অক্রূরদাসের স্ফূর্তির কারণ ছিলো। সমস্ত বস্ত্র তার বিক্রয় হয়ে গেছে, এখন সে মুক্ত পুরুষ। দিন দুই আমোদ উপভোগ করবে, তারপর গৃহের সন্তান গৃহে ফিরে যাবে। সে ইতোমধ্যে দুখানি শাটিকা বসন্তদাসকে উপহার দান করেছে। ভারী সুন্দর বস্ত্র দুখানি। একখানি স্বর্ণাভ চীনাংশুক–কল্পনায় মায়াবতীর দেহে ঐ বস্ত্র দেখে সে সাগ্রহে বস্ত্রখানি গ্রহণ করে। আর অন্যখানি গাঢ় নীল বর্ণের পট্টবস্ত্র। তাতে আবার স্বর্ণসূত্রের সূচিকর্ম। শাটিকাখানি মেলে ধরলে মনে হবে তারকাখচিত রাত্রির আকাশ। শ্যামবর্ণা মায়াবতীর দেহে ঐ বর্ণের বস্ত্র যে মানাবে না, তা সে জানতো। তাই বস্ত্রখানি গ্রহণ করতে তার ইতস্তত বোধ হচ্ছিলো। তাতে অক্রূরদাস হেসে ওঠে। বলেছিলো, নাও সখা, নিয়ে রাখো–সমস্তই যে পত্নীকে দিতে হবে এমন তো কথা নেই–পত্নী ব্যতিরেকেও তো কোনো রমণী বাঞ্ছিতা হতে পারে।
অক্রূরদাসের আগ্রহে সে সঙ্গী হলো। কিন্তু এমন স্থানে সে নিয়ে গেলো যেখানে যাবার কথা সে কল্পনাও করতে পারে না। অক্রূরদাস তাকে নিয়ে তুললো একেবারে বারাঙ্গনা পল্লীতে। তাকে অপ্রতিভ দেখে জানতে চাইলো, সখা বসন্ত, এই কি তোমার প্রথম? পূর্বে কখনও এরূপ স্থানে আসোনি?
বসন্তদাস বিরক্ত হচ্ছিলো। উত্তর না দিয়ে বললো, চলো, কোথায় যাবে।
সে এক অদ্ভুত জগৎ। কুটিরের দ্বারে দ্বারে বাররমণীরা। ওষ্ঠ রক্তিম, কপোলে শঙ্খচূর্ণ এবং তদুপরি কুঙ্কুম বিন্দু। কঞ্চলিগুলি এতোই স্ফীত যে সন্দেহ হয় ভিতরে গোলাকার প্রস্তরখণ্ড বাঁধা। সে এমন কখনও দেখেনি। নিজ গ্রামে হাটের প্রান্তে কয়েকটি ডোম এবং হড়ডি কুটিরের কথা সে জানে, যেখানে কয়েকটি শিথিলশাসনা রমণী বাস করতো। তারা এমন সাজসজ্জা করতো না। অন্য দশটি রমণীর মতোই ছিলো তাদের বেশবাস। জনরব ছিলো যে তারা অর্থের বিনিময়ে দেহোপভোগ করতে দিতো। কিন্তু এ যে দেখছে, একেবারেই অন্য রূপে যেমন, তেমন আকার প্রকারেও।
মাদকসেবী নাগরেরা যথেচ্ছ ব্যবহার করছিলো। কেউ নীবিবন্ধন ছিন্ন করার কপট ভঙ্গি করছিলো, কেউ মুখ চুম্বন করছিলো, কেউবা অহেতুক চিৎকার করছিলো। অক্রূরদাস একটি কুটিরের দ্বারদেশে উপনীত হয়ে বললো, সখা, এখানে দাঁড়াও। অতঃপর কুটিরের রুদ্ধদ্বারে করাঘাত করলে ভিতর থেকে চিৎকার শোনা গেলো। রমণীকণ্ঠ চিত্তার করে বলছে, রে কুক্কুরীপুত্র, রজ্জু দিয়ে বেঁধে রাখ নিজেকে, আমার কুটিরে এখন লোক আছে।
ঐ কথা শুনে বসন্তদাস আমূল বিচলিত হলো। একটি বিবমিষার ভাব তার সমগ্র দেহাভ্যন্তরকে আলোড়িত করতে লাগলো। অন্য লোক যে রমণীতে উপগত হয়েছে সেই রমণীতেই তুমি গমন করবে? এ কীভাবে সম্ভব? তোমার কি ঘৃণা নেই? যদি অন্যজনের উপগমন হতো তোমার অজ্ঞাতে, তাহলেও না হয় কথা ছিল। কিন্তু এ–তো স্পষ্ট, তবু তোমার রুচি থাকবে? ছি ছি। সে ডেকে বললো, অক্রূরদাস, আমি চললাম–তোমার আনন্দ নিয়ে তুমি থাকো।
অক্রূরদাস আসব পান করেছিলো। তার তখন ঈষৎ মত্তাবস্থা। বললো, কেন সখা, তোমার কি যুবতী রমণী অভিপ্রেত নয়? যদি বলল, তাহলে কিশোরী অথবা বালিকা সন্ধান করি।
বসন্তদাস কি বলবে ভেবে পায় না। তবু বলে, অক্রূরদাস, তোমার ঘৃণা হবে না? যে রমণীকে ক্ষণমাত্র পূর্বে অন্য লোকে ব্যবহার করেছে তার কাছে যেতে তোমার রুচি হবে?
কেন হবে না? অক্রূরদাস বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে বসন্তদাসের মুখপানে চায়। ক্রমে যেন বোঝে কথাটি। শেষে হা হা রবে হেসে ওঠে। বলে, তুমি হাসালে সখা, অন্যের উপগমনের চিহ্ন কি ঐ স্থানে খোদিত হয়ে থাকবে? বারেক ধৌত করে নিলেই হলো।
ঐ সময় একটি কোলাহল সৃষ্টি হয় স্থানটিতে। দেখা যায়, সশস্ত্র প্রহরীদের একটি ক্ষুদ্র দল সদর্পে অগ্রসর হচ্ছে কুটিরগুলির দিকে। বসন্তদাস অনুমান করে, একটি গোলযোগ আসন্ন। সে বিলম্ব না করে ঐ স্থান ত্যাগ করে।
পান্থশালার দ্বারদেশে উপবিষ্ট ছিলেন যবন বৃদ্ধটি। বসন্তকে দেখে বললেন, বস তুমি না বন্ধুর সঙ্গে আনন্দোপভোগের জন্য গেলে–তা এতো শীঘ্র ফিরলে যে? কি দেখলে, নাটগীত নাকি বাজিকরের খেলা?
বসন্তদাস সামান্য ইতস্তত করে। তারপর ঋজু হয়ে দাঁড়িয়ে বলে, না মহাশয়, ওসব নয়–আমরা বারাঙ্গনাদের পল্লীতে গিয়েছিলাম।
বৃদ্ধ অপ্রস্তুত হলেন। শেষে সহজ হওয়ার জন্য ঈষৎ হেসে বললেন, তাহলে শীঘ ফিরলে যে?
বসন্তদাস নিজেরই কাছে অপমানিত বোধ করছিলো ঐ সময়–ক্রোধ হচ্ছিলো তার। বৃদ্ধের কথা তার বিরক্তি উৎপাদন করলো। বললো, হ্যাঁ, শীঘ্রই ফিরলাম। সকলের রুচি কি একপ্রকার?
না, তা বলিনি আমি, বৃদ্ধ সহজ স্বরে বলেন–সে তুমি যা-ই বলো, কেউ তোমার কথা এখন বিশ্বাস করবে না!
মানুষের বিশ্বাস উৎপাদনের জন্য কি আমার কোনো প্রকার দায় আছে?
না, তা নেই, বৃদ্ধ স্বীকার করেন। বলেন, বরং তুমি চলে এসে উত্তম কাজই করেছো–ঐ অভ্যাস কুৎসিত, শাস্ত্রে বলে, অত্যধিক রমণীআসক্তি পুরুষকে দরিদ্র ও নির্বীর্য করে।
ঐ সময় একটি কোলাহল শোনা গেলো। স্থলিত কণ্ঠে চিৎকার এবং গালাগালি করতে করতে একদল লোক এদিকেই আসছে। নিকটে এলে দেখা গেলো, সকলেই পান্থশালাবাসী এবং বিভিন্ন শ্রেণীর বণিক। এরা সকলেই আনন্দ সম্ভোগের সন্ধানে সন্ধ্যাকালে পান্থশালা থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়েছিলো।