এই পর্যন্ত বলে তিনি হাসলেন। বললেন, জ্ঞানানন্দকে বলো তো, তিনি আমাদের ধর্মগ্রহণ করবেন কি না? তোমাদের ধর্মের সঙ্গে আমাদের ধর্মের তো বহু সাদৃশ্য আছে, সেটি জানো তো?
ঐ কথার পর হাসতে হাসতে বিদায়।
বাইরে এসে মিত্রানন্দ বললো, দেখলে তো? যবন সেনাদল সম্পর্কে যবন সাধুপুরুষটির কী ধারণা? নিরঞ্জন হঠকারী ব্যতীত অন্য কিছু নয়।
বহির্দ্বারের নিকটে এসে হঠাৎ বসন্তদাস দাঁড়ালো, আশ্চর্য, এ কে? উজুবটের লীলাবতী?
তরুণীটিকে দেখলো মিত্রানন্দও। বললো, তুমি ওকে চেনো?
হ্যাঁ, আমার স্ত্রীর বাল্যসখী, ও এখানে কেন?
নিকটবর্তী হতেই লীলাবতীর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, ভ্রাতঃ আপনি?
হ্যাঁ, তুমি এখানে কেন?
তারপর লীলাবতী কাঁদলো হাসলো ক্রমান্বয়ে কয়েকবার এবং ঐ হাসি কান্নার মধ্যেই নিজ দুর্ভাগ্যের কথা বর্ণনা করলো। শেষে জানতে চাইলো, মায়াবতী কেমন আছে, তার বিপদ হয়নি তো?
অল্প সময়, কতোটুকুই বা বলা যায়। কখনও এ কথা মনে হয়, কখনও ও কথা মনে হয়। বসন্তদাস লক্ষ্য করলো, লীলাবতীর কথায় সংলগ্নতা নেই।
অদূরে মিত্ৰানন্দ অপেক্ষা করছিলো। সে বললো, এখন যাই লীলা, পরে সাক্ষাৎ হবে।
মিত্রানন্দকে আর কিছু জিজ্ঞাসার নেই। সবই তো জানা হয়ে গেছে। কি অসম্ভব দুরাশা মিত্রানন্দের। কতো স্বপ্ন, মানুষের মুক্তি হবে দাসত্ব থেকে, যুগযুগ ধরে লাঞ্ছিত মানুষ উত্তিষ্ঠত জাগ্রত হবে, মানুষের সৃজন ক্ষমতা শত স্রোতোধারে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ কী হতে যাচ্ছে, মিত্রানন্দ?
মিত্রানন্দ নীরব। কতো দীর্ঘ পথ তাকে পরিক্রমা করতে হয়েছে। কোথায় পট্টিকেরা রাজ্য আর কোথায় জগদ্দল মহাবিহার। সমগ্র ভূ-ভাগের ধূলিকণা তার দুই পায়ে লেগে আছে–সমস্তই কি বৃথা? কৃষ্ণা শুক্লা বিভাবতীর লাঞ্ছনা, সেও কি বৃথা? তার মন স্বীকার করতে চায় না। কিন্তু স্বীকার না করেও উপায় নেই। সে বসন্তদাসের হাত ধরলো। বললো, মিত্র বসন্ত, আমাদের স্বপ্ন রচনা কি স্বপ্নই থেকে যাবে? এতো শ্রম, এতো স্বেদ, এতো আত্মদান–সমস্তই বৃথা? বলো, তোমারও কি মনে হয় সমস্তই বৃথা যাবে?
বসন্তদাস রাত্রির আকাশে নক্ষত্রমালা দেখে। কোন তারকাটির নাম সে কৃষ্ণা রেখেছিলো, এখন সন্ধান করে পায় না। বলে, না মিত্ৰানন্দ, ও কথা আমার কাছে জানতে চেয়ো না–আমি বলতে পারবো না। কারণ, আমি জানি না।
তাহলে কে জানে? মিত্ৰানন্দ বিভ্রান্ত বোধ করে। একদিকে হতাশা আর অন্যদিকে বেদনা। কিছুই কি করণীয় নেই? পথক্ৰমণকালে তার মনে নানান চিন্তা আলোড়িত হয়। জগৎ কি বস্তুপুঞ্জ মাত্র। জীব কি তাহলে বস্তুতেই জাত হয় এবং বস্তুতেই হয় বিলীন? অনন্ত তার বন্দীদশা–বস্তুকে অতিক্রম করার কোনো ক্ষমতাই তার নেই? যদি থাকতো, তাহলো জ্ঞান এবং করুণার আবির্ভাব অবশ্যই প্রত্যক্ষ করা যেতো–বিচ্ছিন্ন মানুষ ঐকমত্যে উপনীত হতে পারতো। কিন্তু তা তো হলো না। অথচ তার বিশ্বাস ছিলো একটি ঐকমত্য হবে। কারণ জ্ঞানানন্দ বলেছিলেন, চিন্তা করো না মিত্রানন্দ, বস্তুময় জগৎ পরুষ, কঠোর এবং ক্ষেত্রবিশেষে নির্মমও বটে, কিন্তু এও আবার সত্য যে ঐ বস্তুময় জগতে অবগাহন করেই জীবসত্তা জ্ঞানের অধিকারী হয়। সুতরাং সাময়িক বিপর্যয় দেখে ভীত হবার কারণ নেই–দেখবে, ঘাতসংঘাতের মধ্য দিয়ে যথাসময়েই জ্ঞান এবং করুণার আবির্ভাব হচ্ছে, আর তা হলেই তখন আর চিন্তার কিছু থাকবে না।
জ্ঞানানন্দের ঐ স্থির বিশ্বাসের এখন কি হবে? সে ভেবে পায় না। শেষ পর্যন্ত দেখা গেলো সম্পূর্ণ বিপরীত ব্যাপারটি ঘটেছে। নিরঞ্জনের মতো নিষ্ঠাবান ভিক্ষুও হিংসাকে প্রতিরোধ করতে চায় প্রতিহিংসা দিয়ে–অত্যাচারী ভ্রাতাকে বিতাড়ন করার জন্য বহিরাগত দস্যুকে আহ্বান করতে দ্বিধা নেই তার। সুতরাং সকল উদ্দেশ্যই তার বিফলে গেলো। এ অবস্থায় জীবের রক্ষা এখন কীভাবে সম্ভব? সে চিন্তা করে কূল পায় না।
ত্রিশরণ মন্ত্রটি সে এখন প্রায় সর্বক্ষণই মনে মনে জপ করে, কিন্তু তথাপি স্বস্তি বোধ হয় না। চক্ষু মুদিত করলে দিব্যচক্রটি আর সে দেখে না–দেখে লেলিহান অগ্নিশিখা এবং রক্তস্রোত। মনে হয়, বহুদূরে কোথায় যেন অসংখ্য আর্ত মানুষ হাহাকার করে যাচ্ছে। ফলে সে প্রায় নীরবেই পথ চলে।
বসন্তদাস জিজ্ঞাসা করে, সখা, তুমি কী ভাবো, বলো তো?
মিত্রানন্দ ম্লান হাসে। বলে, নতুন কিছু নয় বসন্ত, পুরাতন কথাই ভাবি–চিন্তা হয়, ভবিষ্যতে কী হবে।
বসন্ত দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলে–আর ভবিষ্যৎ! ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে কি আর লাভ আছে কিছু! বরং এখন কী করবে সেইটি চিন্তা করো।
আমার তো করণীয় কিছু নেই এখন, মিত্রানন্দ জানায়। তারপর বলে, তুমি কি কিছু করবে বলে ভাবছো?
নাহ্, আমি আর কী করবো–ভাবছি সত্বর গৃহে ফিরবো–তুমি?
আমি, মিত্রানন্দ দূরে দৃষ্টি প্রসারিত করে বলে, হ্যাঁ, আমাকেও ফিরতে হবে মহাভিক্ষু জ্ঞানানন্দের সন্ধান করে তার কাছে যাবো।
তারপর?
তারপর আর জানি না। বসন্তদাসের জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা হয়–যদি জানাই না থাকে তোমাদের, তাহলে কেন এতো আয়োজন করতে নেমেছিলে? যারা তোমাদের ভরসায় নবীন আশায় উজ্জীবিত হয়েছিলো, তাদের কী হবে? প্রশ্নটা জাগে বসন্তদাসের মনে, কিন্তু প্রকাশ করে না সে। মিত্রানন্দ নিজেই যে অসম্ভব মনোকষ্টে পীড়িত হচ্ছে সেটা তো তার অগোচর নয়। সুতরাং কিছু বলতে পারে না সে। একত্রে পথ ভ্রমণ তাদের–কিন্তু দুজনের মধ্যে বিপুল একটা দূরত্ব থেকে যায়।
১২. সন্ধ্যাকালে পথিপার্শ্বের এক গ্রামে
সন্ধ্যাকালে পথিপার্শ্বের এক গ্রামে তারা যাত্রা বিরতি করে। দেহ আর চলছিলো না। দুই দিবসের ক্রমাগত, এবং বিরতিবিহীন পদক্ষেপণ–শরীরের দোষ কি! গ্রাম প্রান্তের মন্দিরটি দেখে বসন্তদাস বললো, সখা চলো, এই মন্দিরেই আশ্রয় নেওয়া যাক।