যে স্থানে মিত্রানন্দ নিয়ে এলো সেটি একটি যবন কেন্দ্র। দ্বারদেশে বহু লোক। সকলেই বলছে, দরবেশ দর্শন চাই, দরবেশ দর্শন চাই।
বসন্তদাস শুনে অবাক। জানতে চাইলো, দরবেশ কি বস্তু? এ কি কারও নাম?
হ্যাঁ, যবনদের এ স্থানীয় প্রধানকে এরা দরবেশ বলে থাকে–শব্দটি যাবনী ভাষায়–এর অর্থ নাকি সংসার ত্যাগী সাধুপুরুষ।
বিচিত্র স্থান, দ্বারদেশে নারী পুরুষের কোলাহল, কিন্তু অভ্যন্তর একেবারেই নীরব। প্রলম্বিত শ্বেতবস্ত্রধারী, দীর্ঘদেহ, শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখ, ধীর পদে যবনেরা গমনাগমন করছে। তাদের দেখিয়ে মিত্ৰানন্দ বললো, এরা এই কেন্দ্রের অধিকারীটির শিষ্য–প্রত্যেকেই ধর্মপ্রাণ।
বসন্তদাসের মনে পড়লো দেবীকোট মেলার সেই যবন বৃদ্ধটির কথা। বললো, এরা তো দেখছি শান্ত এবং ভদ্র–কিন্তু জনরব যে শুনি, যবন জাতি নাকি নিষ্ঠুর এবং দুর্ধর্ষ? এরা কি সত্যই এক জাতি?
আমি বলতে পারবো না। পরিচিত মুখ দেখে মিত্রানন্দ ডাকলো, এই যে মহাশয়, শুনছেন?
এক যবন পুরুষ সম্মুখে এগিয়ে এলো। মুখে স্মিত হাস্য। বললো, আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক, কি সংবাদ? বহুদিন পরে এলেন মনে হচ্ছে?
মহাত্মা আহমদের সঙ্গে কি সাক্ষাৎ হবে? মিত্ৰানন্দ জানালো, বলবেন, মহাভিক্ষু জ্ঞানানন্দের একটি সংবাদ নিয়ে এসেছি।
নিশ্চয় সাক্ষাৎ হবে, আসুন।
লোকটি নিজ ভাষায় অপর একজন সহচরকে কিছু বললে সহচরটি দ্রুত প্রস্থান করে। অতঃপর এক কুটিরের সম্মুখ প্রাঙ্গণে একটি বেদী দেখিয়ে লোকটি বলে, এখানে বসুন, আমি প্রভুকে আপনার আগমন সংবাদ দিয়ে আসি।
কুটিরের সম্মুখে কয়েকজন লোক অপেক্ষমাণ। দেশীয় লোক তারা, কেন অপেক্ষা করছে, কিছুই অনুমান করতে পারে না বসন্তদাস।
ক্ষণকাল অতিবাহিত না হতেই দেখা গেলো, একটি লোক ক্ষুদ্র একটি কলস এবং পানপাত্র এনে সম্মুখে রাখছে। লোকটি নিজ ভাষায় কিছু বলে ইঙ্গিত করলো। বোঝা গেলো, ঐ পানীয় পান করতে হবে। বসন্তদাস অনুমান করে, নিশ্চয়ই কোনো প্রকার আসব। সে উৎফুল্ল বোধ করলো, যাক, বহুদিন পর আসব পানের সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
কিন্তু পান করে দেখলো নিতান্তই মিষ্ট জল–তবে সুগন্ধী এবং তৃপ্তিদায়ক।
পান শেষ হবার পূর্বেই প্রথম লোকটি ফিরে এসে জানালো, বন্ধু মিত্রানন্দ, আসুন, এখনই তিনি আপনাদের সাক্ষাৎ দান করবেন।
কুটিরের ভিতরটি শুভ্র বস্ত্রাচ্ছাদিত। এক প্রান্তে কৃষ্ণাম্বরধারী শক্তিমান এক প্রৌঢ় বসে আছেন। নিকটেই কোথাও ধূপজাতীয় কিছু দগ্ধ হচ্ছে, সুগন্ধে কক্ষটি আমোদিত। প্রৌঢ়ের সম্মুখে একটি উপাধান, সেই উপাধানের উপর একখানি পুঁথি। মনে হলো, কিছুক্ষণ আগেও পুঁথি পাঠ হচ্ছিলো।
দুজনে সম্মুখে বসে প্রথমে প্রণাম জানালো। সাধুপুরুষ বললেন, ঈশ্বরের শান্তি বর্ষিত হোক তোমাদের উপর। তারপর জানতে চাইলেন, মিত্রানন্দ, তোমাদের সমস্ত কুশল তো, মহাভিক্ষু জ্ঞানানন্দ কি ফিরেছেন?
আজ্ঞে না।
না ফেরাই মঙ্গল। ইনি কে? বসন্তদাসের মুখপানে দৃষ্টিপাত করলেন সাধুপুরুষ।
ইনি আমার মিত্র, এবং সহগামী।
উত্তম, বলো, কী সংবাদ?
অর্হৎ জ্ঞানানন্দ আপনার অভিমত জানতে চেয়েছেন–যবন সেনাদলের সঙ্গে কী সম্পর্ক হবে আমাদের? মিত্রতার, না অসহযোগের?
সাধুপুরুষ স্মিত হাসলেন। বললেন, যারা আসছে তারা ভাগ্যান্বেষী সৈনিক, অসহযোগিতা করে কী লাভ বলো? আমি তো মনে করি, মানুষের সঙ্গে মানুষের প্রথম সম্পর্কই হওয়া উচিত মিত্রতার।
কিন্তু একটি বিষয় চিন্তা করার আছে, এই পর্যন্ত বলে সাধুপুরুষটি বিরত হলেন। নিজ ভাষায় মৃদুকণ্ঠে মন্ত্রজাতীয় কয়েকটি শব্দ উচ্চারণ করে পুনরায় বলতে আরম্ভ করলেন, চিন্তার বিষয়টি হচ্ছে, কার সঙ্গে মিত্ৰতা করবে? তারা কি মিত্রতার হস্ত সম্প্রসারণ করে দিয়েছে তোমাদের দিকে? যারা তরবারি উত্তোলন করেছে আঘাত করার জন্য, তোমার হস্ত সম্প্রসারণ করে দিলে তাদেরই দিকে, তাতে ফল কী হবে? তোমাদের হাতগুলি অহেতুক ছিন্ন হয়ে যাবে। সুতরাং কার সঙ্গে মিত্রতা, সেইটি বিবেচনা করা প্রয়োজন। জ্ঞানানন্দকে বলো আমি সংবাদ পেয়েছি যে সদ্ধর্মীদের কেউ কেউ সামন্তপতিদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে যবন বাহিনীকে পথ দেখিয়ে আনতে চান–সাবধান, ঐ কাজ যেন কেউ না করে–এই যবনেরা তুর্কি, এরা বর্বর, জ্ঞান বিদ্যা ধর্ম কোনো কিছুতেই এদের শ্রদ্ধা নেই। এদের ডেকে আনা আর আত্মঘাতী হওয়া একই ব্যাপার।
প্রভু, আপনি কি মনে করেন, যবন সেনারা এদেশে আসবে? বসন্তদাস প্রশ্নটি না করে পারে না।
অবশ্যই আসবে–দস্যু যদি জানতে পারে যে দস্যুবৃত্তি করলে কেউ বাধা দেবার। নেই, তাহলে সে কি করে, বলো?
তাহলে এদেশের মানুষের উপায়?
উপায় তো আমি দেখি না, পরমেশ্বরের কাছে প্রার্থনা ব্যতীত। তবে মনে হয় না, তারা ব্যাপক ক্ষতিসাধন করতে পারবে, কারণ তাদের সংখ্যা অধিক নয়।
আর একটা কথা বলি তোমাদের, মহাত্মা আহমদ জানান, যারা বহিরাগত, তারা যদি মনে প্রাণে বহিরাগতই থেকে যায়, তাহলে এদেশে তাদের ভবিষ্যৎ নেই। কিন্তু যদি তারা মৃত্তিকালগ্ন হওয়ার চেষ্টা করে, প্রকৃতিপুঞ্জের সঙ্গে মিলিত হয়ে যায়, তবে কিন্তু তাদের এদেশ থেকে বিতাড়ন করা অসম্ভব হবে।
ঐ পর্যন্তই কথা। দুজনে উঠে আসছিলো। সাধুপুরুষটি বললেন, তোমরা সাবধানে নগরীতে থাকবে–আমি সংকেত পেয়েছি, যবনেরা রাজধানী আক্রমণ যে কোনোদিন করতে পারে। যদি আগামীকালই শুনতে পাই যে এই নগরীও আক্রান্ত হয়েছে, তাহলে আমি অবাক হবো না।