মন্দিরটি শিবের, এবং অতিশয় প্রাচীন। গর্ভগৃহে একটি তৈল দীপ জ্বলছিলো। কিন্তু নিকটে কোনো জনপ্রাণী দেখা গেলো না।
মন্দির সংলগ্ন কুটির আছে একটি–কিন্তু সেখানেও কোনো মানুষ আছে বলে মনে হলো না। ক্রমে এক সময় দুজনেরই সন্দেহ হলো, এ তারা কোথায় এসেছে? সমগ্র গ্রামটিই যে নিঃশব্দ। কোনো গৃহে শিশুর রোদন নেই, প্রদীপালোক নেই কোনো গবাক্ষে, রমণীকন্ঠের তীব্র কলহ শোনা যাচ্ছে না একবারও। অদ্ভুত কাণ্ড–দুজনেই হতবাক হয়–গ্রামের লোকেরা গেলো কোথায়?
বসন্তদাসের আশঙ্কা হয়–তবে কি এই গ্রামটিও উপদ্রুত হয়েছে? কয়েকটি গৃহের দ্বারদেশ পর্যন্ত সন্ধান করে তারা। দেখে, না–সত্যই কোনো জনপ্রাণী নেই। তবে এও বোঝা যায় যে গ্রামখানি আক্রান্ত হয়নি। হলে, কুটিরগুলির দশা অক্ষত থাকতো না। মনে হয় এরা নিকটস্থ বনভূমিতে আশ্রয় নিয়েছে–মিত্রানন্দ নিজ অনুমানের কথা ব্যক্ত করে। বলে, দেখছো না, এই গ্রামের অবস্থান একেবারেই পথের উপর।
মন্দিরের চত্বরে দাঁড়িয়ে বসন্তদাস বলে, সখা, এ গ্রামে রাত্রিযাপন বোধ হয় সমীচীন হবে না।
কেন? মিত্রানন্দ হাসে। বলে, তোমার কি ভয় হচ্ছে?
বসন্তদাস হাসে না। বলে, অবশ্যই হচ্ছে–ভয়ের কারণ থাকলেও যে ভয় না পায়, সে তো নির্বোধ।
মিত্রানন্দ পুনরপি হাসে। বলে, মিত্র বসন্ত, ভয় পেয়ে কোনো লাভ আছে, বলো? ভয়ের কারণ যেক্ষেত্রে সর্বক্ষণ এবং সর্বত্র উপস্থিত, সেক্ষেত্রে ভয়ের কি আর স্বতন্ত্র কোনো অস্তিত্ব থাকে? ভয় পেয়ে তুমি নিজেকে কোথায় লুক্কায়িত করবে? বরং ও চিন্তা ত্যাগ করো–মনে করো, তথাগতের যা ইচ্ছা, তাই হবে।
বসন্তদাস মিত্রানন্দের মতো হতাশ হতে পারে না। বলে, মিত্রানন্দ, ভীতির একটা মঙ্গলজনক দিক কী জানো? ভীতি জীবনকে অন্তরাল করে রাখে–আর তাতে সে বাঁচে।
ধিক অমন বেঁচে থাকায়!
তুমি ধিক্কার দিতে পারো, বসন্তদাস বলে, কিন্তু আমার কাছে বাঁচবার ঐ কৌশলটি ধিক্কারের বস্তু বলে মনে হয় না। কারণ জীবের প্রাণরক্ষা করা মানুষের একটি পবিত্র কর্তব্য–নিজের ক্ষেত্রে যেমন, তেমনি অন্যের ক্ষেত্রেও। চিন্তা করে দেখো, জীব থাকলেই না জগৎ আছে, এবং তা থাকলে তবেই না পরিবর্তনের সম্ভাবনাটিও থাকবে।
ধরো, তুমি নির্বোধের মতো প্রাণ দিয়ে দিলে, বসন্তদাস নিজের ধারণা ব্যাখ্যা করে। বলে, তাতে কারও কোনো লাভ হবে, বলো? অহেতুক তোমার প্রাণটি চলে যাবে, বরং তুমি যদি এই দুর্যোগে নিজেকে রক্ষা করতে পারো, তাতে যদি তৃণাদপি নীচ এবং অবহেলিত হতে হয় তোমাকে, তথাপি সেই কৌশলটি তোমার জন্য উত্তম। কারণ তুমি বেঁচে থাকলে প্রাণ বাঁচলোএবং সেই সজীব জাগ্রত প্রাণ অবশ্যই তোমার আরব্ধ। কাজটি একদা সম্পন্ন করবে–যদি না পারে, অন্তত সম্ভাবনাটিকে বাঁচিয়ে রাখবে। কিন্তু প্রাণই যদি না থাকে, তাহলে সকলি তো গেলো। সুতরাং চলো, এই বিপজ্জনক স্থান ত্যাগ করি।
মিত্রানন্দ সম্মত হতে পারে না। বলে, আমি দেখতে চাই বসন্ত, শেষ পর্যন্ত কী হয়।
ঐ কথায় বসন্ত হাত ধরে মিত্রানন্দের। বলে, তোমাকে এই অবস্থায় ত্যাগ করতে বলো? তা কি আমি পারবো? পারবো না। এদিকে যদি আমার প্রাণ যায়, তাহলে কী হবে চিন্তা করে দেখো–আমার স্ত্রী, তার উদরের সন্তানটি, নিজের পিতা–মাতা, স্ত্রীর পিতা–মাতা–এতোগুলি জীবন অকূলে পতিত হবে–সে অবস্থায় আমার প্রাণ দানের কোন যৌক্তিকতা থাকবে বলতে পারো?
মিত্রানন্দ কিছু বলে না ক্ষণকাল। শেষে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বলে, চলো, তাহলে।
আহার্য সংগ্রহ করা যায়নি। তারা মন্দির কূপে জলপান করে রাত্রির মধ্যমে পুনরায় পথে নামে।
কিন্তু দুজনের পথ কি এক? কতদূর তারা একত্রে যেতে পারবে? একজন গৃহী, অন্যজন ভিক্ষু। একজনের গন্তব্য সংসারে, অন্যজন যাবে সংঘে। সুতরাং পথ শীঘ্রই পৃথক হয়ে যাবে তা দুজনেই বুঝতে পারছিলো। বসন্তদাসের কষ্ট হচ্ছিলো মনে। বড় আপনজন হয়ে উঠেছিলো দুজনে পরস্পরের কাছে। মঙ্গলদীপ গ্রামে প্রথম পরিচয় তারপর কতো ঘটনা এবং কতো দীর্ঘ পথ একত্রে রয়েছে তারা। অবশেষে বিদায়–আর বিদায়ও এমনকালে যে পুনরায় সাক্ষাৎ হবে কিনা কেউ বলতে পারে না।
তৃতীয় দিবসে অপরাহ্নকালে তারা এক ক্ষুদ্র হাটে উপনীত হলো। জনসমাগম অধিক নয়–কিন্তু বিচিত্র একটি স্তব্যস্ত ভাব চারিদিকে–প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয় বিক্রয় সমাপন করে শীঘ্র গৃহে ফিরতে চায় সকলে। তবে হাট বলে কথা–তার নিজস্ব স্বভাব কিছু না কিছু থাকবেই। ঐ ব্যস্ততার মধ্যেই কুশল জিজ্ঞাসা করে নিচ্ছে পরিচিত লোকেরা–পিতার সঙ্গী বালকটি ক্ষুদ্র বংশীটিতে ফুঙ্কার দিয়ে চলেছে ক্রমাগত একজন তার কন্যাকে বলছে, তুমি কি ঐ খণ্ড মিষ্টান্নটি নেবে, না এই মঠটি হলে তোমার চলবে–একপ্রান্তে আবার দুটি বানর নিয়ে এক বাজিকর তার ক্ষুদ্র ডমরুটি বাজিয়ে চলেছে। বসন্তদাস চারিদিকে দৃষ্টি প্রসারিত করে বললো, এ স্থানে লোকদের মধ্যে দেখছি এখনও আতঙ্ক সৃষ্টি হয়নি।
সে একটি লোককে ডেকে বলে, মহাশয়, এদিকে কি যবন সেনাদলের আগমনের কথা শুনেছেন?
লোকটি হাসে। বলে, তাদের কথা কে না শুনেছে, তবে আমরা ভীত নই–দেখছেন, নিকটেই আমাদের নদী–এদিকে কোনো অঘটন ঘটলেই আমরা পরপারে চলে যাই।