এবং প্রায়ই সে পলায়ন করতো। শীত আরম্ভ হলো–তারপর দেখো বসন্তদাস আর গৃহে নেই। সন্ধান করো, দেখবে, কিশোর বসন্তদাস মেলায় মেলায় পুত্তলি বিক্রয় করছে। শেষে কৈশোর অতিক্রান্ত হলে, নবীন যৌবনে একদা সত্য সত্যই সে পলায়ন করলো। কোথায় গেলো, কি বৃত্তান্ত, কেউ জানলো না। স্ত্রী রোদন করলে হেমন্তদাস শাসন করতেন। বলতেন, ঐ কুৰ্মাণ্ডটার জন্য অহেতুক অশ্রুপাত করছো, ওর কি পিতামাতা সম্পর্কে কোনো জ্ঞান আছে? অমন পুত্র না থাকাই উত্তম।
কিন্তু যখন সে ফিরলো, পিতা কিছু বলতে পারলেন না। কি বলবেন? ঐ যুবা পুরুষকে কি আর তখন কিছু বলা যায়? দেখছেন, দীর্ঘদেহ যুবা পুরুষটি–পরিধানে শুভ্র বস্ত্র, মস্তকে দীর্ঘ কুঞ্চিত কেশ, কর্ণে দুটি স্বর্ণ কুণ্ডল, ঊধ্বাঙ্গের উত্তরীয়খানি স্বর্ণাভ চীনাংশুক, অন্তরাল থেকে অঙ্গদের উজ্জ্বলতা চমকিত হচ্ছে। আর গমন ভঙ্গিটি এমত যে মনে হয় দূর দেশাগত ধনী কোনো শ্রেষ্ঠী অথবা সার্থবাহ ভ্রমণে বাহির হয়েছেন। অমন বয়স্ক সুপুরুষ পুত্রকে কি কিছু বলা যায়? বিশেষত সে পুত্র যখন বাণিজ্য করে গৃহে ফিরছে।
হেমন্তদাসের অর্থের প্রয়োজন ছিলো। গৃহসংস্কার হয়নি বহুকাল। গো–শালার খুঁটিগুলি হয়ে পড়েছিলো দুর্বল ও কীটদষ্ট, ভাণ্ডার গৃহের চালাগুলিতে পচন ধরেছিলো, শয়ন প্রকোষ্ঠের গবাক্ষ ও দ্বারগুলির অবস্থা ছিলো শোচনীয়। এমতাবস্থায় পুত্রের উপার্জিত অর্থ তিনি সদ্ব্যবহার করলেন নিঃসংকোচে। ওদিকে আবার মাতৃদেবীরও সাধ, গৃহে বধূ আনবেন। পিতারও ঐ ব্যাপারে সমর্থন ছিলো। কারণ তিনি ভালো জানেন যে, যুবতী রমণীর বাহুপাশ ছিন্ন করে কোনো নবীন যুবকের পক্ষে বিদেশ যাত্রা করা সম্ভব নয়। সুতরাং সন্ধান করো, কন্যা যেন যুবতী এবং রূপসী হয়। পুনর্ভবা তীরের দীনদাস নামক একটি লোকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিলো হেমন্তদাসের। সে–ই এনে দিলো প্রকৃত সংবাদ।
কন্যাটি প্রকৃতই রূপবতী, যদিও বর্ণটি শ্যামল ভিন্ন অন্য কিছু বলা যায় না। বসন্তদাসের মাতা কন্যাটিকে দেখে আনন্দিত হলেন। সধবা রমণীরা হুলুধ্বনি করছিলো, তিনি ধানদূর্বা দিয়ে বধূবরণ করবেন। গৃহদ্বারে পিঁড়িখানি পাতা, বধূ পিঁড়িতে দাঁড়াবার পরও মাতা বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছেন রূপবতী বধূটিকে। আহা কপালখানি যেন নবচন্দ্রিকা। ওষ্ঠ দুটির তো তুলনা হয় না–যদি হতো, তাহলে বলা যেতো কামকুসুম–আর গ্রীবাটি দেখো, কী মসৃণ, বাহু দুখানি কেমন সুগোল–আর বক্ষোদেশ? অমন কি দেখেছেন কোথাও? না, মনে পড়ে না।
অমন রূপবতী যুবতী যদি বাহুপাশে বাঁধতে না পারে নিজ পুরুষকে, তাহলে ধিক সে যুবতাঁকে।
কি হলো, বিলম্ব কেন? বধূবরণ করো? স্বামীর তাড়নায় বসন্তদাসের মাতা ধান–দূর্বা কুসুম–চন্দনাদি দিয়ে বধূকে বরণ করলেন।
অতঃপর বলাই বাহুল্য যে বসন্তদাসের দিবারাত্রির জ্ঞান লোপ পেয়েছিলো। পক্ষকাল যেন কাটলো ভয়ানক এক ঘোরের মধ্যে, রমণীদেহ তাকে একেবারে গ্রাস করে ফেলেছিলো বলতে হবে। ওদিকে পিতা নিশ্চিন্ত, মাতার আনন্দ আর ধরে না।
তবে ভোগেরও শেষ আছে। পক্ষকালও গত হয়নি, বসন্তদাস পুনরায় উন্মন হয়ে। উঠলো। ঐ সময় নদীতীরের ঘাটে নতুন বণিকেরা এসেছে। বসন্তদাসের সময় অতিবাহিত হয় তাদের সান্নিধ্যে। উপার্জিত অর্থও ততদিনে নিঃশেষিত প্রায়। সে বুঝে নিয়েছিলো, যাত্রার সময় হয়ে এসেছে।
কিন্তু ব্যাপারটিকে ত্বরান্বিত করলো গ্রামপতি কুশল দত্ত। কার মুখে কী শুনেছিলো ঈশ্বর জানেন, একদা এসে হস্ত প্রসারিত করে দাঁড়াল। বললো, আমাকে দুইশত মুদ্রা ঋণ দাও।
কুশল দত্ত এমন ব্যক্তি যার হস্ত প্রসারিত হলে প্রত্যাহৃত হয় না। তা সে রমণী হোক অথবা ধনসম্পদ। তার এক কথা, তোমার নেই, এমন কথা আমি বিশ্বাস করি না। তিন দিবসের মধ্যে আমার দুইশত মুদ্রা চাই–যদি স্বেচ্ছায় দাও, উত্তম, না হলে আমাকে বলপ্রয়োগ করতে হবে।
বসন্তদাস ঘটনাটি কাউকে জানতে দিলো না। কেবল পিতাকে জানালো, আপনার পুত্রবধূ পিত্রালয়ে যেতে চায়। ঐটুকুই কথা। একই শকটে দুজনে গৃহত্যাগ করলো অতঃপর। শেষে দেখা গেলো, পুত্রবধূ যথাস্থানে উপনীত হয়েছে কিন্তু পুত্র নিরুদ্দেশ।
আত্রেয়ীবক্ষে অপেক্ষমাণ অন্যান্য বণিকদের সঙ্গে যাত্রারম্ভ। তারপর শকটারোহণ– দক্ষিণে যাত্রা, কখনও আবার ঈষৎ পশ্চিমে। এক জনপদ থেকে আর এক জনপদে। এক হাট থেকে অন্য হাটে–যদি শকট দুস্পাপ্য হয়, তাহলে অশ্বারোহণ, কিংবা পদব্রজ। কোথাও তৈজসাদি কেনে, কোথাও কেনে গন্ধদ্রব্য, কোথাও লবণ, কোথাও ক্ষৌমবস্ত্র, কোথাও আবার দুকূল–জীনাংশুক। এই প্রকার ক্রয় এবং বিক্রয়। কখনও ক্ষতি এমন হয় যে, মনে হয়, এইবার তার বাণিজ্য শেষ। কিন্তু পরবর্তী উদ্যোগই তাকে আশাতীত লাভবান করে দেয়। দু দুবার তার আশাতীত লাভ হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঐ লাভ থাকেনি। দস্যু এবং রাজ পুরুষদের উপদ্রব এমনই প্রবল যে বণিকের পক্ষে তিষ্ঠানে কঠিন। দস্যুরা কিছুই বলে না, আকস্মিকভাবে আসে এবং পণ্যসামগ্রী লুণ্ঠন করে নিয়ে যায়। কখনও কখনও প্রহারও করে। কিন্তু রাজপুরুষেরা তোমার বিপণীতে এলে ব্যবহার এমন করবে, যেন কততদিনের পরিচয়। পানগুবাক খাবে, আলাপে নিমগ্ন হবে, হাস্যকৌতুকও করবে। শেষে প্রসারিত হস্তের অঙ্গুলি নির্দেশে একে একে দ্রব্যগুলি ভূত্যের হাতে উঠতে থাকবে। ঐ ওঠার যেন শেষ নেই। মনে হবে, পারলে যেন সমস্ত বিপণীটিই স্কন্ধে তুলে নিয়ে যায়।