ব্যাস। শাস্ত্রকথার থেকে অনেক অশাস্ত্রীয় কথা উঠল তারপর। কলহ গড়ালো অনেক দূর, শেষ পর্যন্ত ধুত্তোর বলে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল শেখর।
যথারণ্যথা গৃহম্। আরেকটা শাস্ত্রবাক্য আউড়ে বোধকরি রোদশে জনেই অরণ্যের উদ্দেশে বেরুলো সে।
অরণ্যও খুব বেশি দূরে ছিল না। ঘাটশিলার চার ধারেই অরণ্য। শাস্ত্রমতে যে বাণপ্রস্থ পঞ্চাশশার্ধে হবার, পঞ্চাশের অর্ধেই তাই বরণ করে নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে গিয়ে সেঁধুল সে।।
সন্ধ্যে হয় হয়। জীবনসন্ধ্যা আসার ঢের আগেই সন্ধ্যে ঘনিয়ে এল তার জীবনে।
বিকেলে অফিস থেকে ফিরে চায়ের সঙ্গে এক বাটি হালুয়া খেয়েছে—খিদে তাই পাচ্ছিল না তার। আজ রাতটা না খেয়েই সে কাটাতে পারবে। কাল থেকে বনের ফলমূল তার সম্বল—জীবনের আমূল পরিবর্তন তার কাল থেকেই।
বুদ্ধি করে হালুয়াটা খেয়ে এসেছে পেট ভরে—নিজের বুদ্ধির সে তারিফ দিল। চায়ে চিনি ছিল না, চিনির অভাবে হালুয়াটাও মিষ্টি হয়নি তেমন—সেই কারণেই তার ফর্দের দুনম্বরে আরো বেশি চিনির উল্লেখ ওই।
কিন্তু চিনির যোগাড় করা যেমন কঠিন নিজের বৌকে চিনতে পারাও তার চেয়ে কিছু কম কঠিন নয় বুঝি। বহু আড়ম্বরে শুরু না হলেও এবং বউ-র দিক থেকে আরম্ভ নাহলেও এই প্রথম কলহেই জীবনে অরুচি ধরে গেহল তার। তাই শেখরের এই যৌ-বনপ্রস্থানকে নেহাত লঘুক্রিয়া বলা যায় না হয়ত বা।
শেখর শুনেছিল, ঘাটশিলার জঙ্গলের এই ভূমিকা আদৌ সামান্য নয়, ক্রমেই গভীর থেকে গভীরতর হয়ে মধ্যপ্রদেশের দণ্ডক পর্যন্ত চলে গেছে এই অরণ্য। এর আনাচে কানাচে বাঘ, ভাল্লুক, বন-বেড়াল, খাকশেয়াল, সাপ, বিছে, বাদুড়, বাঁদর সব ওতপ্রোত হয়ে রয়েছে।
কিছুক্ষণ ইতস্তত ঘোরা ফেরার পর গাছের ফাঁকে চাঁদের আলোয় ঘড়ি দেখে সে জানল যে রাত দশটা হয়েছে—এবার শোবার ব্যবস্থা করতে হয় কোথাও। বনে রাত কাটাতে হলে গাছই হচ্ছে সব চেয়ে নিরাপদ এই ভেবে সে একটা গাছে উঠে তার শাখাপ্রশাখার জোড়বিজোড়ের ফোকরে কায়দা করে শুয়ে পড়ল কোনরকমে এবং প্রকৃতির ক্রোড়ে আদিম মানবদের মতই সে ঘুমিয়ে পড়ল দেখতে না দেখতেই।
খানিক বাদে এক বিরাট অজগর সেই পথে যেতে দেখতে পেল শেখরকে। ইস্ লোকটা কী বেকায়দায় শুয়েছে দ্যাখো দেখি! ঘুমের ঘোরে উলটে পড়ে হাড় গোড় ভাঙবে বোধ হয় বেচারা। না, ওকে বক্ষা করা আমার দরকার। আপনমনে আওড়ালো অজগর।
এই না ভেবে সেই পরহিতচিকীর্ষু সাপটা গাছে উঠে সাত পাকে তাকে জাপটে ধরল। এইভাবে ওকে সাপটে রাখলে আর ও গাছের থেকে পড়বে না, ভাবল সাপটা, আর, এখন যদি ওকে রক্ষা করি, তাহলে কাল সকালে এর আমি আরো সেবা করতে পারব। প্রাতরাশ হিসেবে নেহাত মন্দ হবে না মনে হচ্ছে।
সকালে গাছের ফোকর দিয়ে সূর্যের আলো চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙে গেল শেখরের। ঘুম ভাঙতেই শেখর দেখল বিরাট এক অজগর তাকে জড়িয়ে রয়েছে। এক সাতপাকের হাত থেকে বাঁচতে গিয়ে আরেক সাতপাকের ফাঁসে এসে পড়েছে সে। সাপটা তখনন গভীর নিদ্রায় অচেতন। শেখরের ডান হাতটা মুক্ত ছিল, আর দেরি না করে পকেট থেকে তার ছোরাটা বার করে সে সাপের পিঠে বসিয়ে দিল সবলে।
সাপটা তখন আরো জোরে জাপটাবার চেষ্টা করল তাকে-আর ছুরিটাও সেই চেষ্টায় আরো বেশি গেঁথে বসল তার গায়। একটু পরেই অজগর নিজের বাঁধন আগা কবে গাছ থেকে খসে পড়ে ভূমিশয্যায় দেহরক্ষা করল তার।
আলিঙ্গনমুক্ত হয়ে গাছের থেকে নামল শেখর। অজগরের অধঃপতনে শাখায় শাখায় পাখির দল কিচির মিচির লাগিয়ে দিয়েছে ততক্ষণে, বাঁদররা ডালে ডালে হপ হপ করে লাফাতে লেগেছে আর সামনের গাছে এক কাকাতুয়া শেখরের কাণ্ড না দেখে চেঁচিয়ে উঠেছে—কেয়া বাত! কেয়া বাত!
কিন্তু তাদের এসব উৎসাহ-প্রকাশে নজর ছিল না শেখরের। কাল রাত্রে শোবার আগে যদিও তার সংকল্প ছিল যে সকালে উঠে আরো গভীরতর বনে সে প্রবেশ করবে, কিন্তু এখন, সকলের অভিনন্দন, এমনকি, কাকাতুয়াটার সাধুবাদ সত্বেও সে-মতলব সে পরিহার করল। তার মনে হলো যে, বন যতই কেন উপাদেয় হোক না, বাড়ির মতন জায়গা আর নেই।
ইত্যাকার ভেবে বন ছেড়ে ঘরের পানেই পা বাড়ালো শেখর।
আবজানো দরজা ঠেলে ঢুকতেই তার নজরে পড়লো, ঘরের নেতৃত্ব নিয়েছে বৌ। সাবানজলে ভেজানো ন্যাতা দিয়ে মেজে ঘষে ঘরের মেজে তকতকে করতে লেগেছে। গৃহিণী গৃহ মুছতে-ই বটে!
বৌ তাকে আসতে দেখে বলল, কী কাণ্ড তোমার! অমন দুম করে কিছু না বলে চলে গেলে, আমি সারা রাত বাড়া ভাত নিয়ে ঠায় বসে কাটালুম। তোমার যে নাইট ডিউটি ছিল সেটা আমায় বলে যাবে তো?
শেখর কিছু না বলে গুম হয়ে থাকে।
চায়ের জল চাপিয়েছি। নাও, মুখ হাত পা ধুয়ে বোসো এখন–টোস্ট, ডিমসেদ্ধ নিয়ে আসছি সব।
ডেকচেয়ারটায় গা এলিয়ে মনে হলো শেখরের, গভীরতর বনে না সেঁধিয়ে ভালোই করেছে সে। কেননা, পরের বন যতই কেন গভীর হোক না, পরের বোনের মতন মিষ্টি আর হয় না—যদি সে পরী মতই হয় আবার। আর যদি সে ফের ঘরণী হয়ে আসে।
চোখের ওপর ভোজবাজি
সবার উপরে মানুষ সত্য—ঘোরতর সত্যি কথা। উপরওয়ালা যে প্রচণ্ডভাবে অমোঘ, তা কে না জানে? কিন্তু মানুষ আর কতক্ষণ উপরে থাকতে পারে? উপরের মানুষটির কতক্ষণ আর উপরি উপায়ের সুযোগ থাকে? নিজের কর্মদোষে আপনার থেকেই কখন নীচে নেমে পড়ে।
আমরা তো হর্ষবর্ধনকে অদ্বিতীয় বলেই জানতাম, কিন্তু তিনি যে নিজগুণে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করবেন, কবতে পারেন, তা কখনো আমার ধারণার মধ্যে ছিল না।