দুকূল বস্ত্রখানি নিলাম হে, ভারী সুন্দর এর রঞ্জনটি–মুক্তামালাগুলি বুঝি নব্যা বকাশিকার? দুখানি দাও, গৃহিণী পেলে সুখী হবে–আরে! তোমার কাংস্য স্থালীগুলি তো চমৎকার–এগুলি কি পশ্চিমের? আমার গৃহে কয়েকখানির প্রয়োজন, ওরে সুখদাস, স্থালীগুলি গৃহে নিয়ে যা।
বসন্তদাস ক্লান্তি বোধ করে একেক সময়। গণনা করে দেখে, লাভালাভ শেষে একই প্রকার থেকে যাচ্ছে। অতিরিক্ত উপার্জন চলে যাচ্ছে দস্যু নয়তো সামন্তপতি গ্রামপতিদের হাতে। সে ক্রমে হতাশ হতে আরম্ভ করে। যখন যাত্রারম্ভ করে তখন শীতের শেষ। আশা ছিলো, বর্ষার পূর্বেই গৃহে ফিরবে। কিন্তু দেখলো অসম্ভব। সঞ্চয়ে প্রায় কিছুই নেই। অগত্যা স্থির করে, পথিমধ্যেই বর্ষাযাপন করবে। এবং সেই সিদ্ধান্ত মতে সে গ্রাম্য বণিকের মতো হাটে হাটে সামান্য পণ্য ক্রয় বিক্রয় আরম্ভ করে। ঐভাবেই যায় বর্ষাকাল। কিন্তু তাতেও লাভ হয় না। অবস্থা থেকে যায় যথাপূর্বং তথাপরং। সর্বত্রই কোনো না কোনো দুর্বিপাক। ধবলদীর্ঘিকা হাটে বন্ধু শখদত্ত করে প্রতারণা। সমস্ত পণ্য সে ক্রয় করে কিন্তু মূল্য পরিশোধ না করেই পলায়। ফলে বাণিজ্যে আর তার উৎসাহ থাকে না। শঙ্খদত্তের সন্ধানে তাকে যেতে হয় দেবীকোটের মেলায়। প্রাচীন নগরী দেবীকোট তখন পরিত্যক্তপ্রায়। কিন্তু বৎসরান্তে মেলাটি নিয়মিত বসে। শুনেছিলো শঙ্খদত্ত মেলায় অশ্ব ক্রয় করবে। কিন্তু দেখলো, ঐ মেলায় শঙ্খদত্তকে সন্ধান করা কঠিন। তার সঙ্গে তখনও কয়েকখানি মুক্তামালা ছিলো। সে মণিকার বিপণীগুলিতে ঐ মালা কয়খানি একে একে বিক্রয় করলো। বলা বাহুল্য, মূল্য পাওয়া গেলো আশাতীত। কিন্তু তারপর? তারপর আর তার বিক্রয় করার মতো কিছু নেই। সে স্থির করলো, এখন কদিন সে মেলা দেখবে এবং শঙ্খদত্তের সন্ধান করবে।
এও বোধ হয় ভবিতব্যই। না হলে সে বিলম্ব না করে গৃহে ফিরতে পারতো। জীবন তার হতো অন্য প্রকার। কেননা ঘটনা মানুষকে নানা বিষয়ের সঙ্গে সংলগ্ন করে দেয়। মেলার ঘটনাগুলি আকস্মিক, কৌতূহলপ্রদ, কৌতুকময় এবং কোনো কোনোটি দুঃখবহও বটে। আর ঐ সকল ঘটনাই তাকে বিচিত্র পথে চালিত করে।
মেলার প্রান্তে একটি প্রাচীন মন্দির। মন্দিরে কোনো বিগ্রহ নেই এবং বড়ই জীর্ণদশা তার। কোনো এক সময় সম্ভবত পূজা হতো–এখন একেবারেই পরিত্যক্ত। শোনা যায়, ঐ মন্দিরে দেবী বজ্রতারা অধিষ্ঠিতা ছিলেন। কোনো এক সময় নাকি মঞ্জুশ্রী মূর্তিও সেখানে স্থাপিত হয়েছিলো। নিকটবর্তী দুখানি গ্রামের নাম বজ্রেশ্বর ও মঞ্জুকল্প। গ্রাম দুখানিই কেবল ঐ দুই দেবদেবীর নাম ধারণ করে আছে–নতুবা আর কোনো চিহ্ন তাদের নেই। মেলাটি যে কি উপলক্ষে বসে, তাও কেউ বলতে পারে না এখন।
বসন্তদাস পরিত্যক্ত মন্দিরটি দেখতে গেলে পরিচিত হয় এক যবন বৃদ্ধের সঙ্গে। বৃদ্ধটিও মন্দির দেখতে এসেছিলেন। সৌম্য শান্ত মুখাবয়ব, দেখলেই শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত হয়। আলাপে বসন্তদাস জানলো বৃদ্ধটি অশ্ববিক্রেতা। দশটি অশ্ব এনেছিলেন, সবই প্রায় বিক্রয় হয়েছে, অবশিষ্ট দুটি বিক্রয় হলেই গৃহে প্রত্যাবর্তন করবেন। ঐ অশ্ব বিক্রেতাই জানালেন, শঙ্খদত্তের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছে এবং সে দুএকদিনের মধ্যেই একটি অশ্ব ক্রয় করবে বলে অঙ্গীকার করেছে।
ঐ সংবাদের পর কে আর স্থির থাকতে পারে। বসন্তদাস মেলার পশু হাটে শঙ্খদত্তের সন্ধান করতে থাকে। স্থানটি একেবারে নরকবিশেষ। অশ্ববিক্রয়ের স্থানটি সর্বাপেক্ষা বিপজ্জনক। দুদিকে অশ্বের সারি, মধ্যস্থলে প্রশস্ত পথ। ঐ পথেই চলেছে অশ্বের পরীক্ষা। কোন অশ্ব কতখানি শিক্ষিত ক্রেতারা তা পরীক্ষা করে নিচ্ছেন। ফলে কখন যে ধাবমান অশ্ব কার স্কন্ধে এসে পতিত হবে তার স্থিরতা নেই। হৈ চৈ চিৎকার, ধাবমান অশ্বের হ্রেষাধ্বনি, তাদের গ্রীবায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘুন্টিকা মালার ঝুম ঝুম শব্দ এবং মানুষের উল্লম্ফ পলায়ন, সমস্ত একত্রে স্থানটিকে যুগপৎ আকর্ষণীয় ও বিপজ্জনক করে রেখেছে।
আর হস্তি বিক্রয়ের স্থানটি তো একেবারেই অসহ্য। কপি পড়ে আছে ইতস্তত আর স্থানে স্থানে পুরীষপ। সেই স্থূপ আবার প্রায়শঃই মূত্রস্রোতে বিগলিত ও ভাসমান। দুর্গন্ধে ও স্থানে দাঁড়ানো যায় না। তদুপরি সময় নেই, অসময় নেই, মাহুতেরা কুলিশাঘাত করে আর দিগন্তকম্পী বৃংহণধ্বনি ওঠে। সে এমন চিৎকার যে কর্ণপটাহ ছিন্নভিন্ন হবার উপক্রম হয়। তবে সর্বাপেক্ষা অধিক জনসমাগম হয় গো–হট্টে। কতো প্রকার, কতো আকারের যে গোধন হতে পারে তা এই মেলায় না এলে ধারণা করা যাবে না। এ স্থানেও দুসারি গবাদিপশুর মধ্যবর্তী একটি প্রশস্ত পথ রাখা হয়েছে। সেখানে শকটবাহী বলীবর্দদের শক্তি এবং কৌশলের পরীক্ষা হচ্ছে। তাদের সুচিক্কণ লোমাবৃত দেহ, গর্বোচ্চ গ্রীবাভঙ্গী এবং সুছন্দ গমন দেখলে বিশ্বাস হতে চায় না যে এগুলি বলীবদ। মনে হয় এগুলি অন্য কোনো প্রাণী। আর গাভীগুলিকে দেখলে মুগ্ধ না হয়ে উপায় থাকে না। পশ্চিম দেশীয় গাভীগুলি বিদ্ধনাসা, তবে নথের সঙ্গে রঞ্জু বাঁধা থাকলেও ক্রেতাদের পীড়নে একেকবার এমন লম্ফ দিয়ে উঠছে যে তাদের শান্ত করতে বিক্রেতাদের গলদঘর্ম হতে হচ্ছে। তাদের দুগ্ধস্থলীটি বিশাল এবং বাটগুলি প্রায় ভূমিস্পর্শী। প্রতিদিন নাকি দশ ভাণ্ড দুগ্ধ দিতে পারে এরা। দেশীয় গাভীগুলিই কি কম! খর্বাকার, কিন্তু এদের ওলানগুলিও কম স্ফীত নয়। শোনা যায়, এদের দুগ্ধদানের ক্ষমতাও প্রতিদিন পাঁচ ছয় ভাণ্ডের মতো।