বলল, আমি কোথায় যাবো? আমি তো এদের ধর্মগ্রহণ করিনি–আমাকেই বা এরা থাকতে দেবে কেন? এরা অস্বীকৃতি না জানালেও যারা নবদীক্ষিত, তারা জানাবে, তখন?
শ্যামাঙ্গ তবু বলে, আমি যাই, আমাকে যেতে দাও।
চলো তাহলে, আমিও তোমার সঙ্গে যাবো।
শ্যামাঙ্গ দেখলো, লীলাবতী সত্যই যাবার জন্য প্রস্তুত। কিন্তু তার সাহস হয় না। বাহিরে যদি বিপর্যয় সত্যই আরম্ভ হয়ে যায় তখন লীলাবতীকে সে কীভাবে রক্ষা করবে। সে মিনতি করে বলে, লীলাবতী কথা শোনো, অবুঝ হয়ো না–তোমার জন্য এ স্থান নিরাপদযবনেরা যতো নিষ্ঠুরই হোক, স্বধর্মীদের উপর অত্যাচার করবে না।
তুমি না থাকলে, নিরাপদ স্থানে থেকে আমার কী হবে। শোনো শ্যামাঙ্গ, আমার কথা শোনো, লীলাবতী নিরুপায় স্বরে বলে, আমার কোনো গত্যন্তর নেই–তুমি যেও না, তোমার সন্তান আমার উদরে।
শ্যামাঙ্গ স্তব্ধ হয়ে যায় ঐ কথা শুনে। এ কী বলছে লীলাবতী? চারিদিকে কোলাহল, মানুষ প্রাণভয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করছে, ভয়ানক অনিশ্চিত অবস্থা–এই অবস্থায় এ কোন কথা বলছে লীলাবতী? সে লীলাবতীর মুখপানে চাইলো। লীলা তখনও তার মুখপানে চেয়ে আছে। শ্যামাঙ্গ লীলার দুচোখে দৃষ্টি রেখে বললো, সত্যি বলছো?
ঐ কথায় চিরন্তনী নারীর মুখে রহস্যময় হাসিটি ফুটলো। বললো, কেন বিশ্বাস হয় আমার কথা?
কথাটি বলবার সময় লীলার দুচোখে কি কৌতুকের ছায়া দেখা গেলো? শ্যামাঙ্গ নিশ্চিত নয়। কিন্তু তবু মনে হলো, যেন দেখা গেলো একটি ছায়া। হঠাৎ তার সন্দেহ হলো, লীলাবতীর এটি একটি ছলনাময় কৌশল নয় তো? পুনরায় সে জিজ্ঞাসা করে, সত্যি বলছো লীলাবতী?
লীলাবতী যেন বিজয়িনী। অশ্রুলাঞ্ছিত মুখে বিজয়িনীর হাসিটি উজ্জ্বল হয়ে ফুটলো। আর তাতেই শ্যামাঙ্গ বুঝলো ভুল। মনে হলো, তার অনুমানটি সত্যলীলাবতী ছলনাই করছে। ক্ষণেক পরে লীলা যখন বললো, পারবে এখন আমাকে একাকী রেখে যেতে? তখন সে প্রায় নিশ্চিত হলো। বুঝলো, লীলাবতী তাকে কাছে রাখতে চায় এবং যবন ধর্মে দীক্ষিত করতে চায়–সেই জন্যই তার এই ছলনাময় কৌশল। সেও হাসলো এবার। বললো, উত্তম কথা, তোমারই জয় হলো–আমি এ নগরী ত্যাগ করবো না নবধর্মে দীক্ষাও আমি নেবো, কিন্তু এখন নয়–বাইরে যখন অবস্থান করা বিপজ্জনক হয়ে উঠবে তখন, তখন আমি তোমাদের এই কেন্দ্রে আসবো–এখন আমাকে যেতে দাও।
লীলাবতীর মুখে হাসি উচ্ছল হয়ে উঠলো ঐ কথায়। শ্যামাঙ্গের কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো, তোমাকে দেখে এখন আমার লোভ হচ্ছে, ইচ্ছা হচ্ছে রাক্ষসীর মতো তোমাকে চর্বণ করে খাই।
শ্যামাঙ্গ আহত এবং প্রতারিত বোধ করতে লাগলো নিজেকে। লীলাবতী এমন হতে পারলো? এমন হীন কৌশল গ্রহণ করা তার পক্ষে সম্ভব হলো! নিজে তো ধর্ম ত্যাগ করতেই চায়, অন্যকেও সে প্ররোচিত করে! তবে কি যবন কেন্দ্রের সাধুপুরুষটি কোনো প্রকার যাদুবিদ্যা প্রয়োগ করেছেন লীলাবতীর উপরে? তার মনে সন্দেহ উপস্থিত হয়।
আবার কখনও মনে হয়, লীলাবতীর সন্তান সম্ভাবনা কি একেবারেই অসম্ভব? নারী পুরুষে মিলিত হলে সন্তান সম্ভাবনা তো হতেই পারে। যদি লীলাবতীর কথা সত্য হয়? সে অতঃপর আর চিন্তা করতে পারে না। নিজের অনিবার্য পরিণামটি সে স্পষ্ট দেখতে পায় মানসচক্ষুতে। অমন পরিণাম তো সে চিন্তা করেনি কখনও। ।
১৫. প্রায় পরিত্যক্ত নগরীর নির্জন পথে
প্রায় পরিত্যক্ত নগরীর নির্জন পথে পথে কয়দিন সে ভ্রমণ করলো। চোর দস্যু এবং পথকুক্কুর ব্যতীত আর জনপ্রাণী গোচরে আসে না। যারা নগরীতে তখনও আছে, তারা গৃহের বাহির হয় না।
তথাপি সংবাদ পাওয়া যায়। এখন আর অবিদিত নয় কিছু। মহারাজ লক্ষ্মণ সেন নওদীয়ার প্রাসাদ থেকে পলায়ন করেছেন। নওদীয়ার প্রাসাদ ধ্বংস হতে বিলম্ব হয়নি। লক্ষ্মণাবতীও হয়েছে যথেচ্ছ লুণ্ঠিত। সেনাপতিরা পলায়ন করেছেন। সৈন্যরা কেউ পলায়িত, কেউ নিহত আর অবশিষ্টরা এখন যবন সেনাদলের সহযোগী। তারা সদলে এখন নগরের পর নগর লুণ্ঠন করে চলেছে। যে কোনোদিন পুন্ড্রনগরীতেও তারা এসে যেতে পারে।
একাকী ভ্রমণ করতে করতে সে নগরপ্রান্তে সদ্ধর্মীদের প্রাচীন বিহারের দিকে গেলো একদা। তার জনরব শোনা ছিলো যে সদ্ধর্মী ভিক্ষুদের নাকি যবনদের সঙ্গে মিত্রতা হয়েছে এবং ভিক্ষুদের কোনো ভয় নেই। কিন্তু দেখলো, বিহারটি প্রায় পরিত্যক্ত। কয়েকজন তরুণ তখনও অপেক্ষা করছে।
একজন তাকে দেখে কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করে, কি মহাশয়, আপনি নগর ত্যাগ করেননি?
না, সকলেই নগরী ত্যাগ করলে অতিথিদের অভ্যর্থনা কে করবে?
উত্তম, ভিক্ষুটি হাসলো। বললো, উত্তম বলেছেন, জিজ্ঞাসিত হলে আমরাও ঐ উত্তরই। দিই।
ভিক্ষুরা ঐ একই সংবাদ জানে। এবং তাদেরও ধারণা, ভিক্ষুদের যবনেরা কিছু বলবে। একজন বললো, কেন বলবে, বলুন? আমরা তো তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী কোনোভাবেই নই। এক হতে পারতো ধন-সম্পদের কারণ, ধন-সম্পদের লোভে আমাদের আক্রমণ করতো–কিন্তু সে গুড়ে তো এখানে বালি–অধিক হলে আমরা ভিক্ষাপাত্রটি দিয়ে দিতে পারি।
যেন কৌতুকের বিষয়। শ্যামাঙ্গ বললো, এ কি কৌতুকের সময়?
বাহ্, কৌতুক ব্যতিরেকে কী করবো বলুন? রোদন করবো? রোদনের কোনো কারণ আছে কি? রক্তপাত, লাঞ্ছনা, অপমান ইত্যাদি আমরা পূর্বেও দেখেছি, এখনও দেখছি। অন্ধের কি বা রাত্রি, কি বা দিন। তখন ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়রা নির্যাতন করতো, এখন যবনেরা করবে–একই ব্যাপার।