ধারণাটা পালটালো ওঁর গিন্নীর কথায়। যেতেই তিনি ভীষণ খাপপা হয়ে কথাটা জানালেন আমায়। আর বললেন যে, অ্যাদ্দিন লোকটা বেশ চৌকোস ছিল, কিন্তু আপনার সঙ্গে মেশবার পর থেকেই নাকি কেমন ধারা যেন ভোতা মেরে যাচ্ছে। বুদ্ধিশুদ্ধি বলতে কিছু নেই আর কিন্তু আমাকে তো বেশ ধারালো বলেই আমি জানতাম …মৃদু প্রতিবাদের ছলে বলি : উনি যেমন ধার দিয়ে ধারালো, তেমনি ধার নেবার বেলায় আমার তো আর জুডি হয় না।
ধারালো লোকের ধার ঘেঁষতে নেই কখনো। পাশ থেকে ফোডন কাটে গোবরা। ধারে ধারে ঘষাঘষি হয়ে ধার ক্ষয়ে ভোতা মরে যায় শেষ য। তাই হয়েছে গিয়ে দাদার।
তারপর সমস্ত কথা জানতে পারলাম সবিশেষ। হর্ষবর্ধনের চোখের ওপর ভোজবাজিটা ঘটে গেল কেমন করে! যেন কোন যাদুকরের মায়দণ্ডেই হাওয়া হয়ে গেল গাড়িটা!
হয়েছিল কী, হর্ষবর্ধন গত সকালে চুল ছাঁটতে গেছলেন পাড়ার কাছাকাছি এক সেলুনে।
সেলুনে কাল ভীড় ছিল বেজায়। তাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে খানিকক্ষণ।
অপেক্ষমান হর্ষবর্ধনের সামনে কতকগুলো বই এনে ধরে দিল সেলুনওলা–চুপচাপ বসে থাকরেন কেন বাবু! এই বইগুলো দেখুন ততক্ষণ নেড়েচেডে। আপনার আগে তো আরো জনাতিনেক রয়েছেন, তাঁদের ছাঁটাই শেষ হলেই তাবপর আপনাকে ধরব।
বইগুলো নিয়ে তিনি নাড়াচাড়া করছেন এমন সময় অপরিচিত একজন এসে তার পাশে বসল—
নমস্কার হর্ষবর্ধনবাবু! বলেই এক নমস্কার ঠুকল তাঁকে।
নমস–কার! প্রতিধ্বনির সুরে বললেও লোকটা যে কে তা কিন্তু তার আদৌ ঠাওর হয় না।
আপনি আমাকে চিনবেন না মশাই! আপনার প্রায় প্রতিবেশীই বলতে গেলে। দুটো গলির ওধারে আমি থাকি। তবে আপনাকে আমি বেশ চিনি। আপনি আমাদের পাড়ার। শীর্ষস্থানীয়। কে না চেনে আপনাকে?
না না! কী যে বলেন, আমি…আমি নিতান্ত সামান্য লোক। অপরের দ্বারা স্তৃত। হয়ে হর্ষবর্ধন কেমন অপ্রস্তুত বোধ করেন।
আপনি অসামান্য, আপনি অসাধারণ। জানেন, পাড়ার ছেলে বুড়ো সকলে, ইতর ভদ্র সবাই আমরা, আপনার পদাঙ্ক অনুসরণ করি? বলে লোকটি একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করে: এই দেখুন না, আপনাকে এই সেলুনে ঢুকতে দেখে আমিও এখানে দাড়ি কামাতে এলাম। নইলে নিজের বাড়িতেই তো কামাই রোজ। নিজের হাতেই কামাই।
আমি চুল ছাঁটতে এসেছি। হর্ষবর্ধন কথাটা উড়িয়ে দিতে চান। নিজের দৃষ্টান্তস্বরূপ হওয়াটা যেন তার তেমন পছন্দ হয় না।
বলেই তিনি বইগুলো ভদ্ৰলোকের দিকে এগিয়ে দেন—পড়তে দিয়েছে এগুলো। দেরি হবে এখানে চুল ছাঁটবার, দাড়ি কামাবার। হাত খালি নেই কারো—দেখছেন তো! পড়ুন এগুলো ততক্ষণ।
এসব তো রহস্য রোমাঞ্চের বই। দেখেশুনে নাক সিটকান ভদ্রলোক : ভুতুড়ে অ্যাডভেঞ্চারের গল্প যততা। পড়লে মাথার চুল খাড়া হয়ে ওঠে। কেন যে রাখে এগুলো এখানে কে জানে!
ওই জন্যেই বোধহয়। হর্ষবর্ধন বালান : মাথার চুল খাড়া হয়ে থাকলে ছাঁটবার পক্ষেও ওদের সুবিধা হয় হয়ত।
একটা গভীর রহস্যের রোমাঞ্চকর সমাধান করে ওঁকে যেন একটু সহ্যই দেখা যায়।
তা যা বলেছেন। তাঁর কথায় সায় দেন ভদ্রলোক : এই এলাকায় এই একটাই তো ভাল সেলুন! তবে এই বড় রাস্তার ওপরে, পাড়ার থেকে অনেকটা দূর—রোজ রোজ আর কে এখানে দাড়ি কামাতে আসছে বলুন! এধার দিয়ে যাচ্ছিলাম, আপনাকে ঢুকতে দেখলাম বলেই না…তা, আর গাড়িটা কোথায় রাখলেন?
গাড়ি! গাড়ি কই আমার! হর্ষবর্ধন নিজের দাড়িতে হাত বুলোন—গাড়ি নেই বলেই তো এত ঝামেলা, দুবেলা গিন্নী বাড়ি মাথায় করছেন সেইজন্যে! গাড়ি আর পাচ্ছি কোথায়!
সে কী! আপনি পাচ্ছেন না গাড়ি? ভদ্রলোক রীতিমতন সবিস্ময়।
কই আর পাচ্ছি মশাই! তিন বছর হলো দরখাস্ত দিয়ে বসে আছি…তবে এবার একটু আশার আলো দেখা যাচ্ছে। এতদিনে আমার নাম লিস্টির মাথায় এসেছে। সবার ওপরে আমার নাম দেখে এলাম সেদিন। এইবার পাবো মনে হয়।
পেলেও পেতে পারেন। ভরসা দেন ভদ্রলোক মাথায় মাথায় হলেই পাওয়া যায় কিনা?
হ্যাঁ, এজেন্টও সেই কথা বলল। বলল যে, আপনার গাড়ি পৌঁছে গেছে ডকে, দু-একদিনের মধ্যেই মাল খালাস হয়ে আসবে। দিন দুই বাদে এসে দাম চুকিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে যেতে পারবেন, বলল এজেন্ট।
আপনি ভাগ্যবান। উল্লসিত হন ভদ্রলোক, কী গাড়ি বলুন তো?
ফিয়াট তো বলল। হর্ষবর্ধন জানানঃ ফিয়াট না—কী যেন!
ফিয়া—ট! উপচে ওঠা উৎসাহ হঠাৎ যেন চুপসে গেল লোকটার—ফিয়াট।
কিরকম গাড়ি মশাই? হর্ষবর্ধন জানতে উদগ্রীব।
যাছছেতাই! ফিয়াট না বলে আপনি ফায়ারও বলতে পারেন।
তার মানে?
ফীয়ার মানে ভয়। ভয়ঙ্কর গাড়ি মশাই।
সে কী! তবে যে খুব ভালো গাড়ি বলল এজেন্ট?
ওরকম বলে ওরা। বেচতে পারলেই তো ওদের কমিশন। মোটামূটি লাভ।
তাই নাকি?
বেশ বড়ো গাড়িই তো পেয়েছেন? বিগ ফিয়াট, নাকি বেবি ফিয়াট? জানতে চান ভদ্রলোক।
না, তেমনটা নাকি বড় হবে না, বলল লোকটা। তবে নেহাত ছোটও নয় তাবলে। মাঝামাঝি সাইজের বলেছে এজেন্ট।
কজন চাপবার লোক বাড়িতে আপনার?
তিনজন আমল। আমি আমার গিন্নী আর আমার ভাই গোবরা—এই তো। ড্রাইভারকে ধরে জনা চারেক স্বচ্ছন্দে যেতে পাবে, সেইরকম জানা গেল।
কুলিয়ে যাবে তাহলে আপনাদের।
তা যাবে। গোবরা ড্রাইভারেব পাশেই বসবে না হয়, তাতে কী হয়েছে। আমরা কর্তা গিন্নী দুজনায় ভেবে বসব দুজনে। অবশ্যি, আমরা একটু ভাটার দিকে, তাহলেও মোটামুটি আমাদের চলে যাবে মনে হয়।
মোটামুটিই হন আর পাতলাপাতলিই হন, আপনাদের চলে যাবে বুঝলাম। বলার সময় ভদ্রলোকের মুখ বেশ ভার হয়—-তবে গাড়িটা যদি চলে—তবেই না!