লীলা কী ভাবে অনুমান করা যায় না। চকিতে তার জ্বরেখা তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে এবং চোখে দেখা দেয় বহ্নিজ্বালা। বলে, এ তুমি কী বলো শ্যামাঙ্গ, পাপ করিনি আমরা? তাহলে এভাবে নিজ পরিচয় গোপন করে পলায়ন করছি কেন? আমরা যা করেছি তা যদি পাপ না হয়, তাহলে পাপ আর কাকে বলে? তুমি কি আমাকে এই অবস্থায় রেখে দিতে চাও? বলল, আমার কী অপরাধ? আমি কেন সমস্ত দিক থেকে বঞ্চিত হব। আমি তো বলেছি তোমাকে, জীবনকে আমি পরিপূর্ণভাবেই চাই। আমি সংসার চাই, স্বামী চাই, সন্তান চাই–প্রত্যেকটিই আমার প্রয়োজন, একটি ন্যূন হলে চলবে না। যদি আমার পরিপূর্ণ জীবন হয় উত্তম, না হলে জীবনকে আমি প্রত্যাখ্যান করবো।
তাই বলে তুমি নিজ ধর্ম ত্যাগ করতে চাও?
হ্যাঁ, চাই। আমার ধর্ম কোথায়? আমি তো বুঝি না, সত্য সত্যই আমার ধর্ম বলে কোনো বস্তু কখনও ছিলো কি না। যদি ছিলো ধরে নিই, তাহলে সে ধর্ম আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। এমন বিবাহ দিয়েছে, যা আমি চাইনি–সে ধর্ম আমার জীবনকে বিপন্ন করেছে, সে ধর্ম আমাকে পিতৃহীন করেছে–বলো, তাকে আমি ধর্ম বলব?
শ্যামাঙ্গ বিমূঢ় হয়। দেখে, তার সম্মুখে লীলাবতী নয়, যেন অন্য কোনো অপরিচিতা রমণী। সে বলে, লীলাবতী, এ প্রসঙ্গ থাক–এখন চলো, আমরা নিজ গৃহে যাই।
লীলাবতী হাসে। বলে, তুমি আমাকে উন্মাদিনী জ্ঞান করছে। কিন্তু আমি চিন্তা করে দেখেছি, এক গৃহে বাস, এক শয্যায় শয়ন–এতেই কি জীবনকে পাবো আমি, বলো? এক গৃহে বাস করিনি কি? এক শয্যায় শয়ন করিনি কি? কিন্তু তার ফল কি হয়েছে? রাত্রির অন্ধকারে পলায়ন, এই তো? এভাবে কতোবার পলায়ন করবো, কোথায় পলায়ন করবো, বলো? চুরি করেছি, না দস্যুতা করেছি?
শ্যামাঙ্গ প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে। বলে, তুমি যাদের সাহচর্যে আছে তারা বুঝি সকলেই যবন ধর্মগ্রহণ করেছে, তাই না? বালকটির কি নাম বললে যেন?
লীলাবতী এবারও হাসে। বলে, প্রসঙ্গান্তরে যেতে চাও শ্যামাঙ্গ, কিন্তু আমি বালিকা নই। জীবন আমার কম বিপর্যস্ত নয়, লাঞ্ছনা কম হয়নি, আমাকে যদি জীবিত থাকতে হয়, তাহলে সেই জীবন আমার নিজেকেই গঠন করে নিতে হবে।
শ্যামাঙ্গ প্রশ্ন করে, একাকী কি জীবন রচনা সম্ভব?
না, সম্ভব নয়, লীলা স্বীকার করে।
প্রণয় কি প্রয়োজন নয়?
হ্যাঁ, শতবার প্রয়োজন।
আমি?
তুমি আমার, তুমি ব্যতীত আমার জীবন অর্থহীন।
যদি আমি স্বধর্ম ত্যাগ না করি?
অমন কথা বলো না শ্যামাঙ্গ। লীলা এবার বিপন্ন দৃষ্টিতে শ্যামাঙ্গের মুখপানে চায়। বলে, অমন কথা বলো না তোমাকে না পেলে মরণ ব্যতীত আমার গতি নেই।
শ্যামাঙ্গ বলে তখন, লীলা, আবেগাশ্রয়ী হয়ো না, আমরা এই মৃত্তিকার সন্তান, বহুযুগ ধরে পুরুষানুক্রমে আমরা নিজ ধর্ম পালন করে আসছি। আমাদের চিন্তা–ভাবনা, আনন্দ শোক, আবেগ কল্পনা, সমস্তই যেমন আমাদের ধর্মাশ্রয়ী তেমনি আবার মৃত্তিকাশ্রয়ী–এ ধর্ম ত্যাগ করার অর্থ নিজেকেই ত্যাগ করা–এ অসম্ভব ব্যাপার, তুমি ঐ চিন্তা করো না।
লীলার দৃষ্টি সম্মুখে প্রসারিত, কতদূর সে নিজেও জানে না। শ্যামাঙ্গের কথা তার শ্রবণে পশে কি না তাও বোঝা যায় না। এক সময় সে বলে, শ্যামাঙ্গ, জীবন কি বিচিত্র, তাই না? তুমি কী ভাবো আর আমি কী ভাবি। অথচ আমরা একত্র হয়েছিলাম!
তার দীর্ঘশ্বাসটি স্পষ্ট শুনতে পায় শ্যামাঙ্গ। লীলাবতীকে প্রস্থানোদ্যত দেখে সে হাত ধরে। বলে, চলো, আমরা নিজেদের গৃহে যাই।
গৃহে? লীলা যেন অবাক হয়। বলে, গৃহের কথা বলছো, না শয্যার কথা?
শ্যামাঙ্গ নিজেকে অপমানিত বোধ করে ঐ কথায়। বলে ওভাবে বলল না লীলা, তুমি আমার
আমি তোমার, কিন্তু তোমার কী, সেটি বলো?
শ্যামাঙ্গ স্থির দৃষ্টি মেলে রাখে লীলাবতীর মুখপানে। হৃদয়ে তার রক্তক্ষরণ হয়। ভাবে, এ কোন রমণীকে দেখছে সে? আত্মবিস্মৃতা এই নারী কি সুখের জন্য এতোই লালায়িতা যে নিজ ধর্মকে পর্যন্ত ত্যাগ করতে চায়?
লীলা নিজের হাত মুক্ত করে নেয়। বলে, আমি তোমার পুত্তলিটি নই শ্যামাঙ্গ, আমি জীবন্ত নারী–আমার স্বামী চাই, সংসার চাই, সন্তান চাই–ঐগুলিই আমার ধর্ম, অন্য ধর্ম আমি জানি না আমাকে তুমি প্রকাশ্যে বিবাহ করো।
শ্যামাঙ্গকে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। লীলাবতী উদ্গত অশ্রু রোধ করতে করতে দ্বারপথে অন্তর্হিত হয়ে যায়।
১৪. অভিমন্যুদাসকে আহত করে
অভিমন্যুদাসকে আহত করে দীনদাসের পলায়নের কয়েক দিবস পরই সংবাদটি পাওয়া যায়। সংবাদটি নিয়ে আসে কন্যা সরস্বতীর দেবর নবীন স্নাতক মাধবাচার্য।
অভিমন্যু লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনায় সোমজিৎ ঈষৎ চিন্তিত হয়েছিলেন। আশঙ্কা হয়েছিলো, মহাসামন্ত হরিসেন কোনো না কোনো গোলযোগ সৃষ্টি করবে। কিন্তু দেখা গেলো, হরিসেনের পক্ষ থেকে কোনো উচ্চবাচ্য নেই–এমনকি অভিমন্যুদাসও তাঁর কাছে অতিমাত্রায় বিনয়ী হয়ে পড়েছে। তিনি আশ্চর্যই হচ্ছিলেন। একটি ক্ষুদ্র সংবাদ অবশ্য তার কর্ণগোচর হয়েছিলো, কিন্তু তিনি সংবাদটির গুরুত্ব দেননি। হরিসেনের পরিবার পরিজন নাকি কামাখ্যা তীর্থের উদ্দেশে যাত্রা করেছে। সংবাদটি শুনে তাঁর মনে হয়েছিলো–এ আর এমন কি ঘটনা? এরূপ ঘটনা তো ঘটতেই পারে।
মাধবাচার্যের আনা সংবাদ হরিসেনের আচরণের কারণ উদঘাটিত করে দিলো।