এই যদি প্রকৃত অবস্থা হয়ে থাকে, তাহলে আর আমাদের ভূমিকা কোথায়? অন্য এক ভিক্ষু প্রশ্নটি করে। বলে, আমরা দ্রোহ করলাম, রাজাকে বিতাড়ন করলাম, আর রাজ্যের অধিকারী হয়ে গেলো যবন রাজা–এ কেমন ব্যবস্থা হবে, চিন্তা করেছেন?
হ্যাঁ, চিন্তা করেছি, নিরঞ্জন জানায়। বলে, যবনরা বহিরাগত, এসেছে, ধনসম্পদ লুণ্ঠন করে নিয়ে চলে যাবে। তারপর আর কে? তারপর তো আমরা, প্রকৃতিপুঞ্জ। আমাদেরই মনোমতো নির্বাচিত রাজা আমাদের শাসন করবেন, যেমন একদা করেছিলেন গোপালদেব।
নিরঞ্জনের অদ্ভুত শাণিত যুক্তি–এবং অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত তার বক্তব্য–কিন্তু তথাপি মনে হয় না যে তার কথায় কারও মনে আস্থার ভাব সঞ্চারিত হচ্ছে। বসন্তদাসের নিজেরও মনে হয় সমস্ত পরিকল্পনাটিই মিথ্যা ও সুযোগ সন্ধানের উপর নির্মিত। যেন আর এক কৌটিল্যের প্রস্তাবনা। আর সেই সঙ্গে বাস্তব সম্পর্ক বর্জিত অহেতুক উচ্চাশা।
বসন্তদাস দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে সমস্তই দেখছিলো এবং শুনছিলো। তার নিকটেই কয়েকজন শ্ৰমণও দাঁড়িয়ে ছিলো। লক্ষ্য করলো শ্রমণরা স্বতঃস্ফূর্ত মন্তব্য করছে। তাদের মধ্যে তীব্র ক্রোধ এবং আক্রোশ–তারা চিষ্কার করে নিরঞ্জনকে সমর্থন জানাচ্ছে।
কিন্তু সে নিজে নিরঞ্জনের বক্তব্যকে যুক্তিসহ বলে গ্রহণ করতে পারছিলো না। তার মনে হচ্ছিলো, এরা অর্থহীন একটা উচ্চাশা নিয়ে বসে আছে। মাত্র জনা কয় ভিক্ষু গ্রাম গ্রামান্তরে চণ্ডাল ব্রাত্যদের বলবে, আর সঙ্গে সঙ্গে বিদ্রোহ জেগে উঠবে? বিদ্রোহ কি অতোই সহজ? তার অনুমান, এরা প্রকৃত অবস্থা কিছুই জানে না–গ্রামে ব্রাত্য আর কয়জন? অধিকাংশই তো ক্ষেত্রকর। ক্ষেত্রকরেরা সদ্ধর্মীদের কথা শুনবেই, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই।
ঐ সময় একজন ভিক্ষুর বক্তব্য তার শ্রবণে আসে। খর্বকায় প্রৌঢ় ভিক্ষুটি গম্ভীর স্বরে কথা বলছিলেন, বসন্তদাস শুনলো।
ভ্রাতা নিরঞ্জন উচিত কথা বলেছেন, তার কথা আমি সমর্থন করি। তবে তাঁর মূল প্রস্তাবটির বিচার হওয়া প্রয়োজন। তিনি বলছেন, সংঘকেই সমস্ত দায়িত্ব নিতে হবে রাষ্ট্র ব্যাপারেও সংঘের ভূমিকা আছে। কিন্তু আমার প্রশ্ন, সংঘের কথা কেউ চিন্তা করেছেন? আমার তো মনে হয় না, কোনো লোক আমাদের ধর্ম অনুসরণ করতে আসবে। আমাদের মধ্যে কতো বিভাগ, চিন্তা করে দেখুন। সিদ্ধাচার্যরা কতো প্রকার সাধনরীতির কথা বলেন। সংসারত্যাগী সাধকদের ঐ সাধনাচার কি সকলের জন্য গ্রহণীয়? আপনারাই বলুন? আর যদি সাধারণ মানুষ আমাদের সহজভাবে গ্রহণ না করতে পারে, তাহলে আমাদের স্থান কোথায়? আপনারা চিন্তা করুন, আমাদের প্রকৃত শক্তি কতখানি। পক্ষান্তরে দেখুন, একজন গ্রামপতি কিরূপ শক্তিমান। দুই চারিজন সামন্তানুচরই একখানি সম্পূর্ণ গ্রাম ধ্বংস করে দিতে পারে। গ্রামবাসীরা জানে না প্রতিবাদ কাকে বলে, সমস্তই তারা ললাটলিপি বলে গ্রহণ করে।
তাহলে কি আমরা একেবারেই নিশ্চেষ্ট থাকবো? নিরঞ্জনের স্বরে তীব্র বিদ্রূপ।
না, তা কেন, জ্যেষ্ঠ ভিক্ষুরা সমস্বরে বলতে লাগলেন, আমাদের প্রস্তুত হওয়া প্রয়োজন–সংঘকে শক্তিশালী করা, জনগণকে সত্যধর্মে দীক্ষা দেওয়া, এই সকল কাজ আমাদের অবশ্যই করে যেতে হবে। অপেক্ষা ব্যতীত এখন আর আমাদের পথ নেই।
শুধু অপেক্ষাই নয়, আমার মনে হয়, আমাদের চেষ্টা হওয়া উচিত সমাজের সকল শ্ৰেণীর সঙ্গে সদ্ভাব সৃষ্টি করা।
বসন্তদাস দেখলো, দূরে প্রায়ান্ধকার ছায়ায় একজন ভিক্ষু উঠে দাঁড়িয়েছেন। তাঁকে দেখে মৃদু কোলাহল আরম্ভ হয়ে গেলো। কোলাহল শান্ত করার জন্য মিত্রানন্দ চিৎকার করে বললো, বলুন শিবানন্দ, আপনার বক্তব্য বলুন।
সদ্ধর্মী ভিক্ষুটির নাম শিবানন্দ, অদ্ভুত কাণ্ড বলতে হবে, বসন্ত অবাক হয়। পার্শ্ববর্তী শ্ৰমণটি জানালো, লোকটির মস্তিষ্কে দোষ আছে–উনি সর্বধর্মের সমন্বয় চান–তার ধারণা, শিব বোধিসত্ত্ব ছিলেন।
শুনুন, ভিক্ষু শিবানন্দের কথা শুনুন।
যা বলছিলাম, সদ্ভাবের কথা, শিবানন্দ বলতে লাগলেন, আমাদের সদ্ভাব ও মিত্রতা করতে হবে, রাজশক্তির সঙ্গে। তাদের বোঝাতে হবে প্রকৃত পরিস্থিতিটি কি
ভিক্ষু শিবানন্দ কি শৃগাল সমীপে মিনতি করতে বলেন, কুম্ভীর শাবকদের যেন সে ভক্ষণ না করে? একজন তরুণ শ্ৰমণ প্রশ্নটি করে।
না, তা নয়, ব্যাঘ্রকে করজোড়ে অনুরোধ করতে হবে, প্রভু আপনি তৃণ ভোজন করুন! সহাস্যে মন্তব্য করে অন্য আর এক তরুণ ভিক্ষু।
নিরঞ্জন পুনরায় উঠে দাঁড়ায়। বলে, ভিক্ষু শিবানন্দ, আপনার প্রস্তাব উত্তম। অবশ্যই আমরা সদ্ভাব ও প্রীতির হস্ত প্রসারণ করবো। কিন্তু প্রশ্ন, সদ্ভাব ও প্রীতি কিসে উপজাত হয়? নিশ্চয়ই বিশ্বাসে, আন্তরিকতায়, উদারতায়–কিন্তু তার চিহ্ন কি কোথাও দেখেছেন সেন রাষ্ট্রব্যবস্থায়?
সে ত্রুটি তো উভয় পক্ষেই নিরঞ্জন, শিবানন্দ ক্ষুব্ধ স্বরে জানান, সদ্ধর্মীরাও তো উদার হতে পারছে না!
এ আপনি কি বলছেন ভিক্ষু শিবানন্দ? সদ্ধর্মীরা যদি উদার না হয় তো উদার কে? নিরঞ্জন বলতে থাকে, মহারাজ শশাঙ্ক এই পুন্ড্রবর্ধনের কতিপয় সদ্ধর্মীর বিসদৃশ আচরণের কারণে কয়েক সহস্র সদ্ধর্মীকে হত্যা করেছিলেন, সে কথা স্মরণ করুন–স্মরণ করুন, সোমপুর বিহারের কথা–মহারাজ জাতবর্মণের সৈন্যদল বিহার ধ্বংস করে প্রধান ভিক্ষুকে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করে হত্যা করেছিলো। একটি বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠানও কি সামান্যতম রাজানুকূল্য পেয়েছে সমগ্র সেন শাসনকালে? বলুন, দেখাতে পারবেন কোনো প্রমাণ? আপনি উদারতার কথা বলছেন, সেন রাজাদের মতো যদি হতেন পাল রাজারা, তাহলে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম এ অঞ্চলে থাকতে পারতো? ও কথা বলবেন না–রাজপুরুষদের সঙ্গে মিত্রতা সম্ভব নয়, অন্তত এই মুহূর্তে তো নয়ই। আসুন, আমরা ভিক্ষুমণ্ডলীর এই সভায় প্রস্তাব গ্রহণ করি যে, সেন রাজশক্তি লুণ্ঠক, অপহারক ঘাতক এবং নারী হরণকারী, এই রাজশক্তি প্রকৃতিপুঞ্জের সকল বিকাশের পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে–তাই আমরা এই রাজশক্তির অপসারণ চাই।