তাতে লাভ হয় কিছু?
হ্যাঁ, হয়–নদী অতিক্রম করতে যায় না কেউ। লোকটি বিদায়কালে হাসতে হাসতে বলে, মহাশয়, বুদ্ধি থাকলে পুরুষ শ্বশুর গৃহে দেহপাত করতে যায় না কখনও, বুঝলেন?
লোকটি চলে গেলে বসন্তদাস বললো, শুনলে মিত্র, লোকটির কথা? ও কেমন কটাক্ষটি করলো আমার উদ্দেশে?
মিত্রানন্দ হাসে। বলে, এ স্থানের লোকেরা অতিশয় বুদ্ধিমান–সাবধানে কথা বলল।
হ্যাঁ তা-ই দেখছি। বসন্তদাস জানায়, কিন্তু নদীর পরপারে গিয়ে আত্মরক্ষার কথাটি চিন্তা করো দেখি–এদের কে বলেছে এই কৌশলের কথা?
মিত্রানন্দেরও আশ্চর্য মনে হয়। তাহলে কি নিজেকে রক্ষার জন্য এরা নিজেরাই যথেষ্ট?
আহারাদি সম্পন্ন করে দুজনে এক বৃক্ষতলে বিশ্রাম নিচ্ছে ঐ সময় হঠাৎ দেখা গেলোলা, হাটের লোকেরা ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করছে। ব্যাপারটা কী বোধগম্য হবার পূর্বেই বসন্তদাস দুজন শস্ত্রধারী অশ্বারোহীকে হাটে বিচরণ করতে দেখলো।
মিত্রানন্দ বললো, এরা মনে হচ্ছে যবন সেনা, হঠাৎ এখানে কেন? তার প্রশ্নের উত্তর তখন কে দেবে। বসন্ত ব্যস্ত হয়ে পড়লো। বললো, চলো, আমরা বিদায় হই।
হাটে তখনও অনেক লোক। প্রত্যেকেই বিমূঢ়–যে যার ভূমিতে স্থির। মিত্রানন্দ বললো, অস্থির হয়ো না–পলায়ন করতে কি পারবে?
সৈনিক পুরুষ দুটি মনে হয় কোনো লোকের সন্ধান করছে। বার দুই এদিক ওদিক যায়। অতঃপর এগিয়ে আসে মিত্রানন্দের দিকে। বসন্তদাসের ভয় হচ্ছিলো, মিত্রানন্দের ভিক্ষুবেশই তার কাল হয়ে না দাঁড়ায়!
কিন্তু দেখা গেলো, তাদের কোনো হিংস্র অভিলাষ নেই। তারা কোনো এক হর্ষ দত্তের সন্ধান করছে।
মিত্রানন্দ বললো, আমরা দুজনই বহিরাগত–তবে দেখি, যদি কেউ সন্ধান দিতে পারে।
পাওয়া গেলো হর্ষ দত্তের সন্ধান। তার নিবাস পলাশবাটি গ্রামে, ক্রোশ দুই উত্তরে ক্ষণকাল পূর্বেও তাকে হাটে দেখা গেছে–এখন নেই।
সংবাদটি জেনে একজন অশ্ব থেকে অবতরণ করে বললো, আহার্য কিছু পাওয়া যাবে এখানে?
বিপণীতে কয়েকটি মিষ্টান্ন ভাণ্ড ছিলো। সৈনিকটি তার একটি তুলে নিলো। মিষ্টান্ন নিলো, কিন্তু মূল্যদানের ব্যাপারে তার আর হৃক্ষেপ নেই। এদিকে যে প্রৌঢ়াটির বিপণী, সে অতশত বোঝে না। সে অবলীলাক্রমে হস্ত প্রসারণ করে বলে, ও মহাশয়, মূল্য দেননি তো, মূল্য দিয়ে যান।
হায় হায়, করে কি মূর্খ রমণী–অস্ফুটে প্রায় সকল মানুষই বলাবলি করতে লাগলো।
সৈনিক পুরুষটি বারেক ফিরে তাকায়, তারপর পুনরায় সম্মুখে অগ্রসর হয় এবং মিটি মিটি হাসে–যেন বড়ই কৌতুককর একটি ঘটনা ঘটিয়েছে সে।
প্রৌঢ়াটির সম্ভবত আশঙ্কা হয়ে থাকবে তার মিষ্টান্নগুলি অপহৃত হয়ে যাচ্ছে। সে চিৎকার আরম্ভ করে দিলো। সম্মুখে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলো। হারে ড্যাকরা, মূল্য দিবি না কেন, অ্যাঁ? একি তোর মায়ের সেই বস্তু যে মূল্য ব্যতীতই খাওয়া যাবে? তুই ভেবেছিস কি, অ্যাঁ, মূল্য না দিয়েই চলে যাবি–তুই কেন, তোর পিতা এসে মূল্য দিয়ে যাবে–বুঝেছিস, ওরে দগ্ধমুখ হনুমান!
সৈনিকটির দেশীয় ভাষাজ্ঞান সম্ভবত যথেষ্ট নয়। তাকে কী কী বলা হচ্ছে, তার কিছুই বোধগম্য হচ্ছিলো না। তবে অনুমান করছিলো সে, নিশ্চয়ই তাকে মধুর সম্ভাষণে আপ্যায়ন করা হচ্ছে না। ফলে তার বিরক্তি জাগে সম্ভবত এবং সে ক্রুদ্ধ হয়ে তরবারিটি কোষমুক্ত করে উর্ধ্বে আস্ফালন করে।
আর তৎক্ষণাৎ ক্ষিপ্তা প্রৌঢ়াটি তবে রে বলে একটি ভাণ্ড পূর্ণ ঈষদুষ্ণ মিষ্টান্নরস তার মুখে নিক্ষেপ করে। ঘটনাটি এতই অভাবিতপূর্ব এবং আকস্মিক যে সৈনিক পুরুষটি বিমূঢ় হয়ে থাকে ক্ষণকালের জন্য। বিলক্ষণ একটি বিচিত্র দশায় পতিত হয় সে ঐ সময়। তার শিরোবেষ্টনী থেকে, শ্মশ্রু থেকে, কেশ থেকে মিষ্টান্নরস ঝরে পরিচ্ছদাদি সিক্ত করে দিচ্ছে আর সে তরবারিধৃত হস্তেই চক্ষুমার্জনায় ব্যস্ত। বাম হস্তের মিষ্টান্ন ভাণ্ডটি তখনও সে ত্যাগ করেনি।
কিন্তু করতে হলো। কারণ সুপক্ক মিষ্টান্নরসের মধুর আস্বাদন রসনার পক্ষে সম্ভব চক্ষুর সাধ্য কি যে সেই মিষ্ট স্বাদগ্রহণ করে? সেখানে আরম্ভ হয় বিপরীত প্রতিক্রিয়া। অসহ্য যন্ত্রণায় সৈনিকটি অস্থির হয়ে পড়ে এবং সে মিষ্টান্ন ভাণ্ডটি ভূমিতে নিক্ষেপ করে দুই হাতে চক্ষু মার্জনা ও উচ্চস্বরে চিৎকার করতে থাকে। হাটের লোকেরা কোলাহল করে ওঠে তার অবস্থা দেখে। অপর সৈনিক পুরুষটি তরবারি আস্ফালন করতে করতে বন্ধুর সাহায্যার্থে ছুটে আসে। এদিকে কোন এক দুষ্টমতি বালক প্রজ্বলিত একখানি কাষ্ঠখণ্ড দিয়ে আরোহীবিহীন অশ্বটির সুচিক্কণ পুচ্ছে অগ্নি স্পর্শ করে। ফলে অশ্বটি লম্ফ দিয়ে নিমেষে কোথায় যেন চলে যায়।
মনে হচ্ছিলো, সমূহ একটি সর্বনাশ অত্যাসন্ন। তরবারির আঘাতে ছিন্ন শির ভূলুণ্ঠিত হতে আর বিলম্ব নেই। কিন্তু দেখা গেলো কিছুই ঘটলো না তেমন। দ্বিতীয় অশ্বারোহীটি তার সঙ্গীকে তুলে নিয়ে যথাশীঘ্র হাট ত্যাগ করলো।
সম্পূর্ণ ব্যাপারটি যেমন আকস্মিক, তেমনই আতঙ্কজনক, আবার সেই প্রকারই হাস্যকর।
মিত্রানন্দ বললো, দেখলে, উন্মাদ রমণীটি কি কাণ্ড করলো–এখন তো এদের আর রক্ষা নেই।
বসন্ত সকৌতুকে হাসছিলো। বললো, সে না হয় হলো কিন্তু এও তো দেখলে বঙ্গবাসিনী রমণী কিরূপ ভয়শূন্যা হতে পারে। আর নিষ্কোশিত তরবারির বিরুদ্ধে তার অস্ত্রখানি কি প্রকার–কল্পনা করতে পারবে কেউ?