তার কাণ্ড দেখে যবন সেনারা দারুণ কৌতুক উপভোগ করে। তারা বুদ্ধিতে একেবারে বলীবর্দের মতে, এবং তাদের শাস্তিদানও সেই প্রকার। লোকটি দুর্বিনয় প্রকাশ করছে, দাও তার শিরটি ছেদন করে। কেন বাপু, অন্য কৌশল প্রয়োগ করলে তো তোমার কাজও উদ্ধার হয়, আবার লোকটির প্রাণও বাঁচে। অভিমন্যুদাসের নতুন নতুন শাস্তি উদ্ভাবনের ক্ষমতা তাকে সেনাবাহিনীর মধ্যে জনপ্রিয় করে তুলেছে। সে দ্বিপ্রহরে দুই তিনজন সঙ্গী অশ্বারোহী নিয়ে বিহারের উদ্দেশে যাত্রা করলো।
না, অভিমন্যুদাসের কার্য সমাধা করতে বিলম্ব হয়নি–উৎসব আরম্ভ হওয়ার পূর্বেই সে নগরে ফিরে এসেছিলো।
তরুণ ভিক্ষু দুটিকে তারা পায় দ্বারদেশেই। যবন সৈন্যদের দিকে তারা সহাস্যে অগ্রসর হয়েছিলো কয়েক পদ। তারপর আর পারেনি। কবন্ধ দেহ দুটি ঐ স্থানেই পপাত হয়। তবে ছিন্ন হয়ে ভূমিতে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পরও মুণ্ডু দুটির মুখে হাসি ছিলো। আর তৃতীয় লোকটিকে যবনেরা পশ্চাদ্দিক থেকে শূলে বিদ্ধ করে। কিঞ্চিৎ ক্ষোভ রয়েছে অভিমন্যুর। লোকটিকে সে চিনেছে–এ হলো সেই কুম্ভকার, যে লীলাবতীর হাত ধরে পলায়ন করেছিলো। আহা, লোকটিকে সে ঐভাবে হত্যা করতো না। লোকটির মুখে লীলা নামটি উচ্চারিত হয়েছে কয়েকবার। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। শূকরপুত্রটা ছিলো নিতান্ত ক্ষীণজীবী। অন্য কিছু বলবার আগেই তার প্রাণ পক্ষীটি দেহপিঞ্জর ত্যাগ করে শূন্যে উড়াল দেয়। কপাল মন্দ তার–এখন কোথায় সে লীলাবতীর সন্ধান করবে? আর্ত চিৎকারে দীর্ণ দিগন্তরেখায় ধূম্রকুণ্ডলী এবং অগ্নিশিখার দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করে অভিমন্যুদাসের চিন্তা হয়। লীলাবতীকে নিজ অধিকারে তাকে পেতেই হবে, মৃত অথবা জীবিত, যেভাবেই হোক।
১৬. প্রদোষে প্রাকৃতজনের কাহিনী
প্রদোষে প্রাকৃতজনের কাহিনী এখানেই সমাপ্ত। পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, লীলাবতী, বসন্তদাস, ছায়াবতী, মিত্রানন্দ, নিরঞ্জন প্রমুখ চরিত্রগুলির শেষ পর্যন্ত কী হলো? কেন তাদের পরিণতি লিপিবদ্ধ হলো না?
এ প্রশ্নের উত্তরে সবিনয় নিবেদন এই যে, সীমাবদ্ধ ক্ষমতাই লেখককে অধিক বিস্তারে যেতে সাহসী করেনি। উপরন্তু ঐসব চরিত্রের পরিণতি ইতিহাসে মোটামুটি স্পষ্টভাবেই লিপিবদ্ধ।
বিপুল সংখ্যক মানুষের ইসলাম গ্রহণ, যে কারণেই হোক, এদেশের ইতিহাসে একটি সর্বজ্ঞাত ঘটনা। উল্লিখিত চরিত্রগুলির মধ্যে কারও কারও বিলুপ্তি এবং কারও কারও আবার শ্রীচৈতন্য প্রবর্তিত বৈষ্ণব ভাবধারার মধ্যে পুনর্জন্ম লাভ, এও আমরা ইতিহাস থেকেই জানতে পারি। সুধীমিত্র, হলায়ুধ মিশ্র, সোমজিৎ উপাধ্যায় প্রমুখের উত্তরাধিকার যে পরবর্তীকালে স্মার্ত রঘুনন্দনের টোল এবং চতুষ্পাঠীগুলিতে লালিত এবং প্রচারিত হয়েছে–এ বিষয়েও ইতিহাসে সন্দেহের কোনো অবকাশ রাখা হয়নি। সুতরাং লেখকের আর কল্পনার অবকাশ কোথায়?
তবে হ্যাঁ, প্রশ্ন উঠতে পারে শ্যামাঙ্গকে নিয়ে–তার মৃত্যু কি অনিবার্য ছিলো? ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি রেখে আমাদের বলতে হয়, হ্যাঁ, অনিবার্যই ছিলো তার মৃত্যু। তার মতো মৃৎশিল্পীকে জীবিত থাকার অধিকার দেয়নি ঐ সময়ের সমাজ-ইতিহাস। কিন্তু সোমপুর মহাবিহারে প্রকীর্তিত শিল্পধারার উত্তরাধিকারী যে, তার নিঃশেষে মৃত্যু কি সম্ভব? আমাদের বিশ্বাস সম্ভব নয়। দৈহিক মৃত্যু হলেও প্রকৃত মৃত্যু তার হয়নি। তার সমস্ত জীবনোপলব্ধি বীজের মতো প্রোত্থিত ছিলো অনন্ত জন্মধারাবাহী প্রাকৃতজনের নিত্যসংগ্রামী জীবনবৃত্তের মধ্যে। আর সেই কারণেই কয়েক শতাব্দী পরে পুনর্ভবা তীরে এক মন্দির গাত্রের মৃৎফলকে পুনরায় আমরা অপরূপ শিল্পসুষমা ফুটে উঠতে দেখি। এবং ঐ একই শিল্প সুষমা রাঢ়-বরেন্দ্র-বঙ্গ-সমতটের পুত্তলি নির্মাণেও লক্ষ্য করা যায়। যদি কোনো পল্লী বালিকার হাতে কখনও মৃৎপুত্তলি দেখতে পান, তাহলে লেখকের অনুরোধ, লক্ষ্য করে দেখবেন, ঐ পুত্তলিতে লীলাবতীকে পাওয়া যায় কি না–আর যদি যায়, তাহলে বুঝবেন, ওটি শুধু মৃৎপুত্তলিই নয়, বহু শতাব্দী পূর্বের শ্যামাঙ্গ নামক এক হতভাগ্য মৃৎশিল্পীর মূর্ত ভালোবাসাও।