অসম্ভব, মিত্রানন্দ তীব্র স্বরে প্রতিবাদ করে। চিৎকার করে জানায়, ভিক্ষুসভায় এ প্রস্তাব গ্রহণ সম্ভব নয়–এ প্রস্তাব ঈর্ষা ও ক্রোধ প্রসূত, হঠকারী এবং একদেশদর্শী। আমরা মনে করি, এ প্রস্তাব গ্রহণ করা হলে যবনদের আগমনের পথ সুগম হবে–সে ব্যবস্থা আমাদের অভিপ্রেত নয়। আমরা অবশ্যই মানব মুক্তির জন্য সংগ্রাম করবো, প্রয়োজন হলে শতাব্দকাল পর্যন্ত আমাদের সগ্রাম চলবে–কিন্তু বহিঃশক্তির এ দেশে আগমন সহ্য করবো না, আমাদের সংগ্রাম আমাদেরই করতে হবে। আমরা যবন আহ্বানের বিপক্ষেই অভিমত জ্ঞাপন করি। আসুন, সেইমর্মে প্রস্তাব গৃহীত হোক।
হ্যাঁ-হ্যাঁ, না–না, এই প্রকার কোলাহল উঠলো। ভিক্ষুরা একে একে সভাস্থল থেকে বাহিরে চলে যেতে আরম্ভ করলো। এবং এক সময় দেখা গেলো, সভাস্থলে কেউ নেই, সকলেই বাহিরে।
নিরঞ্জনকে দেখলো বসন্তদাস। অতিশয় ক্ষুব্ধ মুখভাব, বাহিরে এসে চীবরের প্রান্তখানি স্কন্ধে তুলে অগ্রসর হচ্ছিলো। বসন্তদাস ডাকলো, ভিক্ষু নিরঞ্জন, আপনার সঙ্গে দুটি কথা আছে আমার।
নিরঞ্জন দাঁড়ায়, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত করে বসন্তদাসের মুখে। তারপর জানতে চায়, আপনি কে?
আমার নাম বসন্তদাস, আমি সদ্ধর্মী নই, তবে বলতে পারেন আপনাদের একপ্রকার সহগামী।
মুহূর্তে নিরঞ্জনের মুখভাব শান্ত এবং ধীর হয়, নমস্কার করে বলে, বলুন আপনার কী কথা আছে?
আপনি ছায়াবতীর কোনো সংবাদ জানেন?
নিরঞ্জনের ভ্রূরেখা ঈষৎ কুঞ্চিত হয়। বলে, হ্যাঁ, ছায়াবতী আমার ভগিনী, তার কোনো সংবাদ আছে?
হ্যাঁ, তিনি আপনার কুশল জানতে চেয়েছেন–আপনি কি তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন?
নিরঞ্জন হাসে। বলে, নারীদের নিয়ে সমস্যা কি জানেন, তাঁরা চিরন্তন মাতা এবং ভগিনী। তিনি জানেন, আমি প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেছি–গৃহীর মানসিকতা আমার নেই, তথাপি তিনি আমাকে কাছে পেতে চান–আমার কি সময় আছে, আপনিই বলুন? তাঁকে। বুঝিয়ে বলবেন, আমি অবশ্যই কদম্বঘাটে যাবো, তবে বিলম্ব হবে। জানাবেন, আমি সুস্থ আছি, ভগবান তথাগতের কৃপায় সুখী আছি।
সবিনয়ে নমস্কার করে অতঃপর নিরঞ্জন আবার সম্মুখের দিকে অগ্রসর হয়।
বসন্তদাস দেখলো, দৃঢ় পদক্ষেপে অগ্রসর হয়ে চলেছে তরুণ ভিক্ষুটি। মস্তক উন্নত, গম্ভীর এবং ধীর। মনে মনে সে শ্রদ্ধা না জানিয়ে পারলো না। এ তরুণ সাধারণ ভিক্ষু নয়, সে বুঝলল, এ সম্মুখে বহুদূর পর্যন্ত পথ অতিক্রম করতে পারবে।
মিত্রানন্দ হতাশ। সভায় সিদ্ধান্ত কিছুই হলো না। মহাভিক্ষু জ্ঞানানন্দ সাধারণ ভিক্ষুদের অভিমত জানতে চেয়েছিলেন–তা আর জানানো সম্ভব নয়। বসন্তদাসকে ডেকে বললো, বসন্ত তুমি কি এবার যাবে?
মিত্রানন্দ আর কী করবে–তার কোনোই কাজ নেই। সেও একপ্রকার হতাশ। আশা ছিলো, সদ্ধর্মীরা মহারাজ লক্ষ্মণ সেনের সঙ্গে যোগাযোগ করে একটি ঐক্যভাব সৃষ্টির চেষ্টা করবে। তাতে অন্যকিছু না হোক, অন্তত সামন্ত মহাসামন্তরা কিছুকালের জন্য দমিত থাকতো। কিন্তু দেখছে, সে পথ একেবারেই বন্ধ–সদ্ধর্মীরা রাজশক্তির মিত্র হতে চায় না। কী যে তারা চায়, কিছুই অনুমান করা গেলো না। একপক্ষ যা চায়, অন্যপক্ষ চায় তার বিপরীত। সুতরাং আর পুন্ড্রনগরীতে অবস্থান কেন? এবার সে যাবে। বললো, মিত্রানন্দ, আমার আর বিলম্ব করে কোনো লাভ আছে, বলো?
না, আর কি লাভ বিলম্ব করে, মিত্রানন্দ জানায়, আমিও এ স্থানে থাকবো না, তবে একটি কাজ এখনও বাকি আছে–আর একটি সংবাদ জানা প্রয়োজন, সেটি হলে আমিও যাবো–তুমি কি যাবে আমার সঙ্গে?
তখন সন্ধ্যা হচ্ছে। ভিক্ষুরা উপাসনার আয়োজন করছিলো। মিত্রানন্দের এক সহচর এসে জানালো, আসুন উপাসনার আয়োজন সমাপ্ত হয়েছে।
মিত্রানন্দ বললো, তুমি যাও, আমি আসছি।
লোকটি চলে গেলে সে আবার বললো, বসন্ত, তুমি যাবে আমার সঙ্গে?
কোথায়, উপাসনায়?
না, আমি যেখানে যাবার কথা বলছিলাম।
অধিক দূরে কি?
না, দূরে নয়, নিকটেই, নগরীর পশ্চিমপ্রান্তে।
চলো যাই।
তাহলে তুমি কিছুক্ষণ দাঁড়াও, উপাসনা আরম্ভ হলেই আমি চলে আসছি–বিলম্ব হবে না।
সত্যই অধিক বিলম্ব হলো না। অল্পক্ষণ পরই ফিরে এলো বসন্ত। বললো, এবার চলো।
সন্ধ্যা গত হয়েছে, তথাপি পশ্চিম আকাশে পাটল মেঘগুলির প্রান্তভাগ রক্তিম ভাব। সেদিকে ইঙ্গিত করে মিত্রানন্দ বললো, দেখেছো, আকাশে কেমন রঙ?
হ্যাঁ, যেন সিন্দুর বর্ণ।
না বসন্ত, আমার মনে হয়, বর্ণটি রক্তের মতোই, সন্ধ্যারম্ভে তুমি দেখোনি, দেখলে বুঝতে। বৃদ্ধরা বলে, আকাশে ঐরূপ রক্ত বর্ণের মেঘ রক্তপাতের ইঙ্গিত বহন করে।
ওসব কুসংস্কার মাত্র, লোকের কল্পনা।
কয়েক পদ অগ্রসর হয়েছে, ঐ সময়ই আবার অদূরে একটি পথকুক্কুর কেঁদে উঠলো।
শুনছো বসন্ত?
হ্যাঁ, পথকুক্কুর কাঁদছে–পথকুক্কুর কাঁদলে মন্বন্তর হয়, এই প্রকার লোকপ্রবাদ আছে।
তুমি বিশ্বাস করো?
না, মিত্রানন্দ। এসব আমার বিশ্বাস হয় না–জ্যেষ্ঠী, শূন্যকুম্ভ, শৃগাল, গোধিকা এসব দেখলে নাকি বহুকিছু হয়, সবই অমঙ্গল–চিহ্ন, কিন্তু আমার বিশ্বাস হয় না।
আমারও হয় না, মিত্রানন্দও জানায়। তারপর বলে, কিন্তু মধ্যরাত্রে গভীর নিঃশব্দতার মধ্যে যখন কুকুরের ঐ প্রকার কান্না ওঠে, তখন সত্যই ভয়াবহ কিছু ঘটবে বলে আশঙ্কা হয়। আজ কদিন ধরেই সন্ধ্যাকাশে রক্তিমাভা দেখা যাচ্ছে। বিশ্বাস করি না, তথাপি মনের মধ্যে কেমন আশঙ্কার ছায়া দোলে।