না, ঐভাবে বললে হবে না, আমরা আপনার কাছ থেকে সুস্পষ্ট প্রস্তাব চাই–দূর থেকে একটি তরুণ ভিক্ষু চিৎকার করে বলে।
সুস্পষ্ট প্রস্তাব আমি অবশ্যই আপনাদের সম্মুখে উপস্থাপন করতে সক্ষম হবো বলে আশা করি। কিন্তু তার পূর্বে আমাদের বিষয়টি চিন্তা করে দেখতে হবে, নিরঞ্জন বলতে থাকে, আমি পশ্চিমের গ্রামগুলি ভ্রমণ করে এসেছি। দেখেছি মানুষের জীবন অতিষ্ঠ এবং অসহ্য। সর্বত্রই দেখেছি উচ্চশ্রেণীর লোকদের হাতে নিম্নশ্রেণীর লোকদের নিপীড়ন হবেই–প্রত্যক্ষে হোক আর পরোক্ষে হোক। লুণ্ঠন, হত্যা, দস্যুবৃত্তি–এগুলি প্রায় নিত্যসঙ্গী মানুষের জীবনে। রাজপাদোপজীবী যারা, তারা কিছুই করেন না–সম্ভোগ ও ব্যসনে তাঁদের আসক্তি সীমাহীন। প্রজারা তাঁদের কাছে যেন পীড়নের পাত্র–পালনের নয়। ছিন্নমূল ক্ষুদ্রতরুর মতোই তাদের অবস্থা। ফলে যখনই দেখি যবনেরা আসে, তখনই তারা হয় পলায়ন করে, নতুবা বশ্যতা স্বীকার করে–কখনই যুদ্ধ করে না। যবন শক্তি ভিন্নদেশীয়। তারা আজ আছে কাল নেই–এমতাবস্থায় এই–ই মাহেন্দ্রক্ষণ, রাষ্ট্রশক্তি একেবারে শতধা বিচ্ছিন্ন–এই ক্ষয়িত রাষ্ট্রশক্তিকে আঘাত করলেই ধসে পড়বে।
আঘাত কে করবে, আমরা? আমাদের কি তাহলে যুদ্ধ করতে হবে? কোন শাস্ত্রে আছে যে ভিক্ষুরা যুদ্ধ করে? সেন রাজার সেনাবাহিনীতে সৈন্য সংখ্যা কতো জানো? অশ্বারোহী কতো বলো? যুদ্ধহস্তির সংখ্যাটি বলতে পারো?
শ্রোতারা একের পর এক প্রশ্ন করে। প্রত্যেকেই নিজ নিজ সন্দেহের কথা জানায়।
কেন, আমরা কি যুদ্ধ করতে পারি না? নিরঞ্জন প্রত্যুত্তরে বলতে আরম্ভ করে, আমি আপনাদের দীপঙ্কর অতীশের কথা স্মরণ করিয়ে দিই–তিনি তিব্বতে বলেছেন, ধর্মকে যে কোনো মূল্যে রক্ষা করতে হবে। রাষ্ট্রশক্তি যদি ব্যর্থ হয় তাহলে সংঘকে সে দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে, সংঘই হবে সমস্ত কিছুর নির্ধারক। প্রয়োজনবোধে সে–ই রাষ্ট্রশক্তির পরিবর্তন ঘটাবে।
কিন্তু এ কথা তো তিব্বতী ভিক্ষুদের উদ্দেশে বলেছিলেন দীপঙ্কর, এদেশ তো তিব্বত নয়।
নিরঞ্জন গ্রীবা ঈষৎ বঙ্কিম করে। মন্তব্যকারীর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত করে একবার, তারপর বলে, ভ্রাতঃ এ তর্ক অর্থহীন। মহাপণ্ডিতের বাণী কেবল এক দেশের সমস্যা সমাধান করবে, অন্য দেশের সমস্যা সমাধানে তা ব্যবহার করা যাবে না–এমন কি হতে পারে? আপনারা জানেন, হতে পারে না, তথাগত বাণীর কথা চিন্তা করুন, বোধিসত্ত্বের কথা চিন্তা করুন। আমার বিশ্বাস, মহাপণ্ডিত অতীশ দীপঙ্করের বাণী সকল দেশের সদ্ধর্মীদের জন্য অবশ্যই পালনীয়–বিশেষত এই দেশে–কারণ এদেশ তাঁর জন্মভূমি।
মিত্ৰানন্দ জানতো না এই প্রকার একটি নির্দেশ মহাপণ্ডিত দান করেছেন। দীপঙ্করের তিব্বতে পরিনির্বাণ হয়েছে সে আজ প্রায় শতাব্দকালের কথা। তার গ্রন্থগুলির কয়েকখানি, শোনা যায়, জগদ্দলে আনা হয়েছে। অতঃপর সেগুলির কি হলো, সন্ধান নেই। নিরঞ্জন কোথায় শুনেছে রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে সংঘের করণীয় বিষয়ের নির্দেশটি সেই জানে। তবে মনে হচ্ছে, নিরঞ্জন অধিক আবেগপ্রবণ, সে আবেগ নিয়ে একটি সিদ্ধান্তের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তাই সে বাধা দিলো। বললো, না এখনও সময় হয়নি, ভ্রাতঃ নিরঞ্জন; তোমার বক্তব্যের প্রথম অংশ আমি সমর্থন করি–তোমার বিশ্লেষণও চমৎকার এবং যুক্তিযুক্ত–কিন্তু তোমার সিদ্ধান্ত আমি সমর্থন করতে পারি না–আমার বিশ্বাস, এ সিদ্ধান্ত হঠকারী যে, বহিরাগত যবনদের সঙ্গে সহযোগিতা করে আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। তোমার বক্তব্যের ঐ অংশ যুক্তিযুক্ত বলে আমি মনে করি যে, সত্যই সংঘকে রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে চিন্তা করতে হবে এবং ক্ষেত্রবিশেষে রাষ্ট্রব্যবস্থায় অংশগ্রহণও করতে হবে। রাষ্ট্রের শাসন যদি ধর্মবিরোধী হয়ে ওঠে, তাহলে সেই শাসনকে অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে। আমার অনুমান, অতীশ সদ্ধর্মীদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করেই রাষ্ট্রব্যবস্থায় অংশগ্রহণের কথা বলেছেন। শঙ্করাচার্য সনাতন ধর্মের যে পুনরুত্থান ঘটিয়েছেন, তা সম্ভব হতো না, যদি রাষ্ট্রব্যবস্থায় সদ্ধর্মীরা মনোযোগী হতেন ও সক্রিয় অংশগ্রহণ করতেন। কিন্তু আমার প্রশ্ন, সংঘ কি যথেষ্ট শক্তিশালী এখন? ভিক্ষুরা পলায়নপর, শাসকরা মারমুখী। এক্ষেত্রে ব্রাত্য এবং অন্ত্যজ ক্ষেত্রকরেরা দ্রোহের পতাকা উত্তোলন করলেই কি সাফল্য আসবে? কয়েকটি স্থানের সংবাদ আমরা জানি, ডোম এবং চণ্ডালেরা ক্রুদ্ধ হয়ে শাসকদের আক্রমণ করেছে, কিন্তু সফল হয়নি শেষ পর্যন্ত। শাসকদের আক্রমণে নিজেরাই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে; ক্ষেত্রকরেরা কেউ সক্রিয় সহযোগিতা দান করেনি। যদি ধরেও নিই যে দ্রোহ সফল হয়েছে, তাহলে তারপরে কে নেবে রাজদণ্ড? সামন্ত মহাসামন্তদের স্থানে কারা আসবে? আমার ধারণায় আসে না সমগ্র ব্যাপারটি।
মিত্রানন্দ পুনরায় জানায়, না ভ্রাতঃ নিরঞ্জন, এখনও সময় হয়নি, আরও আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
নিরঞ্জনের ঋজুদেহ অধিকতর ঋজু হয়। দুই চক্ষুতে বিদ্যুৎ চমকিত হয়–সে দক্ষিণে বামে দৃষ্টিপাত করে উপস্থিত ভিক্ষুমণ্ডলীকে দেখে নেয়। তারপর মিত্রানন্দের উদ্দেশে বলে, না ভ্রাতঃ মিত্রানন্দ, আমাদের অপেক্ষার আর সময় নেই। মগধ এখন যবন সেনাদলের অধিকারে। ওদন্তপুরী বিহার তারা ধ্বংস করে দিয়েছে। গৌড় পর্যন্ত আগমন এখন তাদের ইচ্ছার ব্যাপার মাত্র–চলে এলেই হয়।