একজন বললো, ওহে বালিকাটি বোধ হয় সত্যই সুভগা ছিলো।
অপরজন বললো, আর ঐ যুবতীটি! নিতম্ব দুটি যেন পূর্ণকুম্ভ।
অন্য আরেকজন জানতে চাইলো, ওহে এতো বাক্যব্যয় যে করছো, অগ্রে বলল, তোমরা ঐ বালিকা এবং যুবতীটিকে কি শয্যায় পেয়েছিলে?
না সখা, পাইনি, শূকরপুত্র সৈনিকেরা এমত তাড়না করলো যে আমাদের পলায়ন করে উপায় রইলো না–আহা, বালিকাটি এতো কোমল–যদি একবারের জন্যও পেতাম।
আরে মর্কট, অন্য আর একজন ধিক্কার দিয়ে উঠলো, ধিক তোকে যে, যুবা পুরুষ হয়েও বালিকা বালিকা করছিস। বালিকা রমণে আর এমন কি সুখ! পারঙ্গমা যুবতী রমণরণে স্বেদাক্ত হলে কেমন দেখায়, দেখেছিস কখনও?
ঐ সময় হঠাৎ এক ক্ষীণাঙ্গ প্রৌঢ় ছুটে এসে বৃদ্ধের পদপ্রান্তে উপবেশন করে। বলে, আপনিই বিচার করুন মহাশয়, রাজপ্রহরীরা কী মনে করে নিজেদের? রমণী সম্ভোগের অধিকার কেবল কি ওদেরই? আমাদের দেহে কি বস্তুটি নেই, আঁ? এ কি বিচার তাদের!
প্রত্যেকেই লম্পট এবং প্রত্যেকেই মাদক সেবন করে এসেছে। তাদের প্রমত্তাবস্থার ব্যবহার ন্যক্কারজনক–প্রত্যেকের মুখে দুর্গন্ধ। আর কথা কি তাদের! ঐ স্থানে তিষ্ঠানো দায়। দেখা গেলো বসন্তদাস নিরতিশয় ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছে। সে চিৎকার করে গালাগালি করতে লাগলো। বললো, তোমরা কৃমিকীট, বুঝেছো? মলভাণ্ডই তোমাদের যথার্থ স্থান–তোমাদের শাস্তির এখনই কি হয়েছে? অচিরেই তোমরা শিক্ষা পাবে, চোরের দল, লম্পটের দল কোথাকার।
কিন্তু ঐ ভর্ৎসনায় কী লাভ! সম্বিৎহীনদের কানে তো ঐ প্রকার ভর্ৎসনা পশে না। তাকে উত্তেজিত দেখে বৃদ্ধ হাত ধরে নিয়ে গেলেন অদূরে এক বৃক্ষতলে। বললেন, তুমি অযথা উত্তেজিত হচ্ছে বৎস–এ–তো তোমার একার দায় নয়–তুমি একাকী উত্তেজিত হয়ে কোনো লাভ আছে, বলো?
বড় বিচিত্র তোমাদের এই দেশ, বৃদ্ধ বলতে লাগলেন, এতো দস্যু এতো মাদকপায়ী এবং এমন বিশৃঙ্খল শাসন আমি আর কোথাও দেখিনি। এদেশের মানুষ যে কীভাবে জীবনযাপন করে, আমি ভেবে পাই না। বণিকবৃত্তি ধনাগমের প্রধান উৎস। কিন্তু দেখছি। এদেশে বণিকবৃত্তি অসম্ভব। সকল দেশে রাজপুরুষেরা বণিকদের রক্ষা করে–কিন্তু এদেশে দেখছি ভিন্ন রীতি, এখানে রাজপুরুষেরা পারলে বণিকের সমস্তই গ্রাস করে। এদিকে বণিকদের মধ্যেও দেখো, নিজ বৃত্তি রক্ষার কোনো চেষ্টা নেই। এই যে দেখছো ক্ষুদ্র বণিকদের, এদের কারও মধ্যে উচ্চাশা লক্ষ্য করেছো? অল্পেই এরা তুষ্ট। আর যেটুকু বা উপার্জন করে, তার প্রায় সমস্তটাই ব্যয় হয়ে যায় ব্যসনে। ঐ যে গন্ধ বণিকটিকে দেখলে, আসবপান ও গণিকালয়ের ব্যয় সংকুলানের পর তার আর কী অবশিষ্ট থাকবে, ভাবো তো?
এ আবার অধিক হয়ে যাচ্ছে, বসন্তদাসের মনে হলো। বিদেশী মানুষ তিনি, কেন এতো অধিক কথা বলবেন? সামান্য বিষয়ের উপর অধিক গুরুত্বদান একেই বলে। সে বলে উঠলো, মহাশয় দেখছি ক্ষুদ্র বিষয়কে অহেতুক গুরুত্বদান করছেন, আপনার কথা মিথ্যা নয়–কিন্তু সংসারের তো এই–ই রূপ, সমস্ত কিছুই উত্তমানুত্তমে মিশ্রিত। রাজপুরুষের শাসনের মধ্যেও কি প্রকারভেদে পার্থক্য অধিক থাকে? পীড়ন ও যথেচ্ছাচারকেই তো শাসন বলা হয়, এর অন্যথা যদি কোথাও কিছু থাকে, তাহলে বলতে হবে সেটি ব্যতিক্রম। ব্যতিক্রমকে কি বিধান বলবেন? আজীবন আমরা এই–ই দেখে আসছি। আর বণিকেরা বিলাসব্যসন না করলে কে করবে বলুন? শুধু বণিক কেন, অর্থবান মানুষমাত্রই বিলাসব্যসন করে। দরিদ্রকে বিলাসী হতে দেখেছেন কখনও?
যবন বণিকটি মৃদু হাসেন বসন্তদাসের কথা শুনে। বলেন, তুমি আহত হবে জানলে কথাটি আমি ঐভাবে বলতাম না। বৎস, চিন্তা করে দেখো, কিরূপ বেদনার কথা। বঙ্গ ও বরেন্দ্রে বণিকবৃত্তিই ছিল প্রধান–এদেশের পণ্য এতো দূর দূর দেশে যেতো যে তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। সমুদ্র পর্বত অতিক্রম করে দূরদূরান্তরে পণ্য বিক্রয় সহজ কথা নয়। অথচ সেই কাজটিই করতো এ দেশীয় বণিকেরা। এখন স্বর্ণরৌপ্য তোমরা দেখতে পাও না–কিন্তু এদেশে গৃহে গৃহে এতো স্বর্ণরৌপ্য ছিলো যে বলার কথা নয়।
বৃদ্ধ ভিন্ন দেশবাসী কিন্তু এদেশের কতো সংবাদ জানেন। বসন্তদাসকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতে হয়। তার শোনা ছিলো, কয়েকশতাব্দ পূর্বে বঙ্গ বরেন্দ্রের সেনাবাহিনী দিগ্বিজয় সম্পন্ন করে অঙ্গ কলিঙ্গ মগধ মিথিলা বিদেহ কোশল ইত্যাদি কতো যে দেশ জয় করেছিলো তার নাকি ইয়ত্তা ছিলো না। সে বুঝতে ঐ সব অতীতের কল্পকথা ব্যতীত অন্য কিছুই। নয়। কিন্তু এখন, বৃদ্ধের কথা শোনার পর, মনে হচ্ছে, কে জানে, হয়তো ঐ দিগ্বিজয়ের ঘটনাটিও সত্য সত্যই ঘটেছিলো। তবে বৃদ্ধের সকল কথায় আর তার বিশ্বাস হচ্ছিলো না। এতো অকল্পনীয় ঘটনার কথা কি বিশ্বাস করা যায়?
সে জানতে চাইলো একদা, মহাশয় এতো কথা আপনি কোথায় জেনেছেন? আমি তো কখনও শুনিনি।
বৃদ্ধ বসন্তদাসের মুখপানে চেয়ে হাসেন। বলেন, বৎস, তোমরা নিজেকে জানো –আত্মবিস্মৃতির মতো পাপ আর নেই। এ সকল সংবাদ তুমি যেমন আমার কাছ থেকে জানছো, সেই রূপই আমি অন্যের কাছ থেকে জেনেছি। প্রয়াগের এক বৃদ্ধ বণিক তোমাদের এই সমৃদ্ধ দেশের কাহিনী আমাকে বলেছিলেন। তোমার সন্দেহ হলে কোনো জ্ঞানী পণ্ডিতের নিকট সন্ধান করে জেনে এসো, আমার কথা সত্য না মিথ্যা।