- বইয়ের নামঃ ভালবাসার অনেক নাম
- লেখকের নামঃ শিবরাম চক্রবর্তী
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
ইঁদুর ধরা কল
ইঁদুর অর্চনার রেয়াজ এদেশে নেই, কিন্তু সিদ্ধিদাতার বাহন শ্ৰীমান মূষিকও কিছু কম সিদ্ধিপ্রদ নন – উৎসর এই কাহিনী থেকে আমরা জানতে পাব।
এমনকি অতঃপর ইঁদুরকে নিয়ে একেবাবে বারোয়ারি সার্বজনীনের চল না হলেও ছোট খাট ঘরোয়া উৎসব বেশ জমতে পারে, আশা করা অবশ্যই।
পর্বতের মূষিকপ্রসব বলা ঠিক না গেলেও মূষিকের পর্বতপ্রসব হত বা বলা যায়। পর্বত না হলেও পার্বতী তো বটেই।
সেদিন সকাল আটটার সময় চোখ মেলেই উৎস দেখতে গেল তার ঘরের জানালার গা ঘেঁষে রঙিন শাড়ি ঝুলছে একখানা। তবে ওপরকার ফ্ল্যাটে ভাড়াটে এলো তাহলে এতদিনে।
রঙিন শাড়িটা তার মনেও একটু রঙ ধবালো বুঝি।
উপরে নীচে পাশাপাশি অনেক গুলো ফ্ল্যাট নিয়ে তাদের পাঁচতলা বাড়িটা। একঘরে ফ্ল্যাট, দুঘরা, আর তিনঘরা ফ্ল্যাট সব। প্রত্যেক ফ্ল্যাটের সঙ্গে সংযুক্ত রান্নাঘর, স্নানের ঘর এবং সব কিছু। টেলিফোনও আছে প্রত্যেক তলাতেই। তবে নিজেরটায় দুটি শয়নকক্ষ। তার উপরেরটাও দুঘরা ফ্ল্যাট উৎস এখানে এসে আগেই ওটা দেখেছিল, তার পরে দুটোর ভেতরে পছন্দ করে এই নীচেরটাকেই সে বেছে নিয়েছে।
নিয়েছিল যে তার ভাগ্যি! নইলে, উপরের ফ্ল্যাট হলে এই শাড়িধারিণীর আবির্ভাব তার অলক্ষ্যেই থেকে যেতে হত। তারপরে যাব শাড়ি তার সঙ্গে তার দেখা হয়েছে মুখোমুখি—সিঁড়ি দিয়ে উঠতে নামতে একাধিকবাব। মেয়েটি তরুণী সুশ্রী আর অবিবাহিত, তাও দেখেছে সে।
দেখে তার মনে হয়েছে যে, উপরের ঘর ভাড়া নেবার এমন কী দরকার ছিল মেয়েটির। তার পাশের ফ্ল্যাটটাই তো খালি পড়ে আছে, আর, যে কালে প্রত্যেক ফ্ল্যাটই স্বতন্ত্র, স্বয়ংসম্পূর্ণ আর প্রত্যেক তলাতেই টেলিফোন।
আর একই ভাড়া যখন সব ফ্ল্যাটের, তখন পাশাপাশি বাস না করে উপরে গিয়ে থাকার কোনো মানে হয়?
সিঁড়ি ধরে ওঠা নামার অবসরে গায়পড়া আলাপও যে এক আধটু গড়ায়নি তা নয়। উৎস জেনেছে যে মেয়েটি কোন ইস্কুলের শিক্ষিকা, একলাই থাকে। আর নাম তার পার্বতী। আর সেই সূত্রে মেয়েটিকে সে জানিয়ে দিয়েছে যে সে হচ্ছে উৎস, এক কলেজে প্রফেসারি করে—সম্প্রতি ডক্টরেটের থিসিস লেখায় উৎসাহী।
এর বেশি এগোয়নি আর। তবে নীচের ঘরে নিজের বিছানায় শুয়ে বা ডেকম্মোরে বসে বসেই সে উপরের খবর সব রাখতে পারে। কখন মেয়েটি বেরোয়, কখন ফিরে আসে, কখন তার স্টোভ ধরায় আবার কখনই বা সে বাথরুমে যায়-নীচে বসেই সব টের পায় উৎস।
আর, সেই আন্দাজে যথাসময়ে সে সিঁড়িটার মাথায় গিয়ে দাঁড়ায়। দেখতে পায় নেমে আসছে মেয়েটি কিন্তু তার কুশল জিজ্ঞাসা আর মেয়েটির মিষ্টি হাসির বেশি এগোয় না কিছু আর। নিজের কাজে বেরিয়ে যায় মেয়েটি।
এইরকমই চলেছে, অকস্মাৎ একদিন ধারাটা যেন পালটে গেল কেমন করে।
উৎস বেড়াতে বেরিয়েছে, কিন্তু সিঁড়ির সম্মুখে পৌঁছতে না পৌঁছতেই তর তর করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলো মেয়েটি ভীত চকিত বন্যহরিণীর মতই।
উৎস বাবু! বেরুচ্ছেন নাকি আপনি? জিজ্ঞেস করেছে সে। বেরুচ্ছিলাম, তবে দূরে কোথাও নয়, এই ডাকবাক্সে একটা চিঠি ফেলতেই যাচ্ছিলাম। দাঁড়িয়ে গেল সে।
আমার ঘরে একটা ইঁদুর! সভয়ে জানালো পার্বতী। আমি ছুটে পালিয়ে এসেছি। উৎসর হাতে যে কোনো চিঠি-পত্র ছিল না তা সে লক্ষ্য করেনি।
চলুন তো দেখি। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে উৎস শুধোযনেংটি ইঁদুর? না ধাড়ী একটা?
খুব ধাড়ী নয়, নেহাত নেংটিও না, তার মাঝামাঝি…কিন্তু ভয়ঙ্কর।
তা, ইঁদুর একটু ভয়ঙ্কর বই কি! উৎস সায় দেয় তার কথায়? কামড়ে দিলেই তো র্যাটফিভার। তার কোনো চিকিচ্ছে আছে কিনা আমার জানা নেই।
কী সর্বনাশ! বলে মেয়েটি নিজের ঘরের দরজা খোলে। তারপর তড়াক করে এক লাফে একটা চেয়ারের ওপরে গিয়ে দাঁড়ায় ওই! ওই যে! ভীতিবিহ্বল চোখে সে তাকিয়ে থাকে।
ওটাকে ধরতে না পারলে তো রাত্তিরে আমি ভয়ে ঘুমুতেই পারব না। সে বলে, পারবেন তো পাকড়াতে?
চেষ্টা করে দেখা যাক। উৎসাহিত হয়ে এগুলো উৎস। যদিও আমার তেমন প্র্যাকটিশ নেই। ধরতে গেলে এটা বেড়ালদেরই কাজ তো।
একটু তাড়া পেতেই ইঁদুরটা উধাও হয়েছে। চকিতের মধ্যে চোখের উপরেই যেন অদৃশ্য হয়ে গেল। আনাচেকানাচে কোথাও আর তার পাত্তা নেই।
যাক পালিয়ে গেছে ইঁদুরটা। এতক্ষণে তিনটে বাড়ি ছাড়িয়ে গেছে আমার বিশ্বাস। এ তল্লাটেই নেইকো আর। যা তাড়া লাগালুম ওকে। বলতে গেছে উৎস; বাধা পেয়েছে মেয়েটির কাছ থেকে : পালাবে কোথায়! ওই তো, পাপোষের পাশটিতে ঘাপটি মেরে বসে আছে।
তাইতো! পাপোষের আড়ালেই আত্মরক্ষা করছে বটে।
যাক্, এইবার ওকে ঘেরাও করতে পারব। ডাণ্ডা-টাণ্ডা কিছু দিন তো আমায় দেখি। উৎস বলল, ঠাণ্ডা করে দিই ওকে।
তাড়া খেলেই ইঁদুররা নিজেদের গর্তে গিয়ে সেঁধোয়, তার এতকালের বদ্ধমূল ধারণা যেন টলিয়ে দিল ইঁদুরটা। পাপোষের সঙ্গে আপোষ করে উৎসর চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হলো সে।
না না নাআর্তনাদ করে উঠল মেয়েটি? মারবেন না বেচারীকে। ঐ ঝাড়নটা দিয়ে তাকে ধরে বাইরে নিয়ে যে দূরে কোথাও ছেড়ে দিয়ে আসুন বরং। পাকড়াতে পারবেন না ঝাড়ন দিয়ে?
ঝাডনটার বর্ণবৈচিত্র্যে ইঁদুরটা সম্মোহিত হয়েছিল মনে হয়। সহজেই উৎসর হাতে ধরা দিল সে।
ইঁদুরটা ধরা পড়বার পর চেয়ার থেকে নামল পার্বতী। আপনি আমায় বাঁচালেন উৎসবাবু! উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল সে।