বসন্তদাসের এই এক কাজ। প্রতিদিন পশুহট্টে বিচরণ, আর শঙ্খদত্তের সন্ধান। প্রতিদিনই যবন বৃদ্ধের সঙ্গে দেখা হয়। তিনিও অপেক্ষায় আছেন, কখন লোকটি আসে এবং তার শেষ অশ্বটি ক্রয় করে নিয়ে যায়। বৃদ্ধটি একই পান্থশালার অতিথি, যদিও রাত্রিযাপন করেন ভিন্ন একটি প্রকোষ্ঠে। তবে অন্তরঙ্গতা হতে বিলম্ব হয়নি। দেখা হলেই বলেন, কি বৎস, তোমার মিত্র শঙ্খদত্তের দর্শন পেলে?
বৃদ্ধটি একেবারেই বৃদ্ধ–পক্ককেশ, শ্বেত শ্মশ্রু, এমনকি ভ্রূ–যুগল পর্যন্ত শুভ্র। তাঁর কাছে কতো যে কাহিনী সংখ্যায় গণনা করা যায় না। একবার আরম্ভ করলেই হলো, বিরতি হবে না সহজে, ক্লান্তিবিহীনভাবে বলে যেতে থাকবেন। অতিথিশালার অন্য আর একজনের সঙ্গেও বসন্তদাসের হৃদ্যতা হয়েছে–তবে সে হৃদ্যতা অন্য প্রকারের। বৃদ্ধ যখন তার কাহিনী বলেন, তখন তাতে কৌতুক থাকলেও মাথা নত করে শুনতে হয়। শ্রদ্ধা ও প্রীতির এমন একাকার ভাব পূর্বে কখনও বসন্তদাস অনুভব করেনি।
বৃদ্ধ এবার গৃহাভিমুখে যাত্রা করবেন। বাণিজ্য যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়। গৃহে সকলে অপেক্ষা করে রয়েছে। একটি বালিকা কন্যা আছে তাঁর। কন্যাটি বড় আদরের। ইতোমধ্যে হয়তো বিবাহের বয়স হয়েছে। বৎস বলতে পারো, বিবাহের বয়স হলে দুহিতারা প্রবাসী পিতার কথা চিন্তা করে, না ভাবী স্বামীর চিন্তায় অধিক সময় ব্যয় করে? সাধ্য কি বসন্তদাসের যে ঐ দুরূহ প্রশ্নের উত্তর দেবে। সে হাসে প্রশ্ন শুনে। বলে, মহাশয় বুঝি আশা করেন যে কন্যারা সকলেই পিতার চিন্তায় নিশিদিনযাপন করুক?
না, তা নয়, একটি দীর্ঘশ্বাস নিঃসৃত হয় বৃদ্ধের বক্ষ থেকে। বলেন, বড় আদর করতাম কন্যাটিকে–ঐটিই কনিষ্ঠা কিনা–আর অপরূপ সুন্দরী হয়েছে সে দেখতে, যদি তুমি দেখতে! তুমি স্বজাতীয় হলে আমি তোমাকে জামাতা করতাম।
কথাটি কৌতুক, না সত্যভাষণ, কিছুই বোঝা যায় না। তথাপি সে জানায়, মহাশয়, আমি কিন্তু বিবাহিত।
তাতে কি, আমাদের সমাজে চারিটি পর্যন্ত স্ত্রী রাখার বিধান রয়েছে।
তাই বলে আপনি সপত্নী গৃহে কন্যাদান করবেন?
হ্যাঁ করবো, বৃদ্ধ হাসেন। বলেন, কারণ আমি জানি, আমার কন্যাটিই হবে জামাতার সর্বাপেক্ষা আদরণীয়া।
বস্ত্র ব্যবসায়ী অক্রূরদাস একেবারেই বয়স্য স্বভাবের। তার কৌতুকাদিতে বারণ থাকে না। যতো উদ্ভট প্রসঙ্গ তার আলাপে। একদা জানতে চাইলো, সখা বসন্ত, এদেশে রমণীদের বক্ষ স্তনশূন্য কেন বলতে পারো?
কি অদ্ভুত কথা! স্তনশূন্য বক্ষ যার সে রমণী হবে কি প্রকারে? বোঝে সে, পীতাঙ্গী পার্বত্যজাতীয়া রমণীদের কথা বলছে অক্রূরদাস।
সে জানায়, অক্রূরদাস, একবস্ত্রা ঐ রমণীদের বক্ষদেশে স্তন দুর্লক্ষ্য হলেও তাদের নারীত্বে সন্দেহ পোষণ করো না–বিপদে পড়বে–রমণ রণে কিন্তু তারাই প্রথম আক্রমণ করে এবং পুরুষকে নিঃশেষিত না করে ত্যাগ করে না।
বসন্তদাস লক্ষ্য করছে, রাঢ়দেশবাসী অক্রূরদাসের নারী বিষয়ে আগ্রহ অত্যধিক। ঐ প্রসঙ্গ একবার পেলেই হলো, প্রহরের পর প্রহর সে আলাপ করে যাবে।
শঙ্খদত্তের সন্ধান করার সময় একটি বিচিত্র দৃশ্য দেখলো সে একদিন। কাষায় বস্ত্রধারী, পীতবর্ণ, মুণ্ডিতমস্তক একদল লোক সারিবদ্ধভাবে প্রাচীন মন্দিরের দিকে যাচ্ছে। সকলের মতো তারও কৌতূহল হলো, এরা কারা? কেউ বললো, এরা বণিক–কেউ বললো, এরা সদ্ধর্মী ভিক্ষু, হিমালয়ের পরপর তিব্বত দেশ থেকে এসেছে–আবার কেউ বললো, না হে, এরা সমুদ্রপারের মানুষ, তীর্থস্নানে চলেছে।
প্রকৃত পরিচয় কেউ দিতে পারে না। তবে লক্ষ্য করা গেলো, দেশী ভিক্ষুরা তাদের সঙ্গে সাগ্রহে আলাপ করছে।
পরদিন প্রভাতে আর তাদের দেখা গেলো না। তবে জল্পনা–কল্পনা চললো পরদিনও। অশ্বহট্টের লোকদের মুখে উদ্বেগ চিহ্ন। তাদের আশঙ্কা, ভয়ানক কিছু ঘটবে–সদ্ধর্মীদের এতো সংখ্যক লোক একত্র হয়েছে, এ শুভ লক্ষণ নয়। বসন্তদাস শঙ্খদত্তের কথা জিজ্ঞাসা করলে একজন বিরক্ত হয়ে জানায়, মহাশয়, আপনার কি মস্তিষ্কের দোষ হয়েছে, প্রতিদিন এক কথা? আমরা কি রাজার গূঢ় পুরুষ যে প্রতিটি লোকের আগমন নির্গমনের সন্ধান জেনে রেখেছি? এখন যান, বিরক্ত করবেন না।
সন্ধ্যাকালে দেখা গেলো মেলার নোক পলায়ন করছে। কি বৃত্তান্ত, কেউ জানে না। শুধু জনরব শোনে। ঐ আসে তারা, শীঘ্র পলাও–ঐ এসে গেলো। পলায়ন করুন মহাশয়, যদি প্রাণ রক্ষা করতে চান।
ক্রমে জানা গেলো, নিকটেই কোথাও ভয়ানক যুদ্ধ সংঘটিত হবে। রাজার সেনাদল আসছে বিদেশী সদ্ধর্মীদের দমন করতে। যতো শীঘ পারা যায়, পলায়ন করা উত্তম। যঃ পলায়তি সঃ জীবতি।
কোথায় কি! শেষাবধি কিছুই হলো না। পরদিন দ্বিপ্রহরে দুজন অশ্বারোহী দেখা গেলো–তারা ভিক্ষুদের সন্ধান করলো প্রথমে, তারপর মন্দিরগৃহে বিশ্রাম করতে গেলো। অপরাহ্বে দেখা গেলো ক্ষুদ্র একটি সৈন্যদল আসছে। তারা মেলার কিছু খাদ্যদ্রব্য ও কয়েকটি বিপণী লুণ্ঠন করে বিদায় হলো।
কিন্তু ততক্ষণে মেলার অর্ধাংশ শূন্য হয়ে গেছে।
ঘটনাটি বসন্তদাসকে হতাশ করে দিলো। সে বুঝলো, শঙ্খদত্তকে আর পাওয়া যাবে না।
অপরাহ্নের দিকে একদিন অক্রূরদাস তাকে শয্যা থেকে তুললো। বললো, চলো সখা, আজ কিঞ্চিৎ আনন্দ উপভোগ করে আসি। তোমাকে আজ অতীব উপভোগ্য বস্তু দেখাবো।