হয়েছে হয়েছে, আর বিলম্ব নয়–মিত্রান বন্ধুকে তাড়না করে। বলে মূর্খা রমণীর কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণে এখন লোকালয়টি ধ্বংস না হয়ে যায়।
বসন্তদাস গম্ভীর হয়। বলে, মিত্র, এদেশে ধ্বংসের কি অবশেষ আছে কিছু? ধ্বংস তো হয়েই আসছে। তুমি ধ্বংসের দিকটা দেখলে, কিন্তু তোমার দেশের এক জননী দস্যু আক্রমণ কীভাবে প্রতিহত করতে পারে, সেটি তোমার দৃষ্টিগোচর হলো না। ভাবো তো, যদি সকল প্রাকৃতজন একত্রে এই প্রকারই প্রতিরোধ করে, তাহলে কী হতে পারে? মিত্র, প্রকৃত ব্যাপার এই যে, তোমরা কিছুই করতে পারোনি। যুগ যুগ ধরে প্রাকৃতজন এইভাবেই প্রতিরোধ করে। লাঞ্ছিত হয়, নিহত হয়, ধ্বংস হয়ে যায়, কিন্তু তথাপি ঐ একইসঙ্গে সে প্রতিরোধ করতে ভোলে না–হয়তো বিচ্ছিন্ন, হয়তো একাকী এবং শস্ত্রবিহীন–তথাপি তার দিক থেকে প্রতিরোধ থেকেই যায়।
হাট শূন্য হয়ে গেছে ততক্ষণে। কেবল প্রৌঢ়াটি তখনও তার ভগ্ন পাত্রাদি সম্মুখে নিয়ে রোদন এবং বিলাপ করছে। বসন্ত আর মিত্রানন্দ হাট পরিত্যাগ করলো। এবার আর রাজপথ নয়–প্রাকৃতজনের পথ, যা সঙ্কীর্ণ, কখনও যা জলাভূমিতে গেছে, কখনও গেছে বনভূমিতে। দুজনেরই এখন ধারণা, এই পথই নিরাপদ, গমনাগমন যদি করতে হয়, তাহলে এই পথেই করতে হবে।
গ্রামপ্রান্তের অখ্যাত নদীটির কূলে যখন উপস্থিত হলো তখন দিবা অবসান–প্রায়। উত্তর এবং দক্ষিণ উভয় দিকেরই নৌকা ছিলো। বসন্তদাস মিত্রানন্দের হাত ধরলো। বললো, সখা, চলো আমার সঙ্গে।
মিত্রানন্দ হাসে বন্ধুর কথা শুনে। বলে, অবশ্যই যাবো, তবে এখন নয়–ভিক্ষু জ্ঞানানন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা প্রয়োজন আমার। এখনও জানি না, কী বলবেন তিনি এবং ভিক্ষু সংঘেরই বা কী অভিমত হবে শেষ পর্যন্ত। তবে জেনে রাখো, তোমার কাছে আমাকে আসতেই হবে, যদি বেঁচে থাকি–কারণ তুমিই আমার প্রকৃত বন্ধু–প্রাকৃতজনের অমিত শক্তির দিকটি তুমিই নির্দেশ করে দেখিয়েছে, সখা, আমি আসবো–মায়াবতীর সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে তাকে আমার পক্ষ থেকে আশির্বাদ চুম্বনটি দিতে বলল।
সন্ধ্যাকালে নৌযান দুটি দুই মুখে জলে ভাসলো–একটি দক্ষিণে, স্রোতের অনুকূলে অন্যটি উত্তরে, স্রোতের প্রতিকূলে।
বহু পথ, বহু লোকালয়, বহু বিঘ্ন এবং প্রণয়–প্রতিহিংসা অতিক্রম করে বসন্তদাস এখন স্বদেশে এবং স্বভূমিতে প্রত্যাগমন করছে। ক্লান্তি এবং অবসাদে তার দেহমন ভারাতুর। তার দীর্ঘশ্বাস নির্গত হয় একটি। ভিক্ষু সংঘ কিছুই করতে পারেনি–হরিসেনের অত্যাচারের কোনো প্রতিকার হলো না, মহাসামন্ত শক্তিবর্মণ কিংবা সামন্ত শ্রীনাথবর্মণও রয়ে গেলো একই প্রকার। লাভ হলো না কিছু–পথে পথে ভ্রমণই সার।
বসন্তদাস নদীর ছলোচ্ছল তরঙ্গাভিঘাত শোনে আর দৃষ্টি প্রসারিত করে রাখে দিগন্তের দিকে। কৃষ্ণার কথা স্মরণ হয় তার, স্মরণ হয় ছায়াবতীর কথা এবং নিরঞ্জনের কথা আর দীর্ঘশ্বাস পড়ে একটি একটি করে। স্বপ্ন থেকে, ক্রোধ থেকে, জ্বালা থেকে, প্রণয় থেকে, এখন আবার সংসারের উদ্দেশে যাত্রা। মনে হয়–আপাতত এইটিই তার পথ। কারণ সংসারে মায়াবতী আছে এবং মায়াবতীর গর্ভে তার সন্তান জন্ম লাভের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। তাকে এখন অপেক্ষা করতে হবে। আর সংসার ব্যতীত অপেক্ষাকালের। যোগ্য আশ্রয় অন্য কোথাও কি আছে? থাকলেও সে আশ্রয়ের কথা বসন্তদাসের জানা নেই।
১৩. যবন কেন্দ্রের মধ্যে দুই ভাগ
যবন কেন্দ্রের মধ্যে দুই ভাগ। একদিকে বণিকদের অবস্থান, অন্যদিকে সাধুপুরুষ আহমদ তাঁর শিষ্যদের নিয়ে থাকেন। দুর্বৃত্তদের কবল থেকে উদ্ধার করে আনার পর যবন কেন্দ্রেই আশ্রয় হয়েছে লীলাবতীর। কেন্দ্রে রমণীদের থাকবার কোনোই ব্যবস্থা। ছিলো না–ঐ দিনই আরও দুটি নিরাশ্রয়া তরুণী মহাত্মা আহমদের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা। করে। অগত্যা আহমদ একটি গৃহের ব্যবস্থা করেন। গৃহটি দারু নির্মিত এবং প্রাচীন, কিন্তু সুন্দর।
আহমদ শেষ মুহূর্তেও বলেছিলেন, তুমি কি এই স্থানে থাকবে, না অন্য কোথাও যাবে?
প্রশ্ন শুনে লীলাবতী শেষবারের মতো শ্যামাঙ্গের মুখপানে চেয়েছিলো। তারপরে নিঃসংশয়ে বলেছিলো, আমরা আপনাদের আশ্রয়ে থাকতে চাই।
শ্যামাঙ্গ লীলাবতীর কথা শুনে আহত হয়েছিলো। পরে এক সময় বলেছিলো, তুমি ঐ কথা কেন বললে? সত্যি সত্যি তো আমরা এই স্থানে অবস্থান করছি না।
তবে আমরা এখন কোথায় যাবো, বলো? মাতুল বিদায়কালে একটি কথা বলেছিলেন, মনে আছে?
শ্যামাঙ্গের স্মরণ হয়, সিদ্ধপা বলেছিলেন, পথে যদি কোনো যবন কেন্দ্র দেখো, তাহলে সেখানে আশ্রয় নিও। তবে কি যবন কেন্দ্রগুলি সম্পর্কে সিদ্ধপার সম্যক ধারণা ছিলো?
সিদ্ধপার উপদেশটি স্মরণ হলো, কিন্তু তথাপি শ্যামাঙ্গ যবন কেন্দ্রে আশ্রয়গ্রহণ। করলো না। লীলাবতীকে বলে গেলো, তুমি দিবস কয়েক এখানে অবস্থান করো, আমি শীঘ্রই বাসস্থলের ব্যবস্থা করছি।
শ্যামাঙ্গ যবনদের আচার–আচরণ সম্পর্কে শুনেছিলো মায়াবতীদের গৃহে। মায়াবতীর মাতুল দীনদাস একদল যবন অশ্ব ব্যবসায়ীর উপাসনা ও অনুগ্রহণের রীতিটি বর্ণনা করেছিলেন। দেখলো, দীনদাস যা যা বলেছিলেন সমস্তই সত্য। এদের উপাসনায়। কোনো বিগ্রহ থাকে না। নির্দিষ্ট উপাসনা গৃহ থাকলেও তারা ভূ–পৃষ্ঠের কোনো স্থানকেই অপবিত্র জ্ঞান করে না–পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকলেই হলো। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন যে কোনো স্থানেই তারা নামাজ পাঠ করে। উপাসনাকে এরা বলে নামাজ। শ্যামাঙ্গ শুনতে পায়, প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ এদের ধর্মে দীক্ষাগ্রহণ করছে।