয়ে তো দেখানো যাবে না পড়শীদের। বলেন ভদ্রলোক : তেমন করে দেখাতে গেলে তো তাদের চাপা দিয়ে দেখাতে হয়। নিদেন চাপা না দিলেও, গা ঘেঁষে গিয়ে কি গায়ে কাদা ছিটিয়ে গেলেও চলে, কিন্তু তাতো আর এ গাড়িতে সম্ভব হবে না। তবে হ্যাঁ, পড়শীদের কানে আঙুল দিয়ে দেখাতে পারেন বটে।