আর করবেই বা না কেন? মাত্রই দিবস কয় পূর্বের কথা। একটি বালক করতোয়া নদীবক্ষে নিমজ্জিত হয়ে প্রাণ হারায়। বালকটি এক বিধবা রমণীর একমাত্র সন্তান, তাকে মৃতাবস্থায় তুলে আনা হয়। সকারের আয়োজন হচ্ছিলো। ঐ সময় পুত্রহারা মায়ের শোকার্ত রোদনধ্বনি শুনতে পান দরবেশ সাধুপুরুষ। তিনি বিধবার গৃহে প্রবেশ করে সমস্ত জানলেন তারপর বালকটির পা ধরে উর্ধ্বে তুলে চক্রাকারে ঘূর্ণন আরম্ভ করে দিলেন, বালকটির মুখ দিয়ে প্রচুর জল নির্গত হয়ে গেলে তিনি বালকটিকে ভূমিতে শায়িত করে। বক্ষদেশে চাপ প্রয়োগ করলেন বার কয়েক এবং শেষে মন্ত্রপাঠ করলেন কয়েকবার। আর তাতেই বালকটি চক্ষুরুন্মীলন করলো এবং মা বলে ডেকে উঠলো।
এই দৃশ্য যারা প্রত্যক্ষ করেছিলো তারা জানে, কি অসাধারণ দিব্য ক্ষমতার অধিকারী ঐ সাধুপুরুষ। তিনি মৃত বালকটিকে বললেন, ওঠো, তোমার মাকে গৃহে নিয়ে যাও, আর অবাক কাণ্ড, সত্য সত্যই বালকটি হাত ধরে নিজ মাতাকে গৃহে নিয়ে গেলো। আহা, তখন নাকি প্রভুর দেহ থেকে দিব্যালোক বিচ্ছুরিত হচ্ছিলো! এই প্রকার সব কথা মানুষের।
প্রতিদিন কেন্দ্রের বহির্দ্বারে কুষ্ঠ রোগীদের সারিটি দেখবার মতো। সাধুপুরুষ স্বহস্তে তাদের চিকিৎসা করে থাকেন। কুষ্ঠ রোগগ্রস্ত এতো মানুষ এ দেশে আছে, না দেখলে বিশ্বাস হতো না। কোথায় কোন রমণীটি নিগৃহীত হয়েছে, সে এসে দাঁড়াবে বহির্দ্বারে। ডোম কন্যাটি স্বামীগৃহে যাবে না, তাকেও তুমি দেখতে পাবে ঐ স্থানে দাঁড়িয়ে আছে। সর্ববিধ পীড়ন থেকে মুক্তিলাভের জন্য যেন এই স্থান। হড়ডি কন্যাটি চর্মকারের পুত্রের সঙ্গে বেরিয়ে এসেছে, এদিকে চর্মকার গৃহিণী ঐ কন্যাকে পুত্রবধূ বলে গ্রহণ করতে চান না। এখন প্রভু, কি হবে এই কন্যার? এ সমস্যা সমাধানের দায়ও যেন যবন সাধুপুরুষটির। স্বয়ং সামন্তপতি প্রতিপক্ষে একবার তাঁকে প্রণাম জানাতে আসেন। এমন জনরবও আছে যে, এই সাধুপুরুষের অগণিত অনুচরদের মধ্যে অনেকেই রক্ত মাংসের মানুষ নয়–ঐ অশরীরীদের নাম নাকি জ্বীন। আরও জনরব এই প্রকার যে, তাঁকে সর্পে দংশন করে না, ব্যাঘ্নে ভক্ষণ করে না।
লীলাবতী বলে, জানো, এদের ধর্ম একেবারেই অন্যরূপ। বিবাহ যদি সুখের না হয়, তাহলে এরা দাম্পত্য বন্ধন ছিন্ন করতে পারে এবং স্বামী–স্ত্রী উভয়েই পুনর্বিবাহ করে। আর উচ্চ নীচ ভেদাভেদ একেবারেই নেই। না দেখলে তোমার বিশ্বাস হবে না যে, প্রভু ভৃত্য একত্রে, একস্থালীতে, আহার করে। মা গো, কি ঘৃণার কথা! একস্থালী থেকে আহার করলে একে অন্যের উচ্ছিষ্ট ভক্ষণ করে না, বলো? আরও অদ্ভুত কাণ্ড, এদের ভগবানের বিগ্রহ মূর্তি নেই–এমন ধর্মের কথা শুনেছো কোথাও?
কেন যবন ধর্মের প্রসঙ্গ লীলাবতী বারবার তোলে, শ্যামাঙ্গের বোধগম্য হয় না। যখনই ওর সঙ্গে কথা বলতে যাও ঐ সকল প্রসঙ্গ সে তুলবেই। জানায়, হডি এবং চণ্ডালেরা প্রায় প্রতিদিনই দীক্ষিত হচ্ছে, আর ক্ষেত্রকররা আসছে দলে দলে–তবে প্রতিদিন নয়। এদের দীক্ষাগ্রহণের অনুষ্ঠানটিও সহজ। স্নান করে শুদ্ধ বস্ত্রে পবিত্র দেহে তুমি দীক্ষাগুরুর কাছে ক্ষুদ্র একটি মন্ত্রপাঠ করলে–তারপর আর কিছু নেই, হয়ে গেলে তুমি নতুন ধর্মের লোক। আর যদি দেখতে তুমি উপাসনাকালের দৃশ্য, হাসতে হাসতে মরে যেতে। বারংবার পশ্চাদ্দেশটি ঊর্ধ্বে তুলে এরা ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করে। একসঙ্গে বহুলোক সারি সারি পশ্চাদ্দেশ তুলে রয়েছে–দৃশ্যটি কল্পনা করো তো?
লীলাবতী আনন্দেই আছে বলতে হবে। শ্যামাঙ্গ লক্ষ্য করে, সে আবার পূর্বের মতো হয়ে উঠেছে। সেই পূর্বের মতোই চটুল, হাস্যমুখর এবং বুদ্ধিদীপ্ত। সে বলে, এখানে একটি নবদীক্ষিত বালক আছে, তারও নাম বসন্তদাস–তার যাবনী নাম কী হয়েছে জানো? তার নাম হয়েছে, বাতেন। তোমার নাম যদি ঐরূপ কিছু হয়? মা গো, লীলাবতী হাস্যাবেগে বেপথু হয়ে পড়ে। আর শোনো, বাতেন আমাকে দীক্ষামন্ত্রটিও শিখিয়ে দিয়েছে–অত্যধিক সহজ, কয়টি শব্দমাত্রতুমি শিখবে? বলো, লা–ইলাহা ইল্লাল্লা, মোহাম্মাদুর রাসুলাল্লা। আচ্ছা, এদের ভাষায় এতো ল কেন জানো?
ঐ প্রকার কথা শুনে শ্যামাঙ্গ হতবুদ্ধি হয়ে থাকে। ইতস্তত করে, সদ্যলব্ধ বাসভবনের কথাটি জানাবে কি না। শেষে বলে, তুমি কি এখানেই থাকবে মনস্থির করেছো, নাকি বাইরে অন্য বাসভবনে যাবে?
কথা শুনে লীলাবতীর মুখ ম্লান হয়ে যায়। বলে, কই তুমি যে বললে, গৃহের সন্ধান পাও না–এভাবে একাকী থাকতে বুঝি আমার ইচ্ছা হয়? লীলার অভিমানী স্বর শুনে শ্যামাঙ্গ স্বস্তি বোধ করে। বলে, আগামীকালই আমরা নিজেদের বাসগৃহে যাবো।
লীলাবতীর চোখে নতুন আলো চমকিত হয়। বলে, সত্য বলছো, তাহলে আগামীকাল কেন? এখন গেলে কী হয়? তাকে অত্যন্ত অস্থির এবং চঞ্চল মনে হয়। পারলে যেন এই মুহূর্তেই সে যবন কেন্দ্র ত্যাগ করে। কিন্তু যখন শ্যামাঙ্গের বিদায়ের মুহূর্তটি এলো, তখন সে ইতস্তত করতে থাকে। বলে, ঐ স্থানে আমাদের বাস করতে দেবে তো, নাকি আবার পূর্বের মতো
কথাটি অসমাপ্ত রাখে লীলা। তারপরেই হঠাৎ বলে, এই সাধুপুরুষের কাছে দীক্ষা নিলে হয় না?
অত্যন্ত দ্রুত ব্যস্ততার মধ্যে হঠাৎ উচ্চারিত একটি কথা। কিন্তু শ্যামাঙ্গ গভীরভাবে আহত হয়। বলে, লীলা, স্বধর্ম ত্যাগ যে করে, সে পাপিষ্ঠ–আমরা কি পাপ করেছি, বলো? কেন আমরা নিজ ধর্ম ত্যাগ করবো?